পাঠ্যপুস্তকের খৎনা

সজল এর ছবি
লিখেছেন সজল (তারিখ: শুক্র, ০৬/০১/২০১৭ - ৮:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভুসুকপাদের লজ্জা
চর্যাপদের কবি ভুসুকপাদ। এখনো যেমন কেউ কবিতা-টবিতা তেমন একটা কিনে পড়ে না, বারোশো বছর আগেও কেউ কিনে পড়তো না। পেটের দায়ে তাই ভুসুকপাদকে পাড়ি দিতে হয় দূর-দূরান্তে, পিছনে রেখে যেতে হয় বউকে। ফিরে এসে ভুসুকপাদ দেখতে পান তাঁর বউ আর তাঁর নেই, অবস্থাসম্পন্ন কোন চণ্ডালের হাত ধরে সে চলে গেছে। অনেক লজ্জা আর খেদ নিয়ে ভুসুক লিখেন,

আজি ভুসুক বঙ্গালী ভইলি
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলি

অর্থাৎ কিনা বউ চণ্ডালে নিয়ে যাওয়ায় ভুসুক আজকে বাঙ্গালি হলো। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের অন্যতম কবি বাঙ্গালি হওয়াকে খুব সম্ভবত লজ্জার ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছিলেন। সেই উত্তরাধিকার অজান্তে বয়ে বেড়ায় বাংলা ভাষার দাবীতে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে ফেলা বাঙ্গালিরা। সেই লজ্জা ঢাকতে বাঙ্গালিত্ব বদলে দেয়ার চেয়ে আর মোক্ষম দাওয়াই কী হতে পারে! বাংলা যখন অনেকটা বদলে গিয়ে আর বাংলা থাকবে না, আমাদেরও আর চণ্ডালে বউ নিয়ে যাওয়া বাঙ্গালি থাকতে হবে না।


ছহিহ বর্ণাবলি

পাকিস্তান যুগে একবার বাংলা ভাষার খৎনা দেয়া হয় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ আমদানি করে। কিন্তু নাছোড় কিছু শব্দের প্রতিশব্দ চালু করা গেলো না, তারা রয়ে গেলো তাদের হিন্দুয়ানি গন্ধ গায়ে মেখে। যথেষ্ট শক্ত ঈমান না থাকলে সেই হিন্দুয়ানি গন্ধ কারো কারো নাক এড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু ইসলামি নও বিপ্লবের কাণ্ডারি সাহিত্যিকদের নাক-কান-চোখ এড়াতে তারা সফল হলো না। দেখা গেলো 'স' যুক্তি শব্দগুলোতে হিন্দুয়ানি গন্ধ সব'চে প্রকট। তাই 'স' যুক্ত শব্দ ধরে ধরে হাজাম দিয়ে কেটে তাকে 'ছ' বানিয়ে দেয়া হলো। এইভাবে প্রচুর শব্দের "মুছলমানি" হলো।

সে গেলো অতীতের কথা। আমাদেরকে বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এমন কাফির বর্ণ আরো খুঁজে বের করে সেই বর্ণসমেত শব্দগুলোকে "মুছলমানি" দিতে হবে। ণ-ত্ব বিধান, ষ-ত্ব বিধানে আছে বিদেশি শব্দে ণ, ষ বসবে না। আরবী-ফারসি-উর্দুজাত শব্দে তাই এই দুইটা বর্ণ কোন কাজেই আসবে না। তাই এই দুইটা বর্ণকে ব্ল্যাকলিস্টে ঢুকিয়ে দিলাম। ত্রিমাত্রিক কবির সমসাময়িক এক কবিতায় দেখলাম সে 'ঊ' দিয়ে কোন ইসলামি শব্দ খুঁজে না পেয়ে মারমুখি হয়ে গেছে। তাইলে 'ঊ'ও গেলো কালো তালিকায়। ' ঃ' দিয়ে কি ইসলামি শব্দ লিখা যায়? "কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান", আসুন সবাই মিলে এমন অছহিহ বর্ণগুলো খুঁজে বের করে বাংলা ভাষা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বাংলাকে উর্দুর মত ছহিহ করে তুলি।


ছিলা কলা বুজানো

আওয়ামী লীগ এককাল হিন্দুস্থানের দালাল ছিলো। তাতে তাদের ভোট পেতে নানা সমস্যা হলেও কয়লাসম স্বভাব অনেক ধোয়ার পরেও যাচ্ছিলো না। তাই নানা শ্রেণীর পাঠ্য বাংলা বই জুড়ে তারা একের পর এক কাফির-হিন্দু লেখকের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ ছাপিয়ে দেয়। ভীষণ ঝড়ের রাতের পরেও এক সময় পূব আকাশে সূর্য উঠে, বাকশালি দুঃশাসন কাটিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামাতের ইসলামি জোট। এসেই তারা পাঠক্রমের মুসলমানি দিয়ে দেয় হিন্দু লেখকদের অনেকগুলা লেখা তাড়িয়ে দিয়ে, আর তার বদলে ইসলামের আলোয় আলোকিত লেখকদের ইসলামী ভাবের লেখা দিয়ে।

বাহাত্তরের সংবিধানের গল্প শুনিয়ে বাকশাল আবারো ক্ষমতায় আসে। আর এসেই খৎনা দেয়া পাঠ্যপুস্তকগুলা ধরে ধরে খৎনাপূর্ব অবস্থায় অনেকটা ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বাকশালি দুঃশাসনে ইসলামের বাগানের অনেকগুলা ফুটন্ত গোলাপ শুকিয়ে আসলে ইসলামের তলোয়ারের মত গর্জে উঠে হেফাজতে ইসলাম। তেতুলসমা মেয়েদের খাটে আর ঘাটে পাঠানোর ব্যবস্থা সেরে হেফাজত নীরবে-নিভৃতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে পাঠ্যপুস্তকের খৎণা ফিরিয়ে দেয়ার দাবীতে। বাকশালের ক্বলবে মারা তালা খুলে যায়, পাঠ্যপুস্তকে আবার দেয়া হয় খৎনা।

নির্জীব বই এই কলা ছিলা আর বুজানোর জাঁতাকলে পড়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে কিনা সেটা জানতে হলে হিন্দু বিজ্ঞানী জগদীশ বসুর আবিস্কার নিয়ে ঘাঁটতে হবে, তাই এই বিষয়ক প্রশ্নের কোন উত্তর আমরা খুঁজতে যাবো না।


পরিশিষ্টঃ

প্রাসঙ্গিক খবর


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এখনো বইয়ের খতনার লেভেল এ আছে। এর পরে দেশে আসলে আপনাকে না ধরে খতনা করে দেয় সেইটা খেয়াল কইরেন হো হো হো

সজল এর ছবি

ফ্রি করে দিলে আপত্তির কিছু দেখি না।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রসঙ্গ ভুসুকপাদ

চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন কিনা সেটা নিয়ে কিঞ্চিত বিতর্ক আছে। কারণ, অসমীয়া আর ওড়িয়া ভাষাভাষীগণ চর্যাপদ তাঁদের ভাষার বলে দাবি করেন এবং সেটার যৌক্তিক কারণও আছে। চর্যাপদের আমলে আজকের বাংলা (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ), আসাম ও ওড়িষ্যার ভৌগলিক বিভাজন বিদ্যমান ছিল না। সুতরাং চর্যাপদের কবিদের মধ্যে বাঙালী ও অবাঙালী উভয় গোষ্ঠী বিদ্যমান থাকতে পারেন। আমরা জানি যে প্রতিবেশী জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে কিঞ্চিত রেষারেষি বা ঠেস মারার প্রবণতা থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার, সেক্ষেত্রে ভুসুক অসমীয়া বা ওড়িয়া (ঊৎকল বা কোশল) জাতির মানুষ হলে তাঁর কবিতায় বাঙালী ব্যাশিং থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়। এই পোস্টে উল্লেখিত ৪৯-নং চর্যাটি মাল্লাড়ি রাগের ছন্দে লেখা। মাল্লাড়ি রাগের উৎপত্তি বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম উপকূল। সেই হিসাবে ভুসুক ওড়িয়া হবার একটা সম্ভাবনা থাকে। এই চর্যাটির শুরুটা এমনঃ

"বজ্রনৌকা বেয়ে পাড়ি দেই পদ্মা খাল,
দেশ লুট ক’রে নিল অদয় বঙ্গাল।
ভুসুকু, বাঙালি হলি আজ থেকে ওরে,
নিজের ঘরনি গেল চাঁড়ালের ঘরে।"

এতে আরও স্পষ্ট হয় ভুসুক বাঙালী নন্‌ এবং বাঙালীদের ওপর তাঁর ক্রোধও আছে। কারণ, বাঙালী তাঁর সম্পদ ও স্ত্রীকে লুণ্ঠণ করে নিয়ে গেছে।

ভুসুক তাঁর কবিতায় বাঙালীকে নিয়ে যা-ই বলে থাকুন বাঙালীত্ব নিয়ে পোস্টের লেখকের মন্তব্যঃ "সেই লজ্জা ঢাকতে বাঙ্গালিত্ব বদলে দেয়ার চেয়ে আর মোক্ষম দাওয়াই কী হতে পারে!"-এর সাথে একমত। এই কারণে আমরা প্রতি নিয়ত বাঙালী পরিচয়কে ঢেকে আরও বেশি ধার্মিক সাজার চেষ্টা করি, যদিও ধর্ম পরিচয়ের সাথে বাঙালীত্বের কোন দ্বন্দ্ব থাকার কথা না। এই কারণে আমরা ছেলেমেয়েদের গোড়া থেকে ইংরেজি বোলচাল শেখানোর চেষ্টা করি।

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ তথ্যবহুল মন্তব্যের জন্য। আমার ধারণা ছিলো ওই সময় বাঙালি শব্দ দিয়ে ঠিক কোন একটা জাতিকে বুঝানো হতো না, একটা ডেরোগেটরি শব্দ ছিলো হয়ত। কিংবা হয়ত আপনার কথাই ঠিক।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সোহেল ইমাম এর ছবি

অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ - শামসুর রাহমানের এই লাইনটা সবচেয়ে বেশি মনের মধ্যে বাজে আজকাল।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সজল এর ছবি

উটের পিঠে চড়ে মরুভূমিতে যাচ্ছে, (ইফ ইউ নো হোয়াট আই মীন চোখ টিপি )

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সজল এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পাঠ্যপুস্তকে সর্ষের ভুতের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া গেল। ভুতের আছর নামানোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে ভুতের বংশধরদের নিবারন খুব জরুরী। কিন্তু সেই কাজটা মনে হয় করা হবে না।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সজল এর ছবি

এক সময় পাঠ্যপুস্তকের মলাটের ভেতরে "দ্যা ওয়ান ট্রু বুক" এর কনটেন্ট চলে আসবে। নানা মলাটে সবাই একই বই পড়বে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ইয়ামেন এর ছবি

আসছে দিনে আরো অনেক কিছুরই খৎনা দেখতে পাবো সেই আশাতেই বেচে থাকা। জাজাকাল্লাহু খায়রান।
তোমার খৎনা সমাচার মোক্ষম হয়েছে। উত্তম জাঝা!

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

সজল এর ছবি

JAK Brother!

হ, রিপাবলিক অফ হাজামে স্বাগতম!

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

খাৎনা তো খারাপ নয়, তবে খাৎনা করতে গিয়ে যদি সমগ্র অঙ্গের হানী ঘটে যায়, তবে তো বিরাট মুষ্কিল ! অনেক অজানা কথা জানলাম। ভালো লেগেছে ! হান্টার হান্টার ।

সজল এর ছবি

হা হা, ভালো বলেছেন। জানাতে পেরে ভালো লাগলো, এত জ্ঞান, শেয়ার না করে ভেতরে বাবলড আপ হয়ে যায়।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

আয়নামতি এর ছবি

যথাযথ মুছলমানের ইছলামী রাষ্ট্র হইতে হইলে আরো অন্নেক খৎনা উৎসব দেখবেন ভ্রাত!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।