আত্মকথাগুলোকে কবিতা বলে ভ্রম হয়

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: বুধ, ২৮/০১/২০১৫ - ২:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

// পাথরের মত শীতল হৃদয়হীন কেন বল,
আমি তো দিনের শেষে হাত রেখে দেখেছি পাথরে জমে আছে উত্তাপ...
বিবর্ণ কেন শীতকাল, ধূসর সুন্দর একটা রঙ...কুয়াশার রঙ সাদা...
বেঁচে থাকতেই হবে যেকোন প্রকারেই,
কারণ অন্ধ কিংবা খঞ্জরাও গান গায়,
বহুদূরের মরে যাওয়া তারারাও রাত হলে দপদপ করে জ্বলে ওঠে...//

// কোটি কোটি নক্ষত্ররা বহুদূরে মরে গেছে, অথচ আমাদের আকাশে তারা আজও কী দারুণ সহাস্য দীপ্যমান।
মৃতরা বেঁচে থাকে কী ঊজ্জ্বল হয়ে দূরত্বে!
বিছানার চাদরে আঁকা আছে বিবিধ গাড়ির ছবি। গত রাতে স্বপ্নে দেখি, সাইকেল চালিয়ে আমি চলে যাচ্ছি চাঁদের দিকে।

দু"ডজন বই পড়ব এ বছর। বাসে পড়তে গেলেই ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। মুরাকামি আর কুন্ডেরা এখনও শেষ করা হল না তাই।

চেহারা মনে থাকে শুধু, নাম ভুলে যাই, গন্ধের কথা মনে এলে এখনও সুঘ্রাণ পাই।

বড় হওয়া আর হবে না আমার, বয়স বাড়তে বাড়তে আমি ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যাব।
যে মশাটাকে দেয়ালে পিষে দিই সে আমিই, যে মাছটাকে চিবিয়ে খাই সে আমিই।
ছাতিম ফুলের সুঘ্রাণ ভেসে আসে, জলের শব্দ আসে, পাখিদের কোন পাসপোর্ট লাগে না যেহেতু ঐখানে আকাশটা একটাই।
কোন কিছুই হয়ত সত্য নয়, পুরো ব্যাপারটাই আসলে একটা ইন্দ্রজাল।//

// হাতে সাবান মাখতে গেছি আর অমনিই মনে পড়ল বহুবছর আগে সাবানের ফেনায় ফু দিয়ে বেলুন বানাতে পারতাম আমি, ছিলাম আমি রঙধনুর কারিগর...
সেদিন ভাঁজকরা একটা রোলটানা পৃষ্ঠা টেবিলে একা পড়ে আছে দেখে মনে পড়ল বিমানগুলোর কথা যাদের আমি উড়িয়ে দিয়েছিলাম পাহাড়ের মাথা থেকে,ওদের কথা খুব মনে পড়ে এখন কারণ ওদের পাখায় আমি এঁটে দিতাম কোন অদ্ভুত খেয়ালে রঙিন ফুলের পাপড়ি...
গাড়ি থেকে গ্রামের বাজার দেখতে দেখতে হঠাৎ দৃশ্যপট বদলে যায়, এ বাজারে বহুদিন আগে আমি রোজ স্কুল ফেরার পথে ঢুঁ মারতাম ক্যাপস্ট্যান সিগারেটের প্যাকেটের খোঁজে, এক একটা প্যাকেট তখন বিকেলের চাকতি খেলায় হয়ে যেত শত টাকা...

সে গাছটির কথা মনে পড়ল এভাবে যার বাকল ছুরি দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে চিরে লিখে দিয়েছিলাম নাম...নামটা নিশ্চয়ই বুজে গেছে, নিশ্চয়ই।//

// গতকাল ভোরে বহুদিন পর কান্না পেল।
হয়ত অবচেতনায় একটা ধারণা ছিল খুব কাছের মানুষগুলোর বয়স বাড়ে না, তাঁরা অবিনশ্বর, তাঁদের অসুখ কিছুতেই কাবু করতে পারে না, তাঁদের শরীর শীতার্ত গাছের মত পত্রহীন ন্যুব্জ হতে পারে না।
কুয়াশার আবছায়ার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে বার দু'য়েক তাকাতে হল, নিঃসঙ্গ বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইতু, মোড়টা ফিরলেই আমরা আর কেউ কাউকে দেখতে পাবো না, চেঁচিয়ে বললাম," সাবধানে থেকো মা, ঔষুধ খেয়ো।"
শিউলি গাছের ডালটা তার ছুঁয়ে গেছে দেখে হাবলুকে ডেকে এনে ডালটা একদিন কাটিয়ে নিল মা। মা'র ধারণা না-ফোটা ফুলকলিদের অভিশাপ লেগেছে তার উপর। পুরী থেকে ফিরে আসার পর ইতু বলল," পড়ে গিয়ে মা'র চোট লেগেছে ভীষণ।"
মানুষের বিষাদমাখা মুখ দেখে পৃথিবীর হাসি বন্ধ হয়ে যায় না। ভোরের উপশহরের দোকানী দোকান খুলে বসে আছে, সাইকেল চালিয়ে বিনুনি দুলিয়ে দলবেঁধে ছুটছে কিশোরীরা, কয়লার মিষ্টি একটা গন্ধ জুড়ে আছে চায়ের টং ঘরগুলোয়, ভ্যানওয়ালা রাবারের ভেঁপুতে চাপ দিয়ে ডাক দেয়," ওই পটলা, কিরে রাত্তিরে ঘুমুসনি, নাকি?", ফুলের মালা হাতে চলছে একটা বাচ্চা আর কাছের মন্দির থেকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে একটা বিগ্রহ, মাঠে মাঠে ফুটে আছে সবুজাভ হলুদ সরিষার ফুল, একটা ছোট্ট মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল- তারপর ছুটে পালাল।

ওপার বাংলা এপার বাংলা।

যশোর এসে পৌঁছানোর পর মনে হল,অবচেতনার কুয়াশা থেকে চেতনার প্রচণ্ড রোদে যেন এসে পড়লাম। একজন পেপার খুলে পাশে বসেছিল, বাস জ্বলছে দেখলাম। বাইরে তাকালাম। কোথাও কোন কিশোরী স্কুলে যায় না, বিনুনী বাঁধতে জানে না তারা। পত্রিকার অন্য পাতায় দেখি, অঞ্জলী দেবীকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, ধর্ষণও রয়েছে একটু নীচেই।
ঢাকা পর্যন্ত পুরোটা পথে কোথাও চোখে পড়েনি একটা পাখি। ফুলের দোকান।
এ কেমন দেশ? প্রবল সোৎসাহে লোকজনকে দেখি রেলের লাইন কাটছে, এ ট্রেণে মানুষ বাড়ি যাবে মানুষের কাছে।
এই বিষন্নতা আর সইতে পারি না। অবিরাম ছাইবৃষ্টিতে ডানাভেঙ্গে যাওয়া অসহায় পাখির মত হয়ে গেছি। যারা চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও, তাদের পিঠ চাপড়ে দিই," বেঁচে গেছিস, বেঁচে থাকিস।"
জেঠিমা'র মত সেই মহিলার ছবি মনে ভেসে ওঠে, দত্তপুকুরে যিনি স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন আর পেছনে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিল জেঠুর মত একজন কেউ।
কোথাও চলে যেতে হবে অতি শীঘ্র, শিউলি ফুলের বীজ সাথে নিয়ে। //

// কখনও কি ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকেছ তুমি ঘুঘুপাখি?
নদী, কোনদিন বৃষ্টির পর তোমার জ্বর হয়েছিল কী মাঝরাতে?
এইসব প্রশ্নগুলো নিয়ে সকালের পর দুপুর, বিকেলের পর রাত আসে- শীতকাল চলে যায়।
জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় দেখি বৌগেনভিলিয়ার ডাল, তাতে আমার বিকেলের মন শান্ত হয়ে আসে;
দূরের কোন শহরে তুষার ঝরছে এখন চুপচাপ, চুপচাপ।
ল্যাম্পপোস্টের নীচে ঘুমিয়ে থাকে যে বুড়ো তার মুখের উপর আর আলো ফেলবে না আজ চাঁদ।
পৃথিবীর সর্বত্র খেলা করে যায় অবিশ্রান্ত হাওয়া, যুদ্ধ আর প্রেম।
একদিন আমি খুব উঁচু পাহাড়ে উঠে মেঘ ছুঁয়ে দেখেছি এ আসলে ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু নয়। //


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

বাঃ! অবশেষে মুগ্ধতা নিয়ে আজ ঘুমাতে যাবে এ জ্বর-তপ্ত ক্লান্ত শরীর।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

সুন্দর।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি কি মনে করেন কবিতা আত্মকথন ভিন্ন অন্য কিছু ?
-নাজিয়া ফেরদৌস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।