Warning: Creating default object from empty value in theme_img_assist_inline() (line 1488 of /var/www/sachalayatan/s6/sites/all/modules/img_assist/img_assist.module).

মোল্লা বাড়ির ভূতেরা ভালো নেই

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি
লিখেছেন পান্থ রহমান রেজা (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/০৬/২০০৯ - ১:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাচ্চা ভূতটা হাড্ডিসার। মাথার খাপরি বের হয়ে এসেছে। চোখ দুটো গর্তে লুকানো। টর্চ লাইটের মতো তা ঠিকরে বের হচ্ছে। যেনো জয়নুলের দুর্ভিক্ষের সচল কোনো চিত্র। ‘আমরা এহান থেকে যাইগা মা’ বাচ্চা ভূত মা ভূতকে বলে।
‘যাবি’ বলে মা ভূতটা বিষন্ন দৃষ্টি মেলে।
মা ভূতটাও হাড়জিরজিরে। পাঁজরের সবগুলো হাড় গোনা যায়। পাটকাঠির মতো তা বের হয়ে আছে।
‘হ, যাইগ্যা। এহানে আর থাকা যাইবো না। সব গাছ কাইট্যা ফালাইত্যাছে। সারারাত বিজলি বাতি জ্বলে। তার জন্য রাইতে ঘর থাইক্যা বাইর হয়া যায় না। খাওয়া নাই।’
‘তর তো এহানকার জন্য কোনো মায়া পয়দা হয় নাই। সেদিন হইলি মাত্র। আমি কত বছর ধইর‌্যা এহানে আছি। এই মায়া রাইখ্যা কই যামু, ক।’
‘নিশিবয়রা বিলে যাবি মা।’
‘সেদিন দেখলি না, গোলাম জাইল্যা খালি হাতে ফিরলো। কোনো মাছ নাই বিলে। তাঁতের সুতার রঙের পানি গিয়া সব মাছ মাইর‌্যা ফালাইছে। বিলের মধ্যে যে হিজল গাছটা আছিল, সেটাও মইরা গ্যাছে। ওহানে গিয়া ক্যামনে থাকবি।’
‘মা, এহানে আর ভালো লাগে না।’
‘তর দুঃখ বুঝি রে বাপ। তুই যে খেলবি, সেই গাছ নাই। বাঁশঝাড়টাও পাতলা হইয়া গ্যাছে। সব গাছ কাইট্যা ফেলছে মোল্লার পুত। আকন্দ বাড়ির মেছো ভূতরাও চইলা গ্যাছে। বড় একা হয়ে গেছোস তুই।’
‘মা, তুই এহানে কবে আইছিলি।’
‘বোকা ছেলের কথা শোনো। এহানে কী আমি আইছি। আমার তো জন্মই এহানে। তর দাদার দাদা তারও দাদা প্রথম এহানে আইছিলো। বাপের মুখে হুনছি, তখন কত গাছ আছিলো। বিরাট বিরাট সব গাছ। আম গাছ, তেঁতুল গাছ, শিমুল গাছ। একটা বিশাল বটগাছও আছিলো। যখন এহানে আইছিলো তখন তো শাহজাদপুরে প্রজা বিদ্রোহ শুরু হইছে। কতকাল আগের কথা। সেই ব্রিটিশ আমল। জমিদাররা জমির খাজনা বাড়াইয়া দিছে। কৃষকরা কয়, তারা খাজনা বেশি দিতে পারবো না। এটা তাদের ওপর জুলুম হইছে। জমিদাররা করে কী, তাদের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়া কৃষকদের মারধর করে। কৃষকরাও লাঠি হলঙ্গা নিয়া জমিদারদের মারতে যায়। তখন কৃষকগো দলের নেতা ক্ষুদি মোল্লা তাঁর দলবল নিয়া একবার এহানে আছিলো। তহন এই জায়গাটা এমুন আছিলো না। গাছপালা দিয়া বিশাল আড়া হইয়া আছিলো। তাই দেখতে পায়নি লাঠিয়ালরা। কী সাহস আছিলো লোকটার।’
‘মা, তহন আমগো কী এতো কষ্ট আছিলো?’
‘তহন আমগো কত শান্তি আছিলো রে পুত!’

মট মট করে তেঁতুল গাছটা ভেঙ্গে পড়ে। কামলাদের শোরগোল শোনা যায়। মা আর বাচ্চা ভূতের শান্তি ভঙ্গ হয়। একটা কাকের বাসা ভেঙ্গে পড়লে মোক্তার মোল্লার নাতি আওয়াল কাকের বাসা থেকে সাবান, চুড়ি, এক টুকরো কাপড়ের সাথে একটি ডিম আবিস্কার করে। ডিমটি নিয়ে মোল্লার নাতি সবাইকে দেখাতে গেলে কাকটি তার পেছন পেছন ছোটে। আওয়াল এতে আরো বেশি আমোদ পায়।

এই তেঁতুল গাছটা কতদিনের পুরানো তা মা ভূতটাও মনে করতে পারে না। মানুষরা কত যে গল্প বলে এই গাছটি নিয়ে। এর কোনোটা সত্য, কোনোটা মিথ্যা। আবার কোনোটা সত্য-মিথ্যের মিশেল। তেঁতুল গাছটা নিয়ে মানুষগো অভিযোগেরও অন্ত নাই। একবার বারেক মোল্লার বড় মেয়ে আলেয়া পোয়াতি হয়ে বাড়িতে আইলো। তখন জ্যৈষ্ঠ মাস। কয়েকদিন পর আলেয়া এক কটকটে দুপুরে একটা মরা মাইয়া বিয়াইলো। আলেয়ার জামাই ওয়াদুদ মিয়া সব দোষ দিলো তেঁতুল গাছের ভূতের। শাহপুর মাদ্রাসার বড় হুজুর এসে মন্ত্র পড়া দিলো। মন্ত্র দিলে কী হবে, ভূতেরা তো আর কিছু করে নাই। বড় হুজুর এসে খালি খালি কয়েকদিন ভূতদের কষ্ট দিলো।

সেবার-ই কে যেন কইছিলো তেঁতুল গাছটি কেটে ফেলতে। গাছ কাটলে ভূতেরা যদি ক্ষেইপ্যা যায়, সেই ভয়ে কেউ কাটতে সাহস পায় নাই। কেউ কেউ মনে করতো, গাছে যে প্রথম কোপটি দিবে, তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যাবে। তাই কেউ এতোদিন কাটতে রাজি হয় নাই। কিন্তু বাতেন মোল্লার ছেলে সোহেল শহরে শিক্ষিত ছেলে। ভূত-প্রেতে তার বিশ্বাস নাই। সেই আজকে কেটে ফেললো তেঁতুল গাছটি।

সোহেল হয়তো তেঁতুল গাছটি কাটতো না। ভূত-প্রেতে ভয় না পেলেও ছোটবেলা থেকে তেঁতুল গাছের ভূত সম্পর্কে এতো কিছু শুনে এসেছে যে তাতে তেঁতুল গাছটি কাটতে গেলে তাকে দুইবার ভাবতে হতো। কিন্তু গত সপ্তাহের একটি ঘটনা তাকে কাটতে অনেকটা বাধ্যই করলো। গত সপ্তাহে বউরে নিয়ে গেছিলো আকতার ফার্নিচার্সে। উদ্দেশ্য ছিল একটা ড্রেসিং টেবিল কিনবেন। কিন্তু বউ একটা খাট পছন্দ করে ফেললো। দাম সাকূল্যে ৫৫ হাজার টাকা। বউয়ের গোঁ, এই খাট কিনা দিতে হইবো। একটু কষ্ট হলেও খাট কেনার সামর্থ্য সোহেলের আছে। কিন্তু সোহেল বউয়ের সব কথা শোনার মতো বোকা নয়। মনে মনে বুদ্ধি আঁটলো, গ্রামের বাড়ির তেঁতুল গাছটি কেটে এই ডিজাইনের একটা খাট বউকে বানিয়ে দেবে।

সোহেল শহর থেকে এসে যেদিন বলল, তেঁতুল গাছটি কেটে খাট বানাবে, ওয়্যারর্ডোব বানাবে, সে দিন তার দাদী জাহানারা বেগম ভয়ে আঁতকে উঠলেন। অনেক করে বোঝালেন তার বেয়াড়া নাতিকে। বললেন, তেঁতুল গাছের ভূতটা ভালো না। সংসারে অনিষ্ট করবে। সোহেল শুনে নাই দাদীর কথা। মনে মনে ভেবেছে, খাট না বানালে সংসারে এমনিতেই অশান্তি আসবে।

গাছ কাটা শেষ হলে করাতকলে তা চেরাইও করা হয়। এইবার খাট বানাতে হবে। সোহেল আকতার ফার্নিচার্সের ডিজাইন পকেটে নিয়ে ঘোরে। আর খুঁজতে থাকে কে বানিয়ে দিতে পারবে এরকম খাট। এই খুঁজতে গিয়েই সোহেলের পরিচয় হয় লিটন সূত্রধরের সাথে। লিটন সূত্রধর সোহাগপুর হাটের পূর্ণিমা ফার্নিচার্সের মালিক। ‘আসমান থাইক্যা ডিজাইন আইনা দিলেও এই বান্দা আপনার মাল রাইত পোহাইলেই ডেলিভারি দিবো। তয়, আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়- তেঁতুল গাছের কাঠ বহুত ভালো কাঠ। মাগার আপনের পোলাও ঘুণে ধরা ছাড়া পার কইরা দিবো।’

লিটন ছুতারের কথা শুনে সোহেলের আফসানার কথা মনে পড়ে। একসাথে খাট, ওয়্যারডোর্ব দেখলে আফসানা সত্যিই খুব খুশি হবে। মনের কোণে আফসানার হাসিমুখের ছবি ভেসে উঠতে দেখে সোহেলেরও খুব ভালো লাগে। তার মনে হয় তেঁতুল গাছের কাঠের মতো তাদের সংসার যেন টেকসই হচ্ছে!


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হাসি

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ মানিক ভাই।

রানা মেহের এর ছবি

ভাইয়া
একটা চিঠি দিয়েছি
একটু চেক করুন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

দেখলাম।

কীর্তিনাশা এর ছবি

ভূতের দুঃখে পরাণ কান্দে !!

চলুক

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

আহারে।

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

বেশ

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

তাই।

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

জটিলস্য !
----------------------

--------------------------------------------------------

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হাসি

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সুন্দর আইডিয়া তো। ভালো লাগলো। একটা মেসেজ দিলাম।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

এক্ষুনি মেসেজের জবার দিচ্ছি।

তানবীরা এর ছবি

ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি
পান্থ মিয়ার গল্প হয়েছে মারাত্বক জ্বী
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ভূতরে আমি ডরাই
তাতাপু থেকে তফাৎযাই। চোখ টিপি

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

সুন্দর হয়েছে।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

(লজ্জা পাইছি)

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হাসি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের ডাক দিবেন নাকি?

লেখা ভাল্লাগসে।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

সায়ীদ স্যার থাকতে আমি কোন স্যার যে পরিবেশ আন্দোলনের ডাক দিবো।

রণদীপম বসু এর ছবি

লেখা ভালো হইছে পান্থ। তয় শেষ প্যারাটায় কি কোনো সাসপেন্স দেয়া যাইতো না ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

দাদা সাক্ষাতে তো বলেছি, এখানে আর নাই বলি।

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

না, এইহানেও একটু কও না, শুনি!

ভাল্লাগসে অবশ্য।
হাসি
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

মামুন হক এর ছবি

মোল্লা বাড়ী গোল্লায় যাক
তবুও
ভূত ফ্যামিলি বেচে থাক!

অতিথি লেখক এর ছবি

এতো সুন্দর একটা লেখা, তবু পড়তে একটু দেরিই হয়ে গেল!!!

আশরাফুল আলম রাসেল
(চন্দ্রবিন্দু)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।