ইউরেবিয়া

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি
লিখেছেন সুবিনয় মুস্তফী (তারিখ: শনি, ২২/০৯/২০০৭ - ৭:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

উপরোক্ত শব্দটার সাথে কেউ কেউ হয়তো পরিচিত থাকবেন। Europe এবং Arabia-র সমন্বয়ে গঠিত Eurabia শব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিলো, তা হলফ করে বলতে পারছিনা, কিন্তু ৯/১১-পরবর্তী সময়ে এই শব্দটির বহুল ব্যবহার করে এর প্রসার ঘটিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নব্য রক্ষণশীল (neo-conservative) মহল, যারা কিনা ইরাকে বেহুদা যুদ্ধ বাঁধানোর পিছনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো। ইউরেবিয়া শব্দটা এরা ব্যবহার করে অনেকটা জুজুর ভয় দেখানোর মতো। তাদের বক্তব্য হলো এই যে, অনেক মুসলমান ইতিমধ্যে ইউরোপ মহাদেশে স্থায়ী বসতি গেড়েছে, এবং তাদের যেই রকম প্রজননের হার (এবং পাশাপাশি শ্বেতাংগদের জন্ম-হার যেভাবে মাটিতে গিয়ে ঠেকেছে) তাতে আর বেশীদিন বাকি নেই, ইউরোপে আরব-মুসলমান জনসংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে, এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রভাব আশংকাজনক আকার ধারণ করবে। পশ্চিমা মনোভাবের সাথে আরব তথা মুসলমানদের মনোভাব আর মূল্যবোধের যে মৌলিক পার্থক্য, সেটা এক সময় গিয়ে ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, এবং তার উপর ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিবে।

পশ্চিমের নবীন ঐতিহাসিকদের মধ্যে নায়াল ফার্গুসন (Niall Ferguson) অল্প সময়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। একাধারে কেম্‌ব্রিজ, অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। তিনি কয়েক বছর আগে এক সেমিনারে 'The End of Europe?' শীর্ষক এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে সেই দিন দূরে নয় যখন অক্সফোর্ডের প্রাচীন গীর্জার চূড়ায় ক্রুশের বদলে আমাদেরকে মুসলমানের মসজিদের মিনারত আর তার মাথায় বাঁকা চাঁদ দেখতে হবে।

আজকের লেখাটি সেই মসজিদ বিতর্ক নিয়ে।

*

ফ্রন্টলাইন - ব্রিটেন

পূর্ব লন্ডনের স্ট্র্যাট্‌ফোর্ড এলাকার কাছে নতুন বাসায় চলে যাচ্ছি এই মাসের শেষে। সুন্দর বাসা, গেলে ভালোই হবে। স্ট্র্যাট্‌ফোর্ড এলাকাটি নিউহ্যাম কাউন্সিলের আওতায় পড়ে। সেই নিউহ্যাম-এ অনেকদিন যাবৎ একটি সমস্যা দানা বাঁধছে। এবং সুরাহা হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবলিগী জামাত নামের বিশ্বব্যাপী সংগঠনটি নিউহ্যাম-এ একটি মেগা-মসজিদ নির্মান করতে চায়। ৪০,০০০ লোকের সংস্থান হবে এই মসজিদে, যা হবে ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদগুলোর একটি। যারা নির্মানের বিপক্ষে তারা বলছেন যে তবলিগী জামাত অতি-রক্ষণশীল একটি ইসলামপন্থী দল, তাদের দ্বারা নির্মিত বা পরিচালিত যে কোন মসজিদ উগ্র ধর্মান্ধতার দোষে দুষ্ট হবে। এবং বৃহত্তর বৃটিশ সমাজের জন্যে এহেন বৃহৎ একটি মসজিদ ক্ষতি ছাড়া লাভ বয়ে আনবে না।

মসজিদের পক্ষে যারা তাদের দাবী হলো যে গণতন্ত্রের রীতি-নীতি অনুযায়ী যে কেউ মুক্ত-স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারবে, এবং এতে বাঁধা দেওয়া গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতির একদমই পরিপন্থী। বড় মসজিদের আরো দরকার কারন বর্তমানে যে সব মসজিদ আছে, সে সব দিয়ে আর বাড়ন্ত মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংকুলান হচ্ছে না, বিশেষ করে জুম্মার দিনে আর ঈদের দিনে। বিপক্ষে যারা তারা মসজিদের আয়তন নিয়ে বেশী শংকিত। এত বড় একটি মুসলমানদের মসজিদ এদেশে হতে দেয়া যায় না। এমনকি নিউহ্যাম এলাকার কিছু কিছু মুসলমানও এত বড় মসজিদ চান না, এবং তবলিগী জামাত গোষ্ঠী মসজিদ বানানোর জন্যে এত টাকা কোথায় পাচ্ছে, সেটাও অনেকে খতিয়ে দেখতে চান । Christian Peoples Alliance নামক এক গোষ্ঠী ইতিমধ্যে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর ওয়েবসাইটে ২৭৭,০০০ নাম লিখিয়েছেন, এরা সবাই মসজিদ নির্মানের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

এই যে বিতর্ক, এই যে পক্ষে বিপক্ষে বিবাদ, এই ট্রেন্ড ইউরোপের অনেক জায়গাই পরিলক্ষিত হচ্ছে, এবং যতদিন যাবে এই বিবাদ আরো ঘনীভূত হবে, আরো তিক্ত হতে বাধ্য। আরেকটিমাত্র দেশের উদাহরণ দেবো আজকে, তবে এই বিষয়ে নিয়ে আরো দু-একটি লেখা দেয়ার ইচ্ছা রইলো।

*

ফ্রন্টলাইন - জার্মানী

জার্মানীর চতুর্থ বৃহৎ শহর কলোন (Cologne)। রাইন নদীর তীরে এই শহরটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমানের হামলায় ভস্মে পরিণত হয়ে ছিলো। যুদ্ধ শেষ হলে পরে কলোন শহর পুনর্নির্মান করা হয়। কলোনের ক্যাথিড্রাল পর্যটক আকর্ষণ হিসেবে বিখ্যাত। সমস্যা এই যে কলোনে একটি বিশাল মসজিদ নির্মানের পরিকল্পনা চলছে যার মিনারতের উচ্চতাই হবে ১৬৫ ফুটের মতো, যা প্রায় ১৫-১৬ তলা উঁচু। জার্মানীর মুসলমান সম্প্রদায় মূলত তুরস্ক থেকে আগত। বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে জার্মানীর যে চমকপ্রদ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছিলো, তাতে তুরস্ক থেকে নিয়ে আসা 'Gast-arbeiter' অর্থাৎ গেস্ট ওয়ার্কার বা অতিথিকর্মীদের বিশেষ ভূমিকা ছিলো। মসজিদটি তাদের আর তাদেরই উত্তরসুরী তুর্কী কমিউনিটির দাবী।

কিন্তু কলোন বিভক্ত। শহরের এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর কোন মাথা-ব্যথা নেই মসজিদের সাইজ নিয়ে। এক-তৃতীয়াংশ চায় আরো ছোট আকৃতির মসজিদ, আর এক-তৃতীয়াংশ কোন মসজিদই দেখতে চায় না। কট্টর ডানপন্থীরা মসজিদের বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে বেশ সাড়া তুলতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু ওদিকে আবার রোমান ক্যাথলিক গীর্জা মসজিদের প্ল্যানে সায় দিয়েছে। এখন পর্যন্ত এই খেলা গোলশূন্য অবস্থায় রয়েছে।

*

এই মহাদেশে যতই দিন কাটাই, ততই ভাবি সব কোথায় যাবে শেষমেষ। বৃটেনে পাকিস্তানী আর বাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়, ফ্রান্সে উত্তর আফ্রিকার আলজ়েরিয়া, তিউনিশিয়া আর মরক্কোর অভিবাসী, হল্যান্ড আর বেলজিয়ামেও মরক্কোর মুসলমান, আর জার্মানীতে তুর্কী সম্প্রদায়। সবাই গরীব অল্প-শিক্ষিত হিসেবে এসেছিলো এখানে, কামলা খেটেছে অল্প আয়ে। এসব দেশের মেইন্সট্রীমের সাথে মিশে যেতে পারেনি, তাই ৩০-৪০ বছর পরেও তাদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সত্ত্বা আলাদাই থেকে গেছে।

আর নানা রকমের ভ্যারিয়েবেল এসে যোগ হয়েছে এই সংঘর্ষের ইকুয়েশনে, নানা স্মৃতি কাজ করছে। একদিকে হাজার বছর পুরাতন ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে মুসলমান-ভীতি, ক্রুসেডের ঐতিহাসিক স্মৃতি, জেরুসালেম দখল-বেদখল, মুসলমানদের স্পেন বিজয় আবার তা হারিয়ে ফেলা, ১৫২৯ সালে ভিয়েনার সম্মুখ দরজায় তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের মুসলমান সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে। ইউরোপীয় ভাষায় আজ অব্দি 'Saracen' বা 'Moor' শব্দগুলো রয়ে গেছে - কয়েক শতাব্দী আগে এগুলো বলতে মুসলমানই বোঝাতো। 'Mahomet' (নবী মুহাম্মদ) কে devil-এর সাথে প্রায়শই তুলনা করা হতো। শেক্সপীয়রের সমসাময়িক ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লো একটি নাটক পর্যন্ত লিখেছিলেন (Tamburlaine বা তৈমুর লং), তার একটি দৃশ্যে আগুন জ্বালিয়ে আল-কোরান পোড়ানো হয়

কিন্তু শতাব্দী পার হয়, দিন বদলায়। ইউরোপের আছে সেই ডেমোগ্রাফিক সমস্যা যা কিনা কয়েক বছরের মধ্যেই প্রবলাকার ধারণ করতে বাধ্য। স্পেন বা ইটালির মতন রক্ষণশীল ক্যাথলিক সমাজও আর তাদের শ্বেতাংগ জনসংখ্যা বাড়াতে পারছে না, বার্থ রেট এতই ডাউন যে তা জনসংখ্যার রিপ্লেস্‌মেন্ট রেটের নীচে চলে গেছে। অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো করাতে দরকার পড়ছে, এবং আরো দরকার পড়বে অভিবাসী শ্রমিকদের, নাইলে সমাজ-অর্থনীতির কাজকম্মের প্রবাহ অর্ধেকই আটকে যাবে। কিন্তু এত অভিবাসী আসবে কোত্থেকে? কালো আফ্রিকা আর পশ্চাদপদ মুসলমান জাতিগুলোই বেশী লোক পাঠাতে উদগ্রীব। কিন্তু মুসলমান তো পাশ্চাত্যে এসে মিশতে জানেনা, উপরন্তু মিশতে চায়ওনা। মদ খাবেনা কাজ শেষে, শূকরের মাংস ছোঁবেনা, মসজিদে গিয়ে আজব কোন এক ভাষায় বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়বে, উঠ-বস করবে। মেয়েদের ঢেকে রাখবে কালো কাপড়ের হিজাব-নিকাবে।

মজার বিষয় এই যে যেই 'Mahomet'-এর বিরুদ্ধে এত বিষোদ্গার করা হয়েছে ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, সেই নবীর নামই - তা Muhammad, Mohammad বা Mohamed আকারেই হোক - সেই নামই আজকে ইউরোপের অনেক বড় বড় শহরে নবজাতক ছেলেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় নামে পরিণত হয়েছে। আমস্টার্ডাম-রটার্ডাম-ব্রাসেল্‌স তো বটেই, এমন কি প্যারিস-লন্ডনেও মুহাম্মদ নাম আজ জনপ্রিয়তার তালিকা বেয়ে উঠে যাচ্ছে। উম্মত কি তাহলে তৈরী করেই ছাড়বে ইউরেবিয়া?

এমন কথাও উঠেছে সম্প্রতি যে মুসলমান দেশ থেকে অভিবাসন বন্ধ করে দিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সমাজের মধ্যে থেকে নতুন অভিবাসী আনার ব্যবস্থা করতে হবে - ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি থেকে। কিন্তু তাতে কি মিটবে যুগের চাহিদা?


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার সংগ্রহে প্রাসঙ্গিক দুটো বই আছে পিডিএফ ফরম্যাটে। কেউ চাইলে সাগ্রহে পাঠিয়ে দেবো।

১. While Europe Slept (How radical Islam is destroying the West from within) - ১.৪ মেগাবাইট

২. Onward Muslim Soldiers (How jihad Still Threatens
America and the West) - ১.৮ মেগাবাইট

এছাড়া আছে:
Politically incorrect guide to Islam - ১.৭ মেগাবাইট

সংসারে এক সন্ন্যাসী

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আপনি ভাল একটি টপিক নিয়ে লিখেছেন। ধারনা করি, স্বাভাবিক কারণেই আপনি কোন পক্ষের দিকে আপনার কলম ঘোরাননি; বরং পাঠকের উপরেই তা ছেড়ে দিয়েছেন।

এখন অবস্থা হয়েছে এমন, আপনি যে নাস্তিক (লেখককে বলছি না; সাধারণ অর্থে বলছি) তা কলম ফুঁড়ে লিখতে কোন বাধা নেই, কিন্তু যখনই বলবেন আপনি একটি ধর্মে বিশ্বাসী তখনই শুরু হবে সমস্যা। এ সমস্যা সব ধরনের মিডিয়াতেই রয়েছে। আমেরিকার মত তথাকথিত গণতান্ত্রিক, সেকুলার এবং প্রগতিশীল দেশের জাতীয় রাজনীতিতে সেখানকার চার্চগুলোর কী শক্তিশালি প্রভাব তা নিয়ে কেউ কি কখনো লিখবেন?

লেখাটি ভাল লেগেছে।
...............................
আমার লেখাগুলো আসে স্বপ্নের মাঝে; স্বপ্ন শেষে সেগুলো হারিয়ে যায়।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ওয়েল, ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহ-খোদা মানি, নামাজ-রোজাও ট্রাই করি যখন মায়ের মুখ বেশী মনে পড়ে! চোখ টিপি কিন্তু ইতিহাস, রাজনীতি এসব নিয়ে পড়তে গেলে কিছুটা ডিট্যাচ্‌মেন্ট তো বজায় রাখতেই হয়, নইলে পড়ে লাভ কি। হান্টিংটন যে 'সভ্যতার সংঘর্ষ' নিয়ে এতো প্যানর-প্যানর করেছেন, সেটা আসলেই ঘটে কিনা ভবিষ্যতে তা দেখতে আমি বেশ উৎসুক। বাজি কোন দিকে ধরবো এখনো বুঝতেছিনা। ৯/১১ আর ৭/৭ এর অভিজ্ঞতা আমার ভেতর ভীষণ দাগ কেটেছিলো, সেটা স্বীকারে বাধা নেই। প্রথমটার সময় বসবাস করছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে, দ্বিতীয়টার সময় যুক্তরাজ্যে। কয়েকদিন আগে আব্বা ফোনে বলছিলেন, তো বাবা তোর প্ল্যান কি? আমি হেসে বলি ওনাকে, আব্বা আমি যেখানেই যাই সেখানেই শালারা বোমা মারে, তাই আপাতত প্ল্যানিং বন্ধ রাখছি। উত্তরটা মনে হয় বাপজানের মনে ধরে নাই!!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

মজার বিষয় এই যে যেই 'Mahomet'-এর বিরুদ্ধে এত বিষোদ্গার করা হয়েছে ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, সেই নবীর নামই - তা Muhammad, Mohammad বা Mohamed আকারেই হোক - সেই নামই আজকে ইউরোপের অনেক বড় বড় শহরে নবজাতক ছেলেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় নামে পরিণত হয়েছে। আমস্টার্ডাম-রটার্ডাম-ব্রাসেল্‌স তো বটেই, এমন কি প্যারিস-লন্ডনেও মুহাম্মদ নাম আজ জনপ্রিয়তার তালিকা বেয়ে উঠে যাচ্ছে। উম্মত কি তাহলে তৈরী করেই ছাড়বে ইউরেবিয়া?

মুহাম্মদ কি একক নাম হিসেবে ইউরোপে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে? নাকি মুসলমানদের নামের অংশ হিসেবে? সাধারনভাবে সকল মুসলমানই( প্রেক্টিসিং/নন প্রেক্টিসিং) নামের সাথে 'মোহাম্মদ' জুড়ে দেন । অন্য ধর্মাবলম্বীদের তো এরকম কোনো কাস্টমস নেই ।

যদি খ্রীষ্টান পুরুষরা নিজেদের নামের সাথে ক্রাইস্টের কোন কিছু জুড়ে দিতো, সে ক্ষেত্রে ঐ নামটাই কি ইউরোপে সব থেক জনপ্রিয় হতোনা? যেহেতু এখনো ইউরোপে খ্রীষ্টানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ?

অথবা মুসলমান পুরুষরা যদি নামের আগে 'মোহাম্মদ' না লাগাতো তাহলে ও কি সংখ্যালঘু মুসলমানদের এই নাম সো কল্ড 'সবথেকে জনপ্রিয়' নাম হতো?

-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

জনসংখ্যার ট্রেন্ড কোন দিকে যাচ্ছে - বিশেষ করে অভিবাসী সমৃদ্ধ বড় শহরগুলোতে - সেটা বোঝানোর জন্যেই এই প্যারাটা লিখেছি। কোন ভ্যালু জাজ্‌মেন্টে যাচ্ছিনা, কোন মোটিভও খুঁজছিনা।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কিন্তু এই উদাহরনটা অনেককে ব্যাবহার করতে দেখেছি বিশাল জেহাদী জোস নিয়ে,যেনো এই উদাহরন প্রমান করে দেয় -এই তো মাত্র আর কয়টা দিন,সেন্ট পলস'এর চুঁড়োয় উড়বে সবুজ পতাকা ।

আসলে যখন বলা হয়, 'মোহাম্মদ' ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম,মানে ইদানিং সবচেয়ে বেশী মানুষের নাম রাখা হচ্ছে 'মোহাম্মদ' তখন একটা ধারনা জন্মায় যে-ইউরোপের খ্রীষ্টান ইহুদী সকলে মিলেই তাদের নাম 'মোহাম্মদ' রাখছে অথবা মুসলমানরা ইউরোপে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে ।

টোটাল পপুলেশনের ২০ ভাগ মানুষ যদি মুসলমান হয় আর প্রত্যেকের নামের অংশ হিসাবে 'মোহাম্মদ'লাগানোর রেওয়াজ থাকে -অপরদিকে বাকী ৮০ শতাংশের নামে মোহাম্মদ ও নেই,অন্য কমন কিছু ও নেই- তাহলে সাধারন হিসেবে কমন নাম হিসেব 'মোহাম্মদ' বেশীর ভাগ আসবেই ।

এতে আসলেই 'মোহাম্মদ' নাম সবচেয়ে জনপ্রিয় এটা প্রমানিত হয় কিনা তা নিয়ে আমার দ্বিধা আছে ।

মতলববাজ রা যখন এরকম বায়বীয় তথ্য ছড়ায় যেমন ণিল আর্মষ্ট্রং চাঁদে গিয়ে আজান শুনেছিল- তখন তার সাথে তর্ক করার কোনো মানে হয়না ।
কিন্তু একজন সুবিনয় মুস্তফী'র বিশ্লেষনধর্মী গুরুত্বপুর্ন লেখায় তা আসলে, কিছুটা কথা বাড়াই- এই আর কি ।

-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করি তাহলে। কনফিউশন না রাখাই ভালো। পাশ্চাত্যে প্রতি বছরই নবজাতকদের নামকরনের স্ট্যাটিস্টিক্স সংগ্রহ করা হয়। এটা অনেক বছরের রেয়াজ।

অভিবাসীরা এসব দেশে আসলে পরে সোজা রাজধানী বা বড় শহরের দিকে চলে যায়, যেখানে দেশের লোক, জেলার লোক, এমন কি নিজগ্রামের লোকও পাওয়া যাবে। বড় শহরে unskilled বা semi-skilled কাজ পাওয়াও সহজতর। অন্যদিকে ইমিগ্র্যান্টরা কোন পাড়ায় আসতে শুরু করলে শ্বেতাংগ জনগণ সেই পাড়া ছেড়ে তাড়াহুড়া করে পালায়। দূরে চলে যায়, কিম্বা শহর থেকে একদম বাইরে। এটাকে white flight হিসেবে অভিহিত করা হয়।

তো দেখা যাচ্ছে বড় শহরে শাদা কমে যাচ্ছে, কালো-বাদামী বেড়ে যাচ্ছে। ইমিগ্র্যান্টদের বাচ্চা নেওয়ার প্রবৃত্তিও বেশী। গড়ে ৩-৪-৫টা করে তারা বাচ্চা নিচ্ছে। ওদিকে ইউরোপ জুড়ে শাদাদের জন্ম-হার ২%-এর নীচে নেমে এসেছে, যেখানে রিপ্লেসমেন্ট রেট ধরা হয় ২.১%। ইমিগ্র্যান্ট-বোঝাই শহরে তাই সংখ্যাগুলো আরো বেশী কালো-বাদামীর দিকে ভারী হয়।

কিন্তু সমগ্র দেশ যদি দেখেন, তাইলে চেহারা ভিন্ন। লন্ডনের বাইরে যান, ম্যাক্সিমাম শাদা, প্যারিসের বাইরে যান বা ব্রাসেলসের বাইরে যান, প্রায় সব শাদা। লন্ডনে থাকলে মনে হয় এই দেশে শাদার সংখ্যা বেশির বেশি ৫০-৬০% হবে। কিন্তু না - এই দেশে শাদা এখনো ৯০% এর বেশী, এবং মুসলমান ৫% এরও কম। হল্যান্ড বা ফ্রান্সেও টেনেটুনে ১০% এর বেশী যায় না সেটা।

কিন্তু যেহেতু অনেক বাপ-মাই মুহাম্মদ নামটা জুড়ে দিতে রাজী, তাই মুহাম্মদ নামটা অনেক weight পায়। তার মানে এই না যে দেশ ভরে যাচ্ছে মুসলমানে, কিন্তু তার মানে এইও না যে দেশে মুসলমানের কোন গুরুত্ব নেই বা গুরুত্ব বাড়ছেনা। ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট সারকোজি তার ক্যাবিনেটে একটা না বরং দুইটা মন্ত্রীত্ব পদ দিয়েছেন মুসলমানদের - ফ্রান্সের ইতিহাসে এটা প্রথম। দুইজনই মহিলা - নাম তাদের রাশিদা দাতি এবং ফাদেলা আমারা।

আর জনপ্রিয়তার পরিসংখ্যানটা যে 'বায়বীয়' নয় সেটা একটু গুগল করলেই জেনে যেতেন। আমার চাপা মাইরা লাভটা কি ভাই? প্রতিটা তথ্যের সাথেই লিঙ্ক দেয়া যায়, কিন্তু দৃষ্টি-কটু লাগে বলে আর দেইনি। কিন্তু 'জেহাদী জোশ' নিয়ে যে লেখছিনা বরং নিরপেক্ষভাবে ফ্যাক্ট্‌স তুলে ধরছি, সেটা বোঝাতে হলে এখন থেকে লিঙ্কই দিতে হবে বোধ হয়...

১) নতুন ফরাসি ক্যাবিনেট
২) Muhammad is No 2 in boy's names (The Times, 6th June 2007)

প্রথম প্যারাটা দেখুন - Muhammad is now second only to Jack as the most popular name for baby boys in Britain and is likely to rise to No 1 by next year, a study by The Times has found. The name, if all 14 different spellings are included, was shared by 5,991 newborn boys last year.

অমিত এর ছবি

ফ্রান্সে যে মুসলিম মন্ত্রীর কথা বললেন, তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন কি তাদের ধর্মের জন্য ?

______ ____________________
suspended animation...

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

কিছুটা হলেও তো তাই। এত দিন যাবত ফ্রান্সের সংখ্যালঘু মুসলিমদের বড় নালিশ ছিল যে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় মাইনরিটি হয়েও তাদের রাজনীতি, মিডিয়া, বাণিজ্য - এসবে তেমন কোন রিপ্রেজেন্টেশান নেই। ২০০৫ সালে বেশ ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিলো সমগ্র ফ্রান্স জুড়ে, প্রচুর মুসলমান যুবক যাদের কাজ কম্মো নেই, বা কাজ পেতে হলে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়, তারা দাঙ্গার অগ্রভাগে ছিল। এই সারকোজি-ই তখন তাদের racaille (রাকাই, বা ময়লার আস্তরন) বলে গালি দিয়ে বিরাট হৈচৈয়ের সৃষ্টি করেছিলেন। আবার তিনিই আইন মন্ত্রী হিসেবে রাশিদা দাতিকে নিয়োগ দিলেন। দাতি নিশ্চয়ই তার কাজও জানেন কিন্তু মাইনরিটিদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় টেনে আনার, তাদের কথা যে উপরমহলে ভাবা হচ্ছে সেটা বোঝানোরো এটা একটা কায়দা।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সচলায়তনে এসেছিলাম প্রকৃতি নিয়ে ব্লগাবো বলে, এখন দেখছি সবকিছুর মধ্যেই আমি এসে নাক দেই। নাহ, লাইনে আমাকে থাকতেই হবে।

বোমার কথাটা ঠিকই বলছেন, যেখানে যাই সেখানেই সমস্যা বাধে। দেখা যাক, স্রোত কোথায় ঠেলে নিয়ে যায়।

??? এর ছবি

সুন্দর লেখা। তালাল আসাদ-এর "ফর্মেশন অব দ্য সেকুলার" এর কথা মনে করিয়ে দিল।

....................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

হিমু এর ছবি

বেড়াল আর বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর দু'জনেই হাসি ছেড়ে পড়া শুরু করবে এরকম নিয়মিত লিখলে। পড়ে জানতে পারলাম অনেক কিছু।


হাঁটুপানির জলদস্যু

আরিফ জেবতিক এর ছবি

তথ্যবহুল লেখার জন্য ধন্যবাদ।
"মুহম্মদ এখন ইউরোপে জনপ্রিয়" এই তথ্যটির ব্যাপারে আমি হাসান মোরশেদের সাথে একমত।
এটি আসলেই একটি অপ্রয়োজনীয় এবং মতলববাজী তথ্য,এই তথ্যটি আপনাকে ব্যবহার করতে দেখে আমিও হাসান মোরশেদের মতোই একটু অবাক হয়েছি।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

হুমম... মতলববাজী কেমনে খুঁজ়ে পেলেন বুঝলাম না, কিন্তু আগে যেই সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম সেটাই আবার দেই -

Muhammad is now second only to Jack as the most popular name for baby boys in Britain and is likely to rise to No 1 by next year, a study by The Times has found.

এটা শুধুমাত্রই ডেমোগ্রাফিক ট্রেন্ড-এর একটা প্র্যাক্টিকাল উদাহরণ হিসেবে দিয়েছিলাম। Most popular বলতে তো সবচেয়ে জনপ্রিয়ই বোঝায়, না কি?

হিমু এর ছবি

মুহাম্মদ ইউরোপের জনপ্রিয় ফার্স্টনেম, এই তথ্যটার ইন্টারপ্রিটেশন, এর ভাবানুবাদ জরুরি। নামের গঠন নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই। আমাদের দেশে নামের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নাই, কিন্তু ফরাসী বা জার্মানদের বেশ ভালোভাবেই আছে। ফরাসীদের পরিবারের নামের জন্য বিভিন্ন ফর্মে আলাদা অংশ থাকে, জার্মানদের নামও তিনভাগে বিভক্ত, তার মধ্যে নাম (পদবী) আর প্রথমনাম বেশি কাজে লাগে। মুসলমান শিশুর নাম, ধরা যাক, আবদুর রহমান। সে মুসলমান, কাজেই তার পরিবার থেকে একটা মুহাম্মদ জুড়ে দেয়া হয় নামের শুরুতে। ওটাই হয়ে যায় তার ফার্স্ট নেম, আবদুর তার নামের মধ্যভাগ (যা ব্যবহার না করলেও সমস্যা নেই), রহমান তার পদবী। ইয়োরোপের প্রায় সব দেশে (হাঙ্গেরি বাদে) তার পরিচয় দাঁড়াতে পারে মুহাম্মদ রহমান হিসেবে।

মুহাম্মদ ইয়োরোপের পপুলার নাম, এই তথ্যটি এখন কে কিভাবে "ব্যবহার" করছেন সেটা দেখা জরুরি। বিভিন্ন ব্লগে দেখা যায় ইসলামের বিশ্বজয়ের একটা সূচক হিসেবে এটাকে ব্যবহার করতে, আবার দেখা যায় বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের ইসলাম ধর্মগ্রহণ (নীল আর্মস্ট্রং এর ইসলাম ধর্মগ্রহণ নিয়ে হাস্যকর একটা পোস্ট চোখে পড়েছিলো কোন একটা ব্লগে) দিয়ে ইসলামের মহিমা পরিমাপের একটা চেষ্টা চলে। কিন্তু এই ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তথ্যটির গুণগত দিকটি আড়ালে চলে যায়। মুহাম্মদ নামটি জনপ্রিয়, কারণ ইয়োরোপে মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যার দিক দিয়ে এখন বর্ধিষ্ণু, এটুকুই। মুহাম্মদ নামটি বাংলাদেশে বোধহয় সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়, প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের নাম মুহাম্মদ। প্রতি বছর বাড়ছেও মুহাম্মদের সংখ্যা।

আরিফ জেবতিক যেমন বলেছেন, তথ্যটি অপ্রয়োজনীয় এবং মতলববাজি। আমার মনে হয় তথ্যের ব্যবহারের মাধ্যমে কোন বক্তব্যকে জোরদার করার প্রচেষ্টাকে মতলববাজি বলা যেতে পারে। মুস্তফীর লেখায় সেরকম কোন বক্তব্য চোখে পড়েনি আমার, তাই আমি এই কঠোর বিশেষণের ব্যবহার দেখে পোস্টটা আবারও পড়লাম :)।

ধন্যবাদ।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অয়ন এর ছবি

মুসলমানরা ব্রিটেনের মোট জনগোষ্ঠীর ২.৮% কিন্তু জনপ্রিয় নামের ক্ষেত্রে মোহম্মদ ব্যবহার করার হার ৭.৫%। মুসলমানদের জন্মহার এতো বেশী হলে জনপ্রিয় নাম তো হবেই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।