নীলু ও পলুর কথা- শেষ

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: সোম, ০৫/০৫/২০০৮ - ১২:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাস তিনেক নীলু থাকে তার বোনের বাড়িতে। একবার ঘুমের ওষুধ বেশি পরিমাণে খেয়ে মরেও যেতে চায় কিন্তু কত কী যে দেখার বাকি! মরে গেলে দেখবে কে? নীলু শুনতে পায়, রীমা এখন নীলুর বাড়িতেই থাকে। শ্বশুর গ্রাম থেকে ফিরে এসে নীলুর সাথে দেখা করেন, নীলুকে বলেন, যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে, তুমি এবার বাড়ি চল। আত্মীয়-বন্ধুদের প্রায় সকলেই আসে নীলুর সাথে দেখা করতে। নানা জনের নানান পরামর্শ। কেউ বলেন কেস ঠুকে দে তো কেউ বলেন, মেয়েদের কপালটাই এরকম হয়, মেনে নাও আর কীই বা করবে! নীলু কোনটাই করে না। ডিভোর্সের নোটিশ পাঠায় পলুকে।

ইতিমধ্যে পলু প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করেছে নীলুর সাথে, নীলু কথা বলেনি। নিজে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ বসে থেকেছে ড্রইং রুমে, নীলু দেখা করেনি, কোন কথা শোনেনি, বলেনি।

খবর আসে, পলুর ছেলে হয়েছে। নোটিশ ততদিনে পৌঁছে গেছে পলুর কাছে। পলু নাটোর যায় নীলুর বাবার কাছে, সাথে করে ঢাকায় নিয়ে আসে নীলুকে বোঝানোর জন্যে। কেউ যদি নীলুকে বোঝাতে পারে তো সে একমাত্র নীলুর বাবা। পলু সেটা জানত। অনেক চোখের জল, অনেক মান-অভিমান আর অনেক ক্ষমা-প্রতিশ্রুতির পালা। নীলু ফিরতে রাজী হয়, তবে ও‌ই ফ্ল্যাটে নয়। যে ফ্ল্যাটে পলু মেয়েছেলে নিয়ে এসে তুলেছে সেখানে নীলু যাবে না। পলু তাতেই রাজী। ও‌ই বাড়িরই দোতলার ফ্ল্যাটে নীলু এসে ওঠে। তিনতলার ফ্ল্যাটের কোন জিনিসপত্র নীলু ছুঁয়েও দেখতে আর রাজী নয়, সব নতুন করে আসে আবার। এবার নীলু আর সংসার গোছায় না। শ্বশুর, দেওর কাউকেই নিজের কাছে নিয়ে আসে না। একা থাকে নীলু। নিজগৃহেই নীলু থাকে মেহমানের মত।

পলুর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে ধীরে ধীরে, সময়ের সাথে সাথে। সময় নাকি সব ক্ষতকেই সারিয়ে দেয়। নীলুর ক্ষত সারে না। পলুর ছেলেটি দেখতে ভারী মিষ্টি। বাপের মতই দেখতে হয়েছে অনেকটা। যখন তখন সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নিচে, মা'য়ের কাছে। পলু ছেলেকে শিখিয়েছে নীলুকে মা বলে ডাকতে। নীলু ভুলতে চেষ্টা করে সব ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে। ভোলা যায় না কিছুই। ক্ষত আরও তাজা হয়ে ওঠে রীমার ব্যবহারে। রীমা এক পারফেক্ট সপত্নী । পলু যতই বলুক, বাবুটা নীলুর কিন্তু নীলু জানে, ও পলু আর রীমার বাবু। তার নয়।

নীলু আবার কলকাতায় আসে, এবার সাথে পলু। ডাক্তার জবাব দেয়, নীলুর পক্ষে মা হওয়া সম্ভব হবে না কোন কালেই। নীলু দেশে ফিরে যেতে রাজী হয় না। একটা বাচ্চা দ্ত্তক নেওয়ার পরিকল্পনা করে থেকে যেতে চায় কলকাতাতেই। নীলু শুনেছে, এখানে পথে ঘাটে মানুষের বাচ্চা পড়ে থাকে। একটা বাচ্চা নিজের জন্যে পেয়ে গেলেই ও দেশে ফিরে যাবে। নীলুকে একা ছাড়তে পলরু কিন্তু কিন্তু দেখে সুশীলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে নীলু এসে হাজির হয় আমার বাড়িতে। পরামর্শটি ছিল সুশীলবাবুরই।

শুরু হয় নীলুর খোঁজার পালা। কলকাতার হেন হাসপাতাল, এতিমখানা, হোম নেই যেখানে নীলু যায়নি একটি সদ্যোজাত শিশুর জন্যে। সঙ্গী কখনো সুশীলবাবু তো কখনো আমি। নীলুর মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সন্ধেবেলায় ক্লান্ত নীলু বাড়ি ফিরে চুপটি করে শুয়ে থাকে। কখনো গল্প করে, পুরনো দিনের। কলেজ জীবনের। পলুর কথা বলে। পলুর প্রতি এখন তার আর কোন রাগ-বিরাগ নেই। একটা অদ্ভুত নিরাসক্তি বোধ করে সে পলুর প্রতি। কোন অনুভূতিই আর যেন অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় তুমি আছো কেন পলুর সাথে? প্রশ্ন করে জবাব পেয়েছিলাম, কে জানে, কেন যে আছি নিজেও জানি না!

সুশীলবাবু একদিন খবর নিয়ে আসে, কলকাতার অদূরে বাটা'য় একটি অবিবাহিত মেয়ে সন্তানসম্ভবা। অতি নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েটিকে তার প্রেমিক বিয়ের প্রাতিশ্রুতি দিয়েছিল, বিশ্বাস করে সে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল প্রেমিকের বাহুতে, বিছানায়। সমস্ত প্রতিশ্রুতি সঙ্গে নিয়ে প্রেমিকপ্রবর হাওয়া সন্তান সম্ভাবনার খবর শোনামাত্রই। হাসপাতালে নিয়ে যায় মেয়েটির বাবা, ডাক্তার রাজী হয় না অ্যাবর্শন করাতে, মেয়েটির জীবনহানির আশঙ্কায়। উপায়হীন বাবা প্রায় একঘরে অবস্থায় অপেক্ষায় আছে, কবে বাচ্চাটি জন্মাবে, আর সে নিয়ে গিয়ে কোন হোমে দিয়ে আসবে। নীলু পৌঁছে যায় সেখানে, অনাগত সন্তানটি সে নিতে চায়, নিজের সন্তান পরিচয়ে মানুষ করবে সে। তারা রাজী হয়। বাচ্চা তো তারা কাউকে না কাউকে দিয়েই দেবে, ভালই হল। নীলু বাতাস সাঁতরে সেদিন বাড়ি ফিরে আসে। মাস দুই আরও অপেক্ষা করতে হবে, তা হোক! এতকাল তো নীলু অপেক্ষাই করে আছে। নাহয় আরও মাস দুই সই!

প্রায় প্রতিদিনই সকাল সকাল নীলু রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় হাওড়া ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে, সুশিলবাবুকে সঙ্গী করে সে পৌঁছে যায় মেয়েটির বাড়িতে। হাতে করে নিয়ে যায় নানারকম ফল, খাবার, জামা-কাপড়। স্থানীয় হাসপাতালে নীলু নিজে নিয়ে যায় মেয়েটির চেকআপ করাতে। সারাদিন কাটিয়ে সন্ধেবলায় বাড়ি ফেরে ক্লান্তমুখে উজ্জ্বল এক হাসি নিয়ে। নীলুর এই হাসি দীর্ঘস্তায়ী হয় না। পালিয়ে যাওয়া প্রেমিকপ্রবর ফিরে আসে, দায়িত্ব নিতে চায় তার পিতৃত্বের। খুশির ঢল নামে বাটা'র এক টালির চালের এক কামরার ভ্যানচালকের বাড়িতে। বাড়ির সামনের মন্দিরে পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা রাতারাতি মালাবদল করিয়ে দেয়, ছেলেটি তার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর আগেই।

একদিন সকালবেলা সুশীলবাবুই খবরটা নিয়ে আসে। নীলুর সে কি বুকফাটা কান্না। বিছানায় উপুড় হয়ে হাত চাপড়ে চাপড়ে কান্না মুখে আহাজারি। নীলুকে এমনকি সান্তনা দেওয়ার জন্যেও আমার মুখে কোন কথা যোগায়নি। ফোনে সুশীলবাবুই খবর দেয় পলুকে, নীলু এখানে প্রচন্ড আপসেট আর বাচ্চা পাওয়ার আশাও না এর বরাবরই। পলু পত্রপাঠ নীলুকে দেশে ফিরে যেতে বলে।

সর্বশেষ আশাটুকু বিসর্জন দিয়ে নীলু ফিরে যায় খালি হাতেই।

কিছুকাল নীলুর সাথে যোগাযোগ ছিল। মাঝে মাঝে চিঠি লিখত নীলু। চিঠিতে নানান কথা-গল্প করত নীলু কিন্তু নিজের কোন কথা লিখত না। আমি ঢাকায় গেলে নীলুকে দেখে আসতাম। সেই একই বাড়ির দোতলা- তিনতলায় নীলু আর রীমা থাকে যে যার মত। পারতপক্ষে কেউ কারোর মুখদর্শন না করলেও অতিথি অভ্যাগত এলে রীমা নেমে আসে নিচে, নীলুর ঘরে, ড্রয়িংরুমে বসে থেকে অতিথি আপ্যায়ণ করে। ছেলেটিই শুধু যখন তখন সব নিয়মভঙ্গ করে ঢুকে পড়ে নীলুর ঘরে মা মা বলে। পলু আর রীমার আরেকটি ছেলে হয়েছে শেষবার দেখে এসেছিলাম।


মন্তব্য

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

হেইল দি রাইটার!


মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

কিন্তু নামটা 'নীলু ও পলুর শেষ কথা' হলে ভাল হতো না?


মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

শ্যাজা এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।।

তাও করা যেত কিন্তু শেষ কথা বলে কি আসলেই কিছু আছে! আমার কথাটি এখানেই ফুরলো বটে কিন্তু ওদের কথা তো বহমান... বয়েই চলেছে...


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

হ্যাঁ...শেষ কথা বললে তাকে ওইখানেই রেখে আসা হয়।


মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো।
-নিরিবিলি

শ্যাজা এর ছবি

ধন্যবাদ নিরিবিলি।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

মুশফিকা মুমু এর ছবি

আপনার সিরিজটা এত্ত ভালো লাগল খুব খুব ভালো লাগল, আর খুব ভয় হয় নীলুর জাগায় আমি হলে কি করব ইয়ে, মানে... কখনও মা না হতেপারা ব্যাপারটা যে কি ভয়ংকর একটা মেয়ের জন্য সেটা হয়ত ছেলেরা কখনও বুঝবেনা।
---------------------------------------------------------
মূর্ছনা কেটে গেছে সুর
জোছনা ছড়ায় বেদনা, হৃদয় আনমনা ... চির চেনা তুমি অচেনা।

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

শ্যাজা এর ছবি

আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মুমু।

আপনি কেন নীলুর জায়গায় নিজেকে ভাবছেন। কেউ/ কারোর যেন নীলুর মত ভাগ্য বা পরিস্থিতি না হয়।

কি জানি। যে ছেলেটি বাবা হতে পারে না তারও হয়তো নিজেকে অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। মানুষ নিজেকে সম্পূর্ণ দেখতে পায় তার/তাদের আত্মজ- আত্মজা'র মুখে। ছেলে-মেয়ে বড় করার, মানুষ করার কষ্ট-আনন্দ দুইই তো বাবা, মা দুজনেই ভাগ করে নেয় কিছু বিশেষ ক্ষেত্র-পরিস্থিতি ছাড়া। নজমুল আলবাব বা সেলিনা তুলির লেখাগুলোয় সেটা কী ভীষণ পরিষ্কার ভাবে ফুটে ওঠে।

আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

সৌরভ এর ছবি

কষ্ট পাইলাম।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আজফারে কয়, পীরিত এক ফুরুত পাখি,
স্পর্শ রাখে, গন্ধ মাখে,
চুক্তি নেই তো পাকাপাকি।।
---
শ্যাজাদি, কেনো এতো মন খারাপ করে দেন?


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

শ্যাজা এর ছবি

এই লাইন গুলি কি কোন গানের বিব্লব'দা? আগে শুনি নাই।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

বিপ্লব রহমান এর ছবি

না, শ্যাজাদি। এটি বহুবছর আগে লেখক আজফার হোসেনের মুখে শোনা তার একটি অণুপদ্য।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

মধুশ্রী এর ছবি

শ্যাজু দি,
পড়ার পরে একসাথে মনখারাপ আর মুগ্ধতা এলো ।
এতো প্রাণছোঁয়া লেখা !
কিন্তু একটা কথা হাসি কমেন্টে দেখলুম লিখেছেন ...
"সচলায়তনে সবচেয়ে অচল সচল, কুইড়া সচলের কোন ক্যাটাগরি নাই? থাকলে আমি ফার্ষ্টো হইতাম নিশ্চিত "
-- এই পুরস্কারের জন্যে আমার দাবী কিন্তু সবচেয়ে আগে হাসি

মধুশ্রী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।