ধ্বংসের পাটাতনে

প্রত্যয় এর ছবি
লিখেছেন প্রত্যয় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৬/০৮/২০০৮ - ৮:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নচ্ছার বরষায় উত্তুরের দেওয়ালটাতে ভাঙন ধরেছে এবার। এভাবে চললে এই বর্ষা পর্যন্ত ঘরটা টিকবে কি না সন্দেহ- চিন্তায় রসুলের কপালে ভাঁজ পড়ে; আবার অনেকগুলো টাকা খসল। হায়রে নিয়তি! অথচ কি কষ্ট করেই না বেশ অনেকগুলো টাকা জমিয়েছিল সে; একখানা গাই-গরু কিনবে, দুধ বেচে টাকা জমাবে- সেই টাকায় বিয়ে করবে একটা; বয়স যে ওকে ফাঁকি দিতে বসল। মা বাবা না থাকার এই এক ঝামেলা। সব এসে খালি বলে যায়
-একখান বউ লিয়ে আয় রাছুল। রঁধি খাওয়াবিনে।
ওই পর্যন্তই। তারপর আর কারো পাত্তা নেই। ওই শুনতে শুনতে বছর ছয়েক- আর কত! নিজেরই কিছু করা লাগে। -সে বাড়া ভাতে ছাই। ঘরের চালা ঠিক না করলে ঘর থাকবেনা। যার ঘরই নাই তাকে মেয়ে দিবে কোন বাপে!

এইসব সাত-পাঁচের গ্যাঁড়াকলে আটক রসুলের আকষ্মাৎ ভাবান্তর ঘটে। -ব্যাপারখানা কি? হরিপদের প্রৌঢ় বাপটা ওভাবে দৌঁড়াচ্ছে কেন? আবার কেউ মরল না তো! -অবশ্য মরাটা এখানে নৈমিত্তিক; এইতো মাস-দুই আগে সুলেখার দুটো বাচ্চা একসাথে মরল বাঁধ থেকে পড়ে- খুঁজেই পেল না কেউ; কোথাকার ঢেউ কোথায় টেনে নেয়! এবার কারটা গেল? বাচ্চাকাচ্চার অভাব নেই এখানে; সবসময় জন্মাচ্ছে- প্রতি মাসে দু-একটা। কার যে কয়টা; বাপ-মা নিজেও জানেনা হয়তো। বাঁচা-মরা কোন বিষয় না এখানে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত; এখন সব গা সওয়া। যাক। আল্লাহর মাল আল্লাই নিয়ে যায়। অত ভাবার সময় কোথায় তার? তারচেয়েও কত বড় বড় বিষয় পড়ে আছে- এই তো বেশ কিছুদিন ধরে কানাঘুষা শুনছে; ওদের পুরো পাড়াটা না কি সরকারি সম্পত্তি। বড় বাড়ির ছোট ছেইলে গফুর মোল্লা জায়গাটা কিনে নিয়েছে। আজ-কালের মধ্যে দখল নিতে আসবে। -বললেই হল! দশগ্রামের সবাই জানে এ জমির নিরঞ্জনের পৈত্রিক। বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ ধরে বাস ওদের। যদিও ও বংশের কেউ নেই এখানে; তাতে কি! -নিরঞ্জন তো বেঁচে আছে; পাগল-ছাগল মানুষ- এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়; নিশিরাতে বনে-বাদারে বাঁশি বাজায়- তারপরও, রসুলরা কি ওর দেখাশোনা করে না? অকর্মার ঢেঁকি পাগলাটাকে ওরা কি পালাক্রমে দিনে দু-বেলা খাওয়ায় না? নাহলে কবেই না খেতে পেয়ে মারা যেত। তার বদলে ওর বাপ-দাদার ভিটেয় ঘর বানিয়ে থাকছে ওরা- তাও তো বার বছর হতে চলল। নিরঞ্জনের বাপ-দাদাদের যদিও রসুল দেখে নি; হরিপদেও বাপ তো দেখেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে একসাথে উঠা-বসা ওদের। আর এতদিন পর কেউ যদি বলে বসে-
ভাবনায় ছেদ পড়ে। একটা শোরগোল ধেয়ে আসে সেখানে- নারীকন্ঠের হাঁউমাউ, বুড়ো মানুষের খনখনে গলা, বাচ্চাকাচ্চার অসহ্য চেঁচামেচি; এর মধ্যে ভাঙা গলায় কি সব বলতে বলতে এগিয়ে আসে হরিপদ। কপালের কিনার বেয়ে রক্তের ধারা- কেউ মাথায় মেরেছে তার। -কে? রসুল ছুটে যায়। অমনি সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সবাই বলে- বর্ণনার জট লেগে যায়। তার মধ্য থেকে যা বোঝা যায় তা হল; কিছুক্ষণ আগে বাধের উপরে গফুর মোল্লা হরিপদকে ডেকে বলে
-সবাইকে লিয়ে বিকোলের আগে বোরেয়ে যাবি। হামার জমিন হামাকে খালি কোরে দিবি।
-তুমার জমিন! আমরা যাচ্ছি নে কোথাও। যা খুশি কোরে লাও।
অমনি বলা নেই, কওয়া নেই- হাতের লাঠিটা সজোরে হরিপদের মাথায়
বসিয়ে দিল গফুর। বাধশুদ্ধ মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখল; কেউ বললনা কিছুই। এ এলাকায় গফুরকে ভয় পায় সবাই; গোপনে অনেক কিছুই শোনা যায়- কি সব র্পাটি-র্ফাটি করে; কারো সাথে বনিবনা না হলে হাত-পাও এর রগ কেটে দেয়। এইতো গেল বছর বাধের উপর যে জোড়া-খুনটা হল- ভয়ে কেউ ঘাটায় না ওকে।

এই হট্টগোলে অতকিছু ভাবার ফুসরত নেই রসুলের। -মগের মুল্লুক পেয়েছে! ও বলল আর অমনি চোদ্দ ঘর মানুষ সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে গাঙে ভাসান! আর সহ্য করা যায় না- চল সবে! বেশিদূর যেতে হয় না গফুর সেদিকেই আসছিল
-কি রে রাছুল! তোরা নাকি ঘর ছাড়বিনে?
-ছাড়ব ক্যানে! উ কি তুমার জমিন?
-ছ্যেল না। তবে এখন হামার- সরকারি জমিন; হামি লিজ নিলেম।
-ঝুট্! উ তো নেরঞ্জনের জমিন- সবে জানে।
-তু কি পাগল হলি! পাগল-ছাগল লোক, বনে-বাদারে ঘুইরে মরে, বাপ-মা ছ্যেল কি ছ্যেল না- উর জমিন কিসের!
-অত বুঝিনে বাপু! আমরা যাচ্ছিনে কোথাও।
-ভাল হবি নে রাছুল। জানে বাঁচবিনে একটো।
গফুর রাগে অগ্নিগিরি। শার্দুলের মত হিংস্র চোখজোড়া দপদপিয়ে জ্বলে উঠে যেন- আগুন ওখানে। সে আগুনের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না হিন্দুগুলো। তৎক্ষণাৎ হুড়োহুড়ি- বিছানা-পত্তর, বাসন-কোসন; হিন্দুগুলো ঘর ছাড়ে। -মালাউনের বাচ্চোরা! মুরগার কলজা লিয়ে হাঁটে! -রাগে-দুঃখে রসুলের চোখ বেয়ে পানি চলে আসে। অথচ এতদিন, কতভাবে তাকে উষ্কিয়েছে তারা
-বাপ-দাদার মাটি; এমনি ছেইড়ে দিবো!
-তু মোগো ছেইলে; তু বল- এমনি এমনি ওই বিটা সব লিয়ে লিবে! আমরো চায়ি চায়ি দিখব!
-বল তো বাপ; হেন্দু বলি মোগে পেটে সবাই লাত্থি মারে ক্যান।
-তু মোগো লাগি কিছু করবিনে রাছুল?
ওই করতে গিয়েছিল সে। কি লাভ ছিল তার! অবশ্য লাভ যে একেবারেই ছিল না তা নয়। পাড়াটাতে সর্বসাকুল্যে পাঁচঘর হিন্দু আর নয়ঘর মুসলিম পরিবার- অনেকদিন ধরে একসাথে আছে ওরা; ঝগড়া-ঝাঁটি প্রায়শই- বৃহৎ স্বার্থে সবাই এক। উপায় নেই এ ছাড়া- জায়গাটা কারো পৈত্রিক সম্পত্তি না; বাঁধের পাড়ের একফালি জমি- বার বছর ধরে বাস ওদের- ওরা জানে এটা নিরঞ্জন পাগলার। ওকে নিয়ে ভয় ছিল না। ভয় ছিল অন্যখানে- ও বংশের অন্য কেউ যদি খোঁজ নিতে আসে; আসেনি কখনো। বিপদ এল এমন জায়গা থেকে; ধারণাই ছিল না ওদের।

কাঁধে-মাথায়-হাতে আস্ত দু-চারটি সংসার বয়ে তারা এগিয়ে চলে। তাদের সীমান্তে দু-চারটি কীর্ত্তনখোলা - বয়ে নিয়ে যায় কাকে কোথায়; অদ্ভুত জীবনধারা। সুলেখার দু-কাঁখে দু-দুটি জলজ্যান্ত হাঁড়-চামড়ার দলা; ক্ষিধেয়-দুর্বলতায়-এক দিনের অভুক্ততায় তাদের গলা বেয়ে অবিরাম চিঁ-চিঁ - সদ্য ডিমফোটা ছানা যেন। -না! এখনতরি মরে লি। সুলেখার কাঁধ শরীর ছেড়ে নেমে আসতে চায়। গায়ের সবকটি হাড়ের নির্লজ্জ প্রদর্শনী- ক্রিমি ভর্তি গোল পেটের যমজ দুটো আস্ত হিমালয় যেন- বিরক্তিতে, যন্ত্রণায়, দু-দিনের অভুক্ততায় মাথায় আগুন
-লাক্কসীর নোল বেলেছে। একগন্ডা গিলে খালো- এখনতরি পিয়াস মেটোয় লা। খাবি তো খা-। খা-! খা-! আর কত লিবি? লে-
হয়তো গাঙের জলে ডুবে যাওয়া ছেলেগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। সব গাঙই এক; গাঙের মানুষগুলো- সবার খাই খাই; এত খায় তাও ক্ষিধে মেটে না। -কোথায় যাচ্ছে তারা! -কতদূর? -কেউ জানে না।

সন্ধের আগে সবাই ঘর ছাড়ে; ব্যতিক্রম রসুল। জমির যাওয়ার আগে শুধোয়
-যাবি নে রাছুল? গব তো চইলে গেল।
না। সে যাবে না। গফুরের ক্রোধের আগুন কতটা তেজী সে দেখে ছাড়বে। সবাই ওকে ছেড়ে চলে যাক; সে একাই একশ- এ বিরানভূমির দৌর্দন্ড প্রতাপশালী বীরবিক্রম।

রাত নামে। আকাশে গোল একটা চাঁদ তার আলোর পাখা মেলে- ধীরে, অতি ধীরে। একটু একটু উত্তরালি হাওয়া- শিরশিরে কাঁপুনি; শীতটা একটু আগেভাগেই অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। রসুল একটা ঘোরের মধ্যে- কোন এক গোলকধাঁধা; সব কিছু ধোঁয়া-ধোঁয়া ধোঁয়াময়, পুরু কুয়াশার চাদর এক। তার অনুভূতির স্নায়ুগুলোতে প্যাঁচ লেগে যায়। কিছুই ভাবতে পারে না সে; কিছুই না। এভাবে অনেক্ষণ- তারপর; তার চোখের সামনে সব পষ্ট হয়ে আসে। তাদের সীমান্ত পেরিয়ে দূরবর্তী দু-চারটা গন্ডগ্রামের তীরবর্তী নষ্ট পাহাড়ে কারা এসে থামে; নামহীন- গোত্রহীন- অনেকটা পঁচন লাগা সত্তা- এবড়ো-থেবড়ো নাকমুখ, মুখে শত শত দাগ (দাগ নয়- ফুঁটো। জঘণ্য, বিভৎস, উৎকট- পঁচা মাংসের জলজ্যান্ততা। নয়তো লালবুক ব্যাঙের বিষথলি- নরকের আবর্জনা)। তাদের কন্ঠস্বরে জান্তবতা, পদছন্দে তীব্র হাহাকার- এ যে একরাশ পঁচা মাংসের তাল- সদ্য মৃত্যুকূপ থেকে উঠে আসা। পিঁপড়ের মত তারা এগিয়ে চলে। পায়ে পায়ে থপথপ, হাঁড়ে হাঁড়ে ঠকঠক- চলার তালে পঁচা-গলা মাংস খসে খসে পড়ে; সাদা সাদা গোল গোল চোখগুলো বেরিয়ে আসে কারো। বিভৎস সব নষ্টপ্রেত- । না!!! -প্রচন্ড চিৎকারে আত্মারাম খাঁচাছাড়া বুঝি- রসুল ধরমড়িয়ে উঠে বসে। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্র বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম- স্বপ্ন দেখছিল বুঝি- প্রচন্ড ভয়ে বুক-গলা শুকিয়ে কাঠ; হাতড়ে হাতড়ে বালিশের নিচ থেকে প্রজাপতি মার্কা ম্যাচবাক্সটি বের করে। যত্তসব! খালি ঘস্ ঘস্; আগুনের চিহ্নমাত্র নেই- হাতের ঘামে ভিজে গিয়েছে হয়তো। আরো একটি কাঠি ঘসে নিরাশ হয় সে। হওয়ার নয়। না! আর রাস্তা নেই। তলপেটের চাপটাও হঠাৎ বেড়ে অনেকগুণ। ঘোরের মধ্যে কখন সে বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছিল- এবার তার স্নায়ুগুলো সজীব; হাতের আন্দাজে দরজা খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে। সব মনে পড়ে যায় তার। সামনের বামের ঘরটা আইজুদ্দির আর ডানেরটা জমিরের। মাঝখানের চিকন পথটা পেরোলে কিছুটা জঙ্গল; তারপর মাঠ- আদিগন্ত ধানের ক্ষেত; মাঝখানে দু-চারটা পুকুর- বেশ দূরে দূরে। সেখানে চাঁদ চাঁদ আর খালি চাঁদ; চাঁদের মাতাল করা আলো। -এই বস্তির বাঁশ-খড় পেরিয়ে চাঁদটা ভিতরে পৌঁছায় না কখনো ।
জঙ্গলের আবছায়ায় পেট খালি করে সে। আঃ! শান্তি! তখনই বেজে উঠে সুরটা- একটানা একঘেঁয়েভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে মরে, “বৈদেশ গেলে আমি তোমার সংগ ছাড়ুম না রে- সংগ ছাড়ুম না।” হায়রে নিরঞ্জন- কেউ তার সংগ ছাড়ল না; না চন্দ্ররাত, না পুকুরপাড়, না বাঁশি- সঙ্গ ছাড়ল বনমালীর রাধিকা- যার জন্য এত সুর, এত কান্না, ইনিয়ে-বিনিয়ে বাঁশির রোদন; সাহা বাড়ির মাধবী। আহারে! কত রাত ধরে মেয়েটা কেবল শুনেই গেল, শুনেই গেল- রাধিকা হয়েছিল একদিন; গভীর রাতে ছুটে বেরিয়েছিল প্রায়। শেষরক্ষা হয়নি আর- মায়ের হাতে ধরা। সব্বোলাশ! উঠতি মেয়ে- বাঁশিতে পায়িছে। আল ঘলে লাখা যাবি লা। -তারও সপ্তাহ্ দুয়েক পরে পালকিতে চেপে মেয়েটা অন্যজনার। নিরঞ্জনের বিরাম নেই। -এ এক নেশা; এক মোহ- বাঁশির মোহ- রাতের মোহ- চাঁদের মোহ- খালিগায়ে কাঁপন ধরানো শিরশিরে বাতাসের মোহ। পুকুরের জল টলটল, ধারটাতে হাস্নাহেনার ঝাড়- এক উগ্র ধরণের মিষ্টি গন্ধে পরিবেশটা আরেকটু ভারী, আরেকটু স্বপ্নীল- এর কোনটাকে অস্বীকার করবে সে! হয়তো এর পুরোটাই স্বপ্ন- উগ্র ধরণের মিষ্টি স্বপ্ন; চোখে জ্বালা ধরানো চাঁদ, বুকে ব্যাথা জাগানো বাঁশি, গায়ে কাঁপন ধরানো ঝিরঝিরে হাওয়া, মস্তিষ্ক ভারী করে তোলা উগ্র ধরণের হাস্নাহেনা- চাঁদটা আরেকটু পষ্ট হলে বাঁশিটা আরেকটু করুণ, আরেকটু গভীর- সুরটা তাকে চেপে ধরে; বুকের গভীরতম সূক্ষ প্রদেশে নিজের অজান্তে লালন করে চলা একটি স্থির চিত্র ছিন্ন-ভিন্ন-বিদীর্ণ করে তোলে- একান্ত ব্যক্তিগত একটি। না! কিছুই হওয়া গেল না জীবনে- না কেষ্ট, না মধাব; অন্ততঃ গোষ্ঠের রাখাল হলেও- হায়রে কেষ্ট; বুকের ভেতর কি ব্যাথাটাই না ছিল তার- অনেক বেশি- বাঁশির সুরে ঝরে ঝরে পড়ত- ছুটে বেড়াত দিগবিদিগ- কিছুটা ভালবাসা সেখানে; রাধা কিভাবে সইবে এত! আর এখানে, কোন দূর পাড়াগাঁয়ে এক মধ্যবয়সী দোকানদারের ঘামে ভেজা লোমশ বুকের নিচে একজোড়া শক্ত বাহুর পিঞ্জরে বন্দী তার রাধা। লোকটা সব খেয়ে নিল তার- বুক-গলা-পেট-হাত-পাও- সব। লোকটা ঠোঁট খেল তার, বাতাবি লেবুর কোঁয়ার মত বাঁকা-বাঁকা ঢেউ খেলানো ঠোঁট দুটো; এমনকি কানদুটো- খাবেই তো। কান থাকলে মেয়েটা বাঁশি শুনবে, ঠোঁট থাকলে বলতে চাইবে, পা থাকলে ছুটে আসবে- এত করতে দেওয়া হবে কেন ওকে! জানে না সে; কিছুই না। নেশায় পেয়েছে ওকে; তীব্র নেশা। নেশায় পেয়েছে রসুলকেও- ধীরে ধীরে সে এগিয়ে চলে; জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বিশাল ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সাপের মত একেবেঁকে চলা আল ধরে- নিরঞ্জন তখনো আধামাইল দূরে; তবে, সুরটা- ওর বাঁশিটা; অনেক কাছে- বুকের ঠিক অন্তঃস্থলে- সে ক্রমাগতই এগিয়ে চলে। আরো কিছুটা; আকষ্মাৎ অন্যরূপ- তার ঠিক পিছন পিছন কে বা কারা! ভেজা ঘাসের উপর সমবেত পদশব্দ- থপথপ, খসখস; আরেকটা মৃদু গুঞ্জন- প্রচন্ড ভয়ে তার শিরদাঁড়া কেঁপে কেঁপে উঠে। পিছনে তাকিয়ে দেখার সাহস হয় না আর- ঝেড়ে দৌড় দিবে না কি? সহসাই তার জটিল ভাবনা-চিন্তার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পায় সে- কিছু বুঝে উঠার আগেই, ধপ্- কেউ একজন সজোরে মাথায় মেরে বসে তার। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং উঠে দাঁড়ানোর আগেই শক্ত কতগুলো হাত মাটিতে চেপে ধরে- চিৎ করে; এবার সে দেখতে পায় তাদের- চাঁদের রঙের পোষাক সবার; একই ধারার দাঁড়ি- এ যে হাজারখানা গফুর; হাতে তাদের লম্বা তলোয়ার- চাঁদের আলোয় চকচকিয়ে উঠে। এখানে রসুল কোরবানির গরুর মতন- চেয়ে চেয়ে দেখে; আকষ্মাৎ আর্তচিৎকার- প্রচন্ড রকমের; বাঁশির আওয়াজ ছাপিয়ে, আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে- তারা যেমন এসেছিল তেমনি চলে যায়।

অনেকটা ধ্বংসের পাটাতনে যখন অমানিশা; দৃশ্যটি চিতল মাছের মত ভুস্ করে রসুলের স্মৃতির পর্দায় ঘাঁই দিয়ে উঠে। একগাদা কিলবিলে শরীর, হাঁড়ে-হাঁড়ে ঠকঠক, পায়ে পায়ে থপথপ-। উপরে গোল একটা চাঁদ, নিচে মাতাল বাঁশির সুরÑ সবুজ ঘাসের বুকে একরাশ লাল রক্তের উষ্ণতায় তড়পাতে তড়পাতে তাদের কোনটাই উপভোগ করা হয়ে উঠেনা তার।


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

আপনার গল্পগুলো অন্যরকম সুন্দর!!

--------------------------------------------------
"সুন্দরের হাত থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়/
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে..."

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।