বড় হয়ে যাচ্ছি ,বড় হয়ে গেলাম এখন

রাসেল এর ছবি
লিখেছেন রাসেল (তারিখ: শনি, ১৫/০৩/২০০৮ - ৫:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শুক্রবারের ছুটি ঘোষণার সাথে সাথে আমাদের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্ত্ন ঘটে গেলো- কোনো এক সময়ে যখন শনি রবি বন্ধ ছিলো তখন সকাল থেকেই উৎসবের আমেজ থাকতো পাড়ায়- আমরা তখনও মায়ের আঁচল ছেড়ে বের হতে পারি নি- আমার নিজস্ব জগত ছিলো সদর দরজা থেকে আমতলার উঠান- সেখানেই একটা বল নিয়ে বসে থাকি- দেয়ালে আঁকিবুকি কাঠকয়লায়- আর তখন আকাশে তাকাবার অবসর ছিলো অনেক- ঐ মেঘটা মেঘ না ঠিক একটা উট- তার পাশে উড়ে যাচ্ছে পাখি- পাখির ওড়াটাও অনায়াস- অনেক উপরে উড়ে যাচ্ছে চিল- ডানা নাড়ায় না বললেই চলে-

চিল নামছে- কাকের দল ধাওয়া করছে চিলকে- অথচ সেইসব চিলের ঘরদোর কোথায় জানা ছিলো না- আমার কাছে এখনও তারা সেই সুদুর আকাশের বাসিন্দা। চিলের ডাক তেমন মনোহর না- তীক্ষ্ণ ভীষণ- তবে তার ডানা ঝাপটানো দেখা যেতো যখন ১০০ কাক এক সাথে চিলের পিছে পিছে উড়ছে-

সামনে ডোবা আর ডোবার উপরে ঢোলকলমী গাছ- তার পাশে ধুতুরা আর কাঁটা গাছ- সেসব গাছের নাম জানা হবে না- স্থল পদ্মের গাছ দেখে তাকিয়ে থাকি- তুলা গাছ দেখে ভাবি এই ছোট ছোট গাছ থেকে কিভাবে কাপড় বানায়- আর বাতাসে শিমুল তুলো উড়তে থাকে- বাসার পাশের বেল গাছের পাতা ঝড়ে যায়- অনেক রকম উলোট-পালোট ঘটতেই থাকতো-

পাশের বাসার মামারা সাদা জার্সি নিয়ে কাঠের বলে ক্রিকেট খেলছে- আর ডোবার সামনেই জয়নুন চাচার ঘরে সবাই বসে কঙ্গো বাজিয়ে গান গাচ্ছে- তাহের মামার অদ্ভুত ক্ষমতা- যেকোনো গানের সুর শীস দিয়ে তুলে দিতে পারে- আর আমাদের সামনেই গড়ে উঠলো নবরুপীর পাকা দালান-

সেখানেই সারা রাত ওরে সালেকা ওরে মালেকা গাইছে সালাম মামা- আমাদের নিষিদ্ধ জগতের হাতছানি- সেখানে সন্ধ্যার আগে একটু উঁকি দিয়ে চলে আসা- আর শনি বারের প্রতীক্ষায় থাকা- সকালে স্টারট্রেক- ভ্রু বাঁকা মানুষের অদ্ভুত জগত-
আমার বয়েস বাড়ছে- আমার স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় পড়া সবকটা দোকানের মানুষ দেখে দেখে যাই- সেই ৭টায় স্কুল শুরু- ঘুম থেকে উঠতে হবে ৬টায়- অবশ্য বাসার নিয়ম মেনেই আমাদের দিন শুরু হয় ভোরের আলো ফুটবার পরে-

আমার স্কুলের বরাদ্দ টিফিনের পয়সা পকেটে নিয়েই স্কুলের সামনের আচার আর বাদামের দোকান- জলপাইয়ের আচার টাকায় ৪টা জলপাই- বেশ অনেকটা চালতা আর কুলের আচার- সেসবের অদ্ভুত স্বাদ- কাগজের পাতার উপরে লালা ঝরে ঝরে শেষ- চাটতে চাটতে কাগজ ফুটা হয়ে যাওয়ার পরে আঙ্গুলের আশেপাশে লেগে থাকা আচারের অবশিষ্টাংশ চেটে তবেই শান্তি- আর আটানার বাদাম- তখন বাদামের কেজি ১৮ টাকা-

বাসার সামনে বাজার- আর স্টেশন- পাশের রাস্তা ধরে অনেকটা গেলেই সামনের মোড়ে দাদা বাসা- দাদার বাসার হেমিওপ্যাথি ওষুধের দানা আর একটু রেকটিফাইড স্পিরিট- গলার ভেতরে গরম ঝাঁঝ নেমে যেতো- পেটের ভেতরে গরম লাগতো- এইসবের লোভেই বিকেলে একা একা দাদার বাসায় যাওয়ার চেষ্টা- তবে তখনও শনি বার রবি বার ছুটি- দাদা বাসায় যাওয়ার আরও একটা নেশা ছিলো কার্টুন দেখা- মিকি মাউস- স্কুবিডু-
এমন নিয়মিত জীবনে ছন্দ পতন নিয়ে আসলো শুক্র বারের ছুটির ঘোষণা-

মাঝে মাঝে বাজারে যাওয়া আর ফলহাটি থেকে ১ টাকার আতা আর কামরাঙ্গা কিনে টিফিনের টাকার সদব্যবহার শিখছি- আর পাড়াতো মামাদের কবলে পড়ে গরমের দুপুরে শসা কিনে কুয়োর গভীরে ফেলে রাখা- তার পর শুকনো মরিচ পোড়ানো আর লবনের সাথে মেখে খাওয়ার প্রস্তুতি- দুপুরে খেলা শেষে কুয়োর গভীর থেকে ঠান্ডা শসা তুলে কেটে খাওয়া- নুন মরিচ মাখিয়ে- কিংবা তরমুজ আর ফুটি ভালোই লাগানো গেলো না- গন্ধটাও বিকর্ষক- স্বাদটাও বালির মতো কিচকিচ করে-

ছাদের উপরে বিলাতী আমড়ার গাছ- আমড়া পাতার স্বাদ ভালো- কচি আমড়া পাশের বাসার নানীর চোখ এড়িয়ে পেড়ে আনা একটা বাড়তি যোগ্যতা ছিলো- তবে দেয়ালে উঠে টিনের ছাদে- গরমের দুপুরে চপ্পল না পড়ে উঠলে পায়ের পাতায় ছ্যাঁকা লাগতো- আঙ্গুল আর গোড়ালীর উপরে ভর করে পা টিপে হাঁটার শিক্ষা শেষে দেখা গেলো দুপুরের দিকে তারা সবাই স্লানে যায়- সে সময়টাই সবচেয়ে ভালো- কেউ পাহারায় থাকে না সে সময়- যতপারো পেড়ে নাও-

বাসার পাশের তেঁতুল গাছের বদমান ছিলো সেখানে জ্বিন আছে- তাই সে গাছের তেঁতুল পাকে না- আর পাকলের ভেতরে পোকা ধরে- আসলে পোকা না সেগুলো জ্বিনের থুতু লেগে এমন হয়-
রাতের বেলায় তার পাশের পায়খানায় যেতেও কলিজা শুকিয়ে কাঠ- চোখ বুজে কোনো মতে কাজ শেষ করেই ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজকে বেঁচে গেলাম আর রাতে পানি খাবো না-
এসব কিছুই বদলে গেলো- আমার তখনকার প্রিয় কার্টুনগুলোর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে গেলো- অনেক মানত আর সদকার প্রতিশ্রুতির পরেও আমাদের শুক্রবারের ছুটি রদ হলো না-

হাকিম নড়ে হুকুম নড়ে না- এরশাদের সময়ের হরতালের মতো শুক্রবারের রাস্তা- কোথাও কিছু চলছে না- পার্থক্য একটাই- হরতালে বন্ধ থাকতো সিনেমা হল তবে শুক্র বারের ম্যাটিনি শোতে মা আর খালারা যেতো- রাজ্জাক কবরী- ইলিয়াস কাঞ্চন আর ববিতা জাফর ইকবাল- বাসায় সপ্তাহে এক দিন চিত্রালী আসতো সেখানে বড় নায়িকার ছবি-

শুক্রবারের জুম্মার নামাজের আয়োজন ছিলো না তেমন , আসলে শুক্রবারে বন্ধের আগে জুম্মার নামাজের মাজেজা বুঝতাম না- তাই আমাদের শুক্রবারের রুটিনে নতুন জিনিষ যোগ হলো- সকালে শুরু হওয়া খেলা অবশ্যই শেষ হতে হবে ১২ টা ৩০এ- জুম্মার আজান দেওয়ার সাথে সাথে খেলা বন্ধ-

তখন কলপাড়ে যাও- টিপকল চেপে গোসল করো- স্যান্ডো গেঞ্জী পড়ে শার্ট গলিয়ে যাও মসজিদে- জেলখানা মসজিদের পুরোনো চাতালের পাথরের চোখএর মুয়াজ্জিন- আর একদিন সে আমাদের তার পাথরের চোখ খুলে দেখিয়েছিলো- সেই থেকে তার মতো মুর্তিমান বীভিষিকা আর কেউ ছিলো না- একটা মানুষ পুট করে চোখ খুলে হাতের তালুতে রাখছে এ মানুষ মোটেও সুবিধার না- আর তখন মানিকগঞ্জে আর সাটুরিয়ায় হঠাত করেই টর্নোডো শুরু হয়- বাসাবাড়ী ধ্বংস হয়- আর মানুষ মারা যায়- কেনোই বা সেখানে বন্দুক যুদ্ধে মারা যায় পুলিশ আর মুসুল্লি- আমি জানি না- মনে পড়ে না এখন- তবে সাঁটুরিয়া খুবই ভয়ংকর জায়গা ছিলো-
আমাদের শুক্রবারের জীবনে এর পরেও একটা নিয়মতান্ত্রিকতা তৈরি হয়- বাসায় টিভি না থাকায় আমারা যারা যাযাবর দর্শক তারা কখনো চৌধুরিদের বাড়ী- কখনও গার্ডের বাড়ী- কখনও মনা মামাদের বাসায়- কখনও আকবরদের বাসায় গিয়ে সুপার ম্যান দেখি- তার নানা রকম দুর্ধষ অভিযানের সাথে তার সুপার ডগ-
আমাদের চোখের সামনের ধ্বসে পড়লো আকবরদের শোবার ঘরের মেঝে- আমাদের সামনেই টিভিটা- সোফা আর টিভির মাঝে বিশাল গর্ত- আর এর পরে মোস্তাক মামার বাসায় টিভি আসার পরে আমাদের সদ্যযুবা মামারা নবরুপীর আড্ডা বাদ দিয়ে মোস্তাক মামার ডেরায় চিরস্থায়ী হয়ে গেলো-
আমাদের শুক্রবার শুরু হতো চমৎকার-
সকালের ১০টার ভেতরেই মাঠে অবশ্যই উপস্থিত থাকা- ক্রিকেট খেলা- এর পরে জুম্মার আজান দিলে মসজিদে- এর পরে থান্ডার ক্যাটস- আর সে সময়ে আমাদের বাসায় পুরোনো সাদাকালো একটা টিভি কেনা হলো- আমাদের আনন্দ আর ধরে না- যাযাবর দর্শক না আমরা নিজেরাই বাসায় বসে দেখতে পারবো- আর কেউ বাধা দেওয়ার নেই- প্রতীক্ষায় সমস্ত সপ্তাহ- কবে আসবে শুক্রবার- আর থান্ডার থান্ডার থান্ডার ক্যাটস হো চিৎকার দিয়ে ছুটে যাওয়া-
দুপুরে লোড শেডিংযের সময় বসে থাকা অপেক্ষায়- কখন লোড শেডিং শেষ হবে- খেলা ফেলে টিভির সামনে বসে থাকা-

শুক্রবার দুপুর মানেই গরুর ঝোল- গোল আলু দুই টুকরো করে হাল্কা লবন দিয়ে ভেজে গরুর ঝোল - সেই সাথে সাদা ভাত আর ডাল- যদি শীতের দুপুর তাহলে টমেটো আর যদি সেটা গরমের দুপুর তবে শসার সালাদ- আর শীতের দুপুরে বাড়তি ছিলো ধনে পাতার চাটনি তেঁতুল দিয়ে-
জনপ্রতি বরাদ্দ ছিলো ৩ টুকরা আলু- ২ পিস গোস্ত আর ঝোল এক চামচ- চাইলে হয়তো একটু বাড়তি ঝোল পাওয়া যেতো তবে আলুর টুকরা ছিলো মহার্ঘ- সেটা চাইলেও আসতে ৩এর বেশী ৪ হতো না- বাসার সবার মাথা গুনেই আলু দেওয়া হয়-

স্বাদু সেই আলুর ঝোল- আর যেহেতু চাইলেই পাওয়া যেতো না তাই সেই একটুকরো আলুর চার পাশে অল্প অল্প কামড় দিয়ে ভাত খাওয়া- একটু একটু করে আলু শেষ হতো আর বুকের কষ্ট বাড়তো- তবে সব সময়ই একটা লক্ষ্য থাকতো যেনো ভাত খাওয়া শেষ হওয়ার পরেও একটু আলূ থাকে- ডালটা শুষে খাওয়ার পরে নোনতা, একটু ঝাল এই আলু লাগতো অমৃতের মতো-

আমাদের বার্ষিক আয় বাড়লো ধীরে ধীরে- আমাদের শুক্রবারের দুপুরের মেন্যু বদল হয় নি অনেক দিন- তবে এর পরে আলাদা বাসায় এসে আমাদের দুপুরের মেন্যুতে খিচুড়ি আর গরুর ঝোল যুক্ত হলো-
জানি না কেনো তখন একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল সব দিন সব বাজারে গরুর গোস্ত বিক্রি হতো না- আমার সামনের বাজারে নিয়ম ছিলো সোম বার বুধ বার গরু বিক্রি হয় না- তবে খোশাশডাঙ্গি হাট আর রেল বাজার হাটে সেদিন গরুর মাংস বিক্রি হতো- আর রামনগর বাজারে মঙ্গল বার বিক্রি হতো গরুর মাংস=

নিয়মিত মাছের দিন শেষ হলে মাঝে মাঝে ঘরের মুর্গি জবাই করে মুর্গির ঝোল- সেই ট্রাডিশনাল ঝোল- মুর্গির ঝোলের সেই অনবদ্য স্বাদ ভুলতে পারি না- সেই গন্ধ হঠাত একটু আগেই নাকে লাগলো- কে কোন বাসায় রাধছে জানি না- আমার বাসার সামনে ৫টা বড় বড় ৬ তলা বাসা- এসবের কোনো না কোনো এক রান্না ঘর থেকে আসছে এ গন্ধ- আর ভালো লাগছে না-
বাসায় এখন আগের মতো শুক্রবারের নিয়োম মেনে ঝোল হয় না- হয় না মুর্গির ঝোল , আমাদের জীবনের রীতি বদলে গেছে-
আমার জীবনের শুক্রবারের দুপুরে এখন জুম্মা নেই- দুপুরে কড়া রোদে খেলা নেই- কানুইয়ের কোনে জমে থাকা ময়লা নেই- গোসলের সময় মাথা থেকে ঝড়ে পড়া নোনতা পানির স্বাদ নেই- আসলে কোনো কিছুই নেই আগের মতো-

আমি বড় হয়ে গেছি-


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

হ। হুদাই বড় হইছি। হইতেছি।
বড় না একটানে বুড়া হইতেছি।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

"আমার ছেলেবেলা"-সম্পাদক জনাব আরিফ জেবতিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি হাসি

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সহমত।

ধুসর গোধূলি এর ছবি
অনুভূতিশূন্য কেউ একজন এর ছবি

রাসেল ভাই, শুক্রবারের অনেক স্মৃতি মনে করায়া দিলেন।
কী যে করি, লিখতে পারি না।
আপনাদের মতো লিখতে জানলে, লিখে ফেলতাম আজই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।