বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সীমাহীন অংশীদারিত্ব সংলাপে ব্লগারদের আমন্ত্রণ প্রসঙ্গে

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি
লিখেছেন পান্থ রহমান রেজা (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/০৫/২০১৩ - ১:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সপ্তাহখানেক আগের কথা। একটি ইমেইল এসেছে। মার্কিন দুতাবাস থেকে। ঢাকায় আসছেন ওয়েন্ডি আর শারম্যান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি। তিনি বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের ওপর একটি বক্তৃতা দিবেন। ২৭ মে সোমবার রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে সেই বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হবে। বক্তৃতার শিরোনাম: এক সীমাহীন অংশীদারিত্ব: যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক। সেই অনুষ্ঠানে আমার দাওয়াত। তাও আবার ব্লগার হিসেবে। ইমেইলে আমন্ত্রণ পেয়ে খুব ঘাবড়ে গেলাম। আমি কেন? বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের কিছুই জানি না আমি! যাই হোক, দিন কয়েক পরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ কার্ড এলো। কার্ডের সাথে অনুষ্ঠানের বিস্তারিত। তারাই আসলে অনুষ্ঠানটির আয়োজক।

অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম মিডিয়া অতিথিদের মধ্যে আমিই একমাত্র ব্লগার। আমেরিকান সেন্টারের প্রেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অফিসার কেলি জানালেন, আরো কয়েকজন ব্লগারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তারা। তারা আসেননি বা আসতে পারেননি। কিংবা এও হতে পারে, তারা এসে নিজেদের ব্লগার পরিচয় দেননি।

কিন্তু মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারির বক্তৃতার মতো হাই প্রোফাইলের অনুষ্ঠানে ব্লগারদের আমন্ত্রণ কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন কেলি। তাকে জিজ্ঞেস করা যেত। তবে অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি ছিলেন ভীষণ ব্যস্ত। তাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। আর আমারও তাড়া ছিল অফিস ফেরার। বক্তৃতা শেষেই দৌড়াতে হয়েছে। তাই জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

ব্লগারদের নিয়ে আমাদের অনেকের ধারণা ভালো না। একটু পিছনে ফিরি। ঘটনা বছর দুয়েক আগের হবে। বাংলামোটরে একটি পত্রিকা অফিসে গেছি। এক সাংবাদিক বড়ো ভাইয়ের কাছে। অফিসে কিছুক্ষণ থেকে দুজনেই নিচে নেমে আসি। উদ্দেশ্যে চা-বিড়ি পান। নিচে একজন টিভি মিডিয়া তারকার সাথে দেখা। উনি সেই বড়ো ভাইয়ের খুব ক্লোজ। তারকার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন- “ও হলো পান্থ। আগে পত্রিকায় লিখতো। এখন ব্লগে লেখে”। “ব্লগে লেখেন? ব্লগে তো সবাই গালিগালাজ করে দেখি”। কালেরকণ্ঠ পত্রিকাও ব্লগের ভাষা নিয়ে একবার অভিযোগ তোলে। তাদের সাথে তাল মেলান আরো অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিও। তবে শাহবাগ আন্দোলন ছিল তাদের সবার মুখে চপেটাঘাত। সেই চড় খেয়ে তারা টের পেয়েছেন ব্লগের শক্তি।

শুধু বাংলাদেশই নয়, বাংলাদেশের আগেও ব্লগের এই শক্তি টের পেয়েছে তিউনিসিয়া, মিশর। বুয়াজিজির আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে তিউনিসিয়ায় বেন আলী বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেলেও আন্দোলনের প্রাথমিক ভিত্তি প্রোত্থিত হয়ে আসছিল ব্লগে, ইউটিউবে। বেন আলীর দুর্নীতি ফাঁস করে, বিমানে করে রাজ পরিবারের লোকদের শপিং বিলাসের ভিডিও ইউটিউবে প্রচার করে। মিশরেও তাই। ‘উই আর খালিদ সাঈদ’ ফেসবুক পেজের আগেই মোবারক বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধেছিল ব্লগে হোসনি মোবারকের দু:শাসনের প্রতিবাদে। এই বড়ো বড়ো ঘটনা ছাড়াও ব্লগের শক্তির ছোটখাট অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে।

আর একটা ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। বেশ আগে অনলাইনে পড়েছিলাম। গুগলে খুঁজলাম সেই ঘটনাটা। পেলাম না। ঘটনাটি ঘটেছিল জাপানে। নতুন একটি প্রডাক্টের লঞ্চিং হবে। রেওয়াজ হলো মিডিয়ার লোকদের ডেকে ঘটা করে প্রডাক্ট লঞ্চিং করা। কিন্তু সেবার কোম্পানির কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের ডাকলেন না। ডাকলেন ব্লগারদের। ফলাফল, তারা সাংবাদিকদের মাধ্যমে যে পরিমাণ কাভারেজ পেয়ে থাকেন, তার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি পেলেন। এ কারণেও আজকাল বাইরের অনেক দেশেই নানা অনুষ্ঠান, আয়োজনে ব্লগাররা আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশে ব্লগাররা ব্যক্তি পরিচিতির বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছেন কি না আমার জানা নেই। তবে হ্যাঁ, টেলিভিশনের টকশোগুলোতে ব্লগাররা যাচ্ছেন এখন। তাদের অভিমত দিচ্ছেন। আগামীতে এই সীমানা যে আরো বাড়বে, তা বলাইবাহুল্য।

এখন আসি বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের বক্তৃতা আয়োজনে। দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ-মার্কিন অংশীদারিত্ব সংলাপ। গত বছর প্রথম আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেবার হিলারি ক্লিনটন এসেছিলেন। ওয়েন্ডি শারম্যান গতবারও এসেছিলেন। এবারও এসেছেন।

বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের হালচালের আমি কিছুই জানি না। মাঝে মাঝে পত্রিকায় জিএসপি সুবিধা, টিকফা নিয়ে লেখা দেখি। কিন্তু কখনো মনোযোগ দিয়ে পড়া হয়ে উঠেনি। আবার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মার্কিনিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও এখানে-ওখানে শুনি। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রতি মার্কিন আগ্রহের কথাও শোনা যায়। তবে এসব কিছুর জ্ঞান পত্রিকায় পড়া বা এখানে-ওখানে শোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই আমার পক্ষে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে বিশ্লেষণমূলক কিছু বলা মুশকিল। একজন শ্রোতা হিসেবে সেখানে কি কি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটা বরং তুলে ধরতে পারি।

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ শিরোনাম হয়েছে রানা প্লাজার ঘটনায়। ওয়েন্ডি শারম্যান শুরুতে সেই শিরোনামটাই তুলে ধরলেন। এ নিয়ে সরকার, সুশীল সমাজ, শিল্পখাতের নেতাদের সাথে তার আলোচনার কথাও উল্লেখ করলেন। জানালেন, ১৯১১ সালের ২৫ মার্চ তারিখের আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরির অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। ওই অগ্নিকাণ্ডে ১৪৬ জন গার্মেন্টসকর্মী মারা গিয়েছিলেন। সেই ঘটনা আমেরিকার শিল্পখাতের সংস্কার কার্যক্রমকে বেগবান করেছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষ আর তাজরিন ও স্মার্ট ফ্যাক্টরির আগুনের বেদনা এবং ছাইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাবে।

শারম্যান তার সফরের সময়কালে দেখেছেন বিরোধীদলের হরতাল কর্মসূচী। তার বক্তৃতায় সেই কর্মসুচীর কথা উল্লেখ করে বলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের শহরকে নিত্যনৈমিত্তিকভাবে চক্রাকার সহিংসতার জন্য বন্ধ থাকতে দেখে আমার দুশ্চিন্তা হয়। তিনি সবাইকে এই সহিংসতার চক্র থেকে বেরিয়ে আসার আহবান জানান। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের অবদানের কথা উল্লেখ করেন। দারিদ্র্য নির্মূলে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকের কথাও উল্লেখ করেন। গ্রামীণের অখণ্ডতাও চান। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টির প্রশংসা করেন তিনি। পণ্য, সেবা ও মানুষের চলাচল আরো গতিশীল করতে দেশগুলোর বাণিজ্যিক বাধাগুলো ভেঙ্গে ফেলার আহবান জানান। তাছাড়া, আমেরিকা বাংলাদেশকে নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে তার ফিরিস্তিও তুলে ধরেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং মার্কিন রাষ্ট্রদুত ড্যান মজীনা বক্তব্য রাখেন।

আরো জানার জন্য:
ওয়েন্ডি আর শারম্যানের দেয়া বক্তৃতার কপি: বাংলা, ইংরেজি
দ্বিতীয় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারিত্ব সংলাপের যৌথ বিবৃতি
ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারিত্ব সংলাপের তথ্যপত্র


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

যাওয়ার কথা ছিলো, পারলাম না যেতে। সময় মন খারাপ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নির্ঝর অলয় এর ছবি

সুন্দর লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। আরেকটু বিস্তৃত হতে পারত আলোচনা।

ব্লগকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। সাহিত্যের উদ্দেশ্য যেহেতু মনের সাথে মনের যোগ এবং মনের ভাব প্রকাশ সেহেতু সাহিত্যে ব্লগ একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। বটতলার উপন্যাস যেমন ধ্রুপদী ঔপন্যাসিকদের আবেদন কমাতে পারেনি, তেমনি কিছু মূর্খের গালাগালির জন্য সমগ্র ব্লগ মাধ্যমটি কলুষিত হয়ে পড়ে না।

হয়তো আর দশ বছর পরই ব্লগই হবে সাহিত্যের প্রধান মাধ্যম।

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

“ব্লগে লেখেন? ব্লগে তো সবাই গালিগালাজ করে দেখি”।

অবাক হই, যখন দেখি, মিডিয়ায় কাজ করেন এমন অনেকেও 'ব্লগ ও 'ব্লগার' বিষয়ে ধারনা রাখেন না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।