বাস্তবতার রাজনীতি

নৈষাদ এর ছবি
লিখেছেন নৈষাদ (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৪/২০১৭ - ৭:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে-ই-হাদিসকে মূলধারা শিক্ষার স্নাতকোত্তর পর্যায়ের স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা এখন পুরানো খবর।

আমরা জানি গণভবনে যে অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা দেয়া হয়, সেখানে অন্যান্যদের সাথে হেফাজাতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী উপস্থিত ছিলেন, তিনি আবার কওমি মাদ্রাসাগুলোরও নিয়ন্ত্রক। এই স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠান প্রধানমন্ত্রী আরেকটি কথাও বলেন -‘‘সুপ্রিম কোর্টের সামনে সম্প্রতি স্থাপন করা থেমিসের মূর্তি আমিও পছন্দ করিনি৷ থেমিসের মূর্তিতে আবার শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এই মূর্তি স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমি কথা এগিয়েছি৷ দেখি কী করা যায়৷'' উল্লেখ্য, হেফাজতে ইসলাম এই মূর্তি/ভাস্কর্য সরানোর দাবী (অন্যথায় আন্দোলন) করে আসছিল। এগুলি পুরানো খবর। আমি শুধু আমার মতামতটা তুলে রাখলাম।

হেফাজতে ইসলামির আমির আহমদ শফীর সাথে প্রধানমন্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি সোস্যাল এবং মূলধারর মিডিয়াতে বেশ প্রচার পেয়েছে।

এখানে আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কিছুদিন আগে ‘মূলধারার’ পাঠ্যবইয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়, যেটা হেফাজতে ইসলামের দাবী ছিল। এই বছরের ২২ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসের এই সংক্রান্ত একটা প্রতিবেদনে সম্প্রতি মিডিয়াতে প্রচুর ‘কাভারেজ’ পাওয়া মুফতি ফয়জুল্লার এই পরিবর্তনে হেফাজতে ইসলামের কৃতিত্ব দাবী করে দাম্ভিক উচ্চারণ দেখতে পাই, “Mufti Fayez Ullah, of Hefazat-e-Islam, said he had been compelled to go over those people’s heads to high-ranking officials.”

প্রত্যাশিতভাবেই আওয়ামী লীগের একাংশের এবং প্রগতিশীলদের মধ্য এই বিষয়গুলি ভীষণ অস্বস্তির জন্ম দিয়েছিল। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নায্যতা দিয়েছেন, ‘বাস্তবতা বিবেচনা করে রাজনীতি করা হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক যে বাস্তবতা রয়েছে এবং জাতির যে অনুভূতি রয়েছে, তাতে আমরা যাঁরা রাজনীতি করি, তাঁদের সেই বাস্তবতা নিয়ে এগোতে হবে। বাস্তবতা মেনে যাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তাঁরাই প্রগতিশীল রাজনীতি করেন। আমরা সেটা মেনে নিয়ে রাজনীতি করছি।’

আওয়ামী লীগের বড় অংশ মনে করে ‘মাঠের বাস্তবতার’ কথা বিবেচনা করে এটা করা উচিত। আওয়ামী লীগের অনেকে এমনও বলেছেন যে, দেশের বাস্তবতা যে পরিবর্তন হয়েছে, শহুরে মধ্যবিত্ত সেটা বুঝতেই পারেনি। গত কয়দিনের কাসেম বিন আবুবাকারের তথাকথিত ‘জনপ্রিয় লেখকের’ তকমা এমন ধারণার ‘নায্যতা’ হিসাবে দেখানো হয়েছ।

এই বাস্তবতার পক্ষে অনেক কথা শুনেছি, এই ব্যাপারে আলোচনার ইচ্ছে নাই। (কয়েকজন আবার বিএনপির একমাত্র কমপিটিটিভ এডভান্টেজকে নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়ায় সুখ/শোক পেয়েছে।) নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের মত একটা সফল দল ‘দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা’ বুঝে। ১৯৯০ এর পর থেকে একমাত্র ২০০৮ এর নির্বাচন বাদে সাধারনত নির্বাচনের মৌসুমে আওয়ামী লীগের মধ্যে এই ‘বাস্তবতা’ উপলব্ধি করে একধরণের পরিবর্তনের ব্যাপার আমারা দেখে এসেছি (বিশেষকরে পোষাকে)।

২০০৬ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতিকালে আওয়ামী লীগ ‘বাস্তবতা’র বিচারে খেলাফত মজলিসের সাথে ৫ দফা চুক্তি করেছিল। বিএনপি অবশ্য তখন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার অনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছিল।

কিন্তু ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ‘বাস্তবতার’ সব দ্বিধা-দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। খেলাফত মজলিসের সাথে চুক্তি তখন আর প্রয়োগযোগ্য ছিল না। নারী-নীতি, ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া, যুদ্ধপরাধীর বিচার, ডিজিটালাইজেশন এসব সাহসী এবং প্রগতিশীল অঙ্গিকার নিয়ে ভোটের মাঠে ছিল।

গত ৩০-৩৫ বছরের মধ্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগ ৪৯% ভোটের সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়ে সংসদে গিয়েছিল। অর্ধেক ভোটার ‘দ্বিধা-দ্বন্দ হীন’ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল।

আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণে মনে হয়েছে ‘মাঠের বাস্তবতা’ এতদিন পর্যন্ত নির্বাচনে তমন প্রভাব ফেলেনি এবং এই ‘বিরাট ভোট-ব্যাংকের’ হিসাব আসলে ‘বিরাট অতিরঞ্জন’। ১৯৭০ এর ন্যাশানাল এসেম্বলি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ টি আসন। ভোটের শতকরা হিসাবে পেয়েছিল প্রায় ৭৫%। তারমানে ২৫% মত ভোটার আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি, যার একটা বড় অংশ হয়ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাও চায়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে, সত্তরের সেই অদম্য দিনগুলিতেও ২৫% বিপক্ষে ছিল।

১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ এ আওয়ামী লীগের শতকরা ভোটের হিসাব ছিল যথাক্রমে – ৩০.০৮%, ৩৭.৪৪%, ৪০,০২% এবং ৪৯%। ক্রমবর্ধমান হিসাব। আবার ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ এই চার নির্বাচনে মূল তিনটি দলের (আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি) প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হিসাব ছিল ৭২.৮১%, ৮৭.৪৪%, ৮৮,৬৪% এবং ৮৯.২০%। জামায়তে ইসলামি অপরদিকে ১৯৯১ সালে সর্বোচ্চ ১২.১৩% থেকে ২০০৮ তে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ৪.৬% এ নেমে এসেছে।

১৯৯১ এবং ২০০১ এ বিএনপি আওয়ামী লীগ থেকে মোট ভোটের হিসাবে যথাক্রমে মাত্র ২,৪৭,৬৮৩ এবং ৭,৫৪,৪৩৮ ভোট বেশি পেয়েছিল। আবার ১৯৯৬ আওয়ামী লীগ মোট ভোটের হিসাবে ১৬,২৬,৮০৬ ভোট বিএনপি থেকে বেশি পেয়েছিল। এগুলো মোটামোটি মার্জিন্যাল পার্থক্য। কিন্তু ২০০৮ এ যখন সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছেড়ে আওয়ামী লীগ সাহসী মেনিফেস্টো নিয়ে হাজির হল, তখন বিএনপি থেকে ভোটের ব্যবধান ছিল ১,০৯,২৩,৬১৫। এই পরিসংখ্যান অবশ্য ‘বাস্তবতার’ রাজনীতিকে অস্বীকার করে।

২০০৮ এর ডিসেম্বরের নয় বছর পর কী আসলেই কি বাস্তবতা এমন যে হেফাজতে ইসলামির মত একটা প্রতিক্রিয়াশীল দলকে মাথায় তুলতে হবে? আমি জানিনা। যদি হয় এর কারণ কী? বৈশ্বিক ডান-পন্থার উত্থান। নয়ত এর দায়ভার আওয়ামী লীগে কিছুটা বর্তায়।

তবে, ক্ষতি কিন্তু বেশ হয়ে যাচ্ছে। ভাস্কর/মুর্তি বিতর্কে মূর্তি ভাঙ্গা নায্যতা পেয়ে যাচ্ছে, পাঠ্য-পুস্তকে পরিবর্তন তো হয়েই গেছে। প্রগতিশীল শিক্ষাবিদেরা দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচি দেখে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের তার স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছেন, যদিও কওমি মাদ্রাসার অভিবাবকেরা সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে যাচ্ছেন, কিংবা এর পাঠ্যসূচিতে কী আছে সেটা সবখানে পরিস্কার না।

সর্বোপরি, বিশাল জনগোষ্টিকে মূলধারায় নিয়ে আসার একটা অলীক ‘বাস্তবতা’ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়েছে, বিরাট ভোট-ব্যাঙ্কের এক অতিরঞ্জিত ধরণার সৃষ্টি করা হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের ‘কমপিটেটিভ এজ’ নাই।

হেফাজতে ইসলামির আমির আহমদ শফীর সাথে প্রধানমন্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবিটা বহুবছর ধরে রেফারেন্স হিসাবে ফিরে আসবে। আওয়ামী লীগ আবোল-তাবোল নায্যতা দিয়ে যাবে।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়কার একটা নির্বাচনী পোস্টারের কথা মনে পড়ে। ছবিতে হিজাব পরিহিতা শেখ হাসিনা দেশবাসীর দোয়া চাইছেন। বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে চেনেন, অন্তত ১৯৮১ সালের মে মাস থেকে তো বটেই। তারা শেখ হাসিনার যে মুখটা মনে করতে পারেন সেটা সাধারণ সুতী শাড়ী পরা, মাথায় ঘোমটা দেয়া বা না দেয়া, চশমা চোখের একজন হাস্যোজ্জ্বল নারীর। হজ্জ্ব-ওমরাহ্‌-ইস্তেমা ইত্যাদি কালে বাড়তি ওড়না বা চাদরের কথাও তারা মনে করতে পারেন, কিন্তু হিজাব – কখনোই না। পোস্টারে শেখ হাসিনার অপরিচিত ছবি দেখে ভোটাররা বিভ্রান্ত হন, দ্বিধায় পড়ে যান। আমরা জানি সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসনে জিততে পেরেছিল। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারার হাজারোটা কারণের মধ্যে এই বিভ্রান্তিকর পোস্টারটাও ছিল। পরবর্তীকালে লোকে শেখ হাসিনাকে মূলত হিজাব ছাড়াই দেখেছেন। এতে তারা এটুকু ধারণা করতে পেরেছেন যে শেখ হাসিনা রাতারাতি পালটে যাননি, তিনি নিজের পূর্বপরিচয়ের সীমাতেই আছেন।

কিন্তু ২০১৭ সালে এসে বাংলাদেশের মানুষ কোন শেখ হাসিনাকে দেখতে পেলেন?

কোন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হলে বাকিদের উঠে দাঁড়ানোটা কনভেনশন। গণভবনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আগমনে আহমদ শফি বসে থেকে বুঝিয়ে দিল যে সে এসব কনভেনশনের তোয়াক্কা করে না। এমনকি অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কদমবুসি করার চেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়ে সে বুঝিয়ে দিয়েছে অনুষ্ঠানের ব্যান্ডমাস্টারের ব্যাটনটা কার হাতে। শেখ হাসিনা এই জীবনে এমন প্রচুর মানুষকে সাক্ষাত করেছেন যারা একইসাথে বয়োজ্যেষ্ঠ, জ্ঞানী, সর্বজন শ্রদ্ধেয়; কিন্তু তাদের কয়জনকে তিনি আনুষ্ঠানিক সভায় পা ছুঁয়ে কদমবুসি করেছেন? এই নতজানু শেখ হাসিনাকে যে বাংলাদেশের মানুষ চিনতে পারছে না সেটা কি তিনি জানেন বা বোঝেন?

সাধারণ নাগরিক হত্যা, পুলিশ-বিজিবি সদস্য হত্যা, ব্যাংক ও এটিএম লুট ও অগ্নিস্মাৎ করা, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস করা (পরিবহন পুলের গাড়ী, স্টেডিয়ামের টার্ফ, আইল্যান্ডের গাছ, জাতীয় মসজিদের আসবাব), মসজিদের মাইকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে জনউত্তেজনা সৃষ্টি করা ইত্যাদি জঘন্য ফৌজদারী অপরাধের জন্য দায়ীদেরকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করে কঠোর শাস্তি দেয়াটা যেখানে কাম্য ছিল সেখানে উলটো তাদেরকে রেলের জমি দেয়া, তাদের ব্যাপারে নতজানু আচরণ করা দুর্বৃত্তদের ঔদ্ধত্যর সীমা বাড়াতে বাড়াতে আজ এই পর্যায়ে এনেছে।

আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি আওয়ামী লীগ কথিত এই ‘বাস্তবতা’টা কী সেটা বোঝার। সেই চেষ্টা সম্পর্কে বলার আগে একটু ক্ষমতা, ভোট ইত্যাদি নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নেই।

আওয়ামী লীগের প্রায় সাত দশকের ইতিহাসে সব সময় তারা হয় ক্ষমতাসীন দল ছিল অথবা প্রধান বিরোধী দল ছিল। আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় গেছে সেটা ভোটে জিতেই গেছে। ১৯৮৮ আর ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি ছাড়া সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গেছে, এমনকি সামরিক শাসনামলেও। সুতরাং আওয়ামী লীগের ক্ষমতাভিমুখী রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে ভোট। পরিসংখ্যান বিবেচনায় নেই আর সাধারণ অভিজ্ঞতা খাটাই, যে কোন বিবেচনায় সবচে’ খারাপ দিনেও আওয়ামী লীগ কমপক্ষে ৩০% ভোট পায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনদিন কোন ইসলাম-পছন্দ দল জাতীয় নির্বাচনে ৩০% ভোট পায়নি। বস্তুত তাদের ভোট জামায়াতসহ ১০%ও হবে না। তাহলে ৩০+ কেন ১০- এর পেছন পেছন ঘোরে? একই প্রকার আচরণ করে বিএনপি তার সমর্থকদের বিরক্তির কারণ হয়েছে এবং সাধারণ ভোটারদের আস্থা হারিয়েছে। বাংলাদেশের ভোটের হিসেব, ভোটারদের ভোট দেবার হিসেব যে ভিন্ন প্রকারের সেটা ডঃ ইউনূস ‘সর্বনাশ’ (সর্বদলীয় নাগরিক শক্তি) করার সময় টের পেয়েছে। আওয়ামী লীগ কি এই সত্যটা বিস্মৃত হয়েছে?

আওয়ামী লীগ কি কোন কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে এই ‘বাস্তবতা’ খুঁজছে? সাম্প্রতিক কালে আওয়ামী লীগ কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচনের হিসেব এক নয়, ফ্যাক্টরগুলোও এক নয়। সুতরাং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোকে লিটমাস টেস্ট বলে বিবেচনা করার খুব বেশি কারণ নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারার কারণ, হয় ভুল প্রার্থী দেয়া অথবা অভ্যন্তরীণ কোন্দল। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। কর্নেল আকবর হোসেন নামে বিএনপির এক প্রয়াত নেতা কুমিল্লায় ‘একবার’ হোসেন নামে পরিচিত ছিল। কারণ সে পাঁচ বছরে একবার কুমিল্লায় যেত জাতীয় নির্বাচনে ভোট চাইতে। তারপরেও ‘একবার’ হোসেন বার বার জাতীয় নির্বাচনে জিততো। এর রহস্য কী সেটা জিজ্ঞেস করায় সে বলেছিল, বাহার আর আফজাল নামের আমার দুই জন কর্মী আছে, ওরাই আমাকে জিতিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, বাহার আর আফজাল হচ্ছেন কুমিল্লা আওয়ামী লীগের দুই নেতা যাদের মধ্যকার কোন্দল আজও বিদ্যমান। সাম্প্রতিক কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জেতার অন্যতম কারণ এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার দ্বন্দ্ব।

বর্তমান আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে বিপুল পরিমাণ ‘ত্যাগী’ ও ‘ভোগী’ নেতা বিদ্যমান। ‘ত্যাগী’ ক্যাটেগরিতে আছে ঐসব নেতারা যারা বিভিন্ন দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে অন্যদের বিশেষত সামরিক শাসকদের পক্ষ্মপুটে আশ্রয় নিয়েছিল। পরে আবার আওয়ামী লীগের সুদিন আসলে তারা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে’। ত্যাগীদের মধ্যে আরেকটা গ্রুপ আছে যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর বৈদেশিক ঘি-মধুর অভাবে পড়ে ‘বোধিলাভ’ করে এবং মার্কস-লেনিনকে ত্যাগ করে নৌকাতে উঠে পড়েছে। ত্যাগীদের তৃতীয় গ্রুপে আছে জিয়ার সৈনিক আর মওদুদীর সৈনিকেরা যারা গায়ের চামড়া বাঁচাতে নৌকায় উঠে পড়েছে। এতে জানও বাঁচে সাথে দুটো আয়ও হয়। ‘ভোগী’ ক্যাটেগরিতে আছে ঐসব নেতারা যারা আসলে ব্যবসায়ী, এবং রাজনীতিটা তাদের জন্য ব্যবসায়ের একটা ‘টুল’ মাত্র। এই ভোগী আর ত্যাগী নেতাদের ভীড় বাড়লে নির্বাচনে ভুল প্রার্থী দেয়া আর অভ্যন্তরীণ কোন্দল কেবল বাড়বেই। তাতে নির্বাচনে পরাজয়ের ঝুঁকি কেবল বাড়তে থাকবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এদেরকে কাউয়া/হাইব্রীড/ফার্মের মুরগী বলেছেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগে এর বাইরে আরেকটি নিরব গ্রুপ আছে যারা কখনো কখনো নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করতে ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়াতে সমর্থ হয়। হিজাবী পোস্টার, খেলাফতের সাথে চুক্তি, হেফাজতকে মাথায় তোলা এই গ্রুপের কৃতিত্ব। তাদের আল্টিমেট লক্ষ্য আওয়ামী লীগকে বিএনপির অনুরূপ দুরবস্থায় ঠেলে দেয়া। এরাই হচ্ছে ‘বাস্তবতাবাদী’ গ্রুপ। এরা চায় এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো (তা বিএনপি হোক আর আওয়ামী লীগ হোক) বিভ্রান্ত হোক, বিপথগামী হোক, ধ্বংস হোক। তাহলে তাদের আকাঙ্খিত পদ্ধতি – অর্থাৎ বিনা নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রের চির বিদায় ঘটানো যায়।

কওমী মাদ্রাসাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে, তাতে যথাযথ সংস্কার করে তার ডিগ্রীকে স্বীকৃতি প্রদান করাটা কাম্য ছিল। কিন্তু তা না করে হেফাজতের দাবীকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে মেনে নেয়াটা দেশকে ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার নামান্তর। আর থেমিস-কাণ্ড তার অবশ্যম্ভাবী কনসিকোয়েন্স। ‘বাস্তবতাবাদী’ গ্রুপের আকাঙ্খিত বাংলাদেশের চেহারাটা কেমন হবে সেটা একটু একটু করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি জেতে তাহলে বুঝতে হবে আসলে আওয়ামী লীগ হেরেছে, যেমনটা ২০০১ সালে হয়েছিল। দল হিসেবে বিএনপি ধ্বংস হয়েছে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে, আর আওয়ামী লীগ ভরাডুবির পথে যাবে রাষ্ট্রবিরোধী, সমাজবিরোধী হেফাজতে ইসলামের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলে।

নৈষাদ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য। বিশ্লেষণের সাথে সহমত। আমার খুব বেশি কিছু যোগ করার নেই। আপনার মত আমিও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি এই ‘বাস্তবতা’টা বোঝার।
ছবিটা আমাকে নিশ্চিতভাবেই অস্বস্তিতে ফেলেছে। গত ছয়-সাত বছরের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই ছবিটা রিপ্রেজেন্ট করেনা। বহু বছর এই ছবি রেফারেন্স হয়ে ফিরে আসবে।

সোহেল ইমাম এর ছবি

আওয়ামী লীগের অনেকে এমনও বলেছেন যে, দেশের বাস্তবতা যে পরিবর্তন হয়েছে, শহুরে মধ্যবিত্ত সেটা বুঝতেই পারেনি।

আমার মনে হয় এই মধ্যবিত্তকে আমলে না আনাটাই প্রমাণ করছে আওয়ামীলীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা দেউলে হয়ে উঠছে। এই ভুলটা বিএনপিও করেছিলো। কেমন যেন মনে হচ্ছে রাজনৈতিক কুটবুদ্ধির ক্যারিশমা দেখালেও দলটা আর তার সময়কে পড়তে পারছেনা। লক্ষণটা দেশের জন্য তো বটেই দলের জন্যও ভালো না।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নৈষাদ এর ছবি

ধন্যবাদ।
‘শহুরে মধ্যবিত্তের’ বিস্তৃতি কতটা সেই ব্যাপারেও আমি সন্ধিহান। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট্ট মফস্বলের যে মানুষটা অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ঢাকায় আমার সহকর্মী থেকে রাজনীতি অনেক ভাল বিশ্লেষণ করে, সে কী শহুরে মধ্যবিত্তের আওতায় পরে। আওয়ামী লীগের নিশ্চয়ই ভোটারের বিশ্লেষণ আছে…জানিনা। তবে আমার কাছে এই ‘বাস্তবতাকে’ অতিরঞ্জন মনে হয়েছে।

Emran  এর ছবি

আওয়ামী লীগের নেতারা যতই ইসলামী লেবাস ধারণ করুক না কেন, যারা ইসলাম-পছন্দ রাজনীতির সমর্থক, তারা কোনদিন আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় নাই, তারা কোনদিন আওয়ামী লীগকে ভোট দিবেও না। তাদেরকে তোয়াজ করার কোন দরকার আওয়ামী লীগের নাই - এই সত্য আওয়ামী লীগকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিৎ।

সরব চিন্তাঃ এই লেখা ২০১০-২০১১ সালে পোস্ট হলে এতক্ষনে অন্ততঃ ৫০টা মন্তব্য চলে আসত! তাহলে কি ধরে নেব যে বাংলা ব্লগের সূর্য অস্তায়মান?

Emran

নৈষাদ এর ছবি

ইসলাম-পছন্দ রাজনীতির সমর্থকদের ভোটের ব্যপারে আপনার সাথে আমি পুরোপুরি সহমত। (আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক অবশ্য ‘হার্ড-কোর’ এবং ‘সফট’ ইসলাম-পছন্দ রাজনীতির ‘সমর্থকদের’ কথা বলেছেন। ‘হার্ড-কোর’ না দিলেও ‘সফট’দের নিয়ে আসার আশা প্রাকাশ করেছেন)।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।