অসমাপ্ত অশেষ সুন্দর

সুমন তুরহান এর ছবি
লিখেছেন সুমন তুরহান [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৭/০২/২০১২ - ৭:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তাঁর কথা ভাবতে চাইনা, ভাবতে ভালো লাগেনা। তবু প্রতি ফেব্রুয়ারি শেষে আত্রান্ত হই তীব্র নীরর্থকতাবোধে, দিগন্ত জুড়ে নেমে আসে মহাজগতের মতো বিপুল অন্ধকার; কোনো রাতও অতো অন্ধকার নয়। রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোকটুকুও আর নেই। আর ফেরা নেই, আর অগ্রগতি নেই, চিরকালের মতো থেমে গেছে তাঁর মৃত্যুহীন প্রাণ। আর কখনো তিনি নিঃশ্বাস নেবেন না; আলো তাঁকে আর চকিত করবেনা; তাঁকে সুখী করবেনা নক্ষত্র, শিশির, ঘাসফড়িং, ইন্দ্রিয়, নদী বা নারী; তাঁর অনন্য মগজে সাড়া দেবেনা বর্ণমালা আর ধ্বণিপুঞ্জ; খাবার খুঁজতে এসে ফিরে যাবে উদাসীন দাঁড়কাক।

তাঁর কথা ভাবতে চাইনা, ভাবতে ভালো লাগে না। তীব্র শুন্যতা ঘিরে ধরে চারপাশ।

সংঘটিত হয়েছে একটি অসামান্য জীবনের ট্র্যাজিক পরিসমাপ্তি; আমাদের নষ্ট অসভ্য ইতর জংলি মূর্খধর্মগ্রস্থ, বর্বরশাসিত সমাজরাষ্ট্র তাঁকে বেঁচে থাকতে দেয়নি। কিন্তু তাঁকে কি আরো আগে স্তব্ধ করে দেয়া যেতো না? তিনি কি চিরকাল প্রথা, কুপমন্ডকতা, আর সংস্কারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন না? বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের মাঝে আর কেউ তাঁর মতো স্পষ্টভাষী ছিলেন না, আর কেউ এমন তীব্র ভাষার শানিত চাবুকে বাঙালিকে চাবকানোর সাহস করেন নি। আমাদের দুর্বল, আপোষকামী প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিরা সাধারণত ধর্মীয় কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা নিয়ে দু’চারটি কথা বলেই উপসংহারে পৌছে যান। শুধু তিনি ছিলেন অনন্য ব্যতিক্রম; শুধু কুসংস্কারকে আক্রমণ করেই দায়িত্ব শেষ করেন নি, খোদ বিশ্বাস আর সংস্কারের গায়ে করেছেন আঘাতের পর আঘাত। প্রায় ৭০টি গ্রন্থের অজস্র পৃষ্ঠায় তিনি ছিন্নভিন্ন করেছেন প্রতিক্রিয়াশীলতার যুগযুগলালিত দূর্গ। তাঁর সৃষ্টি আলোড়ন জাগিয়েছে প্রচণ্ড, বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে তীব্র; এবং বছরের পর বছর তিনি ছিলেন আমাদের পাঠক ও জাগ্রত চেতনার মধ্যে।

প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন আমাদের একমাত্র প্রথাবিরোধী। চুড়ান্ত বাকদক্ষ তাঁর বক্তব্যে আক্রান্ত হয়েছে ধর্ম, ঐতিহ্য, পুরুষতন্ত্র - এমন আরো অনেক সামাজিক আবর্জনা। আরো অনেক বিভ্রান্তিকর, তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিগণ, যাদের লেখকজীবন ও ব্যক্তিজীবনের মাঝখানে বাস করে অসততার মহাসাগর, তাদের তুলনায় তিনি ছিলেন সৎ ও সুস্পষ্ট। তাঁর সাথে মুখোমুখি দেখা করার আগে তাঁকে ঘিরে আমার মধ্যে বাস করতো রহস্য, মনে হতো এই মানুষটি আলো আঁধারির সান্ধ্য রহস্যঘেরা এক কবি। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই আবিষ্কার করি তিনি কোনো রহস্যময় ঐন্দ্রজালিক নন, তাঁর সবটাই ভোরের আলোর মতো স্বচ্ছ। তিনি একজন সুস্পষ্ট মানুষ, যাঁর লেখা কথা কাজ বক্তব্য ও জীবনধারণ পদ্ধতি সুস্পষ্ট। কিছুটা উদ্ধত মনে হয়েছিলো তাঁকে, কিন্তু প্রতিভার ঔদ্ধত্যে সততা যতোটা প্রকাশিত হতে দেখি, প্রতিভার বিনয়ে কি ততোটা দেখি? বিনয় আর সুবিধাবাদের মাঝে রয়েছে কি কোনো সূক্ষ্ম যোগাযোগ?

একথা দিবালোকের মতো নিশ্চিত জানি, প্রথা ও প্রতিক্রিয়ার কালো দানবিক সুর কখনো তাঁর ভেতরে প্রবেশ করেনি। তাঁকে ঘিরে ধরেনি সুবিধার সোনালি খড়কুটো, যেমন ঘিরে ধরেছিলো আরো অনেককে। শুধু তিনিই সাফল্যের ক্ষুদকুড়ো ভিক্ষে চান নি কোনো দল, সংঘ বা গোত্রের কাছে। মূর্খদের রচিত ইতিহাসে তিনি হয়তো বহুকাল ‘বিতর্কিত লেখক’ হিসেবেই আখ্যায়িত হয়ে থাকবেন, তিনি বলতেনও তাঁর সম্পর্কে এই নিরর্থক বিশেষনটি বেশ প্রচলন পেয়েছে; তবে সভ্যতার বিকাশের জন্যে বিতর্ক খুবই দরকার।

প্রথাগত বাঙালিত্বের সীমানা পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক; সমালোচনা সাহিত্যে এনেছিলেন নতুন মাত্রা, চিরে দিয়েছিলেন নিম্নমানসম্পন্ন জনপ্রিয়দের খোলস। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা তুলনামূলক সাহিত্যে প্রগতিশীল ও প্রগতিবিরোধী ধারার পার্থক্যকে। তাঁর সেই সমালোচনা সুখকর মনে হয়নি আল মাহমুদ, সৈয়দ আবুল আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ'র মতো আরো অনেক কবিযশোপ্রার্থীদের কাছে।

চারিদিকে তিনি যখন দেখেছেন ভয়, স্থবিরতা ও শ্বাসরুদ্ধকরতা তখন তিনি কথা বলেছেন। যখন সকলে চোখ বুজে আরাধনা করেছেন প্রতিক্রিয়ার তখন তিনি কথা বলেছেন। যখন চারিদিকে চলছিলো মুদ্রিত মিথ্যাচারের মহোৎসব তখন তিনি প্রতিবাদ করে উঠেছেন। তাই অনেকে তাঁকে বলতেন ‘সাহসী'। তিনি বলতেন, আমাদের মাতৃভূমি আজ এতোটাই নষ্ট যে, অকপট সত্য কথা বলাও এখানে সাহসের পরিচায়ক। যেখানে রাষ্ট্র প্রথাবাদী, মানুষ সৃষ্টিশীলতাহীন, সমাজ নৈতিক দুর্দশাগ্রস্থ সেখানে সত্য বলা টাওয়ারের বিশতলা থেকে লাফিয়ে পড়ার চেয়েও বিপদজনক।

আমরা কি তাঁর মতো স্বাভাবিক সত্য বলতে পারি?

কবিতায় তিনি ছিলেন আমাদের আধুনিকতম প্রতিনিধি। জনপ্রিয় শ্লোগান বা স্তুতি রচনা করেননি তিনি, কবিতার নামে পদ্য দিয়ে প্রতারণা করেননি আমাদের চিরপ্রতারিত বিহ্বল পাঠককে। তাঁর কবিতাই পাই ভাষিক বিশুদ্ধতার সুস্থতম সৃষ্টিশীল রূপ, পাই এ-সময়ের শ্রেষ্ঠ আবেগ উপলব্ধি কামনা বাসনা হতাশা ও সৌন্দর্যবোধ। সমকালীন সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতা নামে পচাগলা দুর্গন্ধময় আবর্জনাসমষ্টি হয়ে উঠেছে তাঁর সুতীব্র ব্যঙ্গ আর আক্রমণের লক্ষ্য। ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ও প্রতিবাদকে তিনি এমন শৈল্পিক অথচ আন্তরিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতায়, যার তুলনা পাইনা। শুধুমাত্র খ্যাতির জন্যে তিনি প্রলাপ ও কবিতাকে এক করে দেখেননি, দাবি করতেন, তিনি ভোগেন নি বাঙলা কবিতার এই জনপ্রিয়তম রোগে।

পিঠে কূঁজ বেছে নিতে পছন্দ করেন আমাদের বুদ্ধিজীবিরা, কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন কুঁজের বদলে ছুরিকাকে, অস্বীকার করেছিলেন মাথা নিচু করে দাঁড়াতে। আমাদের বর্বর সমাজরাষ্ট্র কেঁপে কেঁপে উঠেছে তাঁর লেখায়, আতঙ্কিত হয়েছে জঘন্য মৌলবাদ। এই পঙ্গু, নষ্ট, বিষাক্ত, বিশ্বাসঘাতক রাষ্ট্র পারে শুধু একজন মুক্তচিন্তককে ছিন্নভিন্ন করে দিতে, ভয়াবহ হিংস্র নেকড়েচালিত রাষ্ট্রের কাছে এরচেয়ে উন্নত সংস্কৃতি কি করে আশা করতে পারি? চারপাশে যখন ভেজাল মূর্খ ভণ্ড কপট সুবিধাবাদী ও দালালদের গলা ভরে গেছে বাৎসরিক সোনার পদকে, তখন আক্রান্ত হয়েই পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি।

মৃত্যুকে তাঁর মতো কবিতাময় করে তুলতে কে পেরেছে?

স্বর্গনরক নেই, আমরা কেউ স্বর্গে বা নরকে যাবো না, কিছুদিন শুয়ে থাকবো নিজ নিজ গোবরগাদায়। আমি জানি, ভালো করেই জানি, কিছু অপেক্ষা করে নেই আমার জন্যে; কোনো বিস্মৃতির বিষন্ন জলধারা, কোনো প্রেতলোক, কোনো পুনরুত্থান, কোনো বিচারক, কোনো স্বর্গ, কোনো নরক; আমি আছি, একদিন থাকবো না, মিশে যাবো, অপরিচিত হয়ে যাবো, জানবো না আমি ছিলাম। নিরর্থক সব পূণ্যশ্লোক, তাৎপর্যহীন প্রার্থনা, হাস্যকর উদ্ধত সমাধি; মৃত্যুর পর যেকোনো জায়গাই আমি পড়ে থাকতে পারি,- জঙ্গলে, জলাভূমিতে, পথের পাশে, পাহাড়ের চূড়োয়, নদীতে। কিছুই অপবিত্র নয়, যেমন কিছুই পবিত্র নয়; কিন্তু সবকিছুই সুন্দর, সবচেয়ে সুন্দর এই নিরর্থক তাৎপর্যহীন জীবন। অমরতা চাইনা আমি, বেঁচে থাকতে চাইনা একশো বছর; আমি প্রস্তুত, তবে আজ নয়। চলে যাওয়ার পর কিছু চাই না আমি; দেহ বা দ্রাক্ষা, ওষ্ঠ বা অমৃত; তবে এখনি যেতে চাইনা; তাৎপর্যহীন জীবনকে আমার ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে আমি আরো কিছুকাল তাৎপর্যপূর্ণ করে যেতে চাই। আরো কিছুকাল আমি নক্ষত্র দেখতে চাই, নারী দেখতে চাই, শিশির ছুঁতে চাই, ঘাসের গন্ধ পেতে চাই, পানীয়র স্বাদ পেতে চাই, বর্ণমালা আর ধ্বণিপুঞ্জের সাথে জড়িয়ে থাকতে চাই। আরো কিছুদিন আমি হেসে যেতে চাই। একদিন নামবে অন্ধকার- মহাজগতের থেকে বিপুল, মহাকালের থেকে অনন্ত; কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি আরো কিছুদূর যেতে চাই।

(আমার অবিশ্বাস)

তাঁর কদর্য মৃত্যুদাতারা যখন হারিয়ে যাবে ইতিহাসের কালো গর্ভে, তখন তাঁর বিপুল রচনাবলী বদলে দিতে থাকবে আমাদের মননরাজ্য, ঘটাবে চিন্তার বিপ্লব। তিনি আলো জ্বেলে যাবেন হাজার বছর ধরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, শতাব্দীপরম্পরায়।

তিনি হুমায়ুন আজাদ; মৃত্যুঞ্জয়ী।

-------------------------------

(২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২, হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদী দানবগোষ্ঠীর আক্রমণের ৮ বছর পূর্তি স্মরণে।)


মন্তব্য

উজানগাঁ এর ছবি

অসম্ভব ভালো লাগলো লেখাটি। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে কিছু বলতে কিংবা লিখতে গেলেই কী এক ভীষণ আবেগ ভর করে আমার মধ্যে। খুব পছন্দের মানুষ/লেখক ছিলেন তিনি।

সুমন তুরহান এর ছবি

আর কোনোখানে নয় শুধু রাড়িখাল এলে
মুহূর্তে আমাকে ঢেকে ফেলে
প্রাচীন কুয়াশা। যে আমাকে জন্ম দিলো হাঁটতে শেখালো
সে-ই আমাকে দেখায় আজ কবরের কালো।
আমার অপরিচিত আজ রাড়িখালে যা কিছু জীবিত,
শুধু চেনা তারা যারা অস্তমিত
একদিন যা ছিলো এখন যা নেই।
যাদের সৌন্দর্য দেখে বেড়ে উঠলাম তারা অনেকেই
অন্ধকার, যারা আছে তারাও অসম্ভব ভীত
না থাকার ভয়ে, তারা অত্যন্ত পীড়িত।
যে-যুবকেরা একদিন বেড়ার আড়ালে
হঠাৎ জড়িয়ে ধ'রে চুমো খেতো অনিচ্ছুক যুবতীর গালে,
রাখতো হাত বুকে, তারা আজ নিস্পৃহ কঙ্কাল।
যা ছিলো এখন নেই তাই আজ আমার ভেতরে রাড়িখাল।
আমাকে ঘিরেছে আজ কাল আর কুয়াশার রীতি,
না থাকাই সত্য আজ, সত্য শুধু একে একে অনুপস্থিতি।

(রাড়িখাল এলে / কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু / হুমায়ুন আজাদ)

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

অরফিয়াস এর ছবি

হুমায়ুন আজাদ অজেয় অক্ষয় হয়ে থাকবেন তার লেখায়, নষ্ট সমাজ আর নষ্ট ধর্ম জীবনকে যতই কলুষিত করুক না কেনো, কখনই অমর হতে পারবেনা, কিন্তু তার সাহিত্য অমর হয়ে থাকবে।

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

চরম উদাস এর ছবি

লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই বলার নেই

সুমন তুরহান এর ছবি

উদ্যত তোমার দিকে একনায়কের পিস্তল বেয়নেট ছোরা।
স্বপ্নসৌন্দর্যের চেয়ে বহু দামি দেশলাই, ক্লিপ, চটিজোড়া,
অন্তর্বাস । তুমিই চিহ্নিত শত্রু; - দানবিক ট্রাক
গাল ভ'রে রক্ত চায় । শহরের পথেপ্রান্তে হিংস্র দশলাখ
বৈদু্যতিক তার ঝুলে পড়ে তীব্র তেজে! দীর্ঘ বিক্ষুব্ধ মিছিল
চণ্ডস্বরে গর্জে ওঠে, 'আমরা চাই ছন্দোবদ্ধ, যতি আর মিল
দেয়া কড়া পদ্য, কবিতার দরকার নাই।' মাংসল যুবতী
দশটা গুণ্ডার সাথে ঘুম যায় তবুও কী বিস্ময়কর সতী!
তার কৌমার্য ক্ষুণ্ণ হয় কবিতায়। সমাজের কালো কুকুরেরা
চিৎকারে সন্ত্রস্ত করে স্বপ্নলোক, আতঙ্কিত পদ্ম-জ্যোৎস্না-ঘেরা
পশু ও মানুষ। অন্ধ রাজধানি ভ'রে রটে প্রচণ্ড উল্লাস-
সদর রাস্তার চাই রক্তমাখা ছিন্নভিন্ন ঘৃণ্যতম লাশ।


(কবির লাশ / সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে / হুমায়ুন আজাদ)

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

উচ্ছলা এর ছবি

পিঠে কূঁজ বেছে নিতে পছন্দ করেন আমাদের বুদ্ধিজীবিরা, কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন কুঁজের বদলে ছুরিকাকে, অস্বীকার করেছিলেন মাথা নিচু করে দাঁড়াতে। আমাদের বর্বর সমাজরাষ্ট্র কেঁপে কেঁপে উঠেছে তাঁর লেখায়, আতঙ্কিত হয়েছে জঘন্য মৌলবাদ।

চলুক চলুক

সুমন তুরহান এর ছবি

অসৎ, ভ্রষ্ট, কঁুজবিশিষ্ট আল মাহমুদকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদের সেই আলোচিত কবিতাটি:

আপনাকে দেখিনি আমি; তবে আপনি আমার অচেনা
নন পুরোপুরি, কারণ বাঙলার মায়েদের আমি
মোটামুটি চিনি, জানি। হয়তো গরিব পিতার ঘরে
বেড়ে উঠেছেন দু:খিনী বালিকারূপে ধীরেধীরে;
দু:খের সংসারে কুমড়ো ফুলের মতো ফুটেছেন
ঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত ক’রে তুলেছেন মাতা
ও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুল ভয়েরই কারণ।
তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপে দিয়েছেন
পাড়ি, আর এসে উঠেছেন আরেক গরিব ঘরে;
স্বামীর আদর হয়তো ভাগ্যে জুটেছে কখনো, তবে
অনাদর জুটেছে অনেক। দারিদ্র্য, পীড়ন, খণ্ড
প্রেম, ঘৃণা, মধ্যযুগীয় স্বামীর জন্যে প্রথাসিদ্ধ
ভক্তিতে আপনার কেটেছে জীবন। বঙ্গীয় নারীর
আবেগে আপনিও চেয়েছেন বুক জুড়ে পুত্রকন্যা,
আপনার মরদ বছরে একটা নতুন ঢাকাই
শাড়ি দিতে না পারলেও বছরে বছরে উপহার
দিয়েছেন আপনাকে একের পর এক কৃশকায়
রুগ্ন সন্তান, এবং তাতেই আপনার শুষ্ক বুক
ভাসিয়ে জেগেছে তিতাসের তীব্র জলের উচ্ছ্বাস।
চাঁদের সৌন্দর্য নয়, আমি জানি আপনাকে মুগ্ধ
আলোড়িত বিহ্বল করেছে সন্তানের স্নিগ্ধ মুখ,
আর দেহের জ্যোৎস্না। আপনিও চেয়েছেন জানি
আপনার পুত্র হবে সৎ, প্রকৃত মানুষ। তাকে
দারিদ্র্যের কঠোর কামড় টলাবে না সততার
পথ থেকে, তার মেরুদণ্ড হবে দৃঢ়, পীড়নে বা
প্রলোভনে সে কখনো বুটদের সেজদা করবে না।
আপনার উচ্চাভিলাষ থাকার তো কথা নয়, আপনি
আনন্দিত হতেন খুবই আপনার পুত্র যদি হতো
সৎ কৃষিজীবী, মেরুদণ্ডসম্পন্ন শ্রমিক, কিংবা
তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। আপনি উপযুক্ত
শিক্ষা দিতে পারেন নি সন্তানকে;- এই পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায় এটাই তো স্বাভাবিক, এখানে মোহর
ছাড়া কিছুই মেলে না, শিক্ষাও জোটে না। তবে এতে
আপনার কোনো ক্ষতি নেই জানি; কারণ আপনি
পুত্রের জন্যে কোনো রাজপদ, বা ও রকম কিছুই
চান নি, কেবল চেয়েছেন আপনার পুত্র হোক
সৎ, মেরুদণ্ডী, প্রকৃত মানুষ। আপনার সমস্ত
পবিত্র প্রার্থনা ব্যর্থ ক’রে বিশশতকের এই
এলোমেলো অন্ধকারে আপনার পুত্র কী হয়েছে
আপনি কি তা জানেন তা, হে অদেখা দরিদ্র জননী?
কেনো আপনি পুত্রকে পাঠিয়েছিলেন মুঘলদের
এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে, যেখানে কৃষক এসে লিপ্ত
হয় পতিতার দালালিতে, মাঠের রাখাল তার
নদী আর মাঠ হ’য়ে ওঠে হাবশি গোলাম?
আপনি কি জানেন, মাতা, আপনার পুত্র শহরের
অন্যতম প্রসিদ্ধ গোলাম আজ? আপনি এখন
তাকে চিনতেও ব্যর্থ হবেন, আপনার পুত্রের দিকে
তাকালে এখন কোনো মস্তক পড়ে না চোখে, শুধু
একটা বিশাল কুঁজ চোখে পড়ে। দশকে দশকে
যতো স্বঘোষিত প্রভু দেখা দিয়েছেন মুঘলদের
এ-নষ্ট শহরে, আপনার পুত্র তাদের প্রত্যেকের
পদতলে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে পৃষ্ঠদেশ জুড়ে
জন্মিয়েছে কুঁজ আর কুঁজ; আজ তার পৃষ্ঠদেশ
একগুচ্ছ কুঁজের সমষ্টি;- মরুভূমিতে কিম্ভুত
বহুকুঁজ উটের মতোই এখন দেখায় তাকে।
সে এখন শহরের বিখ্যাত গোলাম মজলিশের
বিখ্যাত সদস্য, গোলামিতে সে ও তার ইয়ারেরা
এতোই দক্ষ যে প্রাচীন, ঐতিহাসিক গোলামদের
গৌরব হরণ ক’রে তারা আজ মশহুর গোলাম
পৃথিবীর। এখন সে মাথা তার তুলতে পারে না,
এমনকি ভুলেও গেছে যে একদা তারও একটি
মাথা ছিলো, এখন সে বহুশীর্ষ কুঁজটিকেই মাথা
ব’লে ভাবে। খাদ্যগ্রহণের পর স্বাভাবিক পদ্ধতিও
বিস্মৃত হয়েছে সে, প্রভুদের পাদুকার তলে
প’ড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া আর কিছুতেই
পরিতৃপ্তি পায় না আপনার পুত্র, একদা আপনার
স্তন থেকে মধুদুগ্ধ শুষে নিয়ে জীবন ধারণ
করতো যে বালক বয়সে। এখন সে শত্রু পাখি
ও নদীর, শত্রু মানুষের, এমন কি সে আপনার
স্তন্যেরও শত্রু। তার জন্য দুঃখ করি না, কতোই
তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে শতকে শতকে।
কিন্তু আপনার জন্যে, হে গরিব কৃষক-কন্যা, দু:খী
মাতা, গরিব-গৃহিণী, আপনার জন্যে বড় বেশি
দুঃখ পাই;- আপনার পুত্রের গোলামির বার্তা আজ
রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা পৌঁছে গেছে তিতাসের
জলের গভীরে আর কুমড়োর খেতে, লাউয়ের
মাঁচায়, পাখির বাসা আর চাষীদের উঠানের কোণে।
তিতাসের জল আপনাকে দেখলে ছলছল ক’রে
ওঠে, ‘ওই দ্যাখো গোলামের গর্ভধারিণীকে’; মাঠে
পাখি ডেকে ওঠে, ‘দ্যাখো গোলামের গর্ভধারিণীকে’;
আপনার পালিত বেড়াল দুধের বাটি থেকে
দু-চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘গোলামের গর্ভধারিণীর
হাতের দুগ্ধ রোচে না আমার জিভে’, প্রতিবেশী
পুরুষ-নারীরা অঙ্গুলি সংকেত ক’রে কলকণ্ঠে
বলে, ‘দ্যাখো গোলামের গর্ভধারিণীকে।’ এমন কি
প্রার্থনার সময়ও আপনি হয়তো বা শুনতে পান
‘গোলামের গর্ভধারিণী, ধারিণী’ স্বর ঘিরে ফেলছে
চারদিক থেকে। আপনি যখন অন্তিম বিশ্রাম
নেবেন মাটির তলে তখনো হয়তো মাটি ফুঁড়ে
মাথা তুলবে ঘাসফুল, বাতাসের কানে কানে ব’লে
যাবে, ‘এখানে ঘুমিয়ে আছেন এক গর্ভধারিণী
গোলামের।’ ভিজে উঠবে মাটি ঠাণ্ডা কোমল অশ্রুতে।
কী দোষ আপনার? মা কি কখনোও জানে দশমাস
ধ’রে যাকে সে ধারণ করছে সে মানুষ না গোলাম?

(গোলামের গর্ভধারিণী / আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে / হুমায়ুন আজাদ)

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

তারেক অণু এর ছবি

শ্রদ্ধা। কদিন আগে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না আরেকবার পড়লাম। ভাষার জাদুকর আমাদের লেখক।

সুমন তুরহান এর ছবি

তুমি জানো না, কোনোদিন জানবে না, কেমন লাগে একটি নড়োবড়ো বাঁশের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তুমি শিশির দেখো নি, কুয়াশা দেখো নি, কচুরি ফুল দেখো নি। তুমি ধানের শীষ দেখেছো টেলিভিশনে, চিল দেখেছো ছবির বইতে। নালি বেয়ে ফোঁটাফোঁটা খেজুরের রস ঝরতে দেখো নি, পুকুরে দেখো নি মাছের লাফের দৃশ্য। তুমি জানো না কেমন লাগে উথাল-পাতাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে, আর কেমন লাগে একটি পাখির পেছনে ছুটে ছুটে সকালকে দুপুরের দিকে গড়িয়ে দিতে। আমি জানি; - না আমি জানতাম।

বিষয়টি অতীত হয়ে গেছে এই কারণে যে, এখন তো আমি জড়িয়ে আছি শহরে; আমার পায়ের নিচে শক্ত কংক্রিট, চোখে নিঅন আলো, চারদিকে গোঁ গোঁ করা ট্রাকের উল্লাস। কতো দিন আমি, তোমার মতোই চাঁদ দেখিনি। শহরে কি চাঁদ ওঠে? কুয়াশা নামতে দেখি নি দুধের সরের মতো, পদ্মার পারে দেখি নি ধবধবে কাশফুলের সাদা মেঘ। কতো দিন দেখি নি ধানের গুচ্ছ, তারার গুচ্ছের মতো। কিন্তু যখন আমি হাঁটি, বিকেলে বেড়াই, বই পড়ি, ঘুমোতে যাই, গড়াই স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে, তখন আমি একটি ফুলের গন্ধ পাই। সে-ফুল আমার গ্রাম, সে-ফুল আমার গাঁ। আমার ছোটোবেলার গ্রাম। রাড়িখাল।

(ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না / হুমায়ুন আজাদ)

অসাধারণ রূপময় গদ্য!

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

তানিম এহসান এর ছবি

তাঁর কদর্য মৃত্যুদাতারা যখন হারিয়ে যাবে ইতিহাসের কালো গর্ভে, তখন তাঁর বিপুল রচনাবলী বদলে দিতে থাকবে আমাদের মননরাজ্য, ঘটাবে চিন্তার বিপ্লব। তিনি আলো জ্বেলে যাবেন হাজার বছর ধরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, শতাব্দীপরম্পরায় ........

সুমন তুরহান এর ছবি

... আমরা তো নষ্ট হ'য়ে গেছি নষ্ট ইঁদুরেরই মতো।
তবুও আশ্চর্য! আমাদের ঘরে আজো জন্মে শতো
শতো নিষ্পাপ পুষ্পের মতো শিশু, যাদের অম্লান
হাসিতে ঝিলিক দেয় সত্য, ঝরে শান্তি ও কল্যাণ।
তারাও তো নষ্ট হবে নষ্ট পৌরপিতাদের পাপে,
যেমন হয়েছি নষ্ট আমরা সামাজিক অভিশাপে।
বাঁশিওলা তুমি একবার এসেছিলে হ্যামিলনে,
এ-সংবাদ জানে সবে পৃথিবীতে- পেরু থেকে চীনে
জানি তুমি বেদনাকাতর, তবু আর একবার
এসো, এ-শহরে, করো আমাদের উজ্জ্বল উদ্ধার।
তুমি এসে শহরকে ইঁদুরের উৎপাত থেকে
উদ্ধার করবে, তা চাই না। কেননা ইঁদুর দেখে দেখে
সহ্য হ'য়ে গেছে আমাদের। তুমি পবিত্র বাঁশিতে
সুর তোলো, আমাদের শিশুগণ পবিত্র হাসিতে
বের হোক গৃহ থেকে। তোমার বাঁশির সুরে সুরে
তোমার সঙ্গে তারা চ'লে যাক দূর থেকে দূরে
কোনো উপত্যকা বা পাহাড়ের পবিত্র গুহায়-
পৌরপিতাদের পাপ যেনো না লাগে তাদের আত্মায়।
শিশুদের শোকে কষ্ট পাবো, তবু সুখ পাবো বুকে
নষ্ট হয় নি তারা আমাদের মতন অসুখে!


(হ্যামেলিনের বাঁশিঅলার প্রতি আবেদন / আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে / হুমায়ুন আজাদ)

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

স্টয়িক রাসেল এর ছবি

বাঙালি এতটাই বর্বর যে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে কখনো বাঁচতে দেয় না। বেচে থাকে ইতিহাসের কলঙ্কিত, পচা ,গান্দা ,ঘৃণ্য জানোয়ার গুলি।

সুমন তুরহান এর ছবি

ছেলেবেলায় আমি যেখানে খেলতাম
তিরিশ বছর পর গিয়ে দেখি সেখানে একটি মসজিদ উঠেছে।
আমি জানতে চাই ছেলেরা এখন খেলে কোথায়?
তারা বলে ছেলেরা এখন খেলে না, মসজিদে পাঁচবেলা নামাজ পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বুড়িগঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়ে
যেখানে একঘন্টা পরস্পরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলাম আমি আর মরিয়ম,
গিয়ে দেখি সৌদি সাহায্যে সেখানে একটা লাল ইটের মসজিদ উঠেছে।
কোথাও নিষ্পলক দৃষ্টি নেই চারদিকে জোব্বা আর আলখাল্লা।

পঁচিশ বছর আগে বোম্বাই সমুদ্রপারে এক সেমিনারে গিয়ে
যেখানে আমরা সারারাত নেচেছিলাম আর পান করেছিলাম আর নেচেছিলাম,
১৯৯৫-এ গিয়ে দেখি সেখানে এক মস্ত মন্দির উঠেছে।
দিকে দিকে নগ্ন সন্ন্যাসী, রাম আর সীতা, সংখ্যাহীন হনুমান;
নাচ আর পান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ফার্থ অফ ফোর্থের তীরের বনভূমিতে যেখানে সুজ্যান আমাকে
জড়িয়ে ধ’রে বাড়িয়ে দিয়েছিলো লাল ঠোঁট,
সেখানে গিয়ে দেখি মাথা তুলেছে এক গগনভেদি গির্জা।
বনভূমি ঢেকে আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত ঝুলছে এ ক্রুদ্ধ ক্রুশকাঠ।

আমি জিজ্ঞেস করি কেনো দিকে দিকে এতো প্রার্থনালয়?
কেনো খেলার মাঠ নেই গ্রামে?
কেনো নদীর ধারে নিষ্পলক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার স্থান নেই?
কেনো জায়গা নেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধ’রে চুম্বনের?
কেনো জায়গা নেই নাচ আর পানের?
তারা বলে পৃথিবী ভ’রে গেছে পাপে, আসমান থেকে জমিন ছেয়ে গেছে গুনাহ্য়
তাই আমাদের একমাত্র কাজ এখন শুধুই প্রার্থনা।

চারদিকে তাকিয়ে আমি অজস্র শক্তিশালী মুখমণ্ডল দেখতে পাই,
তখন আর একথা অস্বীকার করতে পারিনা।


(প্রার্থনালয় / কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু / হুমায়ুন আজাদ)

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হুমায়ুন আজাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

সুমন তুরহান এর ছবি

বেশি কাজ বাকি নেই; যতোটুকু বাকি বেলা পড়ার আগেই
শেষ ক'রে উঠতে হবে। তবে খুব তাড়া নেই, যদি শেষ ক'রে
উঠতে না পারি, থেকে যাবে, ওরা আমার বা নিজেদের হয়ে
সম্পন্ন করবে, ওদের যতোই বকি তবু ভার দিয়ে যেতে
হবে ওদের ওপরই। নিজের সমস্ত কাজ কখনোই কেউ শেষ ক'রে
উঠতে পারে না। যদি শেষ ক'রে উঠতে না পারি ভারি হয়ে উঠবে না বুক;
দুপুর পর্যন্তই যতো অসন্তোষ, তারপর শুধু নিরুদ্বেগে কাজ ক'রে যাওয়া।
মাঠে যেতে হবে একবার, দেখতে হবে আগাছা উঠেছে কিনা,
পানি পৌছেছে কিনা ধানের শেকড়ে; দেখতে হবে গাভীদের দড়ি
কতোটা বাড়াতে হবে। কয়েক বালতি জল ঢালতে হবে
বেগুনচারায়, পথটাও ক্ষয়ে আসছে, কয়েক চাঙড়ি মাটি ফেলতে
হবে এপাশে ওপাশে। উত্তরের জমিটায় যেতে হবে একবার;
বহুদিন হয় নি যাওয়া দিঘির ওপারে। বেশি কাজ
বাকি নেই, বেলা পড়ার আগেই শেষ ক'রে উঠতে হবে;
তবে কাজই বড়ো কথা নয়, ধানের শেকড়ে পানি
দেয়ার সময় সবুজের ঢেউয়েই মুগ্ধ হয়েছি বেশি, কাজ করছি ব'লে
কখনো হয় নি মনে, মনে হয়েছে আনন্দ করছি। গরুর দড়িটা
বাড়াতে গিয়ে ঘাসের মতোই মাংসে ঢুকেছে সুখ, উত্তরের জমিটায়
গেলে ঢেকে গেছি লাউয়ের পাতার মতো দিগ্বলয়ে। বেশি কাজ
বাকি নেই, বেলা পড়ার আগেই গোধূলি দেখতে দেখতে
ফিরবো ঘরে, যদি শেষ নাও হয় সব কাজ দুঃখ থাকবে না,
আমাকে থাকবে ঘিরে গোধুলির খুরের শব্দ পাখিদের স্বর উত্তরের জমির
গন্ধ রাতের আকাশ অসমাপ্ত অশেষ সুন্দর।

(বেশি কাজ বাকি নেই / কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু / হুমায়ুন আজাদ)

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

অসম্ভব ভালো লাগলো লেখাটি।
হুমায়ুন আজাদের প্রতি শ্রদ্ধা।

সুমন তুরহান এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রাজাসাহেব!

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

আলামিন এর ছবি

মানুষে মানুষে মতভেদ থাকতেই পারে কিন্তু এই মানুষটি শুধু তার ভিন্নমত নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেনি, সুতীব্র লেখনির বাক্য-বাণে বিদ্বেষে রূপ দিয়েছেন, আর নিউটনের তৃতীয় সুত্রানুযায়ী তিনি তার প্রতিক্রিয়ার স্বীকার হয়েছেন মাত্র। আর নাস্তিকরা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কোন "free will" এর অস্তিত্ব স্বীকার করেনা। কাজেই হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ঘটেছে...কাউকে দায়ী করার অর্থ, নাস্তিকতা থেকে আস্তিকতার দিকে ধাবিত হওয়া। (http://www.susanblackmore.co.uk/Conferences/Sharpham Aug 2006.htm

অরফিয়াস এর ছবি

মানুষে মানুষে মতভেদ থাকতেই পারে কিন্তু এই মানুষটি শুধু তার ভিন্নমত নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেনি, সুতীব্র লেখনির বাক্য-বাণে বিদ্বেষে রূপ দিয়েছেন, আর নিউটনের তৃতীয় সুত্রানুযায়ী তিনি তার প্রতিক্রিয়ার স্বীকার হয়েছেন মাত্র।

বাহ অসাধারণ, এভাবেই আমরা খুনকে জায়েজ করে চলি, তাই না?? !! তিনি "নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছেন মাত্র" বাহ চমত্কার, তা আপনার বা আপনাদের থিসিস অনুযায়ী আর কার কার নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুযায়ী প্রতিক্রিয়ার শিকার হওয়া উচিত ছিলো ?? আর কি কি প্রমান করতে চলেছেন সূত্র থেকে, আর কে কে এই লিস্টে আছে??

আর নাস্তিকরা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কোন "free will" এর অস্তিত্ব স্বীকার করেনা। কাজেই হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ঘটেছে...কাউকে দায়ী করার অর্থ, নাস্তিকতা থেকে আস্তিকতার দিকে ধাবিত হওয়া।

প্রকৃতির নিয়মে কালকে আপনাকে এসে একদল কল্লা কেটে রেখে গেলো তো আপনার পরিবার বা বন্ধুরা আশা করি বিচার প্রত্যাশা করবেনা, মামলা-ঠামলার ধারে কাছেও যাবেনা, কারণ প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই যুগে যুগে মানুষের কল্লা কাটা হয়েছে তাইনা??!! নাস্তিকতা আর আস্তিকতার এই মহান পাঠ কোথায় পেয়েছেন, কোন সে মহাগুরু জানাবেন ??

কারো নির্যাতন-খুন-হত্যার জন্য তাহলে আর আমরা থানা-পুলিশ কোর্ট-কাচারী কেনো রাখি, সরকারেরই বা কি দরকার, কি দরকার এতো চিল্লাচিল্লি করে, সব তো প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই হয় তাই না???

আশা করি এটাও জানেন প্রকৃতির নিয়মেই কিছু মানুষরুপী হায়েনার জন্ম হয় যাদের আসল চেহারা মুখোশের আড়ালে থাকে আর এরই সাথে জন্ম হয় কিছু মানুষরুপী কুকুরের।

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

আলামিন এর ছবি

নাস্তিকতা আর আস্তিকতার এই মহান পাঠ কোথায় পেয়েছেন, কোন সে মহাগুরু জানাবেন

বোধ করি, আপনি নাস্তিকদের দলে না। আমার দেয়া লিঙ্কটা তে ঢু মেরেছেন তো?
আপনার জন্য Stefen Hawking এর "The Grand Design থেকে উদ্ধৃত করলাম,
"Though we feel that we can choose what we do, our understanding of the molecular basis of biology shows that biological processes are governed by the laws of physics and chemistry and therefore are as determined as the orbits of the planets. Recent experiments in neuroscience support the view that it is our physical brain, following the known laws of science, that determines our actions, and not some agency that exists outside those laws. For example, a study of patients undergoing awake brain surgery found that by electrically stimulating the appropriate regions of the brain, one could create in the patient the desire to move the hand, arm, or foot, or to move the lips and talk. It is hard to imagine how free will can operate if our behavior is determined by physical law, so it seems that we are no more than biological machines and that free will is just an illusion.”

আমরা biological machine বৈ তো আর কিছু নই, "free will" আসবে কোথা থেকে?

আর নাস্তিকরা থানা-পুলিশ কোর্ট-কাচারী কেন করে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।

সুমন তুরহান এর ছবি

... মানুষ দুর্ভাগা মানুষ একটি মিশ্র প্রজাতি।
চিরকাল গাধার গর্ভে আর ঔরসে জন্ম নেয় গাধা,
গরুর গর্ভে ও ঔরসে জন্ম নেয় সরল শান্ত গরু,
বাঘের ঔরসে আর গর্ভে কখনো কালকেউটে জন্মে না,
যেমন কালকেউটে কোনো দিন কালকেউটে ছাড়া
প্রসব করে না হরিণ বা রাজহাঁস বা স্বপ্নের মতো কবুতর।
কিন্তু মানুষের ঔরসে আর গর্ভে আমি জন্ম নিতে
দেখেছি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাধা, নর ও নারীর সঙ্গমে
আমি ভূমিষ্ঠ হতে দেখেছি আফ্রিকার নেকড়ের চেয়েও
ভয়াবহ হিংস্র নেকড়ে। ...

(পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না / সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে / হুমায়ুন আজাদ)

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

ওরে আল্মিন ভাইরে কদ্দিন পর দেকলাম রে, ভাই এদ্দিন কৈ আছিলেন? আন্নের ছাগুগিরি এদ্দিন মিছাইছি হাছা কৈলাম.........আন্নি এলা আয়া পড়ছেন আবার.........


_____________________
Give Her Freedom!

সুমন তুরহান এর ছবি

আশা করি এটাও জানেন প্রকৃতির নিয়মেই কিছু মানুষরুপী হায়েনার জন্ম হয় যাদের আসল চেহারা মুখোশের আড়ালে থাকে আর এরই সাথে জন্ম হয় কিছু মানুষরুপী কুকুরের।

এই শোকের দিনেও মানুষরূপী হায়েনারা সেই নৃশংস হামলাকে জায়েজ করার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

অরফিয়াস এর ছবি

চালাবেনা কেনো, সুযোগ তো আমরাই করে দেই, খুনি হয়ে যায় ভাষা সৈনিক আমাদের দেশে

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

সুমন তুরহান এর ছবি

যে তুমি ফোটাও ফুল ঘ্রাণে ভরো ব্যাপক সবুজ,
জমিতে বিছিয়ে দাও ধান শিম খিরোই তরমুজ,
কুমড়োর সুস্বাদ, যে তুমি ফলাও শাখে ফজলি আম,
কামরাঙা পেয়ারা বাতাসে দোলাও গুচ্ছগুচ্ছ জাম,
যে তুমি বহাও নদী পাললিক নদীর ভেতরে,
লালনপালন করো ইলিশ বোয়াল স্তরে স্তরে,
যে তুমি ওঠাও চাঁদ মেঘ ছিঁড়ে নীলাকাশ জুড়ে,
বাজাও শ্রাবণ রাত্রি নর্তকীর অজস্র নূপুরে,
যে তুমি পাখির ডাকে জেগে ওঠো, এবং নিশ্চুপে
বালিকার সারা দেহ ভরে দাও তিলেতিলে রূপে,
আর কণকচাঁপার গন্ধে আর ভাটিয়ালি গানে,
যে তুমি বইয়ে দাও মধুদুগ্ধ গাভীর ওলানে,
খড় আর ঘাস থেকে, যে তুমি ফোটাও মাধবী
আর অজস্র পুত্রকে দাও ছন্দ ক’রে তোলো কবি,
যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর
সেই তুমি কেমন ক’রে বাঙলা, সে তুমি কেমন ক’রে,
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছো পালেপালে শুয়োর কুকুর
?

(যে তুমি ফোটাও ফুল / আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে / হুমায়ুন আজাদ)

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

সবার নিকট এক সময় হুমায়ুন আজাদ একদিন অনিবার্য হয়ে যাবে, সেই আশায় বুক বাঁধা..........

লেখা হিসেবে এটা উচু শৈল্পিক মানে বৈভবী। একটু কি নিয়মিত হতে পারবেন আজকাল, প্রিয় কবি?


_____________________
Give Her Freedom!

সুমন তুরহান এর ছবি

ধন্যবাদ কবি। সময় করে উঠতে পারছি না কিছুতেই। আর পড়তে যতো ভালো লাগে, লিখতে ততো ভালো লাগে না। তবে চেষ্টা করবো।

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

চিলতে রোদ এর ছবি

শ্রদ্ধা!

সুমন তুরহান এর ছবি

ধন্যবাদ, চিলতে রোদ!

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।