সায়র

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: রবি, ১৫/১২/২০১৩ - ৪:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দরজা খুলল সুচরিতা, জয়ন্তের আগেই আজ বাসায় এসে পৌঁছেছে সে। দু’জনের কাছেই দু’টো চাবি থাকে, যদিও বাড়িওয়ালা তাদের একটিই চাবি দিয়েছিল বাসা ভাড়া নেয়ার সময়। তখন অবশ্য সুচরিতার চাকরীটা হয়নি। প্রথম দিকে চাবি একটা থাকায় বেশ অসুবিধা হত সুচরিতার, জয়ন্ত’র আগেই কখনও কখনও অফিস শেষ করে তিনতলা ভেঙ্গে বাসায় এসে সিঁড়ির উপর বসে থাকতে হত ওকে। জয়ন্ত না আসা পর্যন্ত কারও বাসায় গিয়ে যে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আসবে সে ইচ্ছেটুকুও করত না তখন তার। দোতলার শায়লা আপা একদিন ছাদ থেকে কাপড় আনতে গিয়ে সিঁড়িতে ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে জোর করে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। চাবি দু’টো করার কথাটা বাড়িওয়ালাকে ওরা জানায়নি লোকটা যদি আবার এই অজুহাতে কিছু একটা বলে বসে এই ভয়ে। সুচরিতা জয়ন্ত দু’জনেরই এই একটা জায়গায় অসম্ভব মিল। দুনিয়ার কাউকে পারতপক্ষে না ঘাঁটিয়ে জীবনটা যাপন করে যেতে পারলেই তারা খুশি। সোফার উপর ব্যাগটা রেখেই জয়ন্ত শার্টের হাতা আর বুকের বোতাম খুলতে খুলতে বাথরুমে ঢুকল। এই শহরে দিনে দু’বার স্নান করতেই হয় ওদের, কখনও কখনও তিনবার। কলে পানি থাকে না সবসময়, দু’টো বড় বড় প্লাস্টিকের ড্রামে তাই তারা পানি ধরে রাখে সকালে উঠে। ছোট একটা বাসা, বলার মত আছে কেবল খোলা একটা বারান্দা, ওখান থেকে আশপাশটা একটু দেখা যায়। ছুটির সন্ধ্যাগুলোয় দু’জন কোথাও না গেলে বারান্দাতে চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে বসে ওরা চা খায় আর খোলা আকাশটা দেখে। সুচরিতা কাপড় শুকোয় এখানে, কোনায় একটা ছোট মাটির টবে একটা তুলসীর চারা। বাথরুম থেকে হুট করে বেরিয়ে জয়ন্ত বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলে, ‘ তোয়ালেটা না নিয়েই ঢুকে পড়েছিলাম, ওটা কী করছ তুমি, রিতা, বেশ গন্ধ তো!’ সুচরিতা মনে হল না কথাটা শুনল, কিন্তু সাথে সাথেই জয়ন্ত যখন একটু গলা চড়িয়ে বারান্দার ওদিক থেকে বলে উঠল, ‘ এটা কে এনেছে এখানে? তুমি এনেছো এই পাখি এখানে রিতা?’ সুচরিতা রান্নাঘর থেকে না বেরিয়ে পারল না। কিন্তু জয়ন্তর চোখে একধরনের তীব্র বিরক্তি আর রাগ দেখে সে একটু অবাকই হল, ‘ হুম, সায়রটা সুন্দর কথা বলতে পারে, অফিস থেকে আসার পথে এক জায়গায় দেখে মজা লাগল, ভাবলাম কিনে নিয়ে যাই, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেয়া হবে।’ ‘সারপ্রাইজ! আজ কি আমার জন্মদিন যে তুমি আমাকে সারপ্রাইজ গিফট দেবে? রিতা, পাখিটা তুমি ফিরিয়ে দিয়ে এসো কাল, আই ডোন্ট ওয়ান্ট দ্য বার্ড টু টক ননসেন্স এরাউন্ড মাই ইয়ারস। আর তোমার যদি ওটা পাখিওয়ালাকে ফিরিয়ে দিতে লজ্জ্বা লাগে তবে আমিই আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছি ওটা এখন।’ সুচরিতা জয়ন্ত’র এই রাগের কোন অর্থ খুঁজে না পেয়ে মেঝেতে চামচ গড়িয়ে পড়া তেলের দিকে তাকিয়ে রইল এক মূহুর্ত, তারপর বলল, ‘ কিন্তু, তুমি এত ক্ষেপছ কেন জয়ন্ত বল তো, পাখিটা তো বারান্দাতেই থাকবে, ঘরে অনেকে পেট রাখে না? তাছাড়া একটা কথা বলা পাখি তো খুবই ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা, ঠিক আছে, ওটার দেখাশোনা আমিই করব, তোমাকে কোন ঝামেলা পোহাতে হবে না।’ সুচরিতা আর জয়ন্ত’র মধ্যে যে মাঝেসাঝে কথাকাটাকাটি হয় না তা নয়। হয়, বেশ হয়। তবে ওরা দু’জনের কেউউ বেশীক্ষণ ঝগড়া চালিয়ে যেতে পারে না। কেউ একজন বলেই ফেলবে, ‘ আচ্ছা বাবা তুমিই ঠিক। হল তো?’ সুচরিতার কথায় মনে হল জয়ন্ত আরও একটু বেশীই উত্তেজিত হয়ে গেল, বলল, ‘ তা নয় রিতা, দেখাশোনা করাটা কোন ফ্যাক্টর নয়। তোমার কাছে যেটা ইন্টারেস্টিং আমার কাছে সেটা খুবই কষ্টকর। ইউ কুড হ্যাভ কলড মি বিফোর বায়িং দিস বার্ড।’ ‘ কী হয়েছে বল তো দেখি জয়ন্ত, একটা সায়র তোমাকে কী কষ্ট দেবে এমন, মাঝে মাঝে তোমার নাম ধরে রাত বিরেতে ডাকবে এই তো?’ তোয়ালেটা কাঁধের ওপর ফেলে জয়ন্ত বারান্দা থেকে বসার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘ তুমি তো বাবার ব্যাপারটা জানো রিতা, দেয়ার ওয়াজ আ স্টোরি, এই পাখিটা আমাকে সেটা মনে করিয়ে দিল। এদিকে এসো, তোমাকে অনেককিছু বলা বাকী রয়ে গেছে আমার।’

সুচরিতা রান্নাঘরে ঢুকল আবার, চুলোটা নিভিয়ে খাবারটা নামিয়ে বসার ঘরে এসে দেখল জয়ন্তর চোখে-মুখে পৃথিবীর গভীরতম বিষাদ। ভালবেসে বিয়ে করেছিল ওরা। জয়ন্ত কখনও কিছুই লুকোয়নি তার কাছে। তবে, কী সেই কথা যা জয়ন্ত’র ওকে বলা হয়নি, তাও আবার একটা পাখি নিয়ে? শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল সে, ‘ বল জয়ন্ত।’ জয়ন্তের গলাটা ভাল, তবে কখনও ও খুব ইমোশনাল হলে ওটা ক্র্যাক করে। ‘ রিতা, মা কি তোমাকে কখনও বলেছিল বাবা কীভাবে মারা গিয়েছিলেন?’ সুচরিতা জয়ন্তের আর্দ্র গলা শুনে একটু ঘাবড়ে গেল, উৎকন্ঠিত হয়ে বলল, ‘ হুম, মা একদিন বলেছিল, বাবাকে ১৪ই ডিসেম্বর রাজাকারেরা খুন করেছিল। কিন্তু ঘটনাটার ডিটেলস উনি আমাকে কিছু বলেন নি। আমিও বেশী কিছু জানতে চাইনি কোনদিন। কিন্তু বাবার মৃত্যুর সাথে পাখির কি সম্পর্ক?’ সুচরিতার কৌতুহলী চোখের দিকে না তাকিয়ে মেঝেতে জমে থাকা কয়েক ফোঁটা তেলের দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘ বাবাকে আমি কখনও চোখে দেখিনি রিতা। তোমাকে এই কথাটা কখনও আমার বলা হয়ে ওঠেনি। আমি কখনও কাউকে বাবাও ডাকতে পারিনি। মা বলেছিল, বাবাকে যখন ওরা মেরে ফেলেছিল তখন নাকি আমি মা’র পেটে। আমার বাবাকেও তাঁর সন্তানটিকে না দেখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নি্তে হয়েছিল।’ সুচরিতা জয়ন্তর হাতে হাত রাখে। চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। জয়ন্ত বলে চলে, ‘ মা’র কাছেই শুনেছি, বাবা নাকি খুব সুন্দর, ফর্সা ছিল। ছবিতে দেখেছি বাবার চোখে চশমা, মাথাভরা চুল। বাবা নাকি সায়র পুষত। খুব ভালবাসত এই পাখি। আর পাখির মুখে বোল ফোটাত নানা রকমের। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবার বাড়ির সবাই ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল, বাবা যায়নি, মাকে ঐ অবস্থায় নিয়ে তিনি ছুটোছুটি করতে রাজী হননি। মাকে নিয়ে উনি রয়ে গিয়েছিলেন দাদুর বাড়িতে। ঐ বাড়িতে নাকি মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝে এসে লুকিয়ে থাকত। বাবা অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে এরকম কথা মা আমাকে কিছু বলেনি। দাদু একবার বলেছিল বাবা গান লিখে মুক্তিযোদ্ধাদের দিত। কতটুকু সত্যি কে জানে। বাবার সায়রটা নাকি ‘জয় বাংলা’ বলতে পারত। বাবাই শিখিয়েছিল।’ জয়ন্ত বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে, সুচরিতা একটু চমকে ওঠে। ‘আমাদের গ্রামে মিলিটারি গিয়েছিল অনেক পরে। রাজাকারেরা এসে বাড়ি বাড়ি আগুন দিয়ে যেত। আর লুট করত। যে রাতে মিলিটারিরা দাদুর বাড়িতে এসেছিল সেদিন নাকি মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে ছিল ধানের গোলাঘরে। দাদু স্কুলে উর্দু পড়াতেন। মিলিটারিরা নাকি দাদুর কথায় আশ্বস্থ হয়ে চলে গিয়েছিল। মিলিটারিরা যখন গ্রামে ঢুকত তখন মা’রা খাল পেরিয়ে বোয়ালখলি ঢুকে পড়ত, করলডেঙা নামের একটা পাহাড়ে সবাই চলে যেত। বাবা যেখানেই যেত সায়রটাকে সাথে সাথে রাখত। তুমি জানো রিতা, পাখিটার নাকি বাবা নাম দিয়েছিল জয়ন্তী। আমার নামটা নাকি বাবা ঠিক করে রেখেছিলেন আগে থেকেই। সায়রের নামের সাথে মিল রেখে।’

জয়ন্ত’র গলাটা যেন আরও আর্দ্র হয়ে উঠে। সুচরিতা বলে, ‘মা আমাকে এতসব কখনও বলেনি।’ ‘বলেনি কারণ বাবার মৃত্যু হয়েছিল অবর্ণনাতীতভাবে। ডিসেম্বরের দিকে দাদুর গ্রামে রাজাকারেরা নির্মম অত্যাচার চালায়। মা’র শরীর তখন খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। মা’কে তাই দিদিমার সাথে বড়ুয়া পাড়ায় রেখে এসেছিল বাবা। বড়ুয়া পাড়ায় মিলিটারিরা যেত না। ১৪ই ডিসেম্বর দাদুর বাড়িতে আসে রাজাকারেরা। কীকরে যেন তারা খবর পেয়েছিল বাবার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ আছে। বাবা ধানের গোলাঘরে লুকিয়ে ছিল। জয়ন্তী নামের সায়রটাও নাকি বাবার সাথেই ছিল। সারা বাড়ি অনেক খুঁজেও কাউকে না পেয়ে ওরা যখন চলে যাচ্ছিল তখন পাখিটা ডেকে উঠেছিল নাকি ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ বলে। সেই ডাকটা বাবা বা পাখিটা কেউউ বন্ধ করতে পারেনি। গোলাঘর থেকে পালিয়ে যেতে পারেনি বাবা। রাজাকারেরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে দাদুর সামনে। অনেক নির্যাতন করে ওরা বাবাকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বের করে ফেলেছিল ওরা বাবা’র চোখ। দাদু বলেছিল, যারা বাবাকে মারছিল ওদের অনেকেই নাকি ছিল বাবার সাথে স্কুলে পড়ত। বাবাকে ওরা দাদুর সামনেই গুলি করেছিল, তার আগে বেয়নেট দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে গেছে বাবার ফর্সা শরীরটাতে। আমার মা বাবার সেই চক্ষুহীন, ক্ষতবিক্ষত মৃত শরীরটা দেখেনি। দিদিমা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। ‘জয় বাংলা’ বলা সায়র পাখিটা্র গলা একদিন চরম উন্মত্তাবস্থায় উনি নাকি বটি দিয়ে কেটে ফেলেছিলেন। আমার জন্ম হয়েছিল ১০ জানুয়ারি। তখন যুদ্ধ শেষ। জন্মেই আমি একটা স্বাধীন দেশ দেখি, বাবাকে দেখিনি কোনদিন।’

জয়ন্ত থামল। মেঝেতে তেলের ফোঁটাগুলোর পাশে জমে গেছে জলের ফোঁটা। সুচরিতার গাল বেয়ে কখন যে অশ্রুধারা নেমে গেছে খেয়ালই করেনি জয়ন্ত। বলল, ‘দ্যাটস ওয়াই আই কান্ট স্ট্যাণ্ড এনি টকিং বার্ড রিতা। তুমি হয়ত ভালবেসেই পাখিটাকে রাখতে চেয়েছ ঘরে। কিন্তু আমি বারান্দাতে গিয়ে পাখিটার দিকে তাকাতেই মনে হল খাঁচার ভেতর বসে আছে ফর্সা একটা লোক, নাকের উপর চশমা আঁটা, কিন্তু কোটরে কোন চোখ নেই।’ সুচরিতা উঠে গিয়ে বারান্দায় গেল। খাঁচাটার ঝাঁপটা খুলে ভেতরে হাত দিয়ে সায়রটাকে বের করে আনল সাবধানে। সন্ধ্যার আকাশে আলো আর খুব বেশী অবশিষ্ট নেই। তুলসী পাতাগুলো বাতাসে কাঁপছে তিরতির করে। দূরের মাঠটাতে এখনও ক্রিকেট খেলছে ছেলেগুলো। পাখিটাকে ছেড়ে দিতেই মূহুর্তেই কোথায় যেন সেটি উধাও হয়ে গেল, সুচরিতার মনে হল, কোথাও যেন কেউ ডেকে উঠল ‘জয় বাংলা’।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কোথাও যেন কেউ ডেকে উঠল ‘জয় বাংলা’।

চলুক

শব্দ পথিক

অমি_বন্যা এর ছবি

ছুয়ে গেল দাদা। একাত্তর দেখিনি তবে এইসব লেখনি আমাদের দেখিয়ে সেইসব বীভৎসতা ।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক
জয় বাংলা

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

উত্তম জাঝা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।