অপারশেন ( ১ম পর্ব )

প্রত্যয় এর ছবি
লিখেছেন প্রত্যয় [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০১/১১/২০০৮ - ১১:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কি কমলাপুর; কি এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন- ইদানিং বাতেনের জয়-জয়কার। বছরখানেক আগেও সবার লাথি-গুঁতো ছাড়া কিছুই ছিল না বাম পা কিছুটা খোঁড়া ছেলেটির অনুসঙ্গে। কি কুলিগিরি, কি ভিক্ষা- সবখানেই অপাচ্য ( পুরানো ভিখারি ভাত পায়না; তায় আবার নূতন আমদানি)। দিনে দু-দিনে একবেলা খাবার হয়তো- তখনো কিছুই চিনেনি ছেলেটি। যখন চিনল- ততদিনে বাংলা ভাই ওর জঙ্গী বাহিনীসহ ধরা পড়েছে। সেদিন কি পরিমাণ আনন্দ ছেলেটার।
-আরে! ধরা পড়ল বাংলা ভাই; এইডা লাফায় ক্যান?
-কি রে পিচ্ছি! তোর আবার কি হইছে?
-কি হইছে, মানে! ঐ বেডার বোমায় আমার বাবা-মা-ভাই-বোন সবকয়টা মরছে- আমি খুশি হমু না!
আকষ্মাৎ সবার দৃষ্টি ফিরে। বলে কি ছেলেটা। এতদিন সবাই টিভিতে দেখেছে, পেপারে শুনেছে- শাপ-শাপান্ত; গালি দিয়েছে অনেকবার- নির্যাতিতদের জন্য আহা-উঁহু; চাক্ষুস দেখার সুযোগ হয়নি কখনো- না বাংলা ভাই, না নির্যাতিত কেউ। কে জানত তাদের একজন এই কমলাপুরের পিচ্ছি-পিচ্ছি কুলিবাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে আছে! দোকানদার নান্না মিয়া ক্যাশ-কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে হাত ধরে ওকে টেনে বসায়।
-এই, এর লাইগা স্পিশাল নান আর ডাইল-ভাজি লইয়া আয়। আর কিছু খাবি বাপ? (দরদ উথলে উঠে ওর। অথচ মাত্র একদিন আগে ওর দোকানে দাঁড়িয়ে টিভি দেখার অপরাধে ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছিল ছেলেটাকে- ‘হালায় ফকিন্নির বাচ্চাগুলানের লাইগা কাস্টমার আইতে পারল না।’ তখন কি সে জানত বাঁ-পা খোঁড়া এই পিচ্ছিটার সব আকর্ষণ বাংলা ভাইয়ের জঙ্গী বাহিনীতে! প্রতিনিয়তই টিভিতে খবর হচ্ছে- এক জিনিস ঘুরে ফিরে বারবার; ঐ দেখে দেখে মুখস্ত হয়ে গেছে সবার। এবার নূতন জিনিস শোনা হবে!)
-তোর বাড়ি কোনহানে?
-রাজশাহীর বাগমারা।
বলে কি ছেলেটা! একেবারে বাংলা ভাইয়ের দেশের বাড়ির লোক। একে তো আর ছাড়া যায় না- পুরো ভিড়টাই ঘিরে ধরে ওকে
-তোর বাপরে কি গাছে ঝুলাইছিল?
-মায়েরে মারল কেমনে! বাংলা ভাই মেয়ে মানুষ মারছে- আগে তো শুনছি না!
-কি করছিলে বাপে? এমনিই মারছে?
অনেক প্রশ্ন তাদের। মুখে অর্ধেকটা নানরুটি পুরে রাখা প্রশ্নবাণে জর্জরিত বাতেন গোঙানির মত জবাব দেয়
-না ছার। বোমায় মরছে। গেলবার কমলাপুরে বোমা ফুটল না।
-হ। মনে পড়ছে। ঐ যে সাতজন না আটজন একসাথে মরছিল- কয়েকটার তো চেহারাই চেনা যায় নি; ঐগুলান তোর ফেমেলি। তা, ঢাকায় আইছিলি কি করতে? বাংলা ভাইয়ে তাড়াইছিল?
-মঙ্গা নামছিল। খাইতে পাই না। বাপে কল ঢাকায় যামু-
অতি উৎসাহী কজন আকষ্মাৎ উৎসাহ হারায়- কত কিছু ভাবছিল তারা; বাংলা ভাই পিচ্ছিটার বাপকে মোটর বাইক নিয়ে তাড়াচ্ছে, গাছের আগায় ঝুলাচ্ছে- তা না! মঙ্গা হইছে উত্তরবঙ্গে, আর মানুষগুলো মরতে আইল ঢাকায়। এর চেয়ে তো টিভিতেই ঢেড় বেশি। এই যে একটু আগে সাতজনের ফাঁসির রায় হয়ে গেল- অন্যরা হলে কি করত; কান্নায় ভেঙে পড়ত, মাথা নিচু করে থাকত। আর ওরা করল কি; একসাথে সবাই বলল, ‘আলহামদুল্লিাহ্’। -কত খুশিই না হয়েছে তারা। সেই আনন্দে তো কোরাস শুরু করে দিল আধ্যাত্মিক গুরু সাইখ। আহা! কি তার কন্ঠ আর কি সে গান।

জিহাদী কাফেলার তুমি বীর সৈনিক
মৃত্যুকে করো নাকো ভয়
তৌহিদী হোক শুভ কামনা
মুসলিম সে তো হল সিংহ পুরুষ
শাহাদাৎ হয় যদি কামনা
শক্ত হাতে ধর রশি -
মৃত্যুকে ভয় করো না।

ওর ভরাট গলায় পুরো আদালত গমগমিয়ে উঠেছিল হয়তো। সেখানে তো আর থাকা গেল না- জিনিসটার সত্যতা যাচাইও হল না। সেখানে এই পিচ্ছি যদি তার চেয়ে একটু বেশি চমকপ্রদ শোনাতেই না পারে; তবে ওকে ঘিরে ধরা কেন! তার চেয়ে টিভিই ভাল। গেল- নান্না মিয়ার নান আর ডালভাজির পুরোটাই লস্। ক্ষোভে নান্না মিয়া কাউন্টারে ফিরে আসে আবার। ঐ সব বোমার কহিনীতে তার চলবে? তাও একটু দূরে-টুরে হলে কথা ছিল। ফুটছে তো এই কমলাপুরে; ওর চোক্ষের সামনে। সেই গল্পটা পিচ্ছির চেয়ে নান্নামিয়াই ভাল বলতে পারবে। পিচ্ছি তো বোমা খাইয়া বেহুঁশ ছিল। দেখছে না কি কিছু! -দু-একজন তাও প্রশ্নবাণ চালাতেই
থাকে। বাতেন তখন সবেমাত্র পানির গ্লাস হাতে নিয়েছে
-বাংলা ভাইরে সামনা সামনি দেখছস্ কহনো।
-দেহি নাই আবার! কতবার পিছন পিছন ঘুরছি, চায়ের দোকানে একলগে চা খাইছি; অর দরবারেও গেছিলাম কয়েকবার।
-দরবার!
-হ! বাংলা ভাইয়ের দরবার ছিল একখান। রাজাকার বাড়ির তেঁতুলতলায় চেয়ার টেবিল নিয়ে বসত বাংলা ভাই। বাড়ির সামনে-পিছনে, আশে-পাশে অনেকগুলা মানুষ- হাতে চকচকা ইয়া লম্বা-লম্বা তলোয়ার। কি সে তলোয়ার- দেখলেই মনে অয় ঘাড়টা মাথা থেইকে সরে গেল। এক কোপ যদি এইসে পড়ে, আপনের মত আট-দশখান মানুষ একলগে দুই টুকরা।
আবারো টনক নড়ে সবার। তাইতো! এইসব কাহিনী তো টিভিতে দেখানো হয় নি- নান্না মিয়া আবারা ক্যাশ-ছাড়া।
-তারপর!
-তারপর আবার কি? প্রতিদিন বিকালের আগে বাংলা ভাই বিচার বসাইত- ঐ বিচারে খালাস বইলে কিছু নাই। যে ধরা, সেই মারা। আমরা দেখতে যাইতাম। ঐ যে, একটা লোকরে গাছের সাথে ঝুলায়া রাখছিল না- তার আগো তো হাতুড়ি দিয়া বাইরায়া তার আঙ্গুল থিকে নখগুলান সব উঠায়া ফালাইছিল। আহারে! -কি পরিমাণ চিল্লাইতেছিল লোকটা। কিছু করার নাই- তুমি দোষ করছ, শাস্তি তুমি পাবাই।
-কি করছিল?
-সেটা আমি কেমনে কমু? বাংলা ভাই জানে।
ভিড় ক্রমাগতই বাড়ে। সবাই কিছু না কিছু শুনতে চায়। বাতেন এটা বলে, ওটা বলে- ক্ষণে-ক্ষণে তার ক্ষিধে পায়; এসব বিষয়ে মানুষের কার্পণ্য নেই- উদার হস্তে তারা খাওয়ায়। বাতেন শাইখের গল্প করে; প্রথম যেবার এসেছিল- কি নূরানি চেহারা! কথাবার্তার কি ধার! ধারটা এখনো আছে। নইলে আদালতে উঠে কেউ বলার সাহস রাখে, “তাগুতির আদালত অপবিত্র; স্যান্ডেল খুলব না। আগে কখনো খুলিনি।” আর বাংলা ভাইটা- কি তার কথার জোর (আমাকে বাংলা ভাইও ডাকতে পারেন, আরবী ভাইও ডাকতে পারেন; বাংলার মত আরবীটাও আমি খুব ভালো পারি-) কি সুন্দর আদালত ভর্তি মানুষের সামনে ডায়লগ ছাড়ে- ‘শকুন দোয়া করে গরু মরার জন্য, পুলিশ দোয়া করে মামলার জন্য, উকিল দোয়া করে মক্কেলের, রাজনীতিবিদরা চিন্তা করে সন্ত্রাশ পালনের আর জে. এম. বি. চিন্তা করে দেশের মুক্তির।’ -হ্যাঁ। মুক্তিই বটে! দেশের সব মানুষের একসাথে মুক্তি। চিরতরে- মরে গেলে তো সব মুক্তি পেয়েই গেল। হালায় আলেমের ঘরের জালেম! বাপটাতো ভালো মানুষ ছিল- একেবারে মাটির মানুষ। এই মানুষের ঘরে- অথবা হয়তো নয়! সে নিজেও হয়তো তাই ছিল- মাটির মানুষ না হলেও অন্তত সুন্দর কথাবার্তার ভালো লাগার মত একজন। প্রথম যখন বাংলার মাস্টার হয়ে এল- বেশ খুশিই হয়েছিল সব। তাইতো হবে; মাস্টার মানুষের ছেলে (বাপকা বেটা, সেপাইকা ঘোড়া)। না! বাপের নাম ঠিকই রেখেছিল সে। কথাবার্তায় বেশ- লেখাপড়ায় আরো একধাপ; এত বেশি সুনাম লোকটার- বাতেনের খালি মনে হত সে কলেজে উঠে না কেন! অথবা, লোকটা যদি স্কুলে ক্লাস নিত।
হাটে বাজারে কতবার পিছন পিছন ঘুরেছে তার- আহা, কি সুন্দর করেই না কথা বলে লোকটা। একদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেল। বাতেনের খারাপ লেগেছিল সেদিন। -ফিরেও এল আবার। তখন সেখানে সর্বহারার রাজত্ব। রাতের আঁধারে মানুষ মারত তারা- মানুষ মারা নয়; ওরা বলত ‘শ্রোণীশত্রু দমন’। দলবেধে এসে রাতের বেলা ঘরের দরজা ভেঙে পুরুষটাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসত উঠানে। তারপর- ঠুস্। -বাবা-মা-বৌ-ছেলেমেয়ে সবার সামনে গুলি করতে মারত। গুলি কোথায়! ও তো কালি খরচ। ওদেও যে কমান্ডার তার তো কোনদিন একটার বেশি কালি খরচ করা লাগেনি কখনো। ভয়ে তটস্থ ছিল সবাই। কোনদিন কার ঘাড়ে এসে পড়ে- দুশ্চিন্তায় ঘুম হয়না কারো। -একদিন সারা বাগমারায় মাইকে মাইকে রটিয়ে গেল সবাইকে সর্বহারার হাত থেকে বাচানোর জন্য জে. এম. বি. বাহিনী আসছে। সবাই অবাক- এ আবার কি! সবাই উৎসুক- দেখতে কেমন তারা? তারা আসল মোটর বাইকে চড়ে; পরনে পাঞ্জাবি সবার- হাতে অস্ত্র। যখন তারা নামল- আরে এ যে বাংলা ভাই! এসেই অভয় দিল- আর ভয় নেই। জে. এম. বি.’র পক্ষ থেকে আমরা এসে গেছি। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে সবাই। সেদিন খুশিই হয়েছিল বাতেন- ওর সপ্নের শিক্ষক বাংলা ভাই তবে নায়কের পার্ট নিল! -পরদিন থেকে শুরু হল সর্বহারা নিধন। আরে সর্বনাশ। ওরা তো তাও গুলি করে মানুষ মারত; আর এরা। অকল্পনীয়! আবারো সবার ঘুম হারাম। আগে ঘুম হত না ভয়ে; এখন ঘুম হয় না বিভৎসতায়। সেসব ভেবে বাতেনের গা গুলিয়ে আসে। তারপরও ভাবতে হয়- এতগুলো মানুষের উৎসাহের আগুনে সে জল ঢালবে কিভাবে?


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।