অপারেশন (৩য় ও শেষ পর্ব)

প্রত্যয় এর ছবি
লিখেছেন প্রত্যয় [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৬/১১/২০০৮ - ১১:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জ্ঞান ফিরেছিল অনেক দেরিতে। তখন তার হাতে ব্যান্ডেজ, বাঁ পায়ে প্লাস্টার, পেটে ক্ষিধে, গলায় তৃষ্ণা আর কানের সামনে অবিরাম অস্ফুট এক কাতরানো স্বর, ‘-পানি। -পানি।’ -ওর বুবু; লাল হয়ে আসা নীল জামার বুবু পানি চাইছে। কে আছ; ওকে পানি দাও- কাতর কন্ঠে সে গোঙানির মত শব্দ করে, ‘পানি।’ সাদা পোষাকের এক নার্স দৌড়ে এসেছিল তৎক্ষণাৎ। আরো একজন- কি সব বলাবলি করল তারা; নাম জানতে চাইল; দেশ- বাবা-মা- কে আছে ঢাকায়- ওখানে গিয়েছিল কেন; বাতেন ভ্যবলার মত ফ্যলফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। তখনো কি সে জানত; ওর পেয়ারের বাংলা ভাই- ভালো ভালো কথাবার্তা; ঐ লোকের ইশারায় এতকিছু। জানা উচিত ছিল। বাংলা ভাইয়ের দরবার নিয়ে অনেক কিছুই শুনত সে- ভয়ে কোনদিন চাক্ষুস দেখার সুযোগ হয়নি তার; এখানে এসে যদিও রং চড়িয়ে বলে- বাঙালি এমনই; যত বেশি রং, তত বেশি পছন্দনীয়। তারপরও মাঝেমধ্যে একটা দুটো লাশ কি চোখে পড়ত না- পা উল্টিয়ে বেঁধে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা লাশটা! -প্রভাতির দুই বগির মাঝখানের জায়গাটাতে কিনারের সাথে হেলান দিয়ে বসে সেইসব ভাবতে ভাবতে বাতেনের রাগ চড়ে যায়। কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে তাকে- যদি একবার কাছে পেত সে; আকষ্মাৎ কোথায় যেন হারায় সে- এক শূন্যতায়। সেখানে সব অসম্ভবের অনেক অন্তরালে, অনেক গভীরে ধোঁয়া-ধোঁয়া ধেঁায়াময় হালকা একটা সম্ভাবনার অস্তিত্ব যেন। বাতেন দিশেহারা- বুকের ভিতরটা উথলে উঠে। এক অন্ধকূপ- কত আগে কোন সে রাজপ্রহরী তাকে ছুঁড়ে দিয়েছিল অনেকটা গভীর, চির অন্ধকারময় লাশের দঙ্গলে। সব লাশ- মরা লাশ, পঁচা লাশ, টাটকা লাশ, বাসি লাশ; পঁচে গলে নিঃশেষিত কঙ্কাল লাশ- চটচটে থকথকে দূর্গন্ধময় লাশের গলিত সত্ত্বা। তীব্র উন্মাদনায় দু-হাতে সেই পাহাড় এলোমেলো করে বাতেন কি যেন খুঁজে। ভিতরে- আরো ভিতরে আরো পঁচা আরো গলা লাশ- লাশের গন্ধে বাতেনের মুখে বমির লহর; হাতের বিরাম নেই। এইতো পেয়ে যাচ্ছে সে- প্রায় পেয়ে গেল বলে। সেই দাড়িভর্তি মুখ, বিশাল বপু, শালকাষ্ঠ বাহু, সাদা পাঞ্জাবি- ঐ তো পালিয়ে যাচ্ছে সে। বেরিয়ে গেল প্রায়- সে মরিয়া হয়ে উঠে। সামনে- আরেকটু সামনে। না! পারল না। তার আগেই পেরিয়ে গেছে লোকটা। একটা দরজা সেখানে। অনেকটা ভারী- অনেকটা অন্ধকার- অনেক অনেক দৃঢ় ছোট্ট একটা ধাতব দরজা; ধরলেই ঝমঝম, ধরলেই ঝন্ঝন্। বাতেন জানে; তার ওপারে আগুন আগুন এবং শুধুই আগুন- চির জাগ্রত দোজখের আগুন। এ আগুন জ্বালায় এবং পোড়ায়- পোড়ায় এবং জ্বালায়; নিঃশ্বেষ করে না কখনো- ভষ্মও না (আস্ত খাসির রোস্ট যেন- পুড়বে এবং নিজের জলে নিজেই সেদ্ধ; ছাই হয় না কখনো)। তবুও লোকটা ভাগ্যবান। বাতেনের প্রতিহিংসার অগ্নিশূল দোজখের তুলনায় অন্ততঃ সাতগুণ তীব্র। নিরাশ হল সে- চোখ অশ্র“ ছাড়ল, দু-হাত মাথায় এবং আকষ্মাৎ কি যেন ভেবে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সর্বশক্তিতে সেই গুরুভার দরজায় পেল্লাই এক ধাক্কা। ভুল ভেবেছে সে। এ যে ইন্দ্রের অমরাবতী, কৃষ্ণের কুঞ্জবন, হেলেনের ট্রয়, হারুণ-আর রশিদের বাগদাদ- না হলেও অন্ততঃ ইন্দোনেশিয়ার বালি বা ইতালির রোম। ডিজনির ওয়ান্ডারল্যান্ড হওয়াও অবিচিত্র কিছু নয়- যেহেতু এদের কোনটাই সে দেখেনি- তুলনা দেওয়া ভার। অথবা হয়তো অনেক আগে মামুনের কাছ থেকে ধার করা ছোটবেলার গল্পের বইয়ে পড়া ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’। কি যেন হত সেখানে! সোনা ফলত- না কি লম্বা লম্বা হাত পা ওয়ালা ভাল ভাল জীনেরা ঘুরে বেড়াত! তাই হবে হয়তো। অনেক ক্ষমতা জীনগুলোর। সব খাবার-দাবার ওদের হাতে। হাত বাড়ালেই বনফুলের মিষ্টি অথবা ইগলু কোম্পানির আইসক্রিম; না হলেও অন্ততঃ আস্ত একপ্লেট মোরগ-পোলাও- সেই কত আগে কোন এক পাড়াতো চাচা নাকি মামার বিয়েতে মোরগ পোলাও খেয়েছিল; স্বাদটাও ভুলে বসেছে। নয়তো একপ্লেট তেহারি হলেও মন্দ হত না। হয়তো এটাই সেটা- নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় না হোক একটা বিয়েবাড়ি হলেও হয়। উৎসাহে উথলে উঠে সে। আকষ্মাৎ দমে যায়- এত লোকের সর্বনাশ ডাকার পর লোকটা এখানে এল কিভাবে! তাহলে কি ঐ কথাগুলোই ঠিক- ইহকালের সব ঝুটা, সব মিথ্যা; পরকালের পাওয়াটাই সব। তাই বলে; ইহকালেওতো লোকটা কম পায়নি। ফাঁসির আসামীÑ সর্বঘৃণিত লোকটার জন্য সরকার বাসা ভাড়া করেছিল। সেখানে কত আরাম; এসির হাওয়া, নরম বিছানা, নতুন পাঞ্জাবি- দুবেলা বাইরের খাবার; কি ছিল সেখানে- কোরমা-পোলাও, না-কি লোকটার অতি প্রিয় খুশবুওয়ালা পরটা-হালুয়া। খুব পছন্দ করত জিনিসটা- সেখানে, এখানেও- এমনকি যেদিন ধরা পড়ে সেদিনও হাসপাতালে ঐ জিনিসটাই চেয়েছিল। -এলাচি, দারুচিনি- আরো নাম না জানা অনেকগুলো মশলাওয়ালা হালুয়অর ভুরভুরে খুশবুতে তার চারপাশ ভরে উঠে। বারকয়েক লোল টেনে স্বাদের কিছুটা অনুধাবন করার চেষ্টা চালায় সে।

অনুধাবণ হয়ে উঠে না তার। ভাবতে ভাবতে সে খেয়ালই করেনি এয়ারপোর্ট এসে গেছে ট্রেনটা। বুঝল তখনই- যখন গার্ডেও ময়লা বুটের একটি লাথি তার কোমড়ে; ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে সে। মুহূর্তেই ওর রাগের সমস্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সহস্র লেলিহান শিখা উচিয়ে ছুটে যায় র্গাডের দিকে। শুয়োরটা পয়দা হইছে কোন নর্দমায়! আকষ্মাৎ স্কুলের কথা মনে পড়ে তার। মাস্টারে কি যেন সব বলত- পেটের মধ্যে একটা থলি আছে। সেখানে ভাত হজম হয়। আরেকটা থলিতে গু জমা থাকে- সময়ে সময়ে বেরিয়ে আসে; আরেকটাতে মুত। কি যেন নাম ছিল ওসবের- ডুডেনাম, ইলিআম। ইলি আম- নামটা মনে আছে বেশ। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ত সে। বহুৎ ভালো ইসটুডেন ছিল। সারে ওর বাজানরে বলত- মাথায় ব্রেইন আছে। বড় পাশ দিয়ে ডাক্তার-ফাক্তার হইয়া যাইবো। অরে তুমি কষ্ট কইরা হলেও লেখাপড়া করাইও। সেই থেকে খাব ঢুককছিল- ওর মনে; ওর বাজানের মনে। ঘরে মাছ আসলে মুড়োটা ওর পাতে- ঘিলু না খাইলে ব্রেইন হবো কেমনে। হয়তো ঘিলু খেয়ে খেয়ে ওর ব্রেইন সত্যি সত্যি আনেক বেড়ে গিয়েছে। ব্রেইনের পরিধি মাথার সীমানা পেরিয়ে ঘাড়-গলা ছাপিয়ে বুকের খানিকটা- পেটের কিছুটাও হয়তো দখল করে নিয়েছে- সব থক্থকে ঘিলু, থক্থকে ব্রেইন। নাহলে এত মনে থাকে কেন ওর; এত খাব্ দেখে কেন! লেখাপড়া করলে এতদিনে হয়তো সত্যি সত্যিই ডাক্তার-ফাক্তার হয়ে যেতো- পেরাইভেট কারে ঘুরে বেড়াত, অফিসে পাঙ্খার হাওয়ায় দিনমান বসে থাকা, রোগির পেট কাটা- নাড়িভুঁড়ি, ডুডেনাম, ইলিআম-। আবারো ইলি আম- নামটা ভুলার মত না। ওদের সাথে পড়ত জমির মুন্সির মাইঝ্যা পোলা আক্কাস- মহা ফাজিল; সাররে বলে- ‘ছার- ইলি আম! এইডা আবার কোন জাত? খাইতে কেমুন? চুকা না মিডা? আপনে দেখছেন? লম্বা না গোল? সবুজ না হলদা? ঢিলান লাগে না আপনাই ঝইড়া পড়ে?’ -কে জানে! সে প্রশ্নের উত্তর সে পাইনি ঠিকই- তবে ওকে কারো ঢিলাতে হয়নি; আপনাই খসে পড়েছে। অথবা হয়তো ঢিলিয়েছিল! কেউ জানে না। ওর ভাবার বিষয়ও না। তারচেয়ে রেলের গার্ডগুলোর যথোপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণই ওর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাতেনের হাতে ছুড়ি ঝক্মক্- ডাক্তার সে; সামনের টেবিলে গার্ডটি শোয়ানো- সে পেট কাটে; ঘচ্ঘচ্ করে কাটে (কোররবানির গরু এক- জুম্মন আলী কসাই এর মত টেনে টেনে চামড়া ছিলে)। আচ্ছা! চামড়া কি পুরোটাই টেনে বের করে আনতে হয়? তাহলে তো গলাটাও কাটা লাগে। এত কাটলে জোড়া লাগাবে কেমনে! সেলাই করবে- ওর হাতে যেমন করেছিল; নিজের আজান্তেই একবার বামহাতের দীর্ঘ সেলাইয়ের দাগে ডানহাতের আঙ্গুলগুলো খেলে উঠে। সেলাইয়ের সত্ত্বা তাড়িয়ে তাড়িয়ে অনুভব করে সে- সেইসব মোটা মোটা সুতো; পুরো গায়ের চামড়া সেলাই করতে গেলে ওরকম অন্ততঃ কয়েক বান্ডিল সুতো লাগবে। এত সুতোই বা পাবে কোথায়। তার উপর টেবলেট, স্যালাইন- মাথায় জট লাগে ওর। সেই অবসরে গার্ডের লাঠির একটা বাড়ি তার কোমড়ে আছড়ে পড়ে- অশ্রাব্য গালাগালি সেখানে। সমস্যা কি এইসব কুত্তার বাচ্চাগুলানের। খ্যাচাখেচি করবার না পারলে- আবারও একবার ভিমরি খায় সে; বছর দু-বছর আগেও তার ভাবনায় অনেক ভালো ভালো জিনিসপত্র আসত। বছরভর রাস্তায় নর্দমায় পঁচতে পঁচতে আর গার্ড-পুলিশ-রিক্সাওয়ালার খানকির বাচ্চা শুনতে শুনতে ওর চিন্তাশক্তির সিংহভাগই এখন খানকির বাচ্চা। সেইসব অশ্রাব্য শব্দাবলীর বিরামহীন সঙ্গীতে নিমজ্জিত সে আবারো ডাক্তার- হাতে সময় খুব কম (ইতিমধ্যে গার্ডের লাঠির একটি বাড়ি তার পাছায় এসে পড়েছে)। না। পেট কেটে লাভ নেই কোন। কাটতে হবে ওর জিহ্বা; চোখের পলকে টেনে, ছিঁড়ে ফালিফালি- এবার বল; যতখুশি গালাগালি কর- যতখুশি বোমা মারার অর্ডার দে, যতখুশি মানুষকে গাছে ঝুলাতে বল। আকষ্মাৎ সে স্তম্ভিত; ভুল হয়ে যাচ্ছে কোথাও। আবারও সে দেখে- আবারও। এতক্ষণ ধরে কার জিহ্বা কাটছিল সে (ততক্ষণে লাঠির দ্বিতীয় চুম্বন)! অত ভাবার সময় নেই। আরেকটা কাজ বাকি- ঘচঘচ করে সে হাত কাটে; ডান হাত, বাম হাত- এবার; মার বোমা! কিভাবে মারবি? তলোয়ার নিয়ে ঘুরবি? গাছে ঝুলাবি মানুষকে? কর। কেমনে করবি তুই? -লাঠির তৃতীয় বাড়ির আগেই তার ভয়ঙ্কর রকমের জটিল অপারেশন সমাপ্তি টানে। বছর চারেক আগে এই অপারেশনটা সে যদি সত্যি সত্যি করতে পারত- অথবা অন্য কোন ডাক্তার; বা কোন একজন কসাই। থাক্। ভাবার সময় আছে অনেক। আগেতো পিঠ। -এসব দোটানার মধ্যে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত বাতেন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে বোমার আঘাতে কিছুটা খোঁড়া বাম-পা খানা টেনে নিয়ে চলে। তার সত্তাজুড়ে অনেকগুলো অপারেশনের টেবিল- হাত কাটা, জিহ্বা কাটা অনেক অনেক লোক সেখানে- ধরণীমাতার আবর্জনবৎ সন্তানবৃন্দ। আরেকটু পিছনে বিশাল বিষ্ফোরণ, গাছে ঝুলানো মানুষ, একরাশ মাংসপিন্ড- ওর বাবা-মায়ের। সবকিছু ছাপিয়ে মুমূর্ষু এক আর্তনাদ, ‘পানি’।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।