স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম ০১

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: সোম, ২৪/১২/২০০৭ - ৫:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভূমিকা
আমার সংগ্রহের যে মুষ্টিমেয় কিছু গ্রন্থকে আমার কাছে অমূল্য মনে হয় তার মধ্যে পূর্ণেন্দু দস্তিদার লিখিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’ বইটি অন্যতম। আমার ধারণা বইটি এখন দুষ্প্রাপ্যও বটে। ব্রিটিশ ভারতে চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে এ গ্রন্থ রচিত হলেও এতে উল্লেখ্য হাবিলদার রজব আলী খাঁ, মাস্টারদা সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার, কল্পনা দত্ত আজ আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। আমরা অনেকে শুধু নামগুলোই জানি, জানি না এই বীর মুক্তিকামী মানুষগুলোর পেছনের গৌরব-গাঁথা; যেমনটা আমরা অনেকেই জানি না একাত্তরের অনেক বীর শহীদের গল্প। এ লেখার উদ্দেশ্য হল ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ বর্ণণার মাধ্যমে মুক্তিকামী সেইসব বীর শহীদদের বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং এসব আন্দোলনে চট্টগ্রামের অগ্রণী ভূমিকার বিবরণ তুলে ধরা। তিনশ পৃষ্ঠার বিশাল এই গ্রন্থটি এখানে হুবহু তুলে দিতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু সময়স্বল্পতার কারণে সারাংশ আকারে এখানে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণণা দিতে চেষ্টা করেছি কিছু নিজের ভাষায়, কিছু লেখকের কাছ থেকে ধার নিয়ে। অনেক কেটে-ছেঁটে যে বিষয়গুলো নিয়ে লিখব ভাবছি তা হল- ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন, সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের আত্মপ্রকাশ ও ১৯৩০ সালের অস্ত্রাগার লুন্ঠন, জালালাবাদ যুদ্ধ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ এবং সর্বশেষ ইংরেজগণ কর্তৃক সূর্য সেন ধৃত ও হত্যার বিবরণ। আজকের পর্ব সিপাহী বিদ্রোহ।

সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৫৭
===========================

ভারতবর্ষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহই যে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম গণ-আন্দোলন তা আজ স্বীকৃত। এর শুরুটা হয়েছিল ব্যারাকপুরে। ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে বীর সিপাহী মংগল পান্ডে টহল দিচ্ছিলেন। দূরে ৩৪ নং পদাতিক বাহিনীর সিপাহীদের লক্ষ্য করে হঠাত তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, এসো ভাইসব- যে ফিরিঙ্গিরা আমাদের ধর্ম ও জাতিচ্যুত করেছে, তাদের খতম করে আমাদের দেশকে স্বাধীন করি। হট্টগোল দেখে ইংরেজ এডজুটেন্ট লেফটেন্যান্ট বাগ ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসেন। কাছে আসতেই মংগল পান্ডের বন্দুক গর্জন করে ওঠে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তলোয়ারের ঘায়ে মংগল পান্ডে লেফটেন্যান্ট বাগ এবং আরেকজন সার্জেন্ট মেজরকে ঘায়েল করেন। অন্যান্য ইংরেজ কর্মচারীরা এ সময় তাকে ঘিরে ফেললে মংগল পান্ডে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। আহত মংগল পান্ডে এবং তাকে আটক করতে অস্বীকার করায় ঈশ্বরী পান্ডেকেও আটক করা হয়। ১৮৫৭ সালের ৮ই এপ্রিল সকাল ১০টায় ব্যারাকপুর ময়দানের পাশে একটি অশ্বথ গাছে ঝুলিয়ে এই দুই বীর সিপাহীকে ইংরেজরা ফাঁসী দেয়। সিপাহী-বিপ্লবের আগুন এখানেই প্রথম ধূমায়িত হল।

এ পর্যন্ত কাহিনী কম-বেশী আমরা সবাই জানি। যেটা জানি না তা হল, এরপর চট্টগ্রামের মুক্তিপাগল বীর সিপাহীরাই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সারা ভারতে সবার আগে বিদ্রোহের ঝান্ডা উঁচু করে তুলে ধরেছিলেন। মংগল পান্ডে ও ঈশ্বরী পান্ডের ফাঁসীর পরে ভারতের সিপাহীদের মধ্যে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের ৩৪নং রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। হাবিলদার রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহীরা সরকারী কোষাগার থেকে তিন লক্ষ টাকা লুট করে নিল। জেলখানার কয়েদীদের মুক্তি দিয়ে তারা সৈন্যদের ব্যারাক পুড়িয়ে দিল এবং অস্ত্রাগার ধ্বংস করল।

তারপর তিনটি সরকারী হাতি আর দুটি ঘোড়ার উপর লুটের মাল চাপিয়ে এই সিপাহীরা চট্টগ্রাম শহর থেকে বড় সড়ক ধরে ত্রিপুরার দিকে এগিয়ে চলল। তারা আশা করেছিল স্বাধীন ত্রিপুরা রাজার সাহায্য ও সহানুভূতি তারা পাবে। কিন্তু ইংরেজের দালাল ত্রিপুরা রাজা নিজের সৈন্য দিয়ে সিপাহীদের ত্রিপুরায় প্রবেশ করতে বাধা দিল। সেখানে বাধা পেয়ে কুমিল্লার পাহাড়ি এলাকার দিকে সিপাহীরা অগ্রসর হলেন। সেখানেও ত্রিপুরের রাজা আক্রমণ চালালে সিপাহীরা মণিপুর রাজ্যের উদ্দেশ্যে সিলেটের দিকে এগিয়ে যায়। ইংরেজ মেজর বাইজের নেতৃত্বে সিলেটের পদাতিক বাহিনী চট্টগ্রামের এই মুক্তিপাগল বিদ্রোহীদের আক্রমণ করে। সীমান্ত ষ্টেশন লাতুতে উভয় পক্ষের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। সংঘর্ষে মেজর বাইজ নিহত হলেও বিদ্রোহী সিপাহীরা ছত্রভংগ হয়ে যায়। পরে তারা বনের মধ্যে আত্মগোপন করে। এরপর তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।*

তথ্যসূত্র- স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম। লেখক-পূর্ণেন্দু দস্তিদার। বইঘর প্রকাশনী,চট্টগ্রাম। প্রথম প্রকাশঃ অক্টোবর,১৯৬৭।

*সিপাহী বিদ্রোহের তথ্যগুলি লেখক পূর্ণেন্দু দস্তিদার চট্টগ্রাম জিলা কংগ্রেসের প্রাক্তন সহ-সভাপতি ত্রিপুরা চরণ চৌধুরীর রোজনামচা এবং কবি সত্যেন সেনের প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে রচিত বই ‘মহাবিদ্রোহের কাহিনী’থেকে সংগ্রহ করেছেন।


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

অতিশয় মহৎ ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

তানভীর এর ছবি

ধন্যবাদ। এই একটি মন্তব্যেই পরের পর্ব লেখার জন্য অনেক উৎসাহ পেলাম হাসি

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।