অপারেশন ( ২য় পর্ব )

প্রত্যয় এর ছবি
লিখেছেন প্রত্যয় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৫/১১/২০০৮ - ১:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভালই চলে বাতেনের- সময়ে সময়ে ছোটখাট ভিড় লেগেই থাকে ওকে ঘিরে। এ কয়দিনে অনেক উন্নতি হয়েছে ওর গল্পের; তলোয়ারগুলো প্রতিবার একহাত করে লম্বা হতে হতে দশে ঠেকেছে প্রায়- অবিশ্বাস হয়না কারো; প্রশ্নও তুলে না কেউ। এখন একটাই সমস্যা- বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে; চোখের সামনের পরিচিত দৃশ্যপট নিমেষেই ধোঁয়াশা- ভেসে উঠে কিসব। এইতো সকালে- ট্রেনে উঠেছিল সে। শুয়োপোকা ট্রেন- ঢাকা আসলেই দম ফুরোয় যেন- গা টেনে টেনে চলে; তার ভিতর একটা খালি সিটের জন্য এদিক সেদিক ঘুরছিল সে। আকষ্মাৎ নীল- একটা নীল পর্দা তাকে ঘিরে ধরে। সেখানে নীল- শুধুই নীল- অসংখ্য নীলের সমষ্টি সেখানে। আদি-অন্ত-আদিগন্ত- পুরোটাই নীলে নীলাম্বর। একটুকরো পাথরের মত ক্রমশ ঘূর্ণায়মান- পতনশীল তার অস্তিত্ত্বই এখন নীলে নীলময়। নীল সাগরের বুক চিঁড়ে নীল অতলে তলাতে থাকে সে।তার কাঁধ ছুঁয়ে নীল মাছের ঝাঁক- অদূরে নীল তিমি, নীল হাঙর, নীল জামা। আকষ্মাৎ সব হারায়। বরশিতে আটকে পড়া মাছের মত কে যেন তাকে টেনে তোলে। কি আশ্চর্য! নীল জামাটি এখনো চোখে বিধে আছে। তখন সবেমাত্র মহানগর প্রভাতী খিলগাঁও রেলগেইট পার হচ্ছে। মেয়েটি একেবারে সামনে- ক্রসিং এর সাথে লাগানো প্রায়। বাতেন ছিল দুই বগির মাঝখানে টয়লেটের সামনের খালি জায়গাটায়। আশেপাশে খালি সিট অনেকগুলো ছিল- সমস্যা একটাই; গার্ড। এ এক জিনিস; চক্ষে দেখার মত! এইতো সামনের বগিতে মাঝখানের মুখোমুখি সিটদুটোকে বিছানা বানিয়ে- একটাতে গা; একটাতে পা- কি সুন্দর ঘুমিয়ে আছে- মুখ হা করে। আহা! কি আরামের কুমিরা ঘুম। এয়ারর্পোট স্টেশন আসুক- লাফিয়ে উঠে সিট ঝেড়ে-ঝুড়ে এমন ভাব নিবে যেন নিশিদিন সে সিটগুলো পাহাড়া দিয়ে আসছে যাতে প্যাসেঞ্জার ছাড়া অন্য কেউ বসতে না পারে। হালায় জানোয়ার! দুইমাস না ধোয়া শার্ট-প্যান্ট; তায় আবার এ পাড়া, ও পাড়ার জঘণ্য সব জিনিসপত্রের ছাপ- রাতভর কত কি করেছে তার পাত্তা আছে! তাও দেখ্- গোছল দূরের কথা, হাত-মুখ ধোয়ার নাম পর্যন্ত নেই। সে হালায় দুই সিটকে বিছানা বানিয়ে গায়ের ময়লা গদির লাল কাপড়ে লেপ্টালে কোন সমস্যা নেই; সমস্যা সব বাতেনদের জন্য। ভাবখানা এমন- রাস্তার ভিখারি সিটে বসলে যেন রাস্তা
জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব নর্দমা ডাস্টবিন সহয়োগে সিটের উপর উঠে বসবে।
কারে বোঝাবে মনের দুঃখ- দু’কদম সামনে যাক সে; পাগলা কুকুরের মত গার্ডটা লাফিয়ে উঠবে। আরপর চড়-চাপড়- অভ্যেস হয়ে গেছে অবশ্য (ওটাই ওদের বাধ্যতামুলক- প্রতিদিন ভাত না জুটুক; ঐ জিনিস কয়েকবার করে মিলবে); তবুও সকাল সকাল খালি পেটে ওসব ভালো লাগে না। অমন আরো কয়েকটা জিনিস ভালো লাগে না ওর- রেললাইনের ধারে সবাইকে উদোম পাছা দেখিয়ে হাগা-মোতা; পানি নাই, পর্দা নাই, লাজ-লজ্জ্বা-রোয়াব-সম্ভ্রম (ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছিল;তো- শিক্ষিত সেন্টিমেন্টটা তাই পিছু ছাড়ে না ওর)। সেই সুবাদে মহানগর প্রভাতি তো আশির্বাদ। রাত অবধি কমলাপুরে গলাবাজি- তাও সময়ে সময়ে পাল্টায়, জায়গায় জায়গায় পাল্টায়, মানুষ বুঝে পাল্টায়। কখনে তা উপযুক্ত- একেবারে পারফেক্ট সেটিসফেকশান; টিভি বিঞ্জাপনের কথাগুলো মাথায় খেলে ওর। সেই হিসেবে এই সময়টা ওর পারফেক্ট সেটিসফেকশান সময়- হুজুগে বাঙালি এখন ‘বাংলা ভাই’ হুজুগে মেতেছে। এর পুরোপুরি ফায়দা নেয় সে; কথাটাতো সত্যি- দুটো টাকা দেন সার, তিন দিন কিছু খাইনা। বাংলা ভাইয়ের বোমায় বাপ-মা মরছে। আমার বাম-পাও খান খোঁড়া অইছে। খাওয়াইবো কে? -আসলেই কাজ হয়। তিন দিনের অভুক্ততায় মানুষ যতটা না গলে; বাংলা ভাই নামে গলে তার চেয়ে ঢেড় ঢেড় বেশি।
-বাংলা ভাইয়ের বোমা! কোনহানে? তুই পিচ্ছি মানুষ- দেইখাতো মনে হয় বাইরে থিকা উইড়া আইছস।
-হ সার। আমি কইলাম উত্তরবঙ্গের।
-কস কি। খোদ বাংলা ভাইয়ের পেয়ারের বান্দা মনে অয়। তা, তোর বাপে মরছে কেমনে? বাংলা ভাইয়ের চেলা ছিল? বিট্রে করছে? না কি সর্বহারা!
-না সার। বাপে ছেল খেতের কামলা। সেবার মঙ্গা- খাওন নাই, দাওন নাই; সবাই মিলা মরবার লাগছিলাম আর কি। আর না পাইরে বাপে কইল, সব গুছাইয়া ল। সবে মিলা ঢাকা যামু। ওখানে না খাইয়া থাকা লাগে না।
সত্যিই তাই- ওর চোখের সামনে আরেকটি নীল ভেসে উঠে। ওর কালো রঙের বুবু নীল একটি জামা পড়ত- চোখ ধাঁধিয়ে তোলা নীল। যখন বাড়িতে থাকত, যখন স্কুলে যেত, যখন মাঠে মাঠে ছুটত, যখন শাক তুলত- পাতা কুড়োত; যখন খেতে পেত, যখন পেতনা- সবসময় নীল জামাটি ছিল তার। ছোট্ট বাতেনের বন্ধু, সঙ্গী, সহকর্মী- যা কিছু সম্পর্ক, সব ঐ বুবুর সাথেই। এমনকি যেদিন ওরা ঢাকায় এসেছিল- কত আশা মনে; বাপের এক ভাই আছে ঢাকায়- অনেক পয়সাওয়ালা; বিশখানা রিক্সার মালিক- ওখান থেকে একটা চালাতে দিলে তো ওদের আর না খেয়ে থাকা লাগে না। আর, হাজার হোক- ভাই তো। বিপদের সময় ভাই কি ভাইকে বুকে টেনে নিবে না! -প্রচন্ড উৎসাহে একখানা আস্ত সংসার (চারখানা ছেলেমেয়ে- দু’খানা কোলে, দু’খানা বড়; একখানা বৌ, হাঁড়ি-পাতিল, কাঁথা-বালিশ, ছেঁড়া খোঁড়া- কাপড়ের বস্তা; পারে তো ঘরের চালাসুদ্ধ খুলে নেয়) মাথায় নিয়ে ঘর ছাড়ে তারা। কিছুটা বাসে খিছুটা হেঁটে- শেষমেষ রেলগাড়ি। সেই প্রথম- বাতেন মরচে ধরা ধাতব বগির ভাঙা জানালা দিয়ে চোখ পাকিয়ে বাইরে তাকায়- তাকিয়েই থাকে। এতক্ষণে বাজানের দম ফেলার ফুসরত হয়
-কাজটা পাইয়ে গেলে তোরে ভাল একখান স্কুলে ভর্তি করে দিবানে। লিখাপড়া শিখবি- অনেক বড় ডাকতর হবি; মাস্টরে বলছিল না!
বাতেন সপ্নে হারায়- ভাল স্কুল; বাংলা ভাই বাংলা পড়াবে- ইংলিশ ভাই ইংলিশ। ইংলিশ ভাইটা মনে হয় বিদেশি হবে; সাদা সাদা চামড়া, সাদা সাদা চুল- সব সাদা; ফার্মের মুরগি- অকারণেই হাসি পায় তার। সে হাসির রেশ ছিল অনেক্ষণ- যখন তারা কমলাপুর নেমেছিল; আনন্দে বাতেন দিশেহারা- এই সেই ঢাকা! উৎসাহে সামনের দিকে দৌড়িয়েছিল সে। বাবা জিনিস সামলাতে ব্যস্ত, মায়ের কোলে দু-দুটো বাচ্চা- নীল জামা বুবু চিৎকার করতে থাকে, “যাইসনা বাতেন!” আকষ্মাৎ- বুম্। প্রচন্ড বিষ্ফোরণে মাটিতে ছিটকে পড়ে সে। চারিদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া আর ধোঁয়া- ঝাঁঝালো বারুদ গন্ধের ধোঁয়া। মাথাটা ভারী হয়ে আসে; বাম পায়ে চিনচিনে ব্যাথা। এর মধ্যে মাথা তুলে সে। যেখানে বাবা-মা ছিল সেখানে একরাশ মাংসের দলা- একটু সামনে লালে নিমজ্জমান নীল জামার বুবু গোঙানির মত বলে, “পানি।” -বুবু পানি খাবে! কেউ ওকে পানি দাও। -কে দিবে! এই দূর্যোগে কাকে কে চিনে! সবাই পালাচ্ছে তখন- দূরে, বহুদূরে। বাতেন জ্ঞান হারায়।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।