তবে শুনুন একটি খুনের গল্প...

সবজান্তা এর ছবি
লিখেছেন সবজান্তা (তারিখ: শুক্র, ২৮/১১/২০০৮ - ৯:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

০১


তারিখটা ছিলো ৬ই নভেম্বর, সাল ইংরেজী ২০০৮।

সে রাতে বাসা থেকে হলে গিয়েছিলাম আমাদের শেষ বর্ষের র‌্যাগের প্রোগ্রামে আনন্দ ফূর্তি করার জন্য। সারাদিনের ব্যস্ততায় আর কোন খবর শোনা বা দেখা হয় নি। হলে গিয়েই শুনলাম, আমাদের ব্যাচমেট সিভিলের ছাত্র ফয়সাল কুমিল্লার কাছে এক্সিডেন্ট করেছে। কতটুকু আহত তা কেউই কিছু বলতে পারলো না। তবে চমকে উঠলাম যখন শুনলাম এক্সিডেন্ট হয়েছে এসিডবাহী এক ট্রাকের সাথে, এবং ফয়সাল এবং বাকিরা এসিডদগ্ধ হয়েছে। চাঙ্খারপুলে রাতের খাওয়া সেরে, আরেক বন্ধুর সাথে গেলাম ঢাকা মেডিক্যালে। যেয়ে শুনতে পেলাম, ফয়সাল তখনো এসে পৌছেনি কুমিল্লা থেকে। কর্তব্যরত ডাক্তারের বেশ অপমান আর কটু কথা হজম করেও মোটামুটি ব্যবস্থা করে ফেললাম সবকিছু, যাতে কুমিল্লা থেকে এসে পৌছানো মাত্র আর এক সেকেন্ডও দেরি না হয়।

কিন্তু এত আয়োজন যার জন্য সে কোথায় ? সে তখনো আটকে আছে মেঘনা ব্রীজের কাছে কারণ ব্রীজের একাংশ আটকে ব্রীজের মেরামত কাজ চলছে। বুঝতে পারলাম না এরকম গুরুত্বপূর্ণ ব্রীজের মেরামত কাজ কত দিন ধরে চলে ! কারণ এই মেরামতের কথা শুনছি আজ অনেক দিন ধরেই। অসহায় হয়ে বসে যখন আমরা ভাবতে শুরু করেছি, কোনভাবে কাউকে একটু অনুরোধ করে ব্রীজের কাজটা সাময়িক বন্ধ রেখে অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না, তখুনি দেখতে পেলাম পরপর কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল চত্বরে ঢুকলো, সবকটার গায়েই কুমিল্লা লেখা।

০২


কুমিল্লা থেকে সে সময়ের রোগীদের অধিকাংশই এত বীভৎসভাবে পুড়েছিলো, যে আমরা কেউই তাকাতে পারছিলাম না। বিশেষত কয়েক মাস বয়সের একটা বাচ্চা এমন ভাবে ঝলসে গিয়েছে যে, দেখার পর আমাদের সবাই খুব অসহায় বোধ করতে শুরু করেছিলাম। এদের মধ্যে ফয়সালই একমাত্র নিজের পায়ে হেঁটে ঢুকতে পেরেছিলো হাসপাতালের কেবিনে। সে কারণেই কি না জানি না, রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় পর ফয়সাল সহ আরো অনেককেই হাসপাতালের দোতলায় মাটির উপর ঠাঁই দেওয়া হল। সে রাতের মধ্যে কোন রকমে তোষক, বালিশ এসব ব্যবস্থা করে কিনে এনে দিয়েছিলাম।

বার্ন ইউনিটের ডাক্তাররা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ঢাকা মেডিক্যাল ( কিংবা সরকারী মেডীক্যাল মাত্রই) এমন এক চমৎকার জায়গা, যেখানে কিছুই পাওয়া যায় না। পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার, সারা হাসপাতালে সবাই ছুটিতে। সমস্ত বার্ন ইউনিট ঘুরে একজন মাত্র নার্সকে পাওয়া গেল। যখন আমরা জানালাম ডাক্তার বলেছেন ফয়সালকে নিয়ে আই ইউনিটে যেতে, চোখ পরীক্ষা করাতে, সে স্পষ্ট অস্বীকৃতি জানালো। অগ্যতা আমরাই অনেক খুঁজে নোংরা একটা স্ট্রেচারে করে করে ফয়সালকে নিয়ে চললাম আই ইউনিটে।

ঢাকা মেডিক্যাল এক আশ্চর্য ভুল-ভুলাইয়া। কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আই ইউনিট। কাউকে জিজ্ঞেস করবো, সে উপায়ও নেই। শুক্রবার উপলক্ষে সবাই ছুটিতে। অনেক চেষ্টার পর যখন আই ইউনিটে পৌছালাম সেখানকার কর্তব্যরত সিস্টার খুবই তাচ্ছিল্যভরে আমাদের দেখে জানালেন, আজ এখানে কোন ডাক্তার নেই। কালকের আগে কিছু হবে না। বহু অনুরোধ উপরোধে অবশেষে একজন জুনিয়র ডাক্তার ( কিংবা ইন্টার্ন) যোগাড় করতে পারলাম, যদিও তিনি তেমন কিছুই প্রেসক্রাইব করতে পারননি সিনিয়র ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া।

যদিও বার্ন ইউনিটের ডাক্তাররা খুবই চমৎকারভাবে সাহায্য করেছেন, তবুও সম্পূর্ণ হাসপাতালজোড়া এরকম অসংখ্য দায়িত্বহীনতা, যেমন, যে কেউ রোগীর কাছে চলে যাচ্ছেন জুতো পায়ে দিয়েই কিংবা মেঝেতে রোগী শুয়ে আছে তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাছে তেলাপোকা কিংবা ইচ্ছামতভাবে ফিনাইল ছিটিয়ে চলছে মেঝে পরিষ্কার করা - এসবই আমাদের বাধ্য করেছিলো ফয়সালকে বেসরকারী সিটি হাসপাতালে স্থানান্তর করতে। কারণ যদিও ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট দেশের বৃহত্তম বার্ন ইউনিট বলেই জানি, তবুও এ অবস্থায় রোগী রাখলে ইনফেকশন ঠেকানো হয়ত সম্ভব হতো না।

সিটি হাসপাতালে প্রচুর টাকা লাগতো। আই সি ইউ তে বেড ভাড়াই দৈনিক দশ হাজার টাকা। এর সাথে আরো খরচ আছেই। টাকার জন্যও কিছু আটকে থাকেনি, আমরা সাধ্যমত তুলছিলাম। কিন্তু ফয়সালই আমাদের আর সুযোগ দিলো না।

০৩


এ কথা কখনোই হয়ত বলা যাবে না যে, ফয়সাল বেঁচে যেত শুরুতেই সিটি হাসপাতালে আনলে - তবে এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশের প্রসিদ্ধ এই মেডিক্যাল কলেজে যে পরিবেশে বার্ন এর ইমার্জেন্সী পেশেন্টদের চিকিৎসা করা হয়,তা সম্ভবত উন্নত বিশ্বের কোন ডাক্তার দেখলে মূর্ছা যাবেন। হয়তো এ পরিবেশই ফয়সালকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

সেই সাথে ধন্য আমাদের রাজনীতি আর আমাদের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া সংবেদনশীলতা। এই এক্সিডেন্টের দিনই খুব সম্ভবত দেশে এসেছিলেন "জননেত্রী" শেখ হাসিনা। নেত্রীর দেশে আগমনের খবরের তুলনায় এসব প্রাত্যহিক দুর্ঘটনার খবর খুব তুচ্ছ আমাদের মিডিয়ার কাছে। দুর্ভাগ্য আমাদের ! ফয়সালের চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করে একটা মানববন্ধন করেছিলাম আমরা। সেদিনই সুপ্রীমকোর্ট ট্রুথ কমিশন বাতিল ঘোষণা করেছিলো। "জনগুরুত্বপূর্ণ" এ খবরের কাছে মিডিয়ায় হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের এই সামান্য মানববন্ধন।

আজ ফয়সাল আর নেই। আমরা চেয়েছিলাম এসিড পরিবহনের এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচার হোক, তারা শাস্তি পাক। কিন্তু ফয়সাল এর মা শোকে মূহ্যমান। ওর অসুস্থ বাবাও শোকের ধকল সামলে উঠতে পারেন নি। শোক ভারাক্রান্ত আত্মীয়রাও ফয়সালকে হারিয়ে এ ধরণের পদক্ষেপ নিতে অনীহা বোধ করছেন। এসিড কোম্পানীর দায়ী কর্তা ব্যক্তিদের তাই কিছুই হবে না।

হ্যা, আমাদের নপুংসক রাষ্ট্রযন্ত্র একটা মামলা করেছিলো দুর্ঘটনার দিনই, কুমিল্লার বুড়িচং থানায়। সে মামলার ফলাফল কী হবে আমি, আপনি - সবাই জানি। এভাবেই পার পেয়ে যাবে খুনীর দল, এতগুলি প্রাণকে হত্যার পরও।

আমরা নিশ্চুপ বসে থাকবো। প্রতিদিন সকাল উঠে অপেক্ষায় থাকবো এভাবেই খুন হয়ে যাওয়ার...


মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

"শোকবার্তা নয় অবশ্যম্ভাবী পরিনতি" - নতুন এই ক্যাটেগরিটাই আমার মন্তব্য .... !!

রায়হান আবীর এর ছবি

পড়লাম ভাই...কিছু বলার নাই মন খারাপ

=============================

সবজান্তা এর ছবি

জানি কিছুই হবে না, তবু যতদিন এই দগদগে ঘা না শুকায় হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে না।

কিছুই কি করার নেই আমাদের ? এতগুলো খুনের কোন বিচার হবে না ?


অলমিতি বিস্তারেণ

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

ফয়সালের মৃত্যু- এ যেন স্রেফ "আরো একটি মৃত্যু"- মনে আঁচড় কাটে, কষ্ট দেয়, দেখবেন ধীরে ধীরে এই কষ্টের উপর নির্লিপ্ততার প্রলেপ পড়বে, দায়ীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াবে, আরো মানুষ "খুন" করবে, আমরা আবারও ক্ষুব্ধ হব, কষ্ট পাব, আবারও নির্লিপ্ততার চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যাব...

দুর্ভাগা ফয়সাল ভীষণ ভাগ্যবান যে আপনার মত, তারেকের মত বন্ধু পেয়েছে ও- যারা ওর মারা যাবার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়ে গেছে সামর্থের শেষ বিন্দু-টি দিয়ে।

আপনার কষ্ট, আপনার আক্রোশ- সবই ছুঁয়ে গেল। যে কোনও মৃত্যুতেই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে, আর তা যদি হয় ফয়সালের মতো ছেলেদের, তাহলে তা কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায়। এরকম দুর্ভাগ্য যেন আর কাউকে বরণ করতে না হয়। আমাদের ফয়সাল-রা যেন এভাবে অকালে ঝরে না যায়, এভাবে যেন আর কখনো আমাদের নিষ্ফল হা-হুতাশ না করতে হয়। কিন্তু সেইদিন কবে আসবে? অথবা আদৌ কি আসবে? আর এই হত্যার দায় রাষ্ট্র কি স্বীকার করবে? জানা নেই উত্তরগুলো...


A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?

তারেক এর ছবি

ফয়সালের জানাজার পরপরই আমরা স্কুলফ্রেন্ডরা মিলে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম ক্যাফে তে। যেন কিছুই হয়নি। খুব স্বাভাবিক থাকার অভিনয় হয়তো বা। কিন্তু কে জানতো আমরা অভিনয়ে এত কাঁচা?

আমি, আমরা বন্ধুদের নিয়ে বাঁচি। ওরাই আমার আশ্রয়। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে পার করে দিচ্ছি প্রতিটা দিন, তবু একা সময়গুলোতে ওর কথা মনে পড়ে। আমি টের পাই আমি প্রাণপনে ফয়সালকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছি সচেতনভাবে...

তবু আমার ফেইসবুকে ওর মুখটা হেসে ওঠে, জিমেইলে, ইয়াহুতে হঠাৎ হঠাৎ ওর আইডি টা চোখে পড়ে যায়... হলে ওর রুমে বিছানার উপর ওর জামাগুলো ঝুলছে আজও...

আমি ভাল থাকতে চাই... ভীষন ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চাই, সব বন্ধুদের নিয়ে।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

কুরুবক [অতিথি] এর ছবি

দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর অবস্থা আর বলার মত না।বাংলাদেশের মানুষ মরে জন্তু জানোয়ারের মত।তবে দু;খ হচ্ছে এই ভেবে dmcতে কি আপনাদের কোনো friend ছিল না?ওরা ভালো help করতে পারতো।

সবজান্তা এর ছবি

সুপ্রিয় কুরুবক, আমরা ডি এম সি তে যা সার্ভিস পেয়েছি তার নব্বই শতাংশেরও বেশি শুধু মাত্র বিভিন্ন ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও লিঙ্কের কারণে। সিনিয়ার ডাক্তার থেকে ছাত্রনেতা - সবই ব্যবহার করেছি। কিন্তু সে এক বিচিত্র জায়গা। সেখানে সবাই স্বাধীন। সেখানে কিছুই আসলে যথেষ্ট নয়...


অলমিতি বিস্তারেণ

Adnan Ibne Momin এর ছবি

valo lekha..... kharap lagey faisal er jonno.

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

ফয়সলের মতো কতো সম্ভাবনাময় মানুষ এভাবে অসতর্কতায় অবহেলায় বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। হয়ত আরও যাবে।
তবু আপনার মতো কিছু মানষেরা তো সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। এটাই করে যেতে হবে।
যদি একটি প্রাণও বাঁচানো যায় এই আশায়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

...

তানবীরা এর ছবি

ডি। এম। সির অভিজ্ঞতা আমার আছে। ভয়াবহ। আমার মেয়ে একবার ঢাকায় অসুস্থ হয়েছিল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল ধানমন্ডিতে ছিল। কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমি গেছি সেটা শুধু আমি জানি। লন্ডনে থাকলেও হয়তো আমি অসুস্থ মেয়ে নিয়েই রওয়ানা দিতাম। দেশকে আমি খুবই ভালোবাসি কিন্তু অসুস্থ হলেই মনে হয় কখন যাব। খুবই স্বার্থপর ভাবনা কিন্তু বিপদের পড়েলেই স্বার্থপর হয়ে যাই কেমন করে যেনো।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নকীব [অতিথি] এর ছবি

অপেক্ষায় আছি এভাবেই খুন হয়ে যাওয়ার জন্য............

রাবাব এর ছবি

হুমম।

কীর্তিনাশা এর ছবি

..........

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

কুরুবক [অতিথি] এর ছবি

কি আর বলবো !আমার নিজের মেডিকেলে আজকে সারা সকাল কাটলো এক ফ্রেন্ডের ভাঙ্গা পায়ের চিকিৎসা আর x ray করতে গিয়ে।

সব খানে গলা ফাটায় কথা বললে তারপর লোকজন কথা শোনে।

তবে অনুমান করতে পারছি সবাই যেখানে স্বাধীন সেখানকার অবস্থা আরও খারাপ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।