বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-৩৬ : পেটারি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৩/১০/২০১৪ - ৬:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কিছু জিনিস থাকে প্রিয় থেকেও বেশি প্রিয়। আমার প্রিয় গাছের তালিকাটা বেশ লম্বা। কিন্তু অতিপ্রিয় গাছের কথা বললে সবার আগে আসবে পেটারির নাম। কবে কোথায় গাছটা প্রথম দেখি, সে স্মৃতি নিউরণের অতল সমুদ্রে গা ঢাকা দিয়েছে। তবে প্রথম মুগ্ধতার কথা এখনও স্পষ্ট। সে প্রায় বছর পচিশেক আগের কথা। ৮৯-এর বর্ষণমূখর এক দিনে গিয়েছিলাম এক ফুপুর বাড়ি। গ্রামটা ভারি সুন্দর। ঝোপ-জঙ্গল, নদী, মাঠ, শস্য, ঘাসফুলে আচ্ছাদিত এক আদর্শ বাঙালী গ্রাম। বর্ষার বিশুদ্ধ পানিতে গা ধুয়ে গোটা গ্রামটাই যেন পবিত্র চেহারা পেয়েছে। বৃষ্টিস্নাত গাছপালায় সবুজের অভিযান। সবুজ-সতেজ গাছপালা যেমন আমার শিশুহৃদয়ে দাগ কাটছিল, তেমনি বাহারি ফুলের নানা রঙে স্মৃতির ক্যানভাসে অঙ্কিত হচ্ছিল অমোচনীয় সব ছবি। সেই বর্ষার সেরা ছবি হয়ে আজও আমার মানসপটে গেঁথে আছে মামুলি এক মেঠো ফুল। এরপর পল্লীবাংলার কত গাঁয়ে, কত মাঠে কত অজস্রবার একে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিবারই গাছটা আমার বুকে অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, বুনেছে অন্যরকম ভালবাসার জাল। আর স্মৃতির পর্দায় ডানা মেলেছে শৈশবের সেই ছবি।


কিন্তু এত ভালোলাগা, এত ভালোবাসা যে জন্ম দিয়েছে, সেই ফুলটার, গাছটার নাম কী--এতদিন পর্যন্ত জানা ছিল না। জানার চেষ্টা করিনি তা নয়। গাঁয়ের যেসব মানুষ মেঠো উদ্ভিদের নাম ভালো জানেন তারা পর্যন্ত হার মেনেছেন। অবাক হয়েছি অতি পরিচিত এই উদ্ভিদের নাম লোকে কেন জানে না সে কথা ভেবে। অবশেষে জানলাম সেদিন। ২৪ আগস্ট ২০১৪, ফুলফল সহ গাছটার কিছু ছবি পোস্ট করেছিলাম ফেসবুকের বৃক্ষকথা পেজে। সেখানে জায়েদ ফরিদ ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পরলাম গাছটার নাম। পেটারি। ভারি চমৎকার নাম!


গোটা বাংলাদেশের যেকোনও গাঁয়ে, যেকোনও মাঠে, মেঠো পথের ধারে পেটারি গাছ দেখা যায়। বিশেষ করে বর্ষা-শরতে কমলা-হুলদ ফুলের পরশা সাজিয়ে অন্যরকম এক সৌন্দর্যে রাঙিয়ে তোলে পল্লিবাংলাকে। প্রজাপতি, ভ্রমর, মৌমাছিদের ঐক্যতানে এসময় মুখর হয়ে ওঠে পেটারির ডালপালা, পুষ্পপত্র।


পেটারি বহুবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। মাটির উর্বরতা ও পরিবেশভেদে ৭-৮ পর্যন্ত উঁচু হয় উঁচু হয় পেটারি গাছ। তবে গড় উচ্চতা ৪ ফুটের মতো। পেটারির কাণ্ডের রং গাঢ় বাদামী। কাণ্ড ২-৩ ইঞ্চি মোটা হতে পারে। কাণ্ড শক্ত, ভঙ্গুর। কাণ্ডের একেবারে গোড়া থেকেই ডালপালা বের হয়। তাই পেটারি গাছে ঝোপালো একটা ভাব থাকে।


পেটারির পাতা সাদাটে সবুজ রংয়ের। পাতা দেখতে হাতের পাঞ্জার মতো। পাতার কিনারাগুলো খাঁজকাটা খাঁজকাটা। পাতার ব্যাস গড়ে ৪ ইঞ্চি। নরম। মখমলের মতো। তবে পাতা একেবারে মসৃণ নয়। পাতার গায়ে সূক্ষ, কোমল শুঙ্গ থাকে।


পেটারির ফুল হলুদ কিংবা কমলা-হলুদ রংয়ের হয়। ফুল পাঁচ পাপড়িবিশিষ্ট। পাপড়ি পাতলা। পাপড়িগুলোর মাঝখানে একগুচ্ছ মনোরম কিশোর থাকে। ফুলে তেমন গন্ধ নেই। তবে মধু আছে।


প্রজাপতি, ভ্রমর, মৌমাছি ও বোলতাদের কাছে পেটারির মধু বিশেষ পছন্দের বস্তু। ফুলের ব্যাস সর্বোচ্চ এক ইঞ্চি।


পেটারির ফুল ফোটে খুব ভোরে। সকাল নয়টা-দশটার দিকে ফুল বুজে যায়। বিকেলে সুর্যের আলো মরে এলে আবার দল মেলে এর ফুল। বষা-শরতের বিকেলের মলিন আলোয় গাঁয়ের মেঠোপথে হাঁটতে বেরোবেন, তখন আপনার নাকে আসবে বুনো গুল্ম-লতার মাতালকরা গন্ধ। ফুলের মতো মিষ্টি গন্ধ নয়। কিন্তু লতাপাতার সবুজ গন্ধের সাথে পোটারির হলুদ ফুল গ্রামের মেঠোপথে অপার্থিব সৌন্দর্যের ঠিকানা খুজে দেবে।


পেটারির সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো এর ফল। ব্যতিক্রমি এক জিনিস। এমন চেহারার ফল দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। ফল দেখতে অনেকটা তবলার মতো। তবে আকারে অতি ক্ষুদ্র। ফল নিরেট নয়। পাতলা তন্তুর অসংখ্য অনেকগুলো খোল বা চেম্বার পাশাপাশি সাজিয়ে যেন পোটারির ফল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটা চেম্বারের ভেতরটা বাতাস আর একটা করে বীজ দিয়ে পূর্ণ করা থাকে। বাতাস চেম্বারগুলো ফুলিয়ে রাখে বলে পেটারির ফলের আকার কিছুটা বড়সড় হয়। ফল হাত দিয়ে চাপলে ওর ভেতর থেকে যদি হাওয়া বেরিয়ে যায়, তবে গুটিয়ে এতটুকু আকার ধারণ করে তখন। পেটারির ফলের ব্যাস এক ইঞ্চির মতো। কাঁচা ফলের রঙ সাদাটে সবুজ।


পাকা ফল কালচে ধূসর। ওজন মাত্র কয়েকগ্রাম।
ফুলের সৌন্দর্য সকালে-বিকালে, কিন্তু পেটারির ফলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে মাঝদুপুরে মাঠে নামতে হবে। সুর্যের তেজদ্বীপ্ত আলোয় তখন ঝলমল করে ওঠে পেটারির ফল। আবার সাকালে শিশিরস্নাত কিংবা বাদলের ধারায় গা ধোয়া সবুজ পেটারি দেখেও আপনার মন কেমন করে উঠবে।


ফলের প্রতিটা চেম্বারের ভেতর খুব ছোট্ট ছোট্ট বীজ থাকে। একেকটা বীজের আকার সরিষা বীজের দ্বিগুন। তবে ওজন সরিষার থেকে কম ছাড়া বেশি হবে না। বীজ ধূসর রঙের।


সাধারণত বর্ষার শুরু থেকে শরতের শেষ পর্যন্ত পোটারি গাছে ফুল ও ফল ধরে। পেটারির বৈজ্ঞানিক নাম-- Abutilon indicum.

আগের পর্ব : বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-৩৫ : রাখালিয়া/বুনো ঝুমকোলতা


মন্তব্য

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অসাধারণ! আমি দেখেছি এই গাছের ফল। এত কিছু জানতামই না।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, আমিও তেমন কিছু জানতাম না, জানিও না। যা কিছু লিখেছি সব অভিজ্ঞতা থেকে। বাকিটা অন্যের সাহায্যে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

তারেক অণু এর ছবি

বাহ

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
দেশে ফিরবেন কবে?

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

ছায়াপথের পথচারী এর ছবি

দারুণ! মনে হলো যেন গাঁয়ের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে এলাম! হাততালি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।