কনোকোফিলিপসের সাথে গ্যাস উৎপাদন-অংশীদারি চুক্তি বিতর্ক – তৃতীয় পর্ব

নৈষাদ এর ছবি
লিখেছেন নৈষাদ (তারিখ: শনি, ০২/০৭/২০১১ - ৮:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই পর্বটা শুরু করছি ২৪ জুন ২০১১ প্রগতি সম্মেলন কেন্দ্রে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির (‘জাতীয় কমিটি’) উদ্যোগে ‘কনকো ফিলিপস-এর সাথে তেল-গ্যাস চুক্তি কেন জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি?’ - শীর্ষক আলোচনা সভায় পঠিত অধ্যাপক এমএম আকাশের প্রবন্ধের রেফারেন্স দিয়ে।

সনাতনী গনমাধ্যমে যে কয়জন লেখক আমাকে প্রভাবিত করে (যাঁরা বেশির ভাগই অনিয়মিত ভাবে লিখেন), জনাব আকাশ তাদের অন্যতম। আকাশ স্যার গুরুত্বপূর্ণ একটা জনগনের আন্দোলনের পক্ষে বিস্তারিত এই প্রবন্ধ লিখেছেন। আকাশ স্যারের একটা ধারণা দিয়েই শুরু করি।

একধরণের সাইজমিক ডেটা ম্যাপিং?

আকাশ স্যার লিখেছেন, ‘আমাদের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো হোত যদি উপযুক্ত তথ্যভিত্তিক জ্ঞানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার স্বয়ং বা পিপিপি’র অধীনে বেসরকারি-সরকারি খাত মিলে এই জরিপের কাজটা আমরা নিজেরাই সম্পন্ন করতে পারতাম। সে জন্য যেটুকু অর্থ ও প্রযুক্তি লাগতো তা নিজেরাই যদি সংগ্রহ করতে পারতাম তাহলে তা সম্ভব হতো এবং সেই চেষ্টাটাই আমাদের সর্বাগ্রে করতে হতো। তাহলে আবিষ্কৃত পুরো গ্যাসটাই আমাদের ইচ্ছামতো আমরা ব্যবহার করতে পারতাম এবং কাউকেই সেই জন্য কোনো বাড়তি মুনাফা আমাদের দিতে হতো না’।

স্যারের সাথে সহমত। তৃতীয় রাউন্ড বিডিং এর সময় একজন বিশেষজ্ঞের সাথে এ ধরনের একটা উদ্যোগ আসলেই সম্ভব কিনা সে ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। গভীর এবং অগভীর সমুদ্রে যে ব্লকগুলি এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে না সেগুলির যদি একধরণের প্রাথমিক সাইজমিক ডেটা সরকারের কাছে থাকত তবে সরকারের জন্য অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হত।

নিঃসন্দেহে এই ধরণের উদ্যোগের জন্য প্রাথমিক ভাবে যে টাকার দরকার সেটা জোগাড় করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আকাশ স্যার প্রাইভেট পার্টনার অথবা ব্যাংকের কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে যে বিনিয়োগের কথা বলেছেন সেটা ফিজিবল অপশন বলে মনে হল না। প্রথমত, প্রাথমিক সাইজমিক ডেটাতে যদি হাইড্রোকার্বনের প্রসপেক্ট পাওয়া না যায় তবে বিনিয়োগের কী হবে? দ্বিতীয়ত, সাইজমিক ডেটা একটা ইন্ডিক্যাশন মাত্র, নিশ্চিত হতে ড্রিলিং এর প্রয়োজন আছে। এবং প্রসপেক্ট পাওয়া গেলেও সেই গ্যাস থেকে টাকা পাওয়া শুরু হতে ন্যূনতম ৭/৮ বছর লাগবে। এমন উদ্যোক্তা পাওয়া সম্ভব না, অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে।

তবে এই ব্যাপারে সম্ভাব্য একটা অপশন আছে, পরে আসছি সেই ব্যাপারে। আগে আরও কয়টা ব্যাপার দেখি।

স্থলভাগ নাকি সমুদ্র?

আকাশ স্যার বলেছেন, ‘যদি দেখা যায় পুরনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোর work over করে এবং সুনেত্রা সহ সদ্য আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করে গ্যাস আরো সস্তাতেও পাওয়া যায় এবং রপ্তানির ঝুঁকিও থাকে না বা বিদেশীদের ডেকে আনতে হয় না তাহলে আপাতত সমুদ্র নিয়ে মাথা ঘামানো স্থগিতও রাখতে পারতাম। ইতোমধ্যে আমাদের জ্ঞান, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেতো এবং তখন স্বউদ্যোগে আমরা আমাদের সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধানে তৎপর হতে পারতাম’। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি আমাদের এর মধ্যেই দেড়ি হয়ে গেছে, দ্রুতই নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কাররের দরকার। সেটা স্থলভাগে এবং সমুদ্রে, এবং আমার মতে গভীর এবং অভগীর সমুদ্রে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান স্থলভাগের থেকে বেশি জরুরী। দ্বিতীয়ত, বাপেক্সকে সমুদ্রে অনুসন্ধানের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অভিজ্ঞতার অর্জনের প্রয়োজন।

বাপেক্স, অন্ধকারে আলোক-বিন্দুর প্রত্যাশা

সাদা চোখে রেগুলেটরি অথোরিটি যেভাবে কাজ করা উচিত সেরকমই একটা প্রতিষ্ঠান বলে মনে হয়েছে পেট্রোবাংলাকে, যারা সময়ের সাথে সাথে নিজেদের উন্নত করেছে। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মোটামোটি পজিটিভ, তবে স্বীকার করতে হয় সেটা খুবই অগভীর পর্যবেক্ষণ ছিল। যাই হোক, গত কয় বছর গ্যাস সেক্টরের উপর লেখালেখির উপর ভিত্তি করে পেট্রোবাংলাকে যদি ‘চরম দূর্নীতিপরায়ণ’ একটি প্রতিষ্ঠান, যারা ‘আইওসির দেখভালেই বেশি ইন্টারেস্টেড’ এমন ভাবি আমাকে দোষ দেয়া যায় না।

প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক এমন ‘দূর্নীতিপরায়ণ’ প্রতিষ্ঠানের পেটের মধ্যে বসে, সেই প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়্যারি একটি প্রতিষ্ঠান (বাপেক্স) কী করে আদর্শ একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠবে। যদি ধরে নেই পেট্রোবাংলা দূর্নীতিপরায়ণ এবং এর ভেতরে একটি ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপের’ অস্তিত্ব আছে, যারা বাপেক্সের উন্নতি চায় না, তবে বাপেক্সের আদর্শ একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপ হবে পেট্রোবাংলার বাইরে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধিনে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া। আরেকটা দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যায়, স্বয়ংসম্পূর্ন ভাবে গড়ে উঠতে হলে পেট্রোবাংলার মত রেগুলিটরি প্রতিষ্ঠানের ‘পেট্রোনাইজেশন’ থেকে বের হয়ে আসা জরুরী।

সমুদ্রে কী আমরা আপাতত আইওসি দিয়ে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান বন্ধ করে দিব?

আমি ব্যাক্তিগত ভাবে তা মনে করি না। স্যার বলেছেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের জ্ঞান, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেতো এবং তখন স্বউদ্যোগে আমরা আমাদের সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধানে তৎপর হতে পারতাম’। আমার মনে হয়েছে বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে বাপেক্সেকে অফশোরে্র অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।

ঝুকি বন্টন এবং উন্নয়ন পদক্ষেপ

টাকা অ্যালোকেট করলেই কি বাপেক্সকে শক্তিশালী করা সম্ভব? (এখানে ‘শক্তিশালী’ শব্দ দিয়ে অতি উচ্চ মাত্রার ব্যবস্থাপণা, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক একটি এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি বুঝাতে চাচ্ছি)। সম্ভব না। এর জন্য একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা, যার অনেক অংশের মধ্যে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ একটি, থাকতে হবে। পুরাতন যন্ত্রপাতি দিয়ে বাপেক্স কোন ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়াই অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়েছে বলে আমাদের আত্মপ্রসাদ লাভের সুযোগ নেই। একটি শক্তিশালী এক্সপ্লোরেশন প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠতে হলে অতি উন্নতমানের যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি জ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন এসবের কোনই বিকল্প নেই। [সাবধান থাকতে হবে আমরা যেন পুরাতন যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তিকে স্বাজাত্যবোধের প্রতিশব্দ করে ফেলার পথে না হাঁটি। বিদেশি উন্নত যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক আইনের জ্ঞানের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই।]

নতুন করে আইওসির সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ করে দেয়া উচিত না বলে আমি মনে করি, কিন্তু মডালিটিতে কিছু পরিবর্তন আনার দরকার আছে।

যেভাবেই বলা হোক না কেন, সাগরে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের জন্য ঝুকিযুক্ত যে প্রাথমিক বিনিয়োগের দরকার আছে এটাও একটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার। দেখা যাক একটা মডেলে বাপেক্সের উন্নয়ন এবং ঝুকির শেয়ার করা সম্ভব কিনা?

ক্যারিড ইন্টারেস্ট শেয়ারিং মডেল

আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি নতুন করে কিছু ব্লকে আইওসিকে কাজ করার সুযোগ দেয়া উচিত, যেখানে বাপেক্সের ৪০% থেকে ৫০% ইন্টারেস্ট থাকবে (ধীরে ধীরে ইন্টারেস্টের পরিমান বাড়াতে হবে)। এর মাধ্যমেই বাপেক্সের সমুদ্রে অনুসন্ধান কার্যক্রমের হ্যান্ডস-অন অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব। একদিকে টেকনোলজি ট্রান্সফার, অন্যদিকে আর্থিক ঝুকি বন্টন (এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে লাভও বন্টন)।

ক্যারিড ইন্টারেস্টের ব্যাপারটা এরকম, আইওসি অপারেটর হিসাবে প্রাথমিক বিনিয়োগ পুরোটাই করল (৫০-৫০ ইন্টারেস্ট হলে বাপেক্সের বিনিয়োগের পরিমানও ৫০%)। সফল আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বাপেক্সের অংশের গ্যাসের মূল্য থেকে প্রাথমিক বিনিয়োগ পরিশোধ করবে। অনুসন্ধানে সফল কোন আবিষ্কার না হলে অবশ্য বাপেক্সকে ৫০% বিনিয়োগের টাকা পরিশোধ করতে হবে আইওসিকে। এভাবেই ধীরে ধীরে বাপেক্সকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। সেই সাথে রিস্ক শেয়ারিং।

সেক্ষেত্রে পিএসসির বাইরেও বাপেক্সের সাথে একটা জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার এগিমেন্ট থাকবে সেখানে বিস্থারিত শর্তাবলীর সাথে বাপেক্সকে শক্তিশালী করার মত শর্তাবলী যোগ করা সম্ভব।

ব্যাপারটা পুরো হাইপোথিসিস না, ভারতে আইওসির সাথে ওএনজিসির অন্তত পক্ষে ৩০% ক্যারিড ইন্টারেস্টের উদাহরণ দেখেছি।

বাপেক্সের লোকবল উন্নয়ন বাজেট

আমরা যদি মডেল পিএসসির অনুচ্ছেদ ২৫ দেখি সেখানে টেকনোলজি ট্রান্সফার এবং পেট্রোবাংলা/বাংলাদেশীদের উন্নয়নের কথা বিস্তারিত বলা আছে। মনে করি একটা ড্রিলিং প্রোগ্রামের জন্য একটা সেইফটি গাইড কেনা হল, যেহেতে ড্রিলিং বাজেট কস্ট রিকোভারির আওতায়, সেজন্য এটার মালিকানা পেট্রোবাংলার হয়ে যাবে। যে কোন পরিকল্পনা পেট্রোবাংলার অনুমোদন লাগবে, এবং শেষে প্রপার্টিতে পরিনত হবে।

বিস্তারিত না বলে টাকার অংকে সরাসরি চলে যাই। ২৫/২(বি) অনুসারে কন্ট্রাক্টরকে প্রোডাকশন শুরুর আগ পর্যন্ত প্রতি বছর ৫০,০০০ ডলার (কস্ট রিকোভারেবল না) পেট্রোবাংলার/ বাংলাদেশীদের উন্নয়নের জন্য খরচ করতে হবে (এটাতে কন্ট্রাক্টরের কোম্পানিতে চাকুরিরত দেশি কর্মীরা বাদ যাবে)। প্রোডাকশন শুরু হলে এর পরিমান হবে প্রতি বছর ১০০,০০০ ডলার। এটা ছাড়া আবার ধারা ২৫/৬ অনুযায়ী প্রোডাকশন শুরুর আগে প্রতিবছর উন্নয়ন গ্রান্ট হিসাবে ১৫০,০০০ এবং প্রোডাকশন শুরু হলে প্রতিবছর ২০০,০০০ ডলার (কস্ট রিকোভারেবল না)।

টাকার হিসাব বিভিন্ন হতে পারে, তবে বর্তমান সব পিএসসিতে এই ধারা আছে। সুতরাং অনেক বড় একটা বাজেট পাওয়া যাচ্ছে লোকবল উন্নয়নে। নিশ্চিত করতে হবে এই টাকা শুধু মাত্র পেট্রোবাংলা এবং বাপেক্সের লোকজনের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা অনুসারে ব্যবহার করা হয় (অন্যান্য সাবসিডিয়ারি বাদ, কারণ তাদের উচিত নিজেদের বাজেট থেকে সেটা নিশ্চিত করা)।

বাপেক্সের অনুসন্ধানের জন্য ফান্ড

অনুচ্ছেদ ২০ এ নন-কস্টরিকোভারেবল ফিস এবং বোনাসের কথা বলা আছে। বিস্তারিত গেলাম না, যে কোন ফর্মে এটাও বর্তমানের অন্যান্য পিএসসিতে আছে। যদি নিশ্চিত করা যায় এই বড় টাকাটা বাপেক্সের অনুসন্ধান ফান্ডে জমা হবে, তবেও কিন্তু বড় একটা ফান্ড বাপেক্সের হয়ে উঠতে পারে ধীরে ধীরে।

ফিরে আসি সাইজমিক ম্যাপিং এর ফান্ডে। একটা সম্ভাব্য উপায় হতে পারে বিদেশী তৃতীয় পক্ষ করবে, বিডিং এর সময় আইওসিরা ইনফোরমেশন প্যাকের সাথে টাকা দিয়ে সাইজমিক ডেটা কিনতে পারবে। মিনিম্যাম ওইয়ার্ক অবলিগ্যাশন সেখানে কিছুটা কমে যাবে এবং আইওসি সেই টাকাটা দিয়ে সাইজমিক ডেটা কিনবে (ধরি সাইজমিক লাগবে না)। কিন্তু সেজন্য পেট্রোবাংলাকে বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং চুক্তি করতে হবে। ব্যাপারটা বেশ কঠিন, কিন্তু অন্য দেশে এর প্রয়োগ আছে।

স্যারের লেখার সমালোচনা

আকাশ স্যার এই প্রবন্ধে নিজস্ব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছেন, এর বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। স্যারের নিজস্ব ব্যাখ্যার ব্যাপারে আমার শ্রদ্ধা আছে। তবে তিনটি পয়েন্ট উল্লেখ করতে চাই।

১। আকাশ স্যার শুরুতে তিনি গ্যাস উৎপাদন-বন্টন চুক্তির ব্যাপারে অধ্যাপক তামিমের বর্গাচাষ হাইপোথিসিসকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করেছেন। আমি স্যারের সাথে সহমত। তবে তাঁর প্রথম যুক্তিটা, যে কথাটা অনেকেই বলে থাকেন, সেটা আমাকে অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে আঘাত দিয়েছে। এই যুক্তিতে আমি ব্যাক্তিগতভাবে অপমানিত হই। স্যার বলেছেন, ‘প্রথমত, এই বিশেষ ক্ষেত্রে বর্গাদার হচ্ছে খুবই দুর্বল এবং গরীব এবং বর্গাচাষী হচ্ছে প্রবল প্রতাপান্বিত এক শক্তি। গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন-বন্টন চুক্তিকে ‘সহজ পাঠের’ খাতিরে যদি আমরা বর্গার সঙ্গে তুলনাও করি মনে রাখতে হবে তা হচ্ছে অর্থনীতির ভাষায় একটি বিপরীত বর্গার (Inverse Sharecropping) দৃষ্টান্ত। এখানে গ্যাসক্ষেত্রটি বর্গা দিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ বাংলাদেশ এবং বর্গা নিচ্ছেন প্রবল প্রতাপান্বিত বহুজাতিক কোম্পানি কনকো ফিলিপস। এখানে ক্ষমতার অসমতা এবং অপ্রতিসম তথ্যের (Information Asymmetry) প্রতিকলতা বিদ্যমান’।

হতে পারে পেট্রোবাংলাতে কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যাক্তি/ব্যাক্তিবর্গ আছে, তাতে কোনভাবেই, কোন কাউন্টেই পেট্রোবাংলা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতার একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় না। একটা ব্যাপার আমাদের বুঝতে হবে, চুক্তিতে পেট্রোবাংলা কনোকোফিলিপস অথবা যেকোন আইওসির শুধু কাউন্টার-পার্ট নয়, একটা রেগুলেটরি বডি, যা সরাসরি বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করে। ভারতে রিলায়্যান্স যখন ৭ টিএফসি গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়নে আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তার জন্য বিপির মত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের সাথে বিলিয়ন ডলারে কিছু স্টেক বিক্রী করে, তখন ভারতে কোন গনমাধ্যম রিলায়্যান্সকে দুর্বল প্রতিপক্ষ মনে করেনা।

২। স্যার নিজেও কস্ট-রিকোভারি এবং প্রফিট গ্যাস বন্টনের সাথে এলএনজি করে রপ্তানি সংক্রান্ত ২০ ভাগ সর্বোচ্চ অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের সুযোগের ব্যাপারটা কিছুটা কনফিউজ করেছেন বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের আলোচ্য চুক্তিতে ভাগাভাগির ধরনটিই এমন যে মোট গ্যাসের ৫৫ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে তার ‘‘কষ্ট রিকভারি’’ গ্যাস হিসাবে। বাকি যে ৪৫% গ্যাস থাকবে সেটাই বিভিন্ন অনুপাতে কনকোফিলিপ ও আমাদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। এই অনুপাতগুলি হচ্ছে দরকষাকষির বিষয় এবং তা চুড়ামত্ম করা হয় ফাইনাল চুক্তি স্বাক্ষরের মুহূর্তে। সেটা এখনো পর্য়মত্ম চুক্তির গোপনীয়তার কথা বলে জনগণকে জানানো হয়নি! একটি সাধারণ অনুমান হচ্ছে যে তা অর্ধেক-অর্ধেক ভাগ হবে। তাহলে কিন্তু আমরা সবমিলিয়ে পাবো মোট গ্যাসের মাত্র ২২.৫০% আর কনকোফিলিপ পাবে ৭৭.৫০%। ’’সহজ পাঠের’’ লেখক অবশ্য (দেখুন ম তামিম, ’’গ্যাস উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির সহজ পাঠ’’-দৈনিক প্রথম আলো, ২২ শে ফে: ২০১১) দাবী করেছেন যে গভীর সমুদ্রের গ্যাসের ক্ষেত্রে এই অংশটি প্রতিদিনের উৎপাদন মাত্রা অনুযায়ী নিধারিত হবে এবং তার সর্বোচ্চ পরিমাণটি প্রফিট গ্যাসের ৭৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন পরিমাণটি ৫০ শতাংশ পর্যমত্ম হতে পারে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে মোট গ্যাসের (কষ্ট রিকভারি গ্যাস+ প্রফিট গ্যাস ) সর্বনিম্ন ২২.৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩৩.৭৫ শতাংশ গ্যাস বাংলাদেশ) পেতে পারে। পক্ষান্তরে Cost recovery এবং নিজস্ব প্রফিট হিসাবে কনোকো ফিলিপস সর্বোচ্চ ৭৭.৫০ শতাংশ থেকে ৬৬.২৫ শতাংশ পাবে। এখানে আমরা অবশ্য ধরে নিয়েছি ৫৫% গ্যাসের দ্বারা কষ্ট রিকভারি কমপ্লিট হয়ে যাবে। যদি তা না হয় তাহলে আমাদের গ্যাসের শেয়ার এরপরেও আরো কমবে। আর যদি আরো কম গ্যাসেই কষ্ট-রিকভারি হয়ে যায় (অর্থাৎ পেট্রোবাংলা যদি সর্বোচ্চ দেশপ্রেম নিয়ে কষ্ট মনিটর করে) তাহলে হযতো শেয়ার বাড়বে। কিন্তু তামিম সাহেব যদি রপ্তানির সুযোগ সংক্রান্ত ধারাবলিও এখানে পাশাপাশি তুলে ধরতেন তাহলে পূর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশ পেত। তখন দেখা যেত ভাগ-বাটোয়ারার পূর্বনির্ধারিত সম্ভাব্য অনুপাতটি হচ্ছে ৮০.২০’।

৩। স্যারের বিশ্লেষণের আরেকটা তথ্য কিছুটা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘এই ১৫.৬ উপধারার এবিসি শর্তগুলো তখনই গ্যাসের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে যখন পেট্রোবাংলা এই বৃহৎ আইওসি’র সঙ্গে গ্যাস বিক্রির আর্থিক শর্তটি তথা দাম নির্ধারণে প্রথমে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে এবং ওই দামে তা নিজে কিনতে রাজী হয়’। যুক্তিটা ঠিক না। পেট্রোবাংলা সম্পুর্ন গ্যাস কেনা ক্ষেত্রে এবং তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রীর ক্ষেত্রে মূল্য খুব স্পেসিফিক ভাবে পিএসসিতে বলা আছে। বন্টনের যে শতকরা ভাগ দেয়া আছে, সেটার মাত্রা গ্রহণযোগ্য কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা যায় কিন্তু মূল্যের ব্যাপারে ঐকমতে পৌছানোর কোন ব্যাপার নেই।

অবশ্য স্যার নিজেই আবার কিছুটা স্ববিরোধিতা করে বলেছেন, ‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেছেন, চুক্তির ১৫.৭ ধারায় দাম নির্ধারণের যেসব পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা ব্যবহার করে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দাম এখনই হিসাব করা সম্ভব’।


কিছু জবাবদিহিতা...

ইদানিং কনোকোফিলিপস নিয়ে আমার দুই পর্ব লেখার পর জাতীয় কমিটির বিরোধিতা করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছি। নিজেকে ডিফেন্ড করতে চেয়েছি আমার মত। জাতীয় কমিটির বৃহত্তর উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কোনই দ্বিমত কিংবা দ্বিধা নেই, আমি এনার্জি সংশ্লিষ্ট জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করে ধীরে ধীরে বিদেশ নির্ভরতা কমানোর কড়া সমর্থক। তথ্য উপাত্ত দিয়ে আমি দেখিয়েছি গ্যাস রপ্তানির কোন সুযোগতো এই মুহূর্তে নেই-ই, দ্রুত নতুন গ্যাস ক্ষেত্র খোঁজে বের করা আমাদের দরকার। কিন্তু তথ্য উপাত্ত নিজের মত করে বিচার-বিশ্লেষণ করার অধিকার আমার আছে। এটা যেমন সোস্যাল নেটওর্কিং, ব্লগিং, মাইক্রো-ব্লগিং এর মাধ্যমে সহজ যোগাযোগের সময়, তেমনি তথ্য-উপাত্তের অবাধ প্রবাহের সময়। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি আন্দোলনের এই মুহূর্তের ফোকাস খুব বেশি কনোকোফিলিপস কেন্দ্রিক, যেটা মুল ফোকাসকে ডাইলিউট করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমি মনে করি আন্দোলনের তত্ত্ব-তথ্য নিয়ে খুব পরিস্কার থাকতে হবে।

প্রেশার গ্রুপের সাথে জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের বিভিন্ন অংশের ইন্টারেকশন নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু মতামত ছিল, কিন্তু সেগুলি লেখার জন্য এখন সময়টা প্রশস্ত নয় বলে মনে হল।

একদম শেষে, সচলায়তনে পাতার নিচের ট্যাগ লাইনটা পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ‘লেখা ও মন্তব্যের দায় একান্তই সংশ্লিষ্ট লেখক বা মন্তব্যকারীর, সচলায়তন কর্তৃপক্ষ এজন্য কোনভাবেই দায়ী নন’।


মন্তব্য

নীলকান্ত এর ছবি

আমি মনে করি আন্দোলনের তত্ত্ব-তথ্য নিয়ে খুব পরিষ্কার থাকতে হবে।

সম্পূর্ণ একমত। এই একটি জিনিস গত কয়েকদিন ধরে বলার চেষ্টা করছি।
বোঝার ভুল থাকতে পারে। উপাত্তের ভুল থাকতে পারে। কিন্তু সেসব আমাদের দূর করতে হবে। সঠিক কি তা জানতে হবে।


অলস সময়

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আন্দোলনের এই মুহূর্তের ফোকাস কি কনকোফিলিপস কেন্দ্রিক? আমার তা মনে হয় না। যে কোনো মূল্যে দেশের প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ বিদেশে পাচার ঠেকানোটাই তো ফোকাস।

এই ব্যাপারে সরকারের ফোকাস কী?
বাপেক্সকে শক্তিশালী করে সম্পদ নিজের কাছে রাখাটাই কি সরকারের ফোকাস হওয়া উচিত ছিলো না?

আন্দোলনের তত্ত্ব তথ্য পরিষ্কার হওয়ার চেয়ে এই মুহূর্তে বেশি জরুরী এই বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করা। কিন্তু করছে কোথায়?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুমন চৌধুরী এর ছবি

সরকার অবস্থান পরিস্কার তো করছেই না উল্টা আন্দোলনকারীদের টোকাই বলছে। আনু মুহাম্মদের শার্টৈর দামও জানতে চেয়েছে। আজকের হরতাল যারা করেছে তাদের অনেককেই জানি। তারা কে কতটা ভাংচুর বা ভাংচুরের উস্কানি দিতে পারে তাও জানি। সরকারের এই ঢালাও গ্রেফতারের মতো আচরনের অর্থ হচ্ছে তারা এই প্রসঙ্গে কাউকে কথা বলতে দেবে না।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আজকে সরকার যা করলো তা চরম নিন্দনীয়, উস্কানীমূলক...
উস্কানীটা উদ্দেশ্যমূলক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বইখাতা এর ছবি

ব্যাপক ধরপাকড় হয়েছে... আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যেন সরকার ভয় পাচ্ছে...এই আগ্রাসী আচরণের নিন্দা জানাই...

নৈষাদ এর ছবি

সহমত।

নৈষাদ এর ছবি

(সুমন চৌধুরীর মন্তব্যের জবাব)

সরকারের স্পষ্ট অবস্থান এবং আন্দোলনকারীদের প্রতি প্রতিক্রিয়ার ব্যাপার আপনার সাথে সহমত।

সরকারের এই ঢালাও গ্রেফতারের মতো আচরনের অর্থ হচ্ছে তারা এই প্রসঙ্গে কাউকে কথা বলতে দেবে না।

অর্থ তো এরকমই হয়। অবাক লাগে সরকারের বুদ্ধিবৃত্তিক কোন কমিউনিকেশন নেই, হয় রেটোরিক, বালখিল্যতা নাইলে মধ্যযুগীয় মারামারি।

নৈষাদ এর ছবি

(নজরুল ইসালামের মন্তব্যের জবাবে...)

প্রথমে আসি সরকারের ব্যাপারে। সরকার কিছুই বলছে না পরিষ্কার ভাবে, এমনকী চুক্তির ব্যাখ্যাও দিচ্ছে না স্পষ্টভাবে (যদিও আমি মনে করি পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যেত)। কিন্তু তাই বলে আজে বাজে কথায় কমতি নেই... সংসদে দাঁড়িয়ে টোকাই বলা কিংবা ‘দেশপ্রেমিক’ জাতীয় বালখিল্যতা। অবাক লাগে যখন ‘গ্যাস রপ্তানিতে রাজি হইনি বলে...’ জাতীয় কথা প্রধানমন্ত্রির মুখ থেকে বের হয়।

(যেহেতু আইওসির ‘ক্ষমতা’র ব্যাপারে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা আছে, আমার তাদের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের-ক্ষমতাজনিত থিওরীর প্রতি কখনই ন্যূনতম বিশ্বাস নেই। তবে দেশের প্রধানমন্ত্রি যখন আমাদের এই কথা বলে এবং চারিদিকে সবাই বিশ্বাস করে, তখন আমি কোন হরিদাস পাল...।)

সবচেয়ে অবাক করেছে গতকালের মারমুখী আচরণ....। আমি নিশ্চিত নই এই আক্রোশ কেন কিংবা কার বিরুদ্ধে। এটা সরকারের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাকে স্পষ্ট করে তুলছে।

আসি আন্দোলনে কথায়। নজরুল ভাই, আন্দোলনের এই মুহূর্তের ফোকাস কনকোফিলিপস কেন্দ্রিক বলে মনে হয়েছে আমার। সেটাতে কিছুটা আমার কিছুটা আপত্তি ছিল বলে বলেছি। যদি কনোকোফিলিস্পের চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয় তবে শেভরন সান্তোস কিংবা তাল্লোর চুক্তির বিরুদ্ধে নয় কেন। সবারই তো এই একই রপ্তানির সুযোগ আছে। সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে/এবং সুশীল সমাজ (ভাল অর্থে) আন্দোলনে সংস্পৃক্ত করতে হলে এই জ্বালানি সংকটের সময় সরকারের কি করা উচিত সেটার বিস্তারিত পরিকল্পনা দিতে হবে বলে আমার মনে হয়েছে। অথবা সরকারের একটা মরাল গ্রাউন্ড তৈরী হয় এধরণের চুক্তি করার জন্য।

ব্যাপারটা বুশ সাহেবের ‘ইউ আর আইদার উইথ মি, ওর উইথ দ্য এনিমিজ’ তত্ত্বের মত না। এই দেশে যেহেতু থাকব এবং আমার উত্তরপুরুষ এই দেশে বড় হবে, দেশের ভবিষ্যতের সাথে আমারও ভবিষ্যতও জড়িত।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চুক্তির ব্যাখ্যা তো দূরের কথা চুক্তিটা প্রকাশ করতে সরকারের সমস্যা কী? এই গ্যাস তো আওয়ামীলীগ সরকারের না, ১৬ কোটি মানুষের সম্পদ। এটা কিভাবে কার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে না হচ্ছে সেই হিসেব জনগনের কাছে স্বচ্ছ থাকতে হবে

এই অস্বচ্ছতার সঙ্গে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর "গ্যাস রপ্তানীতে রাজী হইনি বলেই ক্ষমতায় আসতে পারিনি" আমাদেরকে একটা বিশাল প্রশ্নের সামনেই দাঁড় করিয়ে দেয়... তাই নয় কী?

গতকাল সরকারের মারমুখি আচরণ দেখে আমার নিরাপত্তাহীনতা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছে এই অহিংস আন্দোলকে সরকার সহিংসতার দিকেই ঠেলে দিতে চায়, ইচ্ছাকৃতভাবেই। যে গাড়ি ভাংচুর হলো, সেটা কারা করেছে এটা খতিয়ে দেখা জরুরী।
আমজনতা যেহেতু তেল গ্যাসের হিসেব এখনো বোঝে না তেমন, আওয়ামী ছাত্রলীগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা সেক্ষেত্রে সারাদেশে একে একটা নৈরাজ্যবাদ হিসেবে চালিয়ে দিতে পারবে। আর বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র থিউরী হিসেবে দাঁড় করাতেও সমস্যা হবে না। ইতোমধ্যে বিদেশী স্বার্থের অপবাদ কাঁধে চেপেছে। অপেক্ষা করছি "মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বানচাল করতেই এই আন্দোলন" ধরণের বার্তাও পাবো... হাসি

প্রথম থেকেই এই আন্দোলনকে শুধু আনু মুহাম্মদের আন্দোলন বলে খাটো করবার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এটা যে আমজনতার দাবী, তা সরাসরি অস্বীকার করার প্রবণতা।

আপনি যেভাবে বললেন, সেভাবে দেখলে অবশ্যই আন্দোলনের এই মুহূর্তের ফোকাস কনোকোফিলিপস কেন্দ্রীক। কিন্তু এই জাতীয় কমিটি কিন্তু শুধু এই চুক্তির বিপক্ষেই আন্দোলন করছে না... ফুলবাড়ি থেকে বন্দর... সব কিছু নিয়েই সোচ্চার। এমনকি কোনো বিশেষ সরকারের আমলকেও বেছে নিচ্ছে না। সব আমলেই

এই জ্বালানী সংকটের কালে করণীয় কী সেই রূপরেখা দেওয়াটা আন্দোলনকারীদের দায়িত্ব কেন হবে? আর তা না দিলে এ ধরনের চুক্তি করার ব্যাপারে সরকারের মরাল গ্রাউন্ড কেন তৈরি হবে? বুঝি নাই।
পুলিশ না পাঠিয়ে সরকার তো একটা বৈঠকের আয়োজন করতে পারতো। "টোকাই" "মনু মুহাম্মদ" না বলে একবার আলোচনা করতে পারতো

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নৈষাদ এর ছবি

প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ যে আপনি আমার কিছু ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে আপনার যুক্তি দাঁড়া করাচ্ছেন। ব্যাপারটা আমার নিজের বুঝার জন্যও দরকার। (হয়ত আমার বুঝাতেই ভুল আছে)।

১।

এই অহিংস আন্দোলকে সরকার সহিংসতার দিকেই ঠেলে দিতে চায়, ইচ্ছাকৃতভাবেই।

এর যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যুক্তিসঙ্গত। এখানে আরেকটা লজিক দাড়া করানো যায়, যেহেতু বিরোধিদল এই আন্দোলনে সরাসরি সাপোর্ট দিতে পারছে না (এটার তত্ত্ব মন্তব্য ২ তে), গাড়ি-ভাঙ্গাভাঙ্গি টাইপের সহিংস ঘটনার পেছনে ইন্ধন যুগিয়ে পুরো ব্যাপাটাকে ঘোলাটে করে ফেলারও একটা সম্ভাবনা কে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু এই যুক্তি পুরাপুরো ধোপে টেকে না একটাই কারণে – সরকারের মারমুখি আচরণ করেছে প্রথম ক্ষেত্রে। আচ্ছা, আপনার যুক্তি মানলাম।

২। (ক) বিরোধিদল এই আন্দোলনকে কেন সাপোর্ট করতে পারছে না? কারণ তারাও সেই একই শর্তে চুক্তি করেছে (আমার মত)। (খ) কিন্তু প্রধানমন্ত্রির ‘রপ্তানি এবং ক্ষমতায় আসা’ হাইপোথিসিসের ভিত্তিতে আপনি বলতেই পারেন, আইওসির বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে ‘ক্ষমতায় আসা’ অনিশ্চিত করে ফেলা। সুতরাং ‘ক্ষমতালিপ্সু’ কোন পার্টি এর বিরোধিতা করবে না।

৩।

চুক্তিটা প্রকাশ করতে সরকারের সমস্যা কী?

কেউ কেউ এক্সেস-টু-ইনফোরমেশন অধিকারের কথাও বলেছেন।
আমার মন হয় না চুক্তি ‘পাবলিকলি’ প্রকাশ করা সম্ভব। এক মুহূর্তে চুক্তির ড্রাফটা আমার কাছে নেই, কিন্তু যতটুকু মনে হয় এখানে কনফিডেনশিয়্যালিটি বলে একটা ক্লজ আছে, যেটা দুপক্ষকেই রক্ষা করতে হয়। ক্লজ অনুযায়ী চুক্তির ‘পার্টিজ’ এর বাইরে কারো কাছে (যেমন ঋণদান কারী সংস্থা) প্রকাশ করতে হলে কী করতে হবে সেটাও বলা আছে (আরেকটা কনফিনেশিয়্যালিটি চুক্তি করতে হবে)।

(আমি গুগলে সার্চ করে স্বাক্ষরিত চুক্তি তো নাইই, কোন মডেল পিএসসিও পেলাম না, এমন কি পাশের দেশ ভারতের কিছু সাইটও খোঁজেছি।) এবং নিশ্চিত ভাবেই বন্টন % ইত্যাদি গোপনীয় থাকায় সরকার অন্য আইওসির সাথে নেগোসিয়্যাশনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। আমি যেটুকু বুঝি, চুক্তি কখনও ‘পাবলিকলি’ প্রকাশিত হবে না, প্রত্যাশিতও নয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে চুক্তিতে দেশের পক্ষে নয় এমন শর্ত থাকলে তা জনগন কীভাবে জানবে? যে কোন কনফিডেনশিয়্যাল ক্লজ কার্যকারী হবে না যদি ‘রেগুলেটরি বডি’ দেখতে চায়, কিংবা ‘ল’স অভ ল্যান্ড’ চায়। সুতরাং সংসদীয় কমিটি হয়ত দেখতে পারে। প্রাথমিকভাবে জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিই এটা নিশ্চিত করবে। কিন্তু এখানে হচ্ছে না বলে ধরে নিচ্ছি (জনপ্রতিনিধিই যেখানে আইওসি হাইপোথিসিস দেয়)।

আসলে আমি এই জিনিসটাই বুঝতে চাইছিলাম। গনতন্ত্রে জনপ্রতিনিধির সাথে জনসমর্থিত প্রেশার গ্রুপের ইন্টারেকশন কী ভাবে হবে?

৪। ২০০১ এ পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানির ধোঁয়া কিংবা ফুলবাড়ির আন্দোলনের মত জনসম্পৃত্ততা/স্পন্টেনিয়াস সাপোর্ট এই মুহূর্তে নিশ্চিত করা যাচ্ছে কী? সুশীল/বুদ্ধিজীবি শ্রেণিও কিছুটা নিরব, যেভাবে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সরকার জ্বালানী সংকটেকেও একটা এক্সকিউজ হিসাবে পাচ্ছে।

৫।

এই জ্বালানী সংকটের কালে করণীয় কী সেই রূপরেখা দেওয়াটা আন্দোলনকারীদের দায়িত্ব কেন

– কিছুটা দায়িত্ব। সরকার যদি বলে একটাই একমাত্র সমাধান তবে তো আন্দোলনকারীর সম্ভাব্য সমাধানের নির্দেশনাও দিতে হবে।

৬। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়/এবং বুয়েটের ভুমিকাও হতাশজনক। এধরণের একটা ইন্টেলেকচুয়্যাল আন্দোলনের সবক্ষেত্রেই তাদের ভুমিকা, অথচ এত ফারাক। (পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান/ম, তামিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের/বুয়েটের শিক্ষক, আবার আকাশ স্যার কিংবা অধ্যাপক নুরুল ইসলামও শিক্ষক আন্দোলনের অগ্রভাবে সেই ছাত্ররা...।)। কী বিপরীত চিন্তাভাবনা!!

পুলিশ না পাঠিয়ে সরকার তো একটা বৈঠকের আয়োজন করতে পারতো। "টোকাই" "মনু মুহাম্মদ" না বলে একবার আলোচনা করতে পারতো...

হাড়ে হাড়ে সহমত।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

একদিকে সরকারের রহস্যময় নীরবতা, অন্যদিকে মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদের কথা পুরো ব্যাপারটিকে একটি বিভ্রান্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। চুক্তি নিয়ে যে প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে সেগুলোর জবাব দেওয়ার জন্য কেন কাউকে পাওয়া গেলো না?

সমাধানের নির্দেশনা তখনি দেওয়া সম্ভব যখন বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হবে। সরকার তরফে তো সেরকম কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। তিরষ্কার আর অপমানসূচক কথাই কেবল বলা হয়েছে, আলোচনার মাধ্যমেই তো সমাধান হতে পারতো তাই না?

ঢাবি বুয়েট কর্তৃপক্ষের ভুমিকায় হতাশ হওয়ার কিছু নাই... সবই দলীয় বিবেচনা

আমি আপনার যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করছি না। আমিও আসলে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছি। চুক্তি যাই থাকুক না থাকুক, সরকার কেন স্পষ্ট কিছু বলছে না, কেন আচরণ এতোটা মারমুখি তা বুঝতে চেষ্টা করছি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মাজহার এর ছবি

সরকারের এই ঘৃণ্য আচরণের মধ্যেও আমি আশার আলো দেখতে পাই, অন্তত তারা আমাদের মত টোকাইদের গোণায় ধরে..!!

একজন টোকাইয়ের জন্য ছয়জন পুলিশ। রাষ্ট্রের এই ডিফেন্ডিং অ্যাটিটিউড বলছে, চালিয়ে যেতে পারলে- সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পারলে এই টোকাইগিরি বিফলে যাবে না...

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

প্রেশার গ্রুপের সাথে জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের বিভিন্ন অংশের ইন্টারেকশন নিয়ে আপনার মতামত জানতে মন চায়!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।