পরজীবী

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৬/১১/২০১৪ - ৬:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘হায় হায় রে! এখন মোর মেয়ের কী হবে রে?’ বুক চাপড়ে বিলাপ করছে মজিতন। মেয়ে নির্বিকার। ঘরের খুঁটিতে একহাত বেষ্টন করে বসে আছে। চোখ থেকে গড়ানো জল টপ টপ করে ঝরছে দাওয়ার ওপর। শুষ্ক মাটির রাক্ষুসে জিব মুহূর্তে চেটেপুটে শুষে নিচ্ছে ফাতেমার অশ্রুজল। দক্ষিণের উঠোনে নিম গাছের ছায়ায় মাথা দুহাঁটুর ভেতর মাথা গুঁজে বসে আছে তুফোন মিয়া। উঠোন জুড়ে পড়শিদের ঢল। বাড়িতে মড়া পড়লেই কেবল এমন ঢল নামে। ঝাঁকে-ঝাঁকে মহিলারা আসছে-যাচ্ছে। এক ছি হাজার ছি করে বিদ্রুপ করে যাচ্ছে ফাতেমাকে। ডাকসাইটে মহিলা ঘনার মা পর্যন্ত তুফোনের পক্ষ নিয়েছে।

‘সবাই মোর শত্তুর আইজ,’ হাহাকার ফেটে বেরোয় মজিতনের বুক থেকে। ‘কেউ নেই আমার পানে। কমনেগ্যারের নিমাইনষের ব্যাটা বড্ডা আপন হয়েছে! দেখা যাবানি কদ্দিন আপন থাকে।’
পড়শিরাও কম যায় না, ‘তুমার মেয়ে বুঝি ধোয়া তুলসির পাতা? পাড়ার লোকের পেছনে লেগেছ কেন? কিডা তুমার বুকি মাটি দেলে। ঠিক কথাই তো বলছে সবাই। স্বামী আগে না পর আগে?’
‘হায় আল্লাহ, এই তুমার বিচার?’ মোনাজাতের ভঙ্গিতে দুহাত ওপরে তুলে চিৎকার করে মজিতন। ‘আল্লাহ, তোমার এক নেক বান্দার খেদমত করতি গিয়ে মেয়ের এই দশা। তুমিই এর বিচার কইরো, আল্লাহ।’
‘কী, হইছে কী?’ মজিতনের বড় ছেলে ভিড় ঠেলে এসে বলে।
‘কী আর হবে বাপ, আমার কপালপোড়া জেবন! তোর বাপ আমার পর কইরেছে। আমার মেয়ের জেবনেও তাই লিকা আছে।’ বলে জামাতার দিকে আঙুল তোলে মজিতন। ‘ওই হারামির বাইচ্চা ছোটলোক, আমার মেয়ের কপাল পুইড়েছে রে বাপ!’
মেয়ের পক্ষে সাফাই গেয়ে, সত্য-মিথ্যা ভেজাল করে ছেলের কাছে বিচার চায়। বিচার মানে ধরে-বেঁধে জুতোপেটা আরকি। পাড়ার লোক প্রতিবাদ করে। আসল সত্যিটা উন্মোচন করে দাউদের কাছে। দাউদ অগ্নিশর্মা হয়। গাইলের তুবড়ি ছোটায় বোনের উদ্দেশ্যে। ‘শুয়োরের বাইচ্চা শুয়োর! বুড়ো বয়সে এইডা কী করলি! তিন-চাট্টে ছেলেমেয়ে এখন কনে যাবে? ও তো পুরষ মানুষ, গায় বল আছে, এট্টা কিছু কইরে খাবে। চাই কি নতুন এট্টা বউও ঘরে আসবে। তুই কী করবি হারামজাদী?’
‘বউ ঘরে তোলবে মানে! আমার ভিটে, আমার ঘর, সেই ঘরে অন্য মাগী নিয়ে সংসার! এতবড় আস্পদ্দা ঘরজামাইর ব্যাটা ঘরজামাইর!’

তুফোন মিয়া ঘরজামাই-- কথাটা আংশিক সত্যি। ওর বাড়ি এগাঁয়ে নয়। গোকুলনগর। দশ মাইল দূরের পথ। বাপ-মা ভাই-বোন কেউ নেই। দু-দুবার বিয়ের পিড়িতে বসা ফাতেমার সাথে আইবুড়ো তুফোন ছাঁদনাতদলায় বসে শ্বাশুড়ির ভিটেয় ঘর তোলার আশায়। বাঁশের খাপচির বেড়া আর খড়ের চালের ঘর। কিন্তু বছর না ঘুরতেই জানতে পারে এ বাড়ি শ্বাশুড়ির নয়। মামাশ্বশুরের। জাল দলিলের ফল। তবে মামাশ্বশুর বোন-ভাগনে-ভাগনিদের ভিটেছাড়া করে না। সময় দেয়, দাম দিয়ে কিনে নিতে হবে জমি। তুফোন মিয়া দু-তিন বছর খেটেখুটে টাকা জমা করে তার অংশটুকু কিনে নেয়।
খাটতেও পারে তুফোন। পরের জমিতে খেটে, জমি বর্গা নিয়ে চাষবাষ করে। তিন-চারেটে ছেলেমেয়ে নিয়ে বিলাসীতার স্বপ্ন সে দেখে না। কিন্তু মোটামুটি সংসার চলে যায়।

গোরস্থানের সাথে লাগোয়া ভিটে তুফোন দম্পত্তির। জ্বীন-ভূতের আসর হয় মাঝে মাঝে। জ্বীন-ভূত আল্লাহর দোয়া-কালামকে নাকি যমের মতো ভয় পায়। পরহেজগার মানুষকে এড়িয়ে চলে। তাই জীবনে মসজিদের চোহাদ্দি না মাড়ানো তুফোন আরবি পড়া শুরু করে ইমাম সাহেবের কাছে। দাড়ি রাখে, নামাজ ধরে। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে শিখে নেয় জ্বিন তাড়ানোর দোয়া। খুব যে কাজ দেয়, তা নয়। তবে মনের জোরটা বাড়ে। ফাতেমাকেও নামাজ পড়ার তাগিদ দেয় তুফোন। কানে তোলে না ফাতেমা সে কথা। বকাঝকা করে, মারধোর করে, শেষ পর্যন্ত বেনামাজির হাতের জল স্পর্শ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। অগত্যা ফাতেমাকে নামাজ ধরতে হয়।

শুধু নামাজ পড়লেই তো চলবে না, কোরান পড়াটাও শেখা চায়। শেখাবে কে? পাড়ার অনেক মহিলাই পড়তে জানে। কেউ কেউ শেখাতে রাজি হয়। দু-চারদিন শেখায়ও। কিন্তু ঘরকন্নার চাপে শেষমেষ ক্ষান্ত দেয় তারা। ফাতেমার আরুব শিক্ষা আর হয়ে ওঠে না।
এভাবেই চলছিল। হঠাৎ সৈয়দবাড়িতে আবির্ভাব হয় এক মৌলভির। সদ্য হাফেজি পাশ করে বেরিয়েছে। সৈয়দবাড়ির ছেলেমেয়েদের আরবি শেখাবে। সৈয়দবাড়ির দহলিজে থাকার ব্যবস্থা হয়। থাকা-খাওয়াও সেখানে। মোটকথা রাজার হালে থাকে মৌলভি আমিরদ্দি খোন্দকার।
মৌলভির খবর পায় ফাতেমা। বছর বিশেকের চ্যাঙড়া হুজুর। হোক চ্যাঙড়া, খোন্দকার বংশের ছেলে বলে কথা। ফাতেমার সাথে জুটে আরও চার-পাঁচজন। মৌলভি প্রথমে রাজি হয়নি। বেগানা মেয়েছেলে বলে কথা।
ফাতেমা মৌলভির হাতে-পায় ধরে। কথা দেয় পড়ার সময় পর্দা করবে। পর্দা করা ফাতেমার ধাঁতে নেই। নদীতে অর্ধউলঙ্গ হয়ে গোসল করে। ঘাটেই কাপড় পাল্টায়। পরপুরুষ হলে কী হবে, বাপের বাড়ির লোক বলে কথা। কেউ বেগানা নয়। কিন্তু এখন থেকে ওসব আর চলবে না।
অবশেষে মৌলভি রাজি হয়। বাদ-যোহর পড়াবে। তবে সম্মানীটা একটু বেশি দিতে হবে। জনপ্রতি মাসিক দুশো টাকা। মেয়েছেলেরা রাজি হয়। এ যুগে দুশো টাকা খুব বেশি নয়।

পরদিন থেকেই মৌলভির ক্লাস বসে। ফাতেমার ঘরের দাওয়ায় চাটাই পেতে। মৌলভি সুর করে, ‘পড়ে আলিফ জবর আ, বে জবর বা...’। পড়াশেষে আধঘন্টা দীন ইসলামের বয়ান। ফাউ। শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, বাবা-মার সাথে কী আচরণ করতে হবে তার তালিম দেয় মৌলভি। স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত--এ কথাটা বার বার মনে করিয়ে দেয়।
বয়ান শেষ হলেও হুজুরকে যেতে দেয় না ফাতেমা। পিঠা-পায়েস কিংবা চিড়া-মুড়ি না খাইয়ে ছাড়ে না। ঘরে মুরগি আছে। মাঝে জবাই দিয়ে হুজুরকে আপ্যায়ন করে।
প্রথম প্রথম এসব দেখে খুশিই হত তুফোন মিয়া। ভাবত, যাক এতদিনে পরহেজগার হয়ে উঠেছে ফাতেমা বেগম। কিন্তু ক্রমেই ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। এখন তার বাড়িতে হুজুরের দুপরের খাবারটা হয় প্রতিদিন। একটা মানুষের খাওয়া খরচ কম নয়, বিশেষ করে তাদের মতো গরিবের পক্ষে। মুখফুটে কিছু বলতে পারে না তুফোন। ভেতরে ভেতরে ফোঁসে। অবশেষে একদিন গরল উগরে দেয়।
হুজুর গাঁয়ের বাড়িতে গেছে কয়েকদিনের ছুটিতে। তুফোন বউকে বলে, তার মাংস খাওয়ার সাধ হয়েছে। বড় মরগিটা যেন জবাই করে। মুরগি অবশ্য জবাই করে ফাতেমা। তবে বড়টা নয়। ভেতরে ফোঁসে তুফোন। তবে বিস্ফোরণ ঘটায় না। মেজাজ চড়ে যায়।
হুজুর ফিরলে ফাতেমা বেগম পরদিন তোড়জোড় করে বড় মুরগিটা জবাই দেওয়ার। তুফোন নিষেধ করে, গালিগালাজ করে। মাঠে যাবার আগে ফাতেমাকে হুশিয়ার করে যায়, বড় মুরগি জবাই দিলে এসপার-ওসপার হবে। কিন্তু বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখে হুজুর তার কাঁচা ঘরের বারান্দায় বসে রসিয়ে খাচ্ছে। মুরগির বড় রান। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তুফোন। এক তালাক, দু-তালাক, তিন তালাক বলে বাহিন তালাক দিয়ে দেয়। হঠাৎ করেই যেন ফাতেমার পৃথিবীতে ভর করে রাজ্যের শূন্যতা।

পরদিন রাতে সৈয়দবাড়িতে শালিস বসেছে। বিচারকদের একদলের ইচ্ছা তওবা পড়ে বিষয়টা মিটিয়ে ফেলা। আরেকদল শরীয়াহ আইন মানার পক্ষে। অর্থাৎ ফাতেমা তুফোনের ঘর করতে হলে হিল্লা-ইদ্দত পালন করতেই হবে। অন্যদল যুক্তি দেখায়, রাগের মাথায় তালাক দিলে, তালাক কবুল হয় না। তাছাড়া এমন বিশ্বাসী লোক কে আছে, হিল্লা বিয়ে করে সাতদিন পর তালাক দিয়ে দেবে।
‘আপনারা চাইলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।’ আমিরদ্দি হুজুর এতক্ষণ ভিড়ের এককোণে গুটিসুটি মেরে ছিল। এতক্ষণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো। ‘আল্লাহর নামে ওয়াদা করছি, সাতদিন পর তালাক দেব।’
গোটা মজলিশকে হতভম্ব করে দিয়ে ফাতেমা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কুত্তা, জানুয়ার, লুইচ্চোর ব্যাটা লুইচ্চো! তুই আমার ঘর ভেঙিছিস। তোর বিয়ের সাধ আইজ মিইটে দিচ্ছি, র’।’
সৈয়দাবাড়ির বারান্দায় একটা ঝাড়– ছিল। প্রবল আক্রোশে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ধুম ধুম বসিয়ে দেয় হুজুরের পিঠে। হুজুরেভ তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। কীভাবে পালাবে সে পথ খুঁজছে। ফাতেমার ক্রোধ ছোঁয়াচে রোগের মতো সংক্রমিত হয় দাউদ আর তুফোনের মধ্যে। ধর শালর, মার শালার বলে লাফ দিয়ে ওঠে তারা। হুজুরের পায়েও তখন ‘তাড়া খাওয়া কুকুরে’র গতি ভর করেছে। কে যেন ধরে ফেলে পাঞ্জাবির আস্তিন। কিন্তু সামান্য বাধা আমিরদ্দির গতিতে লাগাম পরাতে পারে না। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে ছুটতেই থাকে। অজানার উদ্দেশ্যে। হয়তো নতুন কোনও পোষকের খোঁজে।


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হুমম... গল্প গল্পই... বাস্তবের মজিদেরা দৌড়ানী খায় না মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

গ্রামীণ পটভূমির গল্প বেশ লাগল। তবে আরেকটু সময় দিলে আরও বেশ হতো কিন্তু। শুভকামনা রইল।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

মোস্তফা প্রতীক এর ছবি

গল্পটা অনেক সুন্দর লেগেছে। হাসি

গৌতম হালদার এর ছবি

আবহমান বাংলার নিরেট বাস্তবতা চলুক
অপেক্ষায় থাকবো না, যেখানটাতে জাল ফেলেছি, বড় বড় কোরাল- বোয়াল প্রচুর আছে। দেখেছি।
পড়তেই থাকবো। পড়তেই থাকবো আর পড়তেই থাকবো।
অনেক অনেক শুভকামনা।

গৌতম হালদার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।