ভরসা

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি
লিখেছেন সুলতানা পারভীন শিমুল (তারিখ: শুক্র, ০২/০১/২০০৯ - ১২:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মালার মন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। পরশু ওর বিয়ে। ছেলে বিএ পাশ। দেখতে রাজপুত্রের মতো। টাকাপয়সাও নাকি ম্যালা। কিন্তু ওর মনে এইসব বিন্দুমাত্র দাগ কাটছে না। ও ওর নতুন সংসারের স্বপ্নে বিভোর। নতুন সংসার। কিন্ত সেটা ওর বাবা-মার পছন্দের পাত্রের সাথে নয়। সাগর ভাইয়ের সাথে। সতেরোতে পা দেয়া মালা কবে থেকে মন দিয়ে বসে আছে, নিজেও জানে না। শুধু জানে, তার সব সুখ শুধু সাগরকে ঘিরে।

ওর হবু বরের সাথে তুলনা করলে সাগর কিছুই না। দেখতে মোটামুটি। টেনেটুনে ইন্টারটা পাশ করেছে। মাস তিনেক হলো ঢাকার একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এইসব তুলনায় যায় না মালা। সে জানে, ভালোবাসা হলো ভালোবাসা। অতো হিসেব-নিকেশ করে ভালোবাসা হয় না। ও যতোটা, জানে, তারচেয়ে অনেক বেশি সাগর ভাই ওকে নিয়ে ভাবে। বিয়ে ঠিকঠাক জেনেও ও যে চুপচাপ আছে, সেটা সাগর ভাইয়ের বুদ্ধিতেই। কাল রাতেই সাগর ওকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে। এক কামরার একটা ছোট্ট ঘরে শুরু হবে ওর স্বপ্নের সংসার।

রাতের বেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয় মালা। অনেকদিন থেকে জমানো টাকার সাথে সাথে বিয়ের গয়নাগুলো নিতেও ভোলে না ও। এগুলো তো ওরই। গয়নার পাশেই রাখা যৌতুকের পঁচিশ হাজার টাকা। কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর তুলে নিলো বান্ডিলটাও। মনে মনে বললো, ”মনে কষ্ট নিও না বাজান, এই টেকা তো তুমি তোমার জামাইরে দিবা বইলাই রাখছো। তারে দেওনের লাইগাই টেকাগুলান নিলাম। জানি তোমার মালার উপর তুমি বেশিদিন রাগ কইরা থাকতে পারবা না। তোমার রাগ একটু কমলেই তোমার দোয়া নিতে আসুম।”

গাড়ি ছাড়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মালা। টাকা আর গয়নাগুলো সাগরের কাছে দিয়ে দিয়েছে ও। ঢাকা নাকি চোর-বাটপার আর ছিনতাইকারী দিয়ে ভর্তি। সাগরের কাছেই ওগুলো বেশি নিরাপদে থাকবে। সাগরের কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয় ও। আহ ! কি শান্তি !

: আইচ্ছা, আমাগো ঘরটা কেমুন গো?
: বেশি বড় না রে। ছোট্ট একটা ঘর। একটা বিছানা, কাপড় রাখনের লাইগা একটা দড়ি। আর কিছু বাসন-কোসন। বেশি স্বপন দেখিস না, বুঝলি। পরে মন খারাপ হইবো।
: কি যে কও। তুমি যেইখানে থাকবা, সেই জায়গা আমি স্বপ্ন দিয়া সাজাইয়া দিমু। দেইখো, আমাগো ওই ছোট্ট ঘরেই থই থই করবো আনন্দ।
: তুই অনেক স্বপন দেখোস, না?
: হ। দেখি তো। ক্যান, তুমি দেখো না?
: আর কি কি দেখোস, ক তো।
: সব তো কওন যাইবো না।
: ক্যান?
: যাও, আমার শরম করে না বুঝি?
বেশ কিছুটা সময় কি কি সব যেন ভেবে লজ্জায় লাল-নীল হয় মালা। তারপর আবার বলে
: আইচ্ছা শোনো, বিয়ার পরে তো বড়লোকেরা হানিমুন করতে বেড়াইতে যায়, তাই না?
: হ।
: আমরাও যামু।
: কস কি? তুই কি লন্ডন-আমেরিকা যাইতে চাস?
হেসে গড়িয়ে পড়ে মালা।
: না গো না। অতো সখ আমার নাই। তুমি আমারে ফেন্টাসি কিনডমে নিয়া যাইবা?
: তুই ফ্যান্টাসি কিংডমের কথা শুনলি কই থিকা?
: আমাগো চেয়ারম্যান সায়েবের মাইয়ার কাছ থিকা কতো যে গল্প শুনছি। কও...আমারে নিয়া যাইবা।
: আইচ্ছা যা। বন্দের দিনে নিয়া যামু একদিন।
: হ। ওইটাই হইবো আমাগো হানিমুন।
অন্ধকারে স্বপ্নীল হয়ে ওঠে মালার গলা। আবারো কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে যায়।
: আইচ্ছা শোনো। একটা সুন্দর ফুলদানি কিনুম আমরা, ঠিকাছে? তুমি প্রতিদিন রাইতে ফিরার সময় কতগুলান রজনীগন্ধা নিয়া আসবা। ঘরের কোণায়...
: হা হা হা। পাগলি কয় কি? ঢাকা শহরে তরিতরকারির থিকা ফুলের দাম বেশি, সেইটা জানস? যে বেতন পাই, ঘরভাড়া দিয়া দুইজনের পেট চলাইতেই হিমসিম খাওন লাগবো।
: আইচ্ছা, তাইলে থাক। তুমি থাকলে আমার আর কিছুই লাগবো না।
আবারো অনেকটা সময় নীরবতা।
: আইচ্ছা শোনো। আমিও যদি তোমার লগে চাকরি করি?
: তুই চাকরি করবি? কষ্ট হইবো না?
: কষ্ট কিসের? তোমারে না হাজার বার কইছি, তোমার লাইগা আমি সব, সব করতে পারি। খালি আমারে কইয়ো, কি করন লাগবো। তোমার চাওয়ার থিকা বড় আমার কাছে কিছুই নাই।
গলা আবার অন্যরকম হয়ে ওঠে ওর।
: আমি জানি মালা। তুই আমার সবথিকা বড় ভরসার জায়গা।
আরেকটু কাছে টেনে নেয় সাগর ওকে। এতক্ষণ ধরে বকবক করে ক্লান্ত মেয়েটা পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়ে পড়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে।

মালাকে নিয়ে যখন সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় উঠতে থাকে, অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ও,
: তুমি এই দালানে থাকো?
: না। তয় এইখানে কিছু কাম আছে।
: আমারে ঘরে রাইখা তারপর তুমি আসতা।
: পাগলি, বিয়া না কইরাই তোরে ঘরে তুলুম? আগে বিয়ার ব্যবস্থা করতে হইবো না?
: ও. এইবার বুঝছি।
কাজের ছেলে দরজা খুলে দেয়। বাথরুম দেখিয়ে ওকে হাতমুখ ধুয়ে নিতে বলে সাগর। কোনো কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে যায় ও।

যখন বাইরে বেরুলো, অনেক সতেজ দেখালো ওকে। পাটকাঠির মতো শুকনো এক মহিলার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিলো সাগর।
: এই হইলো মালা। এর কথাই তোমারে কইছিলাম খালা।
হাসিমুখে মহিলা ওকে একটু আদর করে।
: বাকি কথা পরে হইবো। যাও, টেবিলে যাও। আগে নাশতা কইরা লও তোমরা।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওকে বিশ্রাম নিতে বলে সাগর। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ঘরে ঢোকে সাগর। ততণে অস্থির হয়ে উঠেছে মালা। ওকে দেখেই বিছানা থেকে উঠে আসে ও। হাজারটা প্রশ্ন করতে থাকে। ওর হাত দুটো মুঠিতে তুলে নিয়ে মাথায় ঠেকায় সাগর।
: তুই আমারে মাপ কইরা দিস, মালা।
হঠাত করেই চুপ হয়ে যায় মালা। কি যেন বোঝার চেষ্টা করে।
: মালেশিয়া না গেলে আমি কোনোদিন বড় হইতে পারুম না, মালা। এইটা যে আমার কতো বড় স্বপ্ন, তুই তো জানোস। একটা সুযোগ আসছে, শুধু লাখখানেক টেকা হইলেই হয়। আমি জানি, তুই আমার জন্যে সব করতে পারোস। আমার আর কোনো উপায় আছিলো না, মালা...

নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা বোকা মেয়েটাকে পেছনে রেখে দু ফোঁটা জল চোখে বেরিয়ে আসে সাগর। ওর সামনে এখন অনেক কাজ...


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কষ্ট করে সেই মাসির ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা দিয়ে দিলে খুবই উপকার হতো
আমারও মালেশিয়া যাইতে ইচ্ছা হয়

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো হয়ে যান, মশাই।
ভালো হইতে পয়সা লাগে না। হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

মহসীন রেজা
গল্পটা খুব একটা ভালো লাগেনি।সংলাপের আধিক্য বেশি এবং পুরোনো আবেগের পুরোনো প্রকাশ।তবুও ধন্যবাদ।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হুম। একমত।
চেনা আবহ এবং পুরোনো আবেগ বলে আমিও গল্পটা দেবার ব্যাপারে খানিকটা কনফিউজড ছিলাম। তারপর আবার মনে হলো দিয়ে দিই।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

পুরাতন কাহিনী, পরিচিত সমাপ্তি- সবই ঠিক আছে, তবে ভাল লাগসে। জীবনঘেষা এই কাহিনীগুলো চেনা হলেও বারবার পড়তে মন্দ লাগে না হাসি

নতুন বলতে একটা জিনিস দেখলাম - "অনুতপ্ত" সাগর। সাধারণত এই ধরণের গল্পগুলোতে যেটা দেখা যায় তা হল, ছেলেটা বদ চরিত্রের হয় এবং ভাবলেশহীনভাবে মেয়েটার ক্ষতি করে যায়। কিন্তু এখানে মনে হল ব্যাটা বদ হলেও ভেতরে মায়া-মমতা বলতে কিছু আছে চোখ টিপি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হ।
বদ হইলেও তার ভেতরে পচুর মায়া মমতা।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালবাসার মূল্য সাগর মিয়ারা যে কবে বুঝবে...মন খারাপ

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

দময়ন্তী এর ছবি

বড্ড চেনা গল্প বলেই বোধহয় ঠিক খারাপ লাগল না ৷

তবে আপনার অন্য গল্পগুলো বেশী বেশী ভাল ৷

------------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

গরু মেরে জুতা দান মার্কা কাহিনী হয়ে গেলনা ?
ব্যাটা বদ সাগর তার প্রেমিকাকে বিক্রি করে দিয়ে আবার চোখের জল ফালায় !
আমি সামনে পাইলে জুতাপেটা করতাম।

------------------------------------

--------------------------------------------------------

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অবশ্যই, ভুতের ছাও।
তয় ইরাকী জুতা নাকি দেইখা নিয়েন। চোখ টিপি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

যথেষ্ট খারাপ লাগলো প'ড়ে।
মানে, মন খারাপ লাগলো।
মানে, গল্প ভালো হয়েছে। হাসি

-----------------------------------
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ধুরো, সাইফুল ভাই।
কেন জানি মনে হচ্ছে, লোকজন আমাকে শান্তনা দিচ্ছে।
গল্পটা যুতসই হয়নি বুঝতে পারছি। তবু ধন্যবাদ। লইজ্জা লাগে

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

আরে না, সান্ত্বনা দিচ্ছে না। ভালো হয়েছে। এত চিন্তার কিছু নাই। নেকস্ট লেখা নিয়া চিন্তা করেন।
ইশ্, কেমন লজ্জাও পায় আবার! হাসি

-----------------------------------
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

দেঁতো হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

হুমম!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

চিন্তিত

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।