স্বপ্নজনের মা

প্রত্যয় এর ছবি
লিখেছেন প্রত্যয় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৭/০৮/২০০৮ - ৪:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক বৃষ্টিস্নাত বিকালে আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করে বসলাম। কি জঘণ্য ছিল দিনটা! একটানা একঘেঁয়ে বৃষ্টির মধ্যে আত্মগ্লানিতে ম্রিয়মাণ আমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে রাজপথের ধুলিকণায় পর্যবসিত। বেঁচে থাকার ইচ্ছাপ্রদীপ নিমেষেই অন্ধ হয়ে গেল। আমার সকল অনুভব, অনুভূতি; যা কিছু আনন্দ, যতটুকু আশা- সব পঁচে গলে অবশিষ্ট ছিলএকটি ঘৃণার দলা- আমার বাবা এবং তাঁর পূজিত ঈশ্বরের প্রতি তীব্রতম ঘৃণা। আত্মগ্লানিতে ম্রিয়মান আমি মেঘ-বৃষ্টি ছাপিয়ে গর্জে উঠেছিলাম, ঘৃণার গোলা ছুড়েছিলাম, ব্রক্ষ্মান্ডের শ্রেষ্ঠতম শক্তিধর ঈশ্বরের পূজারি আমার বাবার দিকে একের পর এক ছুটে যাচ্ছিল ধিক্কারের ফণা তোলা কালনাগ। বাবার বাড়ি, সাজানো ড্রয়িংরুম, ঝুলন্ত ঝাড়বাতি, বুয়া-মালী-দারোয়ান; স্তম্ভিত ম্যানেজার; আমার শোকে পাথর বোন- তাদের নিষ্পলক আঁখিপটে লাঞ্ছিত ঈশ্বর। তখন আমি দূর্নিবার; ঝড়কবলিত জ্বলন্ত মশাল- দমকে দমকে উস্কে ওঠা আগুনের গোলা। আমার দেখার সময় ছিল না কাকে জ্বালাচ্ছি; জানার সুযোগ ছিল না কিভাবে জ্বালাচ্ছি; বুঝে ওঠার পর্যাপ্ততা ছিল না- কেন? একটি কথা, একটি কারণ, একটি লাইনই আমার জন্য যথেষ্ট- দৈত্যাকার বাড়ির খাঁ খাঁ ড্রয়িংরুমে নিষ্ঠুর শূন্যতার মাঝে আমার মায়ের হৃদযন্ত্রটা একঘেঁয়েভাবে বিকল হয়েছিল। পাঁচ-ছয় আয়া দারোয়ানের বাড়িতে- কি আশ্চর্য! তার শেষ শব্দগুলো মেঘগর্জনে বন্দী, শেষ নিঃশ্বাস ঘরময় কেঁদে ফিরেছে; আর সজল চোখের ঝাপসা দৃষ্টি রুমের কোণায়, ফোনের কাছে, ঝাড়বাতির নিচে, টেলিভিশন, সাউন্ড সিস্টেম, এটা-সেটার দঙ্গলে একটি মানুষের জন্য হাহাকার করে মরছিল- একটিমাত্র রক্তমাংসের মানুষ। যখন তাঁর মাথা ঘুরে উঠেছিল (লাল ভেলভেটের সোফা আর টিভিপর্দার সংবাদ পাঠিকাও হয়তো ঘুরছিল) -মা আমার লাল কার্পেটে শয্যাশায়ী। বাবুর্চির রান্নাঘর, ঘুমকাতুরে বুড়ো মালী আর বুয়া-ড্রাইভার বেপাত্তা। ঝিরঝির বৃষ্টি হয়তো তাদের ভরা নদীতে বান ডেকেছিল। হাতের পিঞ্জরে বন্দী কপোত- নরোম তাদের শুভ্র শরীর কি এক দূর্নিবার ভয়ে কাঁপছিল। কাঁপছিল সব- ঠোঁটের কোণা, চোখের পাতা-। বৃষ্টির মাদকতায় নিচতলার কোন সারভেন্ট রুমে আধো-আঁধারিতে একখানা লোমশ বুকের উত্তপ্ততায় তার রাধা হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এমনটি হরহামেশাই ঘটে- জন্মসূচনা, এবরশন; কে তার খোঁজ রাখে। বাবা সী-গাল; নদী-নালা তার চোখে ধরে না। আমি পরবাসী- বই খুঁটানো ছাড়পোকা। বোনের ফ্রেন্ডসার্কেল। আর, মা- নিঃসঙ্গ গৃহচারী; নিজ ভুবনে নিজেই বন্দী। তখনো পর্যন্ত আমার মা একই অবস্থার আর দশজনের মতো হয়ে ওঠেনি। হয়ে যেত- যদি জীবনের পর্যাপ্ততা থাকত। আমার ইন্টেলেকচুয়াল বাবা তাঁর ভালোমানুষী কাজ ছেড়ে আকষ্মাৎ এক দূর্নিবার ঈশ্বরের উপাসক আর রাতারাতি মিডল্ ক্লাস থেকে সবসুদ্ধ একধাপ উপরে। টেলেন্ট ছিল লোকটা- সুপারটেলেন্ট।কি সুন্দরভাবেই না সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলÑ আমাকেও। বুঝতে যদিও দেরি হয়েছে; আমি অভিভূত। লেখাপড়ার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলাম পনেরোতে। তখন থেকেই বাবার ফোনে মায়ের কুশলাদি।
তোর মাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। ভালো আছে। খালি তোর কথা বলে।
বুকের ব্যাথাটা বেড়েছে। ভাবিস না। ডাক্তার দেখে গেছে।
বাড়ি আসবি কখন? তোর মা অস্থির।
কিন্তু আমার ভাবার সময় কোথায় এত কাজের ভিড়ে? লোকটা জেনে গিয়েছিল আমার দূর্বলতা; ব্যবসায়ীদের এটাই দরকার- অন্যের সাইকোলজি পড়ার দক্ষতা। ‘মা’ শব্দটা দিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করত বাবা। -দূর্বলতাটা আমার ছেলেবেলা থেকেই। প্রবল হয়েছিল বিচ্ছিন্ন হয়ে। আর, চূড়ান্তরূপ- অনন্যের কারণে।

সেই কবে হোস্টেলে পা রেখেছিল- মুখভার, আলুথালু, অ্যাবনরমাল ছেলেটা। অকথ্য কথাবাণে অনড়, সামাজিকতায় জগদ্দল পাথর, ঠাট্টাঙ্গনে অপাচ্য, রুমের অকারণ হতাশা, ইযারমেটদের চক্ষুশুল অনন্য- ধরতনা কিছুতেই। সেও হয়তো বুঝত। উত্তরণের চেষ্টা-চরিত্রও কিছুটা ছিল। তারপর- এক সর্বনাশা বিকালে ধরে গেল আমাতে। ঘটনাটা এমন; হোস্টেলে উঠেছিলাম আমরা ত্রিশজনের মতো- কমবেশিও হতে পারে। প্রথম সপ্তাহগুলো নতুন ক্লাস, নবীনবরণ, দল গঠন, পরিচিতি-সভা, হেন-তেন; আরো কিছু হাউকাউ- আমরা স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম। বিকালের ক্রিকেটটা জমে উঠলে পরে- ্হঠাৎ আবিষ্কার ‘অনন্য চিড়িয়া’।
এই শুভ, তোর রুমমেট কোথায়?
ও তো রুম থেকে বের হয় না। ক্লাসটা করে- বাকি সময় রুম আর বারান্দায়-।
আঁতেল নাকি! লেখাপড়া করে?
না, বইপত্র তো ধরতে দেখিনা।
ভাব! -বুঝছিস্; এটা একধরনের ভাব। তোরা রুমে থাকলে ভাব দেখায়- গো-বেচারা। যখন কেউ থাকে না; দেখে নিস্- ঘাড় গুঁজে বই মুখস্ত করছে।
আরে না।এখনো তো বইই কিনেনি।
তাহলে করেটা কি?
গাঞ্জা টানে না তো!]
না কি শালায় ডাইলখোর!
কি জানি? সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকে; ঘুমায়- কখনো আকাশ দেখে-।
খেলতে আসে না কেন?
ওর নাকি ভালো লাগে না।
মামদোবাজি! দাঁড়া, ওর আঁতলামো ছুটাচ্ছি-
চেষ্টাচরিত্র ভালোই হয়েছিল। ডাইনিং, ক্যান্টিন, কমনরুম, বারান্দা- অভিযান সবখানে।
জগতের সবচেয়ে বড় নির্বুদ্ধিতা হল খেলাধুলায় সময় নষ্ট করা; তোমার কি মত আনন্য-।
রাইট ইউ আর। আরে ভাই, খেলাধুলায় কি আছে! তারচেয়ে আকাশ দেখ- আকাশ।
কি দেখব ভ্রাতা? আমার প্রেমিকাকে!
ছিঃ! অনন্যকে এত ক্ষেপিয়ো না তো। ও কিন্তু রেগে গিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিবে।
আচ্ছা! ও তাহলে কোন একসময় কথা বলত!

উৎসাহে ভাটা পড়ে ক্রমশ বালুচর- এমন অপাচ্য নিরামিষ আগে কেউ দেখেনি। উত্তাপে লোহাও কিছুটা গলে- এ একেবারে অন্য ধাতুর তৈরি। আমি তাও খোঁচা-টোঁচা দিতাম- এমনিতেই; অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। চলে যেত এভাবেই- সইল না। কোন এক বিকালে এক চরম সত্যি আমাকে আঘাত হানল। আমি অনুভূতি হারিয়েছিলাম। স্তম্ভিত, স্থবির, বাকরুদ্ধ আমি অনন্যের অনেক বেশি ম্রিয়মাণ। আমার মায়ের প্রতি বাবার ভালবাসা, মায়ের কুশলাদি, মাকে নিয়ে বাবার বিগলিত কথাবার্তা- সব ভাঁওতা, ছেলেভুলানো চাল। বাবা মনে-প্রাণে ঈশ্বরের পূজারী; ঈশ্বর বাদে আর কারো মুখদর্শনের সময় তার হয়ে উঠে না। হার্ট ফেইলিউরে আমার মা অন্যসত্তা; বাবার পাত্তা নেই। হতচ্ছারা ফাইন্যাল পরীক্ষাটা আমাকেও দিল আটকে (পরীক্ষার দাম হয়তো মানুষের দামের চেয়ে কিঞ্চিত বেশি)। তখন চিরগর্দভ অনন্যটা এগিয়ে এসেছিল, আমার কান্নার বাধে শাবল চালিয়েছিল, অসহায় আমি ওকে জড়িয়ে কেঁদেওছিলাম- অনেক্ষণ। সেই থেকে শুরু। ছেলেটা আমাকে নেশায় ফেলেছিল। আমার ভিতরে মায়ের জন্য ভালবাসার ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ ক্রমশ অগ্নিকুন্ড- তাতেও ওর ক্লান্তি নেই। সে আমাকে মায়ের গল্প শোনাত; -ছেলেবেলায় ফুল কুড়াতাম- শিউলি ফুল। প্রতিদিন সকালে, যখন ঝড়া ফুলে সবুজ ঘাসের গালিচা সাদা হয়ে যেত- আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে কচি হাতের আঁজলা ভরে ফুল নিয়ে আসতাম সামনের বারান্দায়। অনেক অনেক ফুল- হাতে ধরে উঠত না; পড়ে পড়ে সাদা রেখা গড়ত। এক পা কওে আমি এগিয়ে যেতাম; পিছনে পড়ে থাকত একটি করে ফুল- অনাদরে, অবহেলায়; একসময় সবুজ ঘাসে মিশে যেত। প্রতিদিন, প্রতিবার-। ওদিকে অবশিষ্ট ফুলগুলো বারান্দায় জড়ো করে আমি ছুটে যেতাম মায়ের কাছে।
মা। সুই-সুতো দাও। মালা গাঁথব।
অনেক লম্বা মালা গাঁথতাম তখন। সবশেষে একপ্রান্ত নিজের গলায় পরে বাকিটা পরিয়ে দিতাম মায়ের গলে। মা গভীর আবেগে আমাকে কোলে নিয়ে চুমু খেত- ঠিক তিনটি; কপালে, তারপর দু-গালে।
এক আশ্চর্য স্বপ্নে বিভোর হত সে। চোখের কোণে জল; জল জমত আমার চোখে- সেই সময়টাতে প্রতিদিন বিকালে আমরা হাঁটতে বেরুতাম। একটু দূরে কনস্ট্রাকশন ওয়ার্ক; একটা দশতলা বিল্ডিং হচ্ছিল। আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতাম- একেবারে চূড়োয়। তখন পানি ঢালা হত- পায়ের পাতা ভেজানো ঠান্ডা তিরতিরে পানি। মায়াময় আবীর আলোয় অন্যরকম সব- চারপাশের গাছপালা, লোকজন, দালানগুলো, ফুটপাথ, রাজপথ- আমি কে! কোথায় আমি! কেন? -মায়া; সব মায়া- সব অলীক, অবাস্তব। আমি গাঙচিল এক; বহু উঁচুতে উড়তে থাকা সোনালী ঈগল। সেখানে সূর্যের শেষকৃত্য- মেঘেদের শোভাযাত্রা। লাল মেঘ, নীল মেঘ, সাদা বা গোলাপী- সঙ্গী সাথী পলকা হাওয়া। অনন্য খোঁচা দিত।
পাশের ছাদে দেখ।
হুঁ। সুন্দর।
দেখেছিস, মেয়েটির ফর্সা গালে লালের খেলা। ঠিক যেন ভেনাস; মুখ থেকে আভা বের হচ্ছে-।
ডায়লগটা ভালোই। তবে- হারামজাদা; তোর চোখ তো ঠিকই ওব মুখ থেকে চার ইঞ্চি নিচে।
অনন্যের অন্য ভাব; স্বপ্নজন সে- চোখে ভাবালুতা, মখে ‘মা’। আমাদের বাড়ির সামনে বকুল গাছ ছিল। গাছ জুড়ে বকের বাসাÑ সাদা সাদা বক; প্রতি ভোরে পাখিগুলো গাছের ডালে দাঁড়িয়ে গা ঝাঁকাত। তারপর তীরের মতো ছুটে যেত দূর আকাশে; ডানায় রোদের স্পর্শ বুলিয়ে। আমি দেখতাম আর হিসেব রাখতাম- কয়টা পাখি এলো, কয়টা গেলো-।
এক বর্ষায়- সেদিন তুমুল বৃষ্টি, দমকা হাওয়া; একটি বকের বাচ্চা নিচে পড়ে গেল। ডানা গজায়নি; জমে থাকা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমার এত খারাপ লাগল- দরজার দিকে ছুট লাগালাম। হাত টেনে ধরল মা।
কোথায় যাচ্ছ?
মা, বকের বাচ্চাটা পানিতে পড়ে গেছে।
তুমি এখন বাইওে যাবে না।
বাচ্চাটা মরে যাবে, মা-
আমি বলছি, তুমি বৃষ্টিতে ভিজবে না। কচি শরীর; শেষে নিউমোনিয়া না বাধিয়ে বস- তখন কে তোমাকে দেখবে? আমি স্কুল সামলাব, না তোমাকে?
একটু ভিজলে কিচ্ছু হবে না। যেতে দাও মা-
তুমি বাইরে যাবে না। আমি দেখছি, কি করা যায়-
জল ছপছপ- মা বাচ্চাটাকে নিয়ে এলো। আমি গা মুছালাম, গরম সেঁক দিলাম; প্রার্থনা, চোখের জল, উৎকন্ঠা, উৎসাহ- সব জলে ভাসিয়ে পাখিটি মরে গেল। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। মায়ের উপর রেগেছিলাম বেশ; ঐ মহিলাই নষ্টের গোড়া- আমাকে যেতে দিলে বাচ্চাটা হয়তো এভাবে মরত না। ওর সঙ্গে কোন কথা নয়- মুখ ভার বিছানায়। দুপুর গেল; মা কিছু বলল না। বিকাল গেল; মায়ের মুচকি হাসি। রাতে মা কাছে এলো-
ভাত খাবি, আয়-
কিছু বললাম না।
রাগ করেছিস?
এবারও নিশ্চুপ।
আমার সঙ্গে কথা বলবি না?
আর সম্ভব হলো না। মায়ের পিঠে এলোপাথাড়ি কয়েকটি ঘুসি দিয়ে চিৎকার ছাড়লাম
তুমি কেন আমাকে যেতে দিলে না! তোমার জন্যই পাখিটি মরে গেল। তোমার জন্য-
মা হতবাক; তাঁর চোখে জল- গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল
তুই খুব ভাল ছেলে রে অনন্য। তুই অনন্যসাধারণ ছেলে। আমার গর্ব হচ্ছে তোকে পেয়ে।
বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলত; জল আসত আমার চোখে। কি আশ্চর্য! এখনো আমার বিশ্বাস হয়না- এক সমবয়সীর জীবনকাহিনীতে আমার হৃদয় ভিজে পাউরুটির টুকরো। সে আমার সর্বনাশ ডাকছিল; আমার ভিতরটা এমন করেছিল যাতে আমি মায়ের জন্য মাথা কুটতে পারি, বাবার বিরুদ্ধে চিৎকার ছাড়তে পারি আর ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বর’-সে ঈশ্বরকে অস্বীকার করতে পারি। আজ আমার মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার মন খারাপ হয়েছিল। এক অহেতুক ভাবনা আমাকে তাড়াচ্ছিল- এক আবেগ, এক অনুভূতি; সে হাওয়া আমাকে উড়িয়ে নিল অনন্যের বাড়িতে। ছোট্ট মফস্বলে ছবির মত বাড়িটা। দোতলার বারান্দায় মুক্ত সবুজে তখনো আমি বুঝিনি এই কাঠের বারান্দার পরতে পরতে কোন ষড়যন্ত্র। অনন্যের প্রৌঢ় বাবা; দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে হাহাকার। হাতে একটি ডায়েরি- সব সর্বনাশের মূল।
দোষটা আমারই।
ডায়েরিটা তুলে ধরে বললেন,
এটা অনন্যের হাতে পড়েছিল।
তারপর এগিয়ে দিলেন আমার দিকে-
নাও। তোমার সব জিজ্ঞাসা এখানেই শান্তি পাবে।

এক চূড়ান্ত রকমের সত্যি; আমার হাত কতগুলো পাতা উল্টে চলল, চোখ অক্ষরের গলি-ঘুপচিতে পথহারা আর প্রশ্নের মোমের দেওয়ালটা একটু একটু করে গলতে শুরু করল। আমার সব প্রশ্ন- অনন্যের মা, মাতৃপ্রেম; ওর আবেগ অনুভূতি, অ্যাবনরমালিটি- সব রহস্য কপোত এখানে মুক্ত বিহঙ্গ। ওর বাবা-মা; যাঁরা ওকে বড় করে তুলছিল- পাঁচ বছরের সংসারে তাদেও কোলে যখন সন্তান আসেনি, এক স্বামী পরিত্যাক্ত মহিলারকাছ থেকে তাঁরা একটি বাচ্চা কিনেন। সবজির দরে কেনা সেই মানুষের বাচ্চাটি অনন্য। সে জেনে গিয়েছিল ব্যাপারটা। তখন থেকেই ‘মা পাগলা’। সেই পাগলটার জন্য আমার একটু করুণা হল মাত্র- এর বেশি কিছু না। আমার কারো উপর কোন রাগ হল না, ঘৃণা হল না- কিচ্ছু না। মহিলাটি বুদ্ধিমান; কি লাভ হত না খেতে পেয়ে বাচ্চাসহ মরে গেলে! তার চেয়ে- এই ভাল।

এক বার্স্টাডের পাগলামো আমাকে ভিতরে ভিতরে দূর্বল করে তুলছিল। আজ আমি স্বাধীন; জীবনের অর্থ পরিষ্কার আয়না- আমার ইন্টেলেকচুয়াল বাবার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে; ভাবছি ক্ষমা চাইব কি না? আসলে এই মুহূর্তে আমার বেশ কিছু টাকা দরকার। পয়সা বেশি হলে মানুষ নাকি কুকুরছানা কিনে; ঐ জিনিসের আমার অভাব নেই। আমি মানবছানা কিনব- অনেকগুলো; অনন্যকে ওরা কি দামে কিনেছিল জানা নেই (যদিও খোলা বাজারে মানবছানার দাম কুকুরছানার চেয়ে অনেক কম)- তার চেয়েও বেশি দাম আমি দিব। কোন ভুল নয়- ছোটবেলা থেকে ওদের অনুভূতির স্নায়ুগুলো এক এক করে উপড়ে আমি ওদের এমনভাবে বড় করে তুলব যাতে ওরা আমার বাবার মত ঈশ্বরের একনিষ্ঠ সেবক হয়ে উঠে। মানি- দ্যা ওয়ান এন্ড ওনলি গড অব দ্যা ইউনিভার্স; আমি সেই ঈশ্বরের পদপ্রান্তে মুখ বাড়িয়ে দিই।


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

দারুন লিখেছেন ভাই! যদিও বেশ বড় গল্প তারপরও এক বসাতে পড়ে শেষ করলাম। আরো লিখেন, লিখতে থাকেন।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

রাফি এর ছবি

এইসব বাদ।
নতুন লেখা চাই...। শীগগির লিখ...

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

রানা মেহের এর ছবি

[Somehow my machine is not supporting Bangla]

Good writing Prottoy.

Would you mind if I suggest something?
Some word and sentences you have used
have made the the writing bit flat.
Such as
মা হতবাক; তাঁর চোখে জল- গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল
তুই খুব ভাল ছেলে রে অনন্য। তুই অনন্যসাধারণ ছেলে। আমার গর্ব হচ্ছে তোকে পেয়ে।

Or
ব্রক্ষ্মান্ডের শ্রেষ্ঠতম শক্তিধর ঈশ্বরের পূজারি আমার বাবার দিকে একের পর এক ছুটে যাচ্ছিল ধিক্কারের ফণা তোলা কালনাগ।

I understand you tried to catch a moment of deep emotions but those words are just pale for hundred years.

Carry on Prootoy.
Hope to see a good writer in our home.

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

প্রত্যয় এর ছবি

Thanks a lot..............
Yeah....I know what u r talking about. But I drive my stories with some deep feelings. N feelings have no time restriction. I think it may comes in a style of a thousand years old form, as a barbarian.......as well as in the form which we haven't face yet.
Thanks 4 ur comment.....

----------------------------
জীবনের সব আশা য়েখানে শেষ হবে..........
সেই শেষবিন্দুতে আমি আসব।

জীবনের সব আশা য়েখানে শেষ হবে..........
সেই শেষবিন্দুতে আমি আসব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।