অসম্ভবের পথে

প্রত্যয় এর ছবি
লিখেছেন প্রত্যয় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১১/০৮/২০০৮ - ৩:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাড়ির সত্ত্ব নিয়ে দুপক্ষের বাগ-বিতন্ডা যখন চরমে; ভোজবাজির মত তৃতীয় পক্ষের উদয় হল। আশ্চর্য ব্যাপার! কিছুদিন আগেও জায়গাটা দিনভর ঝড়ে ভিজে,রোদে শুকিয়ে পাঁপড়ভাজা হত- ভুল করেও কারো দৃষ্টি এ পর্যন্ত পৌঁছায় নি। একরাশ জলে গা ডুবানো সবুজ সবুজ পাহাড়গুলো নিশিদিন বুনো মোষের মত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ত তখন। হলদে চামড়ার পাহাড়ীগুলো ছাড়া লোকজনের দেখা মিলত কদাচিৎ। যখন পর্যটন বিভাগের চোখ পড়ল; আরে সর্বনাশ- জায়গাটির উপযোগিতায় স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান থ্। এমন একটি জায়গা এতদিন কোথায় ছিল! কোন অতলে! -না। আর ফেলে রাখা যায় না। এখানে পর্যটন কেন্দ্র হবে, দেশ-বিদেশের লোক আসবে- লেগে গেল ধুন্দুমার। পাহাড়ের বুক চিড়ে সিঁড়ি, এখানে সেখানে ঝুলন্ত সেতু, প্রমোদ-বিহারী নৌকা- সবকিছু চোখের পলকে। সবার অন্তরালের সবচেয়ে অবহেলিত জায়গাটি কি এক জাদুমন্ত্রে রাতারাতি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। পাহাড় চূড়ার শতভঙ্গ পরিত্যক্ত কুড়েঘররটিও এখানে পূরাকীর্তি, দর্শনীয় বিষয়, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। প্রতিদিন শত-শত লোক আসে, ঘুরে-ফিরে- চলে যায়। অনেক টাকার ব্যবসা সরকারের (বাইরের লোকদের আরো বেশি)। ব্যবসাটা জিইয়ে রাখতে খাটাখাটনিও প্রচুর; কালোঘাম ছুটে যায় ওদের। -মানুষ নূতনত্বে বিশ্বাসী। নূতন কিছু দরকার ওদের। ওই খুঁজতে খুঁজতে একদিন কারো চোখ চকচক করে উঠল।
একেই বলে পোয়াবারো। এমন জায়গায় কারুকার্যময় কাঠের বাড়ি!
ও তো রাজবাড়ি। দুইশ বছরের পুরানো।
সর্বনাশ! এমন হেরিটেইজ কেউ এভাবে ফেলে রাখে। এভাবে চললে কিছুদিনের মধ্যেই এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। এর দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। এখানে মিউজিয়াম হবে। মানুষ আসবে; দেখবে; তাদের ঐতিহ্যকে জানবে-
কিন্তু, বাড়িটাতো পোড়োবাড়ি নয় জনাব। রাজার ছেলে এখনো ওখানে থাকে।
অসম্ভব! এমন ভয়ঙ্কর নির্জনতায় আর যাই হোক, মানুষ থাকতে পারে না।
অতএব, যেদিন লোকটা দেখল আমি বাড়িটাতে আছি এবং বেশ বহাল তরিয়তেই আছি- তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছিল। অনেকদিন পর আমি যেন টসটসে রসগোল্লা দেখলাম। ধাতস্থ হতেও খুব একটা সময় লাগেনি তার (শিক্ষিত লোকগুলো শার্দুল সব)। কথাবার্তায় পটু অতিচালাক লোকটা অনেককিছু বুঝিয়েছিল আমাকে- এটি পাবলিক প্রপার্টি, দেশের ঐতিহ্য; দেশের মানুষের জন্য উন্মুক্ত হবে তা-। মিউজিয়াম হবে এখানে-
আমি কি সেখানে সং সেজে বসে থাকব?
মানে!
আমি কোথায় যাব?
দেখুন, সরকার বাড়ির সমপরিমাণ মূল্য আপনাকে পে করবে-
মানে, বাড়ি আমাকে ছাড়তেই হবে!
আপনি ভুল বুঝবেন না। আমরা বাড়িটি ছিনিয়ে নিতে আসিনি। কিন্তু, একবার ভেবে দেখুন- এভাবে অযতেœ থাকলে আপনার পূর্বপুরুষের রাজকীয় বাড়ি, এন্টিকস- মানে, আপনার বাবা-দাদাদের স্মৃতিচিহ্ন; বাড়ির বহুমূল্য তৈজসপত্র- সব তো নষ্ট হয়ে যাবে। সরকার চাচ্ছে, এই জিনিসগুলো যাতে সর্বোচ্চ যতেœ থাকে-
জিনিসপত্রের কথা বলছেন তো। ওই বেচে বেচে এতদিন পর্যন্ত আমাদের দুজন মানুষের পেট চলেছে। আর কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।
আর ইউ আ ম্যাড! আপনি জানেন, জিনিসগুলোর দাম কত!
খারাপ না। এক একটা জিনিসের দামে সপ্তাহখানেকের খাওয়ার খরচ উঠে আসে।
ওহ্ সিট্। ইউ ডোন্ট নো হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান। আপনার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা উচিত।
সে আপনাদের মর্জি। শেষ কথাটা আমি বলে দিচ্ছি; যদি বাড়ি ছাড়ার ইচ্ছে থাকত- তবে, অনেক আগেই আমি ওপারে চলে যেতাম। দিনের পর দিন- খেয়ে, না খেয়ে এই নগ্ন নির্জনে পড়ে থাকতাম না।
কথাটা হয়তো ঠিক। তারপরও, দেশের জন্য- দেশের মানুষের জন্য আপনার মধ্যে সামান্যতম মমত্ববোধও কি নেই?
ঐ জিনিস একসময় প্রচুর ছিল- অঢেল। ছোটবেলায় আমার মাকে ওরা মেরে ফেলল; তাদের জন্য আমার মমত্ববোধ ছিল। সরকার নদীতে বাধ দিল; পাহাড়ী ঢলে ভেসে গেল আমাদের সবকিছু। আমি ভেবেছিলাম ভালই হয়েছে; দেশের লোক হয়তো কিছু পাবে এবার-। ওই দিতে দিতে আমার মমত্ববোধের ভান্ডার নিঃশেষিত প্রায়। আর কিছু দেখাতে পারব না আমি। চাইও না।
তবুও বলছি; ভেবে দেখলে ভাল হয়। একসাথে অনেক অর্থ আপনার হাতে আসবে। আর, এটা তো জানেন- সরকার চাইলে এই বাড়ি সিজ্ করতে পারে।
আপনাদের যা খুশি করতে পারেন। আমি বাড়ি ছাড়ছি না।
আশাভঙ্গের অভিশাপ নিয়ে লোকগুলো বাড়ি ছাড়ল। তখনই আরেক উৎপাত। খবর নিয়ে এল সোনাই। - এ বাড়িতে সবমিলিয়ে দুজন লোকের বাস;আমি আর আমার প্রৌঢ় ভৃত্য সোনাই। দুজনের সংসার-তরণীটা এক আশ্চর্য দক্ষতায় টেনে নিত লোকটি। ডিঙি বেয়ে এখানে-সেখানে যেত সে; আশেপাশের সব লোকের সাথে পরিচয় ওর। ঘরের জিনিস বিক্রি, সদাই-পাতি, রান্নাবান্না- সব একাই সামলায়। বাজার থেকে এসেই সে বলল, ওরা বাড়িতে উঠতে চায়।
কারা?
কতগুলো লোক- সে ভালভাবে চিনে না। কয়েকদিন নৌকা নিয়ে এ ঘরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছিল। তাদের দুজন সোনাইকে বাজারে ধরে বসে। একটি লোভনীয় প্রস্তাব আছে ওদের। কিছু জিনিসপত্র রেখে যাবে ওরা এই বাড়িতে। আর; মাসে দু-একদিন ওদের লোক এ বাড়িতে থাকবে। তার বদলে আমাদের পুরো মাসের খরচ বহন করবে ওরা।
-এ কি ধরণের পাগলামো!
জানি না। তবে, লোকগুলো সুবিধার না। ওদের সম্পর্কে অনেক কিছুই শোনা যায়। শেষে হয়তো বাড়িটাই হারাতে হবে।
বাদ থাক। আমাদের কষ্টবোধ নিয়ে আমরা ভালই আছি। কাউকে জড়াতে চাইনা এর সাথে।

এখানে আমি কবি। এক চন্দ্রালোকিত মধ্যরাতে সেই অতীন্দ্রিয় কাব্যময়তা আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমার পরিচিত অনুভূতির অনেক বাইরে অন্যমাত্রীয় বিমূর্ত স্রোতধারায় নিমজ্জমান আমি ক্রমশ বয়ে চলছিলাম অস্তিত্ত্বের গভীর থেকে গভীরে- অনেক গভীরে। তখন লখিন্দরের বাসর ছিল না, ভীষ্মের শরশয্যা ছিল না; রাজবাড়িতে শান-শওকত, রাজপ্রহরীর হাঁকডাক, গ্রামোফোনে নৈশসঙ্গীত, পিয়ানোতে আলতো ছোঁয়া, রংমহলে বাঈজী- এমনকি একশ বছরের পুরানো ’রাজবাড়ি’ নামের এই কাঠের জঞ্জালে সামান্যতম গুঞ্জনেরও আভাস ছিল না। কালোধরা সেগুন কাঠের বারান্দায় আমি তখন চন্দ্রবিলাসী। সামনে একচিলতে সবুজ, দু-একটি বনজ গুল্ম; আরেকটু সামনে রূপোলি বুকের কর্ণফুলি। তার ওপারে; পাহাড়- পাহাড়- আর, পাহাড়-। চন্দ্রধারায় ডুবো-ডুবো মাথা উঁচু উঁচু খাড়া-খাড়া পাহাড়। তাদের পা জড়িয়ে সাপের মতন একেবেঁকে বয়ে চলা চাঁদভাঙা জলধারা। -এ আমার জন্ম-জন্মান্তরের প্রেমিকা। কত কাল ধরে প্রেম আমাদের! সেই শৈশবে- প্রতি চন্দ্ররাতে যখন বজরা ভাসত; সুরায়-নেশায়, বাঈজী-তবলায়, ঘুঙুরের ঝুমঝুম- আমার মহাবীর্যবান চন্দ্রভূক পূর্বপুরুষরা দেহকাব্যের নিপুণ কবি; তখন হাজার মোমের নিভু-নিভু আলোকছটায় নিমজ্জমান আমি নদীর প্রেমে বিভোর। কত বড় চাঁদ বুকে নিয়ে নদী- মিষ্টি-মিষ্টি দুষ্টু মেয়ে; ঢেউয়ের দোলায় চাঁদ গুঁড়োত। আর, বজরার দোতলায় আমার পূর্বপুরুষরা- সুরার বোতল, কতিপয় নর্তকীর সূক্ষ্ম সম্ভ্রমবোধ- । ভাঙাভাঙিতে ওরা ক্লাসিক। রাজ্যের অনেক সুন্দরীর প্রতিরোধ ভেঙেছিল তারা- চিরতরে।- কত আগের কাহিনী! অনেকেই জানেনা হয়তো- রাতের আধাঁরে ডাকাতের উৎপাত; মেয়েগুলো হারিয়ে যেত। -কোথায়? বুঝত অনেকেই- অতটাই সার। -আমার বজ্রকন্ঠী পিতামহ অদ্বিতীয় একজন। কত রকম খেয়াল ছিল তাঁর! রংমহলের মেঝের নিচে বড়সড় এক বাঘ পুষতেন তিঁনি- অভুক্ত নরখাদক। ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাঘটা গর্জাতে থাকলে তাঁর বুকের মধ্যে ব্যাথার ঢেউ উঠত; অন্যরকম অনুভূতি সেখানে। বেশিদিন বাঘটাকে অভুক্ত থাকতে হত না। সেই একটানা পৌরুষদীপ্ত গর্জনে তাঁর ভিতরের পুরুষটা জেগে উঠলে একধরণের জান্তবতায় তিঁনি নিজেই একটা বাঘ। সে রাতেই এক ধ্বংসপ্রায় নারীকন্ঠের আর্তচিৎকারধ্বনি রংমহলের দেওয়াল-পিঞ্জরে বন্দী মুনিয়া। নারীশরীরের সবটুকু রস নিংড়ে নিয়ে রাজামহাশয় মজ্জাটা ছুঁড়ে দিতেন আরেকটি ক্ষুধার্ত বাঘের মুখে। সেখানে অন্যধরণের জান্তবতা; অন্যরকম চিৎকার- ছিঁড়ে খাওয়াটাও। দুটি বাঘের তীব্রতম ক্ষিধের আগুনে অনেকেই আহুতি দিয়েছিল- পাহাড়-রাজ্যের অনেক ষোড়শী, অনেক অষ্টাদশী (এক বাঘের ক্ষিধে পেটে, অন্যটির অন্য কোথাও)। নিঝুম আধাঁরে কান পেতে শোন; মহলের দেওয়ালে তাদের অতৃপ্ত হাহাকার এখনো গুমড়ে মরে। সে এক দিন ছিল বটে - অন্ধকারের দিন। আমার জন্মের আগে ইতি টেনেছিল যুগটি। লোকটি মরেছিল- রহস্যময়ভাবে। -কিভাবে? কেউ জানে না তা। জানার চেষ্টাও কারো ছিল না। সময়টা হাওয়া বদলের। রাজতন্ত্র নামক প্রথাটা কিছুদিন আগে বিদায় নিয়েছিল। রাজার শাসন - সে এক স্বপ্নকথা। তবে, দাপট ছিল। আর ছিল অঢেল সম্পত্তি। এ এক মদিরা; সব মদিরার বড়- রন্ধ্রে রন্ধ্রে নেশা জাগায়- তীব্র উন্মাদনা। সে নেশায় মজে রাজার সুপুত্তুরেরা যুদ্ধে নেমেছিল; নিরব যুদ্ধ- দামামাহীন, আক্রমণহীন, হাতি নেই, ঘোড়া নেই,ঢাল নেই, বর্ম নেই - এমনকি তলোয়ার। পুরো বাড়ি জুড়ে শুধুই ষড়যন্ত্র, শুধুই চক্রান্ত, শুধুই কূটকৌশল। সর্বগ্রাসী মূকযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছিল সবাইকে (এ কি তবে অতৃপ্ত নারী অশরীরীর অভিশম্পাত!)। টিকেছিল একজন- যার ঔরসে আমার জন্ম। হয়তো আমার বাবা; হয়তো নয়-। বাবা শব্দটার অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আমি এতটাই জানি; কোন এক ফাল্গুনের চন্দ্ররাতে এক অতিকায় বজরায় হাজার মোমের সম্ভাষণে ঐ লোকেরই কোন এক রক্ষিতার পেট থেকে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম। সারেং-এর হাঁকডাক, বাঈজীর মূর্ছনা, তবলার ত্রিতাল, নদীর ছলাৎ-ছল এক নবজাতকের আগমন ধ্বনিতে নিমেষেই স্তব্ধ। কোন খেয়ালে রাজা মহাশয় (নামেমাত্র রাজা; সম্পত্তি ছাড়া কিছুই ছিল না তাঁর।) এক প্রসূতিকে বজরায় তুলেছিলেন; কে বলতে পারে! হয়তোবা চাঁদ-মদিরায় মাতাল রাজা প্রতি চন্দ্ররাতে অবিরাম গজল-খেয়ালের একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। এক নবজাতকের আগমনী উচ্চারণ তাঁকে কতটা পূর্ণতা দিয়েছিল- আমি ঠিক জানি না। জানার কথাও নয়। তবে, সেদিন রাজামশায় আনন্দ পেয়েছিলেন, উৎফুল্ল হয়েছিলেন, প্রচন্ড উদ্দীপণায় রাজ্যময় উৎসব ডেকেছিলেন। গ্রহ-নক্ষত্র বিচারে রাজ-জ্যোতিষী ঘোষণা দিয়েছিলেন; এ ছেলে সৌভাগ্যবান। এর কপালে ভাগ্যলিখন। একদিন রাজা হবে এ- রাজাদের রাজা। তৎক্ষণাৎ আমার রক্ষিতা মা সবশুদ্ধ একলাফে রাজরাণী। সেই মর্যাদার ভার সইতে না পেরে আ্মার মাসখানেকের মধ্যে মরেই গেল। পরে জেনেছিলাম, তাঁকে খুন করা হয়েছিল। এক রক্ষিতা রাজরাণী হবে; মুখ মেনে নিলেও মন যে মানেনা। (রাজতন্ত্র এক মোটরগাড়ি; ষড়যন্ত্র তার জ্বালানী।) তাদের দরকার ছিল ছেলেটা। আনন্দের আতিশয্যে এক অস্পৃশ্যকে অনেক উঁচুতে তুলেছিলেন রাজা। -এ তাঁর বদান্যতা। আর কত মহানুভবতা দেখাবেন তিঁনি! তাঁর সম্মানবোধ বলে তো কিছু একটা আছে (ওদের আর কিছু না থাক; সম্মানবোধ প্রচন্ড)।

জ্যোতিষীর কথা ফলেছিল। আমি একদিন সত্যি সত্যিই রাজা হয়েছিলাম- হৃদয় রাজ্যের রাজা; রাজাধিরাজ। না হয়ে উপায় ছিল না। একটি প্লাবন বদলে দিয়েছিল সবকিছু। আগের দিন সব- অলীক স্বপ্নকথা। বান ডেকেছিল নদী; আ্মার প্রেয়সী- রূপোলী বুকের কর্ণফুলি। বৃষ্টি ছাড়াই বান ডাকল সেবার। সে এক আজব বন্যা! এসেছিল দূর্নিবার; প্রচন্ড তেজে সবকিছু ডুুিবয়ে-ভাসিয়ে একাকার। কিছুদিন পর সে স্রোত শান্ত হয়ে গেল- আশ্চর্য রকমের শান্ত! নড়াচড়ার কোন লক্ষণই নেই তাতে। দিনে দিনে সে জলরাশি বাড়ে; বাড়তেই থাকে। ডুবল সবই; চাষের জমিগুলো, নীচু এলাকার ঘরবাড়ি, গোশালার গরু, আস্তাবলের ঘোড়া, এটা-সেটা- আরো কত কি! মাসখানেক পর পাহাড়ের মাথাগুলো শুধু জেগে রইল। রাজ-জ্যোতিষীর গণনা শুরু-
আভিশাপ লেগেছে- মা গঙ্গার অভিশাপ। রক্ত চায় নদী- কুমারী মেয়ের বুকের তাজা রক্ত। নদী-মাকে শান্ত করতে হবে মহারাজ। নাহলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
রাজা র্নিবিকার; থাকার মত কিছুই ছিল না আর। সবহারা মানুষের নিজস্ব কোন শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। তাঁর ঠাঁট-বাট, রাজকীয় হাঁকডাক, অবিরাম বজ্রনাদ -সবকিছু যেন ঐ সম্পত্তির সাথে সাথেই ডুবে গিয়েছিল। ইশারায় কুমারী বলিদান -কথাটা ভাবতে গিয়ে আজ তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। প্রাসাদ বারান্দায় নির্বোধ রাজা -নদীর বিশালতা মাপে; দিগন্তজোড়া রূপালি শামিয়ানা। কোথা থেকে কি হয়ে গেল! -তাঁর বোধে কুলোয় না।

আমি কিছুটা বুঝেছিলাম। -এ নদীর প্রেম। নদী আমাকে ভালবেসে ফেলেছিল। তাইতো, আর দূরে থাকতে পারল না। সবকিছু ভেঙেচুরে ছুটে এল আমার কাছাকাছি। এত কাছে, যেন আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস তাকে ছুঁয়ে যায়; আ্মার প্রতিটি কাব্যকথা -প্রতিটি উচ্চারণ তার বুকের মাঝখানটিতে ঝড় বইয়ে দেয়। -না এসে উপায় ছিল না ওর। সেই ছোটবেলা থেকে রাজ্যময় আমার অবাধ যাতায়াত।সোনাই সবসময় আমার সাথে ঘুরত; পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, সমতলে-অবতলে -সবখানে। আমাকে সেই কোলের বয়স থেকে একটু একটু করে বড় করে তুলেছিল লোকটা। সে আমাকে নদী চিনিয়েছিল; নদীর খুব কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। তখন কতইবা বয়স আমার; সাত কি আট। কিছু একটা ছিল তাতে -নদী আমাকে নেশা ধরিয়েছিল। সেই থেকে আমার প্রতিটি বিকাল বিষণ্ন নদীতীরে; প্রতিটি চন্দ্ররাতে চুপিসারে বজরায়। আর কত সহ্য করবে নদী! সবশেষে আসতেই হল তাকে-

ওসব আমার কাব্যময়তা; বাস্তবতার উল্টোপিঠ-। কিছুদিন পর খবর এল; এ পানি কোনদিনও নামবে না। সরকার নদীতে বাধ দিয়েছে। আটকে থাকা পানি যাবে কোথায়? -যেদিকে ফাঁকা; দে ছুট।
হঠাৎ করে!
জলবিদ্যুৎ নামে কি যেন বানাবে। ঐ জিনিস বানাতে গেলে এমনটাই নাকি করতে হয়।
কি দরকার ছিল এসবের? আমাদের ডুবিয়ে দিয়ে-
বলেন কি মহারাজ! আমি দেখেছি; ঐ জিনিসে তেল ছাড়া প্রদীপ জ্বলে। পাখা হাতে নাড়তে হয় না; আপনাই ঘুরে -আর সে কি বাতাস! -সুখবর হল; সরকার আপনাকে ক্ষতিপূরণ দিবে।
আমার রাজ্যের-
ওসবে ওরা বিশ্বাসী নয়। বড়জোর দু-চারটা গো-শালা, শখানেক গৃহপালিত আর কয়েকশ বিঘা চাষের জমি -তাও যদি প্রমাণ থাকে।
প্রমাণ!
শুভঙ্করের ফাঁকি যাকে বলে। লাভ নেই মহারাজ। ঐ আশায় বসে বসে শেষে বাড়িটাই না ডুবে। তারচেয়ে, এখনো যা আছে, তা নিয়ে ওপারে পাড়ি জমান। উপায় নেই আর।

যত তাড়াতাড়ি পানি এসেছিল, বাড়ি খালি হতে সময় লাগল তার চেয়েও কম। রাজা গেল, রাণী গেল, চাকর-চাকরাণী, দাসী-বাঁদী, নায়েব-গোমস্তা, আয়া-দারোয়ান, ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চা, স্বর্ণমুদ্রা, অলংকার, বাসন-কোসন, আসবাবপত্র, তিনখানা বিশাল আকৃতির বজরা- বাদ পড়লনা কিছুই। বাদ পড়লাম আমি- নিজের ইচ্ছাতেই। রাজা অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল; আমি অনড়। যে নদী সব ছেড়ে আমার কাছে ছুটে এসেছে, তাকে ছেড়ে যাওয়ার মত স্বার্থপর আমি তখনো হয়ে উঠিনি। আর রইল সোনাই (ওর ভালবাসা আমি)।

সেই থেকে আমি রাজা। এই নদীচুম্বিত পাহাড়ী জনপদে দৈত্যাকার ফাঁকা রাজবাড়িতে আমি রাজাধিরাজ। এখানে আমি কবি; দিনভর মহুয়ার নেশায় মজে আমি গর্জে উঠি। পাহাড়ে পাহাড়ে সাড়া জাগে- ধ্বনি-প্রতিধ্বনির অপূর্ব মাতম; উৎসাহে ঝলকে উঠে নদীর বুক। প্রতি চন্দ্ররাতে জলসা বসে এখানে- এই রংমহলে। সেখানে অতৃপ্ত নারীআত্মার তীব্র হাহাকার- বুকের অনেক গহীনে কোন এক অন্ধ-প্রদেশে সূক্ষ্ম ব্যথার সুর তুলে তা। একনিষ্ঠভাবে আমি সেই সুরসাগরে ভাসি। মহুয়ার নেশায় নেশায় আমি নিশিদিন ভেসে ভেসে যাই। -ও জিনিসের অভাব হয়না এখানে। সপ্তাহ অন্তর দুটো পাহাড়ি যুবক ঘড়াভর্তি নিয়ে আসে তা। দু-দশ টাকাতেই খুশি ওরা। এ এক অন্য অনুভূতি; বাস্তবতাবোধের শেষ অংশটুকুও এক আশ্চর্য দক্ষতায় নিংড়ে নেয় তা- থাকে শুধু কল্পনা, থাকে শুধু কাব্যময়তা। এ কাব্যময়তা আমার আবেগে,আমার অনুভূতিতে, আমার দোদুল্যমানতায়। কলম ধরা হয়নি কখনো; সব কবিতা জমা হয়ে আছে বুকের উষ্ণতায় ভালবাসার অক্ষরে। আমি নদীকে ভালবাসি- তার শান্ত জলরাশি; ভালবাসি চন্দ্ররাত, মহুয়া আর আমার কাঠের বাড়ি। মরুক সরকার; এ বাড়ি আমি ছাড়ছি না।

শেষ পর্যন্ত বাড়ি আমাকে ছাড়তেই হল। আমার ভালবাসাই কাল হয়ে উঠেছিল। তিনদিন না খেয়ে ছিলাম আমরা। ঘরে ফুঁটো পয়সাটিও নেই, রান্নার চাল, প্রদীপের তেল- এমনকি মহুয়া। রাজবাড়ির তৈজসপত্র বিক্রি করে ভালই চলছিল এতদিন। অসাধারণ সব - নকশাকাটা কাঠের বাক্স, সোনা মোড়ানো কলমের পালক, চীনামাটির ফুলদানি, শ্বেতপাথরের নারীমূর্তি-। শেষ পর্যন্ত ঘরের কাঠ খুলে বিক্রি করা বাকি ছিল। সোনাই নির্বিকার; অনেক তো করল বুড়ো লোকটা- আর কত? আর, কিইবা করার আছে ওর? - কোণায় জড়োসড়ো- একটানা চোখের জল ঝড়ায় সে। শেষে ভেঙে পড়া কন্ঠে বলে
বাড়িটা সরকারকে দিয়ে দেন ছোটবাবু।
আর দু-একটা দিন। আমরা মরে গেলে ওরা এমনিতেই পেয়ে যাবে।
নিরুত্তর সে; কান্নাটা আরো বাড়ে। সে ভালভাবেই বুঝে গেছে মরে গেলেও এ বাড়ি আমি ছাড়ব না। ওর কষ্টটা আমার জন্য; ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে যাকে বড় করে তুলেছে- তার ধ্বংসটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা লোকটার অবচেতন মন। আমি তখনো নেশার ঘোরে- দূরে কোথাও আশার জ্বলজ্বলে আলো । -কোথায়? -কোন তেপান্তরে?

এবার আমার মনে পড়ে গেল- কারা যেন আসতে চেয়েছিল এখানে। মাসে দু-চারদিন থাকবে। তার বদলে-
ওদের আসতে দিলেই তো হয়।
ওরা লোক ভাল নয়, ছোটবাবু।
পৃথিবীতে খুব বেশি ভাল মানুষ নেই রে সোনাই।
ওরা অতিমাত্রায় খারাপ। মানুষ মারে ওরা। অকারণে-
ছোটবেলা থেকে মানুষকে মরতে দেখেছি আমি; শুধুই মরতে দেখেছি। তখন মরত সুন্দরীরা। আমার মা মরেছিল অকারণে। নদীর প্লাবনে মরেছিল আরো কত জন। নাহয় সেই তালিকায় আরো দু-একজন যোগ হল।
সে নিশ্চুপ; অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আরেকটি দিন অনাহারে। আরো একটি। এইবার আমার সংগ্রামী মনোবল পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এক প্রকান্ড দৈত্যের কাছে পরাজিত আমি। -সকল অপশক্তির শ্রেষ্ঠ -পেটের ক্ষিধে। আমার ভগ্ন কন্ঠ বলে উঠে
বাড়িটা সরকারকে দিয়ে দাও সোনাই।
সে চমকে উঠে তাকায় একবার। একসময় বেরিয়ে যায়- এক ভবিষ্যতের দিকে; হয়তো অনিশ্চিত, হয়তো নিশ্চিত- আমি ভাবতে চায় না।

সোনাই ফিরল বিকেলে। সাথে দুজন লোক- অনেক খাবার-দাবার।
ওরা কি আজকেই বাড়ির দখল নিতে এল।
না, বাবু। এরা অন্যজন।
কি আনন্দ! বাড়ি বিক্রি হয়নি! সোনাই সেই লোকগুলোকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু, এরা তো নিরীহ; দেখে মনেই হয় না এদের দ্বারা খুন করা সম্ভব। সোনাই ভুল শুনেছিল। হয়তো এরা আমার মতই নির্জনতাবিলাসী। -আবার সবকিছু ফিরে ফিরে আসবে; সেই চন্দ্ররাত, সেই মহুয়া, আর কবিতা। আনন্দের ফেনায় ফেনিল আমি খুশিতে উথলে উঠি।

আমার ধারণাই ঠিক ছিল। ওদের একজন ইসমাইল মিয়া- সারাদিন ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে, নিজে রান্না করে খায়; কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। অন্যজন আব্বাস, মাঝেমধ্যে থলেভর্তি কি সব নিয়ে আসে- চলেও যায়। থাকুক ওরা ওদের মত, ওদের কাব্যময়তায়।

সেই বসন্তে সাড়া পড়ে যায়। এখানে চন্দ্রোৎসব হবে। ভরা পূর্নিমাতে বজরায় বজরায় ভরে উঠবে এই জলরাশি- অগণিত লোক সেখানে। কি আশ্চর্য! আমার কাব্যধারা সবাতে ছড়াল কিভাবে? -আমি বুঝিনা।

উৎসবের বেশ আগে থেকে জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। লোক বাড়ে আমার বাড়িতে- একই পোষাকের একই রকম লোক। উৎসবের সন্ধ্যায় বাড়িটা যেন কারখানা। একগাদা পাউডার, একরাশ তরল, এটা-সেটা; কিছু একটা করে তারা। মাঝরাতে দলবেঁধে চলে যায় কয়েজন। আমি তখন খোলা বারান্দায়- আরো কত-শত লোকের মতন চন্দ্রবিলাসী একজন। আজ নদী পরিপূর্ণা; বুক ভরে আছে বজরায়। পূর্বপুরুষের বজরাগুলোর মত; আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি- দেখি- দেখতেই থাকি। আকষ্মাৎ দৃশ্যপট পাল্টে যায়- আমার চোখের সামনে। প্রচন্ড শব্দে আগুন জ্বলে উঠে কয়েকটি বজরায়। তব্রি আর্তনাদ সেখানে; নরক বুঝি পৃথিবীতে নেমে এল। -এর কথাই বলেছিল সোনাই; তখন বুঝিনি আমি। যখন বুঝলাম, ততক্ষণে তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছিল।

ক্ষণপরে ইসমাইল দৌড়ে এল-
একটা ঘাপলা পেকেছে, জনাব। পুলিশ সব জেনে ফেলেছে। এখন হামলা হবে। গুল্লি চালাবে তারা।
তাহলে!
আপনার নেমক খেয়েছি অনেকদিন। ফেলে গেলে হারামি হয়ে যায়। যা পারেন নিয়ে নেন। পালাতে হবে এখন।
এই প্রথম আমি উপলদ্ধি করি, কতটা অসহায় আমি। আমার সকল তেজ, সকল বাক্যবাণ ঠাট্টার মত শব্দ করে যেন। এক বিশাল নৌকায় চড়ে কতগুলো মানুষরূপি দানবের সাথে চোরের মত পালাতে থাকি আমি। পিছনে পুলিশের অন্ধ-আস্ফালন। এই পাহাড়ী জনপদে বিশাল একটা বাড়ি ছিল আমার; বেশ লোভনীয়। হয়তো সেটাই আমার অপরাধ; নয়তো এ নারী আত্মার অভিশাপ। -যে অভিশাপ কুড়িয়েছিল আমার পূর্বপুরুষের দল; তার মাশুল দিতে হল আমাকে আজ -কড়ায় গন্ডায়।
ভালই হয়েছে। ও বাড়িতে মিউজিয়াম হবে; লোকেরা আসবে- আরো কি সব যেন। হয়তো আমিও একদিন আসব, হয়তো না। বাদ থাক সে কাব্যকথা।

মাথা উঁচিয়ে আমি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি। সেখানে অবাক বিস্ময়; কয়েক ফোঁটা চোখের জল- একটু বিষণ্নতা। সে বিষণœতায় ডুবতে ডুবতে আমি একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকি- কোন এক অসম্ভবের পথে।


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

বাহ্ ! এত ভালো লেখা চোখ এড়ালো কি করে? দারুন লিখেছেন আপনি।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।