পাগলাত্মার প্রলাপ

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/০৬/২০১৩ - ৩:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


গল্পটা রহস্য পত্রিকা’র অক্টোবর-২০১০ সংখ্যায় প্রকাশ হয়।
(অলংকরণ : ধ্রুব এষ)

আমি আনারুল। মা বলতেন ‘আনারুল হক’। বাবা ডাকতেন আনু নামে। গাঁয়ের লোকেরা বলত আনারুল পাগলা। ভাঙাচোরা অবয়ব। পাখির নীড়ের মত উষ্কখুষ্ক কেশশ্রী, সাপের খোলসের মত খসখসে ত্বক, অস্পষ্ট বাচনভঙ্গি, বোকাবোকা চাহনি আর বুদ্ধির ঘটে আমড়া কাঠের ঢেঁকি; সবমিলিয়ে গ্রামবাসীদের দেয়া পদবীটা ধারণ করার মত যথেষ্ট যোগ্যতা আমার ছিল। তাই আজও এই গাঁয়ে পাগল ও আনারুল সমার্থক দুটি শব্দ।
যখন দেখতাম, কেউ পাগলের পরিবর্তে ‘আনারুল’ শব্দটা উচ্চারণ করে সন্তানকে আদর করছে; তখন নামের সার্থকতায় অন্তরটা অহংবোধে পূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু অন্যকে তাচ্ছিল্য করার উদ্দেশ্যে কেউ আমার নামটা ব্যবহার করলে তার গালে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করত। সেই ইচ্ছেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর মত সাহস ও ক্ষমতা কোনটাই তখন আমার অনুকূলে ছিল ন

বজ্জাত ছেলেপুলের দল ‘কানে আঁটুলি’ খেপালে মাথায় রক্ত চড়ে যেত। আঁটুলি তো গরুর কানে থাকে, আমাকে কেন বলে এ কথা? নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না। একেকটাকে ধরে ইচ্ছামত ইছামতীর দৈ সদৃশ ঘোলাজল খাইয়ে ছাড়তাম। এর জন্য মাঝে মধ্যে যে চরম মূল্য দিতে হয়নি, তা নয়।
নেশা ছাড়া নাকি পুরুষ বাঁচে না--কথাটা কতটুকু সত্য জানিনে। ধূমপান ছাড়া যে আমার জীবন থমকে যেত--একথা বলতে আজ এতটুকু অপারগতা নেই। সিগারেট জুটত কালে-ভদ্রে; সহজলভ্য আজিজ বিড়ি সাবাড় করতাম মিনিটে দুইটা হারে। একটা পুড়ে উচ্ছিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার আগুনে আরেকটা জ্বলে উঠত। তাই দিনে একটার বেশি দেশলাইয়ের কাঠি ব্যয় হয়নি কখনও।

আমার মত হতদরিদ্র এক বাতুলের পক্ষে রোজ রোজ বিড়ি-সংস্থান করাটা মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। তাই প্রায়ই ছুটতাম মোল্লাবাড়ির বৈঠকখানার সামনে। সাহেবদের আধখাওয়া সিগারেটের পুচ্ছ দিয়ে নেশাটা ভালই মিটত।
মাঝে মধ্যে ধোঁয়াশূন্য দুর্বিষহ মুহূর্তগুলোতে প্রতিবেশী গৃহস্থরা ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হতেন, ‘এই, আনারুল, মোর গাচের নারকল কডা পেইড়ে দে না, ভাই, এক প্যাকেট বিড়ি দুবানি।’
কাজটা কঠিন হলে প্রস্তাবটাও হত লোভনীয়, ‘আইজ এট্টাও নাঙল পাইনি, মোর কলার ভুঁইডা কুইপে দিবি? দুইটো গোলডিপ আর চমচম খাওয়াবনি।’
আমি তো সর্বদা এমন প্রস্তাবের অপেক্ষাতেই উন্মুখ থাকতাম। তবুও মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলতাম, ‘চ’অম চ’অম খা’আবো না, তার ব’দলি বিরি দিলি যা’ আবানি।’

আমার ছোট ভাই কায়েম টের পেলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়ত, ‘তুই যদি ফের মাঙনা কাজ করতি যাইস থালি ঠ্যাঙ ভেইঙ্গে দোবো।’
বাবা অচল মানুষ। মা পাড়ায় পাড়ায় লেপ কাঁথা পেড়ে যা আয় করতেন তা দিয়ে তেল-নুন খরচটা টেনেটুনে চলে যেত। তামাকজাত দ্রব্যটার বিনিময়ে কাজ করিয়ে নেয়ার সময় আমার কর্মদক্ষতা নিয়ে কারও মাথাব্যথা না থাকলেও পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গ উঠলেই আমি অচল। গৃহস্থকে সাধাসাধি করেও কাজ মিলত না। বড় দুই ভাইয়ের আলাদা সংসার। তাই কিশোর ছোট ভাইটার কাঁধে ন্যস্ত ছিল চার সদস্যের সংসারটার ভার।
এমনিতে আমার প্রতি ওর ভালবাসার কমতি ছিল না। কিন্তু অকর্মা অপবাদ দিয়ে কটাক্ষ করাটা এক সময় ওর নৈমিত্তিক অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়।

পাগল হলেও একটা ন্যূনতম বিবেকবোধ বসত করত আমার বুকের জীর্ণ কুটিরে। ছোট ভাইয়ের কাঁধে বোঝা হয়ে থাকার কষ্টটা অনুতাপের অনল হয়ে এই বাতুল হৃদয়টাকে প্রতিনিয়ত ভস্মীভূত করত। তবু আমি অপারগ। চাপা কষ্টের অনুভূতিটা নিজেকে ছাপিয়ে মাতা-পিতার হৃদয়ে সঞ্চালিত হতে সময় নেয়নি।
এক গোধূলি লগ্নে মা ঘরে ফিরে এক অমিয় বাণী শুনিয়ে আমাকে অকর্মার অভিশাপ থেকে মুক্তি দান করেন, ‘অ বাপ...আনারুল হক। তুমার জন্যি এট্টা কাজ ঠিক কৈরে আলাম।’
‘ক’অনে, মা।’
‘ওই পুবির পাড়ার আদু বিষশেষের বাড়ি। ডেলি দশ ট্যাকা কৈরে মাইনে আর তিনবেলা খাতি দেবে।’
মাইনে কত, কাজ সহজ না কঠিন...এসব আমার কাছে গৌণ। তাই মুখ্য বিষয়ে প্রশ্ন তুলি, ‘বিরি দেব’এত, মা?’

আমাকে খুশি করানোর লক্ষ্যে ঠোঁটে জোর করে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলেন, ‘ডেলি এক প্যাকেট কৈরে দেবে।’
‘আদু বিশ-এশ বিরাড বরোনোক মান-ঊষ, বালো-মোন্দ খাতি দেবে, তাই না, মা, ব-অলো।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলেন, ‘হ্যাঁ।’ তাঁর অশ্রু টলমল চোখ দুটো শ্রাবণ ঢলে ভাসবার আগেই পরনের ময়লা কাপড়টার আঁচল তলে আশ্রয় খোঁজে।
আমি না বুঝে প্রশ্ন করি, ‘তুমা’র চোগি কী হৈচে, মা।’
চৌর্য কর্মে লিপ্ত অবস্থায় ধৃত সিঁধেল চোরের মত চমকে মা জবাব দেন, ‘মনে হয় কুট্যো পৈড়েচে।’

দুই
পরদিন থেকে শুরু হয় আমার মাইন্দার জীবন। সাথে সাথে ছন্নছাড়া জীবনটা নিয়ম-কানুনের ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে যায়। কুয়াশার শুভ্র চাদর জড়ানো ভোরে তেল চিটচিটে বর্ষীয়ান চাদরখানা মুড়ি দিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে প্রতিদিন গৃহস্থ বাড়িতে হাজিরা দেয়া, লাঙ্গল কাঁধে ফেলে বলদজোড়া তাড়িয়ে মাঠ অভিমুখে যাত্রা, রাতের পচা-বাসি খাবার দ্বারা উদর পূর্তি, কাস্তে-নিড়িং হাতে খেতে আগাছা পরিষ্কার, দুপুরে ইছামতীর ঘাটে বলদজোড়ার সাথে নিজের গোসল, বিকেলে ধান ভাঙানো, শানি কাটা (গরুর জন্য বিচালি কুচি করা) কিংবা মাঠ থেকে ঘাস সংগ্রহের মত টুকরো কাজ, সন্ধ্যায় গরু-বাছুরগুলো গোয়ালে তোলা, অতঃপর চাকরবাকরদের জন্য আলাদাভাবে রাঁধা খাবার খেয়ে ‘মিইয়া বাই চোরের মা’আতা খা-আবো’ অথবা ‘আইলো দা-আরন পাগুনরে এগা এগা বা-আলো নাগেনা’ গাইতে গাইতে ঘরে ফেরা--এসবই আমার নিত্য দিনের রুটিন হয়ে দাঁড়ায়।

কোনদিন লাঙ্গল চষা বা অন্য কোন কাজ না থাকলে অন্যের জমি চষতে যেতে হত। দিনে দু-তিন বিঘা জমি চাষ করতাম। একেক চাষের মূল্যে আশি টাকা। আমার ঘাম ঝরানো শ্রমের বিনিময়ে আদু বিশ্বাস প্রতিদিন গড়ে দু’শ টাকা আয় করলেও আমার ভাগ্যে দশের গণ্ডি পেরিয়ে কোনদিন এগারো টাকা জোটেনি।
সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির ধকল সহ্য করে কখনও যদি শরীরটা একটু বিদ্রোহ করত, ফলে যদি নিয়মিত রুটিনটার সামান্য ব্যত্যয় ঘটত--সেদিন আমার উপর নেমে আসত অমানুষিক নির্যাতন আর অশ্রাব্য গালিগালাজের ফুলঝুরি।

আদু বিশ্বাসের বারো বছর বয়সী ছেলে বেনু--‘বাপকা বেটা সেপাইকা ঘোড়া’ প্রবাদটার যথার্থতা প্রমাণ করাটাই ছিল যেন ওর জীবনের একমাত্র ব্রত। আমার পিছনে লেগে থাকার জন্য মাথাব্যথা, পেটব্যথা, কৃত্রিম জ্বরের ছুতোয় প্রায়ই সে স্কুল ফাঁকি দিত।

তিন
‘হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার! যাত্রা! যাত্রা! যাত্রা!’ পৌষের মিষ্টি বিকেলে নির্জন মাঠে আপন মনে ঘাস কাটছিলাম। হঠাৎ অদৃশ্য মাইকের শব্দে হাত থেমে যায়। মাথা উঁচু করে বাতাসে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি। মাইকের ধ্বনি ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়।

‘ভাইসব! ভাইসব! মনে রাখবেন, আজ রাত দশ ঘটিকার সময় থেকে শ্যামকুড় হাইস্কুল মাঠে শুরু হতে যাচ্ছে এক জমজমাট যাত্রা উৎসব! যমজমাট যাত্রা উৎসব! অভিষেক রজনীতে আপনাদের সামনে প্রদর্শিত হবে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রা পালা কমলার বনবাস! কমলার বনবাস! কমলা সুন্দরীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় ভরপুর যাত্রাপালা, কমলার বনবাস! শুধু কমলা সুন্দরী নয়, নীল আকাশ থেকে নেমে আসা একদল ডানাকাটা পরীর নৃত্যের ঝংকারে কম্পিত হবে যাত্রামঞ্চ! টিকিটের মূল্য প্রথম শ্রেণী ১৫ টাকা, ২য় শ্রেণী ১০ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণী ৫ টাকা! তাই এমন সুযোগ হেলায় না হারিয়ে আজই চলে আসুন আমাদের যাত্রা উৎসবে। হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার! যাত্রা! যাত্রা!...’

মাইকের ধ্বনি ক্ষীণ হতে হতে পশ্চিমের দিকে হারিয়ে যায়। লোকমুখে যাত্রার অনেক গল্প শুনেছি, দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনও। আচ্ছা, যারা যাত্রা করে তারা কি আমাদের মতই মানুষ? মাইকে তো বলল নীল আকাশ থেকে পরী নামবে--তা হলে ওরা জিন-পরীই হবে--এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘাসের বস্তা বোঝায় হয়ে যায়। যাত্রা দেখার ভূত পেয়ে বসে।

গৃহস্থ বাড়িতে ফিরে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যার কাজগুলো গুছিয়ে ফেলে গৃহস্থ গিন্নির কাছে ভাত চাইলে তিনি জানতে চাইলেন, ‘এত শিগ্গিরি ভাত খেইয়ে কনে যাবি?’ মাথা অবনত করে যাত্রা দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে ভাত বেড়ে দিলেন। অতঃপর মায়ের আঁচল থেকে দশ টাকার একটা নোট নিয়ে পাড়ার জালাল, গফুর, করিমদের সাথে যাত্রা প্যান্ডেলের দিকে যাত্রা করলাম।

বিজলী বাতির ঝলকানিতে স্কুলমাঠ দিনের আলোর মতই উজ্জ্বল। শুনেছি শ্যালো মেশিন দিয়ে এ আলো জ্বালানো হয়। আদু বিশ্বাসেরও দুটো শ্যালো মেশিন আছে--তিনি কেন বাড়িতে বিজলী বাতি না জ্বালিয়ে কুপি-হারিকেন জ্বালান? মস্তিষ্কে এমন হাজারো উদ্ভট প্রশ্ন ভিড় জমায়।
এক প্যাকেট বিড়ি ও পাঁচ টাকার একটা টিকিট কিনে জীবনে প্রথমবারের মত যাত্রা প্যান্ডেলে প্রবেশ করলাম। একটা চেয়ার খালি ছিল, তাতে আরামে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণের ব্যবধানে প্যান্ডেল লোকে লোকারণ্য; তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। মনে অজানা অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চ ভর করে।

হঠাৎ বিজলী বাতিগুলো নিভে যায়। ভড়কে যাই আমি। প্যান্ডেল জুড়ে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে সেটা সাময়িক। অল্পক্ষণের ব্যবধানে লাল-নীল-হলুদ বর্ণের আলোর ছটায় খাটের মত পায়াওয়ালা মঞ্চটা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ব্যান্ডের তালে তালে মঞ্চে আগমন ঘটে বাসন্তি রং শাড়ি পরিহিতা একদল তরুণীর। সমবেত কণ্ঠে গান ধরে ওরা...
এক নদী রক্ত পেরিয়ে
বাংলার আকাশে
রক্তিম সূর্য আনলে যারা...

এরা সবাই তো মানুষ, জিন-পরী কোথায়? একটু পরে ভুল ভাঙে আমার। দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি আর হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে মঞ্চে আসে বিচিত্র পোশাকের একদল ডানাকাটা পরী। তবে এরা আকাশ থেকে নামেনি। মঞ্চের পিছন থেকে এসেছে। তাদের উদ্বাহু নৃত্যের ঝংকারে শুধু মঞ্চ নয়, কেঁপে ওঠে পুরো যাত্রা প্যান্ডেল।

পরীদের নৃত্য শেষ। শুরু হয় মূল যাত্রাপালা। এর মধ্যে একবার টিকিট চেকার ঘুরে গেছে। পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে কেন চেয়ারে বসেছি, তার সদুত্তর প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় আমাকে ঘাড় ধরে মাটিতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কমলার পালায় দর্শকরা সম্মোহিত। প্যান্ডেলে সুনসান নীরবতা। রাণীমা কমলার বনবাস ঘোষণা করলে বাতাসে দর্শকদের আহাজারি ধ্বনিত হয়। মহিলাদের শাড়ির আঁচল সমূহ সাবান ধোয়া কাপড়ের মত স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। আমার জিভ অনুভব করে দু’ফোঁটা লোনা জলের স্বাদ। পরিশেষে সমস্তত ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে, পুনর্মিলনের মাধ্যমে শেষ হয় কমলার পালা। যাত্রায় বুঁদ হয়ে থাকা দর্শকরা প্রফুল্লচিত্তে ঘরে ফিরে যায়।

অনেক রাত পর্যন্ত নিদ্রাহীন থাকার কারণে পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙে। চোরের মত নিঃশব্দে গৃহস্থের গোয়াল থেকে গরুজোড়া বের করে খেতের উদ্দেশে রওনা দিলাম। মধ্যদুপুরে হিমবুড়িকে বিতাড়িত করে সূর্যদেব মাথার উপর চড়ে বসলে চাষকাজ শেষ হয়।
অন্তরে অজানা শাস্তির আশংকা ধারণ করে বাড়ি ফিরে দেখি, গৃহস্বামী ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন। আমার দর্শন পাওয়া মাত্রই আষাঢ়ে মেঘের মত গর্জে ওঠেন, ‘শুয়োরের বাইচ্চা, নাঙ্গল চষতি গিয়েই বারোডা বাজালি, আর কাজ করবে তোর কোন বাপ! কাজ করতি গিয়ে দিন-দুপুরি মাটে ঘুইমে পড়িস, রাইত জেগে যাত্তারা দেখতি নজ্জা করলে না! এত নবাবী হালে মোর বাড়ি থাকতি পারবি নে, বইলে দিলাম।’

এখানেই শেষ নয়, আরও যেসব বুলি আউড়ালেন তা কোন সভ্য মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত হতে পারে না।
প্রতিবাদহীন ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করে সমস্ত গালিগালাজ হজম করলাম। ভিতর থেকে একটা বুকফাটা কান্না বেরিয়ে আসবার জন্য তাগিদ দিচ্ছিল। ঢোক গিলে সেটাকে গলার ভিতর আটকে রাখলাম। গৃহস্থ থামলেন, গরু দুটোকে ‘হুরুর হাঁট-হাঁট’ করে তাড়া দিয়ে মনে মনে আদু বিশ্বাসের মুণ্ডুপাত করতে করতে নদীর পথে চললাম।

চার
ইছামতীকে মনে হয়, যেন সবুজ মানচিত্রের উপর অঙ্কিত এক রূপালী বক্ররেখা। দু’ধারে সবুজের মেলা, একেবারে তীর ঘেঁষে মৃদু বাতাসে দোদুল্যমান রবি ফসলের গালিচা। বর্ষায় আষাঢ় ঢলে টইটম্বুর, শীত-গ্রীষ্মে হাঁটু পানি। জলকিনারে খরশুলা মাছের দল খাবি খায়, ধরতে গেলে পালিয়ে যায়, কিশোরের শিটকিতে (ঠেলাজাল) মায়া, ঝায়া চিংড়ির চটপটানি, ওপারে মালো গিন্নির ছিপের টানে টেংরা-পুঁটির পরান ওষ্ঠাগত। কচুরিপানার জটলায় শোল, মাগুর, টাকিরা ঘাই মারে। শিমুল পাতার আড়ালে শিকার প্রত্যাশী মাছরাঙা কিংবা মৃদু জলে চোখ বুজে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মত চিন্তিত ভঙ্গিতে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কুনোবক--ঝোপ বুঝেই কোপ দেয়। আকাশে গাঙ শালিকের ওড়াউড়ি, পানিতে পানকৌড়ির ডুবচক্র--সবমিলিয়ে বাংলার অন্য ছোট নদীগুলোর সঙ্গে এর তেমন পার্থক্য নেই। তবে দু’তীরে দুটি স্বাধীন দেশের অবস্থান একে আলাদা একটা বিশেষত্ব দান করেছে।

ভর দুপুরে প্রকৃতি তেমন ঠাণ্ডা না হলেও ইছামতীর বরফ-শীতল পানি হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল। উত্তরের হিমেল হাওয়া ক্ষণে-ক্ষণেই এই কাঁপুনিকে একটু করে ঝাঁকুনি দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল অজানার উদ্দেশে।
গরু-বাছুরসহ গোসল করছে আমার মত আরও কয়েক জন চাষা। মহিলারা নাওয়া শেষে পানি ভর্তি কলসি কাঁখে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছিল। সেই পানি দিয়ে কেউ ডাল রাঁধবে, কেউ দেবে বড়ি।

ঘাটে স্ননরত সবাই বাংলাদেশী নয়, কেউ কেউ ভারতীয়। ইছামতীর একই ঘাটে দু’দেশের মানুষের এই মিলন মেলা শুধুমাত্র ধর্মভিত্তিক বাংলা বিভক্তিকরণের ভুল সিদ্ধান্তকেই যেন প্রতিনিয়ত উপহাস করে চলেছে।

এপার-ওপার বাংলার শিশুরা একাকার হয়ে জলকেলিতে মত্ত। এদের দুরন্তপনার কাছে ঠাণ্ডা পানি বা উত্তরের হিমেল বাতাস সবই তুচ্ছ। কিছুক্ষণের মধ্যে বেনু ছোঁড়াটাও এদের সঙ্গী হয়। মুহূর্তকাল অতিবাহিত হওয়ার আগেই আমার প্রতি আদু বিশ্বাস কর্তৃক মধু বর্ষণের ঘটনাটা ঘাটময় চাউর হয়ে যায়। দুষ্টু ছেলেরা ভেংচি কেটে বলে, ‘এই, আনারুল, তুই নাকি গাইল খেইচিস। কিরাম নেগেচে, তেতো না মিষ্টি?’

এমনিতেই মন-মেজাজ ভাল নেই, তার উপর এদের মুখ ভেংচি চাপা ক্রোধটাকে সপ্তম আসমানে চড়িয়ে দেয়। সাপের মত ফোঁস করে লাঠি হাতে তেড়ে যাই। একেকটা যেন বাইন মাছ--ধরার আগেই পিছলে গিয়ে পানিতে ডুব দেয়। মাঝ নদীতে সমবেত হয়ে কোরাস গেয়ে ওঠে, ‘কানে আঁটুলি... কানে আঁটুলি...’

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকি। আসলে নিশ্চুপ থাকার ভান করি। সুযোগ বুঝে বেনুর উপর লাফিয়ে পড়ি। মনের সাধ মিটিয়ে চুবানি দিয়ে ছেড়ে দিই। স্নান অসমাপ্ত রেখেই গলা ফাটাতে ফাটাতে বাড়ির পথ ধরে বেনু--যেন ওর পাকা ধানে কেউ মই দিয়েছে। অপেক্ষমাণ ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা ভেবে বুকটা ধক করে ওঠে। পথিমধ্যেই আক্কাচ চোরা খবরটা দেয়, ‘তোর গেরস্থ জুইতো হাতে কৈরে বইসে আছে। বাড়ি যা, বুজবি ঠ্যালা।’

খবরটা মিথ্যে নয়। গত শনিবার জীবননগর বাজার থেকে যে শক্ত খটখটে জুতো জোড়া এনেছিলেন তার একখানা হাতে নিয়ে গৃহস্থ উঠানে পায়চারি করছিলেন, নাগালের মধ্যে আসতেই তিনি আমার চুল খামচে ধরেন। পিঠের উপর শুরু হয় ধুপধাপ পাদুকা বৃষ্টি। তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠি। পাড়া প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। তবে তারা যাত্রা দর্শকদের মতই একটু-আধটু হা-হুতাশ ছাড়া নিশ্চুপ। কাতর কণ্ঠে নিজ কৃতকর্মের জন্য আদু বিশ্বাসের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করি। কিন্তু নিষ্ঠুর মানুষটার মনে এতটুকু দয়া হয় না, নির্দয়ভাবে পিটিয়ে চলেন। সারাটা দিন অভুক্ত শরীরটা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে আদু বিশ্বাসের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে।

কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরেছিল জানি না। চোখ মেলে দেখলাম, আমার মাথা মায়ের কোলে রাখা। পরম মমতায় তিনি আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, দু’গণ্ড বেয়ে নির্গত হচ্ছে অশ্রুধারা।
হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াই, ‘মা, গুয়ালি গ-অরু তুলা হ-য়নি।’
মা হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘আদু বিষশেষ তুমার আর তার বাড়ি রাগবে না।’

পাঁচ
আদু বিশ্বাসের বাড়িতে মাইন্দার জীবন পার করার পর আমার কর্মদক্ষতা নিয়ে আর কারও সংশয় ছিল না। প্রতিদিন জোনে যেতাম। মাঝে মাঝে চোরাচালানের মালামাল বহনের জন্যও ডাক পড়ত। অল্প পরিশ্রমে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া যেত তাতে। তবে ঝুঁকিও কম ছিল না। সর্বদা বিডিআর-পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আশংকায় তটস্থ হয়ে থাকতে হত।

জীবনের প্রয়োজনেই একটা বিয়ে করেছিলাম। আমার ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো হয়ে এসেছিল পুতুলের মত টুকটুকে একটা বউ। বড্ড বেশি ভালবাসতাম তাকে। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যখন ওর মুখটা দেখতাম--ভুলে যেতাম সমস্ত হতাশা ও ক্লান্তি। তিনমাস একসাথে সংসার করেছিলাম। একবার বাপের বাড়িতে নায়ার করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। আসবেই বা কেন? পাগল স্বামীর সাথে সংসার করতে চায় এমন মেয়ে কজন আছে বলুন।

ছয়
চৈতালী পূর্ণিমার রাত। দুর্বিষহ গরমে ঘরে টেকা দায়। উঠানে বেশ কয়েকটা খেজুর পাতার মাদুর পাতা হয়েছে। একটাতে বাবা ঘুমাচ্ছেন। একটায় মা মেজভাইয়ের দুই ছেলে জমির ও ছমিরকে রাক্ষসের কেচ্ছা শোনাচ্ছেন। একটাতে আমি, পাশে কায়েম ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে নাক ডাকাচ্ছে। বিশ্রী সে আওয়াজ। আমার চোখে ঘুম আসে না। আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। গোল আয়নার মত পূর্ণ চাঁদ, তা থেকে আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে।
রাক্ষসের গল্প শেষ। ছমির প্রশ্ন করে, ‘দাদী, চান্দের গায় কালোপানা উডা কী?’
‘তাউ জানিসনে,’ পণ্ডিতি ফলায় জমির। ‘ভাল কৈরে দ্যাক এট্টা বটগাচ, তার নীচে এট্টা গরু বান্দা, এক বুড়ি সেই গরুডার দুদ দোচ্ছে।’

দখিনা বাতাস ক্লান্ত শরীরটায় প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে যায়। ঘুমের দেশে পথ চলি আমি। ‘আনারুল, বাড়ি আচিস?’ কারও ডাকে পথ চলায় বিঘ্ন ঘটে আমার। ঘুম টুটে যায়।
ছমির ছড়া কাটছে--‘এট্টা তারা দুইটো তারা, ওই তারাডার বউ মরা।’
‘কি-ডা? এত রাত-তিরি কি-ডা ডা-গে?’
‘মুই তোর খালেক ভাই,’ ওপাশ থেকে জবাব আসে।
‘কিছু ব’অলবা নাগি, বাই?’
‘সামনের রবিরার ফজরদের সাতে মোদের মারামারির ডেট পৈড়েচে, তুই মোদের হৈয়ে লাগবি।’
আমার কাঁচুমাচু ভাব দেখে বলেন, ‘তোর সামনে থাকা লাগবে না। পেচন থেইকে নাটি যুগান দিবি।’
‘না, বাই, মুই মার’আমারির মোদ্দি নেই।’

‘শোন, একদিন জোনে গেলি পাইস পঁচিশ ট্যাকা, পাঁচশ’ ট্যাকা ইনকাম করতি কদ্দিন লাগবে হিসেব কৈরে দ্যাক। মোদের সাতে মারামারি করতি গেলি একদিনিই পাবি পাঁচশ’ ট্যাকা।’
আমি চুপচাপ থাকি। তিনি আবার বলেন, ‘ভাল কৈরে বুজে দ্যাক।’
জীবনের ঝুঁকি থাকলেও এমন লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মত আর্থিক সঙ্গতি আমার ছিল না।

রবিবার সকাল। পাড়ায় সাজ-সাজ রব। বোয়ালমারীর মাঠ যেন কুরুক্ষেত্র। পুরুষেরা আসন্ন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত, বৌ-ঝিরা লাঠিসোঁটা ও বিদের কাঠি যোগান দিচ্ছে। কোন এক অদৃশ্য রেফারীর নিঃশব্দ বাঁশিতে শুরু হয় যুদ্ধ।
মাথার উপর লাঠির দমদম শব্দ। আকাশে ওড়া বিদের কাঠি তীর হয়ে প্রতিপক্ষের শরীর ভেদ করছে। লাল রক্তে রঞ্জিত ময়দান। আপনজনদের করুণ বিলাপে বাতাস ভারী। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে আমাদের দল। মাথায় আকস্মিক আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

দুই দিন পর নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালের একটা নোংরা বেডে। মা-বাবা, ভাই ছাড়া পাশে আর কেউ নেই। পাঁচশ’ টাকা কিংবা চিকিৎসা খরচ দূরে থাক, একটিবারের জন্য কেউ খোঁজ-খবর নিতেও আসেনি।

সাত
ফাগুনের শুরু। শীতের হিমবুড়িটা তখনও পুরোপুরি বিদেয় হয়নি। সাত সকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে নারায়ণ রায়ের বাঁশবাগান থেকে ফিরছিলাম। মুখ ধোয়া হয়নি তখনও--তর্জনী ও দাঁতে পোড়া মাটির দাগ লেগে আছে।
রাতে নিম্নচাপের প্রভাবে দমকা হাওয়ার আকারে মৃদু ঝড় বয়ে গেছে। রাস্তায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির চিহ্ন--ধুলোর আস্তরণে ধূসর বর্ণের টিপ বসিয়ে দিয়েছে কেউ। বাতাসের তাণ্ডবে ঝরে পড়া সজনে কুঁড়িগুলো সকালের সোনালী রোদে মুক্তো দানার মত চিকচিক করছে। রায় বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্যাকার বাতাবী লেবু গাছটা তার গর্বিত অবস্থানটার কথা প্রকাশ করতেই যেন এই ফাগুন মাসে হঠাৎ করেই অকৃপণ হয়ে উঠেছে, তার ফুলের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত সারা এলাকা। গাছে গাছে সবুজের নবজাগরণ। এদিক সেদিক থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহু কুহু ধ্বনি।

এমন মুহূর্তে আমার কণ্ঠইবা থেমে থাকবে কেন। বহুদিন পর মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত গানটা, ‘আই-লো দা-আরুন পাগুনরে, এগা এগা বালো নাগে না...’
দু’কলিও গাওয়া হলো না। আমার ফাটা কলসির মত উদ্ভট কণ্ঠের বেসুরো আওয়াজে বিরক্ত হয়ে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসে রায় বাড়ির ডাল কুকুরটা।
ওটার আক্রমণাত্মক গতিবিধি অনুধাবন করে ওখানে আরও দেরি করা সমীচীন মনে করলাম না। ভোঁ-দৌড় দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলাম। কুকুরটাও নাছোড়বান্দা; আমাকে ধরতে না পারলে ও দৌড় প্রতিযোগিতায় রানার আপ হবে--এমন ভঙ্গি নিয়ে আমাকে ধাওয়া করল। একদম বাড়ির মুখে এসে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। কুকুরটাও আমার উপর হামলে পড়ল।

‘ওরে বাবারে’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে উদ্ভ্রান্তের মত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে এলেন মা।
‘ওরে কিডা কনে আচিস, শিগ্গির আয়! আমার আনারুলির কুকুরি কেমড়ে দিয়েচে!’

মায়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির সবাই একে একে বেরিয়ে আসে। বাবা কায়েমকে এক ধমক লাগিয়ে বলেন, ‘দেইড়ে দেইড়ে কী দেকচিস? শিগ্গির সাত বাড়িত্তে তেল-নুন চেয়ে নিয়ে আয়।’

কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পেরে পড়শীরা একে একে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন। যেন গাঁয়ের হাটে কোন সাপুড়ে মজমা বসিয়েছে, আমি সেই সাপুড়ের বশীভূত সাপ। আমাকে ঘিরে উৎসুক নয়নে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবার দৃষ্টিতে সহানুভূতি মেশানো। অর্থ সংশ্লিষ্ট ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেও মৌখিক সহমর্মিতা প্রকাশে কার্পণ্যবোধ নেই কারও। পাঁচশো’ টাকা মেরে দেয়া উত্তর পাড়ার সেই খালেক ভাই পর্যন্ত আমাকে সুস্থ করতে অন্তঃপ্রাণ--‘মাটে যাচ্ছেলাম, চ্যাচামেচি শুইনে ভাবলাম কী হইলো এট্টু দেকেই যাই। হাজার হলিউ তুমরা মোর আত্মীয় মানুষ। তুমাদের বিপাদ-আপাদে মুরা এইগে আসবো না তো কারা আসবে?’
‘তা অ, চাচী সাত বাড়ির তেল নুন খেইয়েচো তো?’...প্রশ্নটা তিনি মাকে উদ্দেশ্য করেই ছুঁড়ে দিলেন।

খালেক ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রইস মোল্লা। উনি জ্ঞানী মানুষ, তাই একটু গম্ভীর প্রকৃতির। কথা কম বলেন। লেখাপড়া শেখেননি, তাই বলে জ্ঞান-বুদ্ধিতে কারও চেয়ে কম যান না। এইট-নাইন পাশ কিংবা মেট্রিক ফেলের মত শিক্ষিত মানুষকে অতি সহজেই যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা দিয়ে পরাস্ত করতে পারেন। সেই ছোট্ট কালে ওস্তাদের কাছ থেকে আরবী পড়া শিখে কোরান তেলাওয়াত করতে শিখেছিলেন। পীর-ফকিরদের পিছুপিছু ঘুরে ঘুরে গ্রামের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলোর মাঝে ফতোয়াবাজি করার মত জ্ঞানটুকু অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন নিজেই মক্তব খুলে কয়েকশো ছাত্র-ছাত্রীকে আরবী শেখানোর পাশাপাশি ইসলামী জ্ঞানে দীক্ষিত করানোর মত মহান পেশায় নিয়োজিত আছেন। এতে একদিকে যেমন গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অর্জন করেছেন, অন্যদিকে গাঁয়ের লোকের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা আদায় করতেও বেগ পেতে হয়নি।

এতক্ষণ চুপচাপ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এবার হয়তো ভাবলেন এদেরকে কিছু সুপরামর্শ দান করা প্রয়োজন। তাই প্রথম বারের মত মুখ খুললেন, ‘এরে আপনারা ছলেমান কবিরাজের কাছে নিয়ে যান। উনি বড়ই কামেল মানুষ। যদি খুদার হুকুম হয়, তো উনার গুড়পড়া খাওয়ালি কুকুরির বিষ কোমনে উধাও হইয়ে যাবে।’

মোল্লার কথায় একজন ছাড়া সবাই একবাক্যে সমর্থন প্রকাশ করল। একটা কলেজ পড়ুয়া মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলে ওঠে, ‘তারচেয়ে বরং ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ভাল হয়ে যাবে।’
‘নাউযুবিল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ...’ বলে রইস মোল্লা মুখে এমন ভাবে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি আঁকলেন যেন ছেলেটা অত্যান্ত কটুকথা বলে ফেলেছে।
‘শোন, বাবা, তুমরা ছেইলে-পিলে মানুষ, ইসলাম সম্পক্কে কট্টুকুই বা জানো। ইস্কুল-কলেজে হিন্দুদের বাংলা আর ইহুদি-নাচারাদের ইংলিশ পড়ানো হয়। তুমরা তো হাদীস-কুরান সম্পক্কে খুব এট্টা জানো না। শুনিচি এসব ফিরি ওষুদগুনু নাকি আমেরিকা থেইকে আসে। আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ...! আল্লাহর ওপর বিশ্বাস থাকলি কোন দাক্তারের দরকার হয় না, কোন ওষুদও লাগে না। যাদের ঈমান শক্ত নয় তারাই দাক্তারের কাচে যায়। ছলেমান কবিরাজ পরহেজগার মানুষ। উনার দুয়া আল্লা খুশি হয়ে কবুল কৈরে নেয়। এইতো গেলো আশ্বিনি আমার ভাইপোডার সাপে কেমড়েলো, ছলেমান কবিরাজের ঝাড়ানোয় তো সেরেলো। কী, সারিনি, খালেক মিয়া?’

সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে খালেক ভাই বললেন, ‘রহিম চাচার বড় মেয়েডারো খ্যাপা কুকুরি কেমড়েলো। কই ও’রতো কোন দাক্তারি ওষুদ লাগিনি। ছলেমান কবিরাজের গুড়পড়া খেইয়েই তো সেরেলো।’
একজন শক্ত সমর্থককে পাশে পেয়েছেন দেখে রইস মোল্লার গলাটা আরও চওড়া হলো--‘বুইজলে, খালেক মিয়া, যত্তোসব নাফরমানিরাই দাক্তারের কাচে যায়।’
‘কই, আমরা তো তা শুনিনি।’

এতক্ষণে আমার কাতরতা এবং রইস মোল্লা ও খালেক ভাইয়ের বাক্যালাপ শ্রবণে মশগুল দর্শনার্থীরা কেউ ছেলেটাকে ভাল করে খেয়াল করেনি। এবার ওর দিকে সবার দৃষ্টি গেল। পরনে প্যান্ট-শার্ট পরা এক শহুরে ছেলে।
ইতিমধ্যে ছেলেটার কথা শুনে মোল্লাজি একশ’বার ‘নাউযুবিল্লাহ-আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ে ফেলেছেন। খালেক ভাই ছেলেটার দিকে কটমট করে চেয়ে বলেলেন, ‘এই ছুড়া, তোর বাড়ি কনে রে?’
‘খলিশপুর।’
‘কার বাড়ি এইচিস?’
রমিজ শেখের ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, ‘রফিক ভাইদের বাড়ি।’

‘দেকে তো মনে হচ্ছে কলেজে পড়িস। এরাম নাফরমানী কতা কন থেকে শিকিচিস? দু’পাতা বিদ্যে শিকে নিজেরে বড় পণ্ডিত ভাবিস, তাই না? ভিনগাঁ’র ছেইলে বইলে মুল্লাজির মুকিমুকি তক্কো করতি পারলি। জানিস এই গাঁ’র সবাই উনার কত সনমান দেয়? ছলেমান কবিরাজের অনেক ক্ষ্যামোতা। তিনি তোর সব কতা শুনতি পেইয়েচে। দেকিস তোর কোন না কোন ক্ষ্যাতি হবে।’
খালেক ভাইকে থামিয়ে মোল্লাজি বললেন, ‘বাদ দ্যাও তো, খালেক মিয়া। ওদের আর কী দোষ। আমেরিকা আর ইন্ডিয়া এদেশের ইসকুল-কলেজের বিষ ঢুইকে দিয়েচে। সবাইর বেপতগামী করতি চায়।’

ছেলেদুটো উলুবনে মুক্তো ছড়িয়েছে। এখানে সুপরামর্শ দান করা অরণ্যে রোদনের শামিল। আরও অপমান সহ্য করার চেয়ে কেটে পড়াই শ্রেয় মনে করল ওরা।
‘আইজকাইলকার ছেইলেপিলে! বড্ড বিয়াদপ। মুরুব্বিদের সনমান দিতি জানে না।’
‘ঠিকই বইলেচেন, মুল্লাজি,’ ছেলে দুটোর প্রস্থানের পর তামাম শিক্ষার্থী সমাজের দোষ-ত্রুটিগুলো ওঁদের দৃষ্টিগোচর হয়। শিক্ষিত হয়ে জাতিকে জাহান্নামের পথ দেখাচ্ছে। জাতির অন্ধকার আচ্ছন্ন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ওঁদের আফসোসের অন্ত থাকে না।

আট
দশদিন পার হয়ে গেছে। ছলেমান কবিরাজের গুড়পড়া কোন কাজে আসেনি, কাজ হয়নি সাতবাড়ি থেকে চেয়ে আনা তেল-নুনেও। হঠাৎ করেই পরশু দিন শুরু হয় ভেদবমি; সেই সাথে জলাতঙ্ক। কেউ বলে পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়েছে। কারও কারও অভিমত, ওসব বাচ্চা-টাচ্চা কিছু নয়--কুকুর বেশে জিনে কামড় দিয়েছে--রসুলপুরের হাকিম পীর ছাড়া এ অসুখ কেউ সারাতে পারবে না।

অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত আজ সকালে একবার বড় ভাই আমাকে নিয়ে হাসপাতালের চৌহদ্দি মাড়িয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তারের সাফ কথা--অনেক দেরি হয়ে গেছে, এ রোগী বাঁচানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
সন্ধ্যায় অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বাকশক্তিও উবে গেছে। গায়ে একটা ছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে খেজুর পাতার মাদুরে ঘরের দাওয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। মা চামচ দিয়ে মুখে ফোঁটাফোঁটা পানি ঢালছেন। কেউ একজন আগরবাতি ধরিয়ে দিয়ে গেছে। সেই ছেলেবেলায় শবে-বরাতের রাতে মোমবাতি-আগরবাতি নিয়ে মেতে ওঠা খেলার সময় আগরবাতির গন্ধটা যেমন লাগত, এ গন্ধটা তেমন নয়। আক্কাচ চোরার মায়ের মৃত্যু-শয্যায় যে আগরবাতিটার গন্ধ নাকে এসেছিল সেটার সাথে এর হুবহু মিল রয়েছে। আমার বুদ্ধি কম হতে পারে, কেউ আমাকে না জানাতে পারে, তবু আমি বুঝতে পারছি--আজ মৃত্যু আমার গলায় বরমাল্য পরাবে।

ক্রমশ প্রতিবেশীদের ভিড় বাড়ছে। কারও কারও মুখ হতে সমবেদনার বাণী নিঃসৃত হচ্ছে, কেউ এসেছেন স্রেফ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে। আসলে এঁরা স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝেন না। আমার প্রতি যে অন্যায় সারাজীবন তাঁরা করেছেন আমি বেঁচে থাকতে থাকতে ক্ষমা না পেলে যে তাঁদের জান্নাতে জায়গা হবে না! তাই আমাকে দেখতে এসে, বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেছি দেখে খালেক ভাই ও আদু বিশ্বাসের মত আরও অনেকেই হতাশচিত্তে বাড়ি ফিরে গেছেন।

মায়ের কণ্ঠে ছেলে হারাবার ভয়ার্ত আর্তনাদ। শিয়রে বসা কতগুলো কিশোরী মেয়ে সুর করে কোরান তেলাওয়াত করছে। স্বজনদের মাতমের সাথে মিশে সে সুর এক করুণ আবহ সৃষ্টি করেছে। মনের পর্দায় ছবি হয়ে একে একে ভেসে আসছে সমস্ত অতীত। সেই শিশুকালে দু’দিন না খেয়ে থাকার পর, নারায়ণ রায়ের আম বাগানে আম চুরি করতে গিয়ে ভৃত্যের হাতে ধরা পড়ার পর লিকলিকে শরীরে কাঁচা কঞ্চির শপাং শপাং শব্দ--স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

মনে পড়ছে, চৈত্রের কাঠফাটা দুপুরে ছোট্ট ছোট্ট ঘাস সর্বস্ব ফসলহীন খেতে চরে বেড়ানো বলদের পিঠে ফিঙ্গে-রাজার রাজত্ব করার দৃশ্য। মনে পড়ছে, হাসেম মিয়ার বাবলা গাছে শালিকের বাসায় আকাশের মত গাঢ় নীল ডিম দুটো প্রতিদিন একবার পরখ করতাম; আশায় থাকতাম কবে ডিম ফুটে বাচ্চা হবে। সেদিন বুঝিনি আজ ছেলেকে ফিরে পাবার জন্য সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে মা যেভাবে মাথা কুটছেন, হয়তো বাসা থেকে বাচ্চাগুলো হারানোর সময় শালিক দুটোর বিলাপে এমন আকুতিই মিশ্রিত ছিল।

মনে পড়ছে, চারপাশের অনাদর-অবহেলার মাঝেও একটুখানি মমতাদানকারী হাঁসুর মায়ের কথা; ইচ্ছে করছে এখনই গিয়ে আগের মত বলি, ‘মা’আমী তুমার বাপ এইয়েচে, তারাতারি বা’আত দ্যাও।’
রাত শেষের দিকে। ‘আসসালাতু খায়রুম মিনান্নাউম’...মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে মুসল্লিদের প্রতি নামায আদায়ের আহবান ধ্বনিত হচ্ছে। কোরান শরীফ পড়ুয়া কিশোরীরা বাড়ি ফিরে গেছে। নেই দর্শনার্থী পড়শীদের কেউই। মা শিয়রে বসে তখনও বিলাপ করছেন। বাড়ির অন্য সবাই আমাকে ঘিরে গোল হয়ে বসে আছে। মাঝে-মাঝে কানে আসছে ওদের চাপা ফিসফিসানি। নিজেকে মনে হচ্ছে সদ্য স্টেশন ত্যাগ করা কোন এক তুফান মেলের যাত্রী--স্টেশনের কোলাহল তীব্রতা হারিয়ে ধীরে ধীরে পিছন দিকে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা ঘূর্ণিঝড় এসে ট্রেনটাকে লাইনচ্যুত করে আমাকে কামরা থেকে ফেলে দেয়।

মহাকাল নামের এক সর্বগ্রাসী দৈত্যের অতল পাকস্থলিতে চিরতরে হারিয়ে যায় আনারুল নামের পাগলটা।


মন্তব্য

সন্দেশ এর ছবি

নীতিমালা থেকে:

২. সচলায়তনে প্রকাশিত লেখাগুলি ৭২ ঘন্টার জন্যে অনন্য থাকতে হবে, এবং অন্য কোন কমিউনিটি ব্লগে, মুদ্রিত মাধ্যমে বা মুদ্রিত মাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে পূর্বপ্রকাশিত হতে পারবে না। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশের ক্ষেত্রে এ নিয়মটি প্রযোজ্য নয়।

প্রথম পাতা থেকে লেখাটি সরিয়ে দেয়া হলো।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, অবগত করার জন্য

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ!!!! প্রতিটা লাইন আলাদা ভাবে অনুভব করা যায়, আবার পূর্ণাঙ্গ একটা আবেদন তো আছেই। স্যালুট বস!!!

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

লেখার সময় ভয়ে ভয়ে লিখেছিলাম, জীবনে প্রথম গল্প কিনা। রহস্য পত্রিকায় পাঠানোর পাক্কা সাড়ে তিন বছর পর ছাপা হয়। ততদিনে হতাশ হলে গল্প লেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।
ধন্যবাদ আপনাকে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।