সমুদ্র সঙ্গম: ভুমধ্যসাগর আর আটলান্টিকএর মিলনমেলা

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৩/০৭/২০০৮ - ১:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হারকিউলিসের চুড়া! মিথোলজিক্যাল কল্পকাহিনীতে এখানেই পৃথিবীর শেষ সীমানা! সে কাহিনী অনুসারেই অর্ধঈশ্বর হারকিউলিস তার অসুরিক শক্তিতে এক বিশাল জলাধারের উত্তরে আর দক্ষিনে আকাশ আর মাটির মাঝামাঝি বিশাল এক স্তম্ভ তৈরী করেন। আর পৃথিবীর সীমানাকে বড় করার জন্যে মিলিয়ে দেন ভুমধ্যসাগর আর আটলান্টিক। উত্তরে সে স্তম্ভ জিব্রাল্টার পাহাড় আর দক্ষিনে আরব ভূমিতে জেবেল মুসা।

এই দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়েই বইছে ভুমধ্যসাগর আর আটলান্টিকের নোনাজল বুকে করে, জিব্রাল্টার প্রনালী। এর দৈর্ঘ ৫০ কিলোমিটার। চওড়ায় যেখানে সবচেয়ে কম, সেখানে ১৪ কিলোমিটার। আফ্রিকা ও ইউরোপের মাঝামাঝি এই এলাকাটি ঐতিহাসিকভাবে অনেক আগে থেকেই আক্রমণ ও প্রতিরক্ষার কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ। ৭১১ সালে আরবী রাজা তারিক জিব্রাল্টার পাহাড়টি দখল করেন। এখানেই ঘাটি করে আক্রমণ চালান স্পেনের অন্যান্য এলাকায়। তার নাম থেকেই ‘জেবেল আল তারিক’ বা তারিকের পাহাড় ও আরো পরিবর্তিত হয়ে জিব্রাল্টার। তারপর নানা আক্রমণ, প্রতিআক্রমণ ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৭১৩ সালে বৃটিশদের অধিকারে আসে পাহাড়টি। স্প্যনিশরা নিজেদের অধিকার ছাড়তে না চাইলেও অস্ত্র বা রাজনৈতিক, কোন প্রভাবই স্থায়ীভাবে কাজে লাগাতে পারে নি। ১৯৬৭ সালের এক
গনভোটে জিব্রাল্টারের ৯৫% অধিবাসীরা বৃটিশ আনুগত্যের পক্ষেই ভোট দেয়। পরিনামে বৃটিশ উপনিবেশে পরিণত হয় জিব্রাল্টার। বিশাল স্পেনের পাশাপাশি ছোট্ট জিব্রাল্টারের অধিবাসীদের এই ঔধ্যত্ব স্প্যানিশদের পছন্দ না হবারই কথা! তারা খুব অপমানিত বোধ করে ও সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। নানা রাজনৈতিক ডামাডোলের চাপে ১৯৮০ সালে সীমান্ত খোলার পরিকল্পনা হলেও তা কার্যকর করা হয় ১৯৮৫ সালে। বৃটিশ মহারানীর প্রতিনিধি শাসক হিসেবে আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রনীতিতে স্বাধীন। তবে প্রতিরক্ষার ভার বৃটিশদের হাতে।

রোটায় আমাদের বাসস্থান থেকে ১২০ কিলোমিটারের পথ জিব্রাল্টার। পাহাড়ী চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথ। এ ধরণের পথে গাড়ী চলাতে বেশ আনন্দ। অনন্ত নীল আকাশ, মেঘের ছিটেফোটাও নেই। বাইরে খুব গরম। বাতাসে যথেষ্ট আদ্রতা না থাকায়, সে গরম আমাদের দেশের মতো অসহনীয় নয়। যে সব ছোট ছোট শহরগুলো পেরিয়ে গেলাম, সেগুলোর নাম আরব আধিপত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মেদিনা, আল জাজিরা, তারিফা। গতকাল আরেকটি ছোট শহরে গিয়েছিলাম। নাম আলগায়িদা।

ভুমধ্যসাগরের কোল ঘেষে মাঝারি উচ্চতার এক পাহাড় জিব্রাল্টার। পাহাড়টির তিন দিকেই সমুদ্র ও এক দিকে স্পেনের স্থলভুমি। পাহাড়ের গা ঘেষে ঘেষে গড়ে উঠেছে বৃটিশ উপনিবেশ জিব্রাল্টার। ট্যুরিষ্টদের গাড়ীর বিশাল লম্বা লাইন পেরিয়ে পাসপোর্ট পরীক্ষা শেষে ঢুকলাম শহরের সীমানায়। পেরিয়েই জিব্রাল্টার এয়াপোর্টের রানওয়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়। বিমান ওঠানামার সময় বন্ধ করে দেয়া হয় গাড়ী চলাচল। শহরে ঢুকে দেখলাম বেশ ঘিন্জি, উঁচুনিচু আর আঁকাবাঁকা শহরের রাস্তাঘাট। দুপুর একটা তখন। ছেলেমেয়েদের স্কুল ছুটি হয়েছে মাত্র। স্কুলড্রেস পড়া ছেলেমেয়েদের দেখে বোঝা গেল, বৃটিশ রাজের শাসনের প্রভাব। ইউরোপের অন্য কোথাও এ ধরণের ড্রেসের প্রচলন দেখিনি। যে রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক বাতি রয়েছে, সে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়াতে দেখিনি ইউরোপের কোথাও। এখানে বাতির সাথে সাথে পুলিশদেরও দেখা গেল সে মোড়ের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে।

শহরের কেন্দ্র থেকে কেবল-কারে পাহাড়ের উপরে ওঠা যায়। কেবল কার যেখান থেকে যায়, সেখানেই গাড়ী পার্ক করার ব্যাবস্থা রয়েছে। তবে সেখানে জায়গা পেতে আধ ঘন্টার মতো ঘুরতে হলো আমাদের। অবশষে টিকিট কিনে উঠলাম কেবল কারে। চারশো মিটার উপরে ওঠার পরই জিব্রাল্টারএর আসল সৌন্দর্য চোখে পড়লো। একপাশে স্পেন, দুইপাশে ভুমধ্যসাগর, একপাশে বে অফ জিব্রাল্টার। নীল আকাশে যেন মিশে আছে নীল সমুদ্র আর অসংখ্য জাহাজ মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে সে নীলের মাঝে। কে বেশী নীল, এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে সমুদ্রই। দক্ষিনে পনেরো কিলোমিটার দুরে আবছা আফ্রিকার উপকূল ডুবে আছে মেঘের আড়ালে। কষ্ট আর আনন্দের এক মিলিত অনুভুতি শিরশিরিয়ে উঠলো বুকের ভেতরে। এ পথেই বহু বছর আগে জাহাজ নিয়ে খালাসী তীরন্দাজ পেরিয়েছিলো নাইজেরিয়ার পথে। জীবনের গন্তব্য তখনও ছিল অজানা। পৃথিবী দেখা আর জীবনকে নতুন করে গড়ার আশায় বাবা মায়ের বাঁধন ভালোবাসা ছেড়ে দেশ ছেড়েছি মাত্র তখন। সত্যিকারভাবে ফিরে আর যাইনি। বাবা-মাও বিদায় নিয়েছেন, আর আমি আজ সাজানো এক জীবনের আড়াল থেকে ট্যুরিষ্ট হিসেবে এখানে যেন নিজেকেই দেখতে এসেছি আবার। হারিয়ে যায় সময়,হারিয়ে যায় মানুষ বিস্তৃতির অতলে, শুধুমাত্র কষ্টটুকুই আপন হয়ে রয়ে যায় ক্যনভাসে। সে ক্যানভাসে দৃষ্টি পড়তেই জল এলো চোখে। বউ আমার ভেতরের ঝড় পরিস্কার বুঝতে পারলো ও মৃদু হেসে আমাকে নিজের ভেতরে ডুবে দিতে দিল। কোন কথা না বলে ক্যামেরা নিয়ে শুধু ছবি তুলে গেল আমার।

কিছু অপ্রত্যাশিত সঙ্গী রইলো আমাদের পাহাড়ের উপরে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে। একপাল বাঁদর। বৃটিশরা আফ্রিকা থেকে আমদানী করেছিল গৃহপালিত পশু হিসেবে। এখন ট্যুরিষ্ট ও জিব্রাল্টারবাসীদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এতো মানুষের আনাগোনায় এদের কোন বিরক্তি নেই, অন্যদেরকেও বিরক্ত করে না ওরা। ছবি তোলার সুযোগ দেবার জন্যে রীতিমতো ভঙ্গী নিয়ে বসে। বাইরে খাবার দাবার নিয়ে না বসার অনুরোধ জানিয়েছে কতৃপক্ষ। বাঁদরদের তা সহ্য না ও হতে পারে!

পাহাড়ের উপরের অংশটি বাঁকানো ছুরির ফলার মতো। তার পাশ ঘেষে কিছুটা গাড়ী চলার রাস্তা। বাকী অংশটি বিপদজনক হাঁটাপথ। রেলিং ছিল একসময়। এখন তার অনেক অংশই ভেঙ্গে নেই আর এখন। এই সরু অংশের মাঝেই পাহাড়ের খাঁদে খাঁদে ছোট ছোট ঘর তৈরী করা হয়েছিল। একসময় হয়তো পাহাড়াদার সৈন্যরা থাকতো সেখানে, এখন হয়তো বাঁদরদেরই বাসস্থান। গরমে গলধর্ম হয়ে আমরাও ঘুরে বেড়ালাম সেখানে।

পাহাড় থেকে নেমে গাড়ীতে ঘুরলাম পুরো পাহাড়ের চারপাশ। জিব্রাল্টারের সমচেয়ে দক্ষিনতম অংশে গাড়ী থামালাম। এখান দিয়েই বয়ে চলেছে জিব্রাল্টার প্রণালী ও পঞ্চাশ কিলোমিটার পশ্চিমে বেয়ে পড়ছে আটলান্টিক মহসাগরে। ট্যুরিষ্টদের ভীড় তেমন নেই। আমরা অনেকক্ষন রইলাম সেখানে। অনেক জাহাজ থেমে আছে মাল খালাসের অপেক্ষায়। কিছু কিছু জাহাজকে নোঙ্গর তুলে চলে যেতে দেখলাম। পাহাড়ের কোল ঘেমে বিরাট এক মসজিদ দেখতে পেলাম। নামফলকে দেখা গেল, জিব্রাল্টারএর অধিবাসীদের জন্যে সৌদী বাদশাহ্র উপহার। পাহাড়ের উপরে চুড়োটি দেখতে পেলাম, যেখানে একটু আগেই হেঁটে বেড়িয়েছি আমরা।সন্ধ্যা হবার একটু আগ অবধি সেখানে কাটিয়ে আবার পাসপোর্ট পরীক্ষার ধকল কাটিয়ে ফিরে এলাম রোটায়, আমাদের অস্থায়ী বাসস্থানে।


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সুন্দর বর্ণনার পাশে এমন সুন্দর ছবি থাকলে... আহ্... দারুণ হচ্ছে... চলুক...
তবে আপনার সেই বহু বছর আগেকার জীবনের গল্পগুলো শুনতে চাই... আগ্রহ হচ্ছে খুব।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তীরন্দাজ এর ছবি

শোনাবো। আপাতত স্পেনের কাহিনী শেষ হোক। অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

ধুসর গোধূলি এর ছবি
তীরন্দাজ এর ছবি

আরো আসবে ধুসর। অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

তানবীরা এর ছবি

স্পেন একটি অপুর্ব সুন্দর দেশের নাম। দুইবার গিয়েছি কিন্তু আরো আরো বার যাওয়ার ইচ্ছে আছে, ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে এই পাশে যাইনি। এটাকি বেনিড্রমের পাশে কোথাও? মনে হচ্ছে আমাকে ম্যাপ দেখতে হবে।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

তীরন্দাজ এর ছবি

বেনিড্রম কি, জানিনা। হয়তো চোখে পড়েনি। এটা ইউরোপের একেবারে দক্ষিনে আফ্রিকার উপকুলের কাছাকাছি। ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

দ্রোহী এর ছবি

চমৎকার এক ভ্রমণবৃত্তান্ত ! ছবিগুলো অপূর্ব !


কি মাঝি? ডরাইলা?

সুমন চৌধুরী এর ছবি

লাজওয়াব হয়ে পড়ছি।



ঈশ্বরাসিদ্ধে:

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ, এদিকে কবে আসার পরিকল্পনা?
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সিম্পলি গ্রেট!
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুশফিকা মুমু এর ছবি

এত্ত সুন্দর ছবিগুলো দেঁতো হাসি লেখাটিও খুব ভাল লাগল
অনেক কিছু জানতে পারলাম হাসি ধন্যবাদ হাসি
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

নাম, বর্ণনা, ইতিহাস ও ছবি সব মিলিয়ে দুর্দান্ত হইছে গুরু।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

আকতার আহমেদ এর ছবি

অসাধারণ তীরুদা! অসাধারণ !!
একরাশ মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে পড়ছি

শাহীন হাসান এর ছবি

আর আমি আজ সাজানো এক জীবনের আড়াল থেকে ট্যুরিষ্ট হিসেবে এখানে যেন নিজেকেই দেখতে এসেছি আবার। হারিয়ে যায় সময়, হারিয়ে যায় মানুষ বিস্মৃতির অতলে, শুধুমাত্র কষ্টটুকুই আপন হয়ে রয়ে যায় ক্যনভাসে।
ইতিহাস সচেতন লেখা। বর্ণন শৈলী চমত্ কার!
ভাল-লাগলো খুব।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।