রামপাল প্রকল্পের নেপথ্যে দেশী-বিদেশী সংযোগ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: রবি, ১০/০৯/২০১৭ - ১:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আপাতদৃষ্টিতে জার্মানির স্টুটগার্টের ব্যাবসায়িক সংস্থা (Fichtner Group)কে মানুষ ও পরিবেশের মঙ্গলের কাজেই নিবেদিত বলেই মনে হবে। তাদের সুদক্ষ প্রকৌশলীরা ইকুয়েডরের রাজধানী কিওটোর এলোপাথাড়ি নদীপ্রবাহকে পরিকল্পিত পথে পরিচালনার কাজে ন্যস্ত। প্যালেষ্টাইনের গাজায় সমুদ্রের জল শোধন করে সুপেয় করায় নিয়োজিত তারা, যাতে যুদ্ধবিপন্ন গাজাবাসীরা পরিষ্কার সূপেয় জলে তৃষ্ণা মেটাতে পারে। মরক্কোর দক্ষিণাঞ্চলে ১৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছে এই সংস্থা। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাতেও পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্ণাট্য উদ্ভোদন করেন গত স্বয়ং মরক্কোর বাদশাহ মোহাম্মদ।

গঠনমূলক কাজের জন্যে দেশের সবচাইতে সফল অর্থনৈতিক সংস্থার মডেল হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি পুরস্কারও প্রদান করা হয় তাদের। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিয়োজিত এই সংস্থার এদেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকরী, শক্তিশালী ও পরিবেশ বান্ধব ভূমিকা উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, এই বক্তব্য সামনে রেখেই তাদের এই পুরস্কার।
“আমরা পৃথিবীব্যাপী বড়ো ও জটিল প্রকল্প বাস্তবায়নে সফল ও কার্যকরী ভূমিকা রেখেছি। আমাদের প্রায় ১৫০০ জন প্রকৌশলী পৃথিবীর একশোটি দেশে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।“ গর্ব করে জানান তারা তাদের ইন্টারনেটে প্রকাশিত ব্রশিওরে। ব্রশিওরে তাদের পরিবেশ বান্ধব প্রকল্পের কথা ফলাও করে প্রকাশ করা হলেও কিছু প্রকল্পের কথা খুব সযত্নে এড়িয়ে গেছেন তারা। তারা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো একটি পরিবেশ-নির্বান্ধব প্রকল্পের সাথে যে সরাসরি যুক্ত, এই প্রকল্প যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির, বিষাক্ত গ্যাস বিকিরণে পরিবেশ ও জীবনধারণে অতি ক্ষতিকর প্রভাবের কারণ হতে পারে, এ কথা ব্রশিওরের কোথাও উল্লেখ করেননি। তথ্যসূত্রে জানা গেছে, তারা বাংলাদেশের রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাথে জড়িত।

এই প্রতিষ্ঠান রামপাল প্রকল্পের পরিকল্পনা, দেখাশোনা ও যান্ত্রিক বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে, এ খবরটি ২০১৫ ও ২০১৬ সালেই বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সুন্দরবন থেকে রামপালের এই কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের দূরত্ব মাত্র চৌদ্দ কিলোমিটার। যদিও সুন্দরী গাছের অভাবনীয় এই প্রাকৃতিক বিন্যাসকে ১৯৯৭ সালে পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো, তারপরও নিজদেশে সুনামধারী এই সংস্থা এই প্রকল্পে অংশ গ্রহণে কোনো দ্বিধা করেনি।
ভারতের Thermal Power Corporation (NTPC) ও বাংলাদেশের সরকারি সংস্থা Power Development Board (BIFPCL) মিলিত প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়নের জন্যে গড়া হয়েছে Friendship Power Company Limited (BIFPCL) নামে এক মিলিত প্রকল্প গোষ্ঠী। সাত বছর আগে তাদের এই প্রকল্পের নকশা প্রকাশিত হবার পর থেকেই সুন্দরবনের অধিবাসী ও পরিবেশবাদীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার।

এই প্রকল্পের বদলে বাংলাদেশের জন্যে সৌরবিদ্যুত ও বায়ুতাড়িত পাখা থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতই সবচাইতে পরিবেশ বান্ধব, এই দাবী দেশীয় সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে Greenpeace, Robin Wood, Avaaz থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিদেশী পরিবেশবাদী সংস্থার। সবারই আশঙ্কা, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিশ্চিহ্ন হবে সুন্দরবন ও পরিণামে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে জলোচ্ছ্বাস ও সুনামি বিরুদ্ধে প্রকৃতিদত্ত প্রতিরোধ। সেই সাথে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পশুপাখিরও বিলুপ্তি ঘটবে, এই আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের পাশাপাশি ইউনেস্কোর মতো বড়ো আন্তর্জাতিক সংস্থাও প্রকাশ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিবছর প্রায় পাঁচশো জাহাজ বোঝাই কয়লা পোড়ানো হবে। এই জাহাজগুলো প্রায় ৬৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে সুন্দরবনের ছোট ছোট দ্বীপের পাশ ঘেঁষে। নদীপথে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তো আছেই, সেইসাথে জাহাজের জ্বালানি তেল বিষাক্ত করবে নদীর জল। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লী থেকে প্রতিদিন প্রায় ২২০ টন বিষাক্ত ধোঁয়া বিষাক্ত করবে পরিবেশ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য পরিবর্তনকে আরও বেশি ত্বরাহ্নিত করবে কার্বন ডাই অক্সাইড। সমুদ্র-স্তরের উচ্চতা বাড়বে, নদীর জলের তাপমাত্রা বাড়বে ও সেই প্রভাবে বিলুপ্ত হবে বিভিন্ন মাছ ও ডলফিন। স্থানীয় জেলেদের নূন্যতম আয়ের পথও আর থাকবে না আর।

এই প্রকল্পের পরিকল্পনা কালীন সময়ে সেখানকার অধিবাসী ও পরিবেশবাদী সংস্থার কোনো মতামত নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ জানিয়েছে বিভিন্ন এনজিও। জীবন ও পরিবেশে কি প্রভাব ফেলতে পারে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র, এ নিয়ে কোনো সমীক্ষাও করা হয়নি। রীতিমতো একতরফা ভাবে পরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালকরা একসময় এলাকার অধিবাসীদেরকেও তাদের বাসস্থান ছেড়ে অনিশ্চয়তায় পাড়ি জমাতে বাধ্য করবে, এই আশঙ্কা অনেকেরই।

সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, রামপালের এই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর্থিক আয় যতোটা, পরিবেশের ক্ষতির হিসেব করে যে আর্থিক ব্যয়, তার চাইতে অনেক বেশি ছাড়িয়ে যাবে। ইউনেস্কো বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ২০১৬ সালে তাদের এক সমীক্ষা প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বায়ুদূষণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষাক্ত তরল পদার্থ, কয়লা পরিবহন, জাহাজ চলাচল ও এর সাথে সম্পর্কিত সম্ভাব্য শিল্পায়ন চিরস্থায়ীভাবে ধ্বংস করবে এই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বাংলাদেশে সরকারের এসব সমীক্ষা ও প্রতিবাদের প্রতি কোনো কর্ণপাতই নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই একই দাবী করে যাচ্ছেন যে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবহার সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিরই কারণ হবে না। যারা এই বক্তব্যের বিরোধী, তাদের জন্যে ধীরে ধীরেই বিপদজনক হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলও বর্বর পুলিশী আক্রমণের শিকার হয়েছে বারবার। “সরকার যেন আমাদের পিটিয়ে শেখাতে চাইছে, সুন্দরবনের চৌদ্দ কিলোমিটার দুরের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতির কারণ হতে পারে না”, বলছেন প্রতিবাদীদের অনেকে। সুন্দরবন রক্ষা কমিটির অনেককেই মৃত্যুভয় দেখিয়ে ইমেইল পাঠানো হয়েছে। “এসবের পরও কোনো অবস্থাতেই আমরা আমরা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে হ্যাঁ বলতে পারি না।“, জানিয়েছেন তাঁরা।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে জোরালো প্রতিবাদের পরও এগিয়ে চলছে এই প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্পের সবচাইতে বড়ো ঋণদাতা, ভারতের এক্সিম ব্যাংক, কিছুটা অনিশ্চয়তায় পড়েছে এতদিনে, প্রতিবাদী পক্ষের এটাই একমাত্র শেষ আশা। রামপাল প্রকল্প তাদের সুনাম নষ্ট করবে, এই ভয় তাদের। একশো ষাট কোটি ডলারের এই প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করার ঋণদাতা হিসেবে প্রধান ভূমিকা তাদেরই। এই ব্যাংকের প্রতিই দশ লাখেরও বেশি সাক্ষর সংগ্রহ করে রামপাল প্রকল্পকে অর্থায়ন না করার আহবান জানিয়েছেন প্রতিবাদীরা।
এ অবধি প্রকল্পের শেয়ার বিক্রি করে ঋণের একাংশ যোগাড় করেছে এক্সিম ব্যাংক। ক্রেতা হিসেবে আছে, ভারত ও আমেরিকার কিছু ঋণদাতা ও ইউরোপের কিছু নামী ব্যাংক, কয়েকটা বীমা কোম্পানি ও বিত্তশালী শেয়ার ক্রেতা। Institute for Energy Economics and Financial Analysis (IEEFA) তাদের এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, জার্মানির ডয়েচে ব্যাংক (Deutsche Bank) একাই কিনেছে ৬,৭২ কোটি ডলারের স্বত্ব। সেইসাথে মিউনিখের আলিয়ান্স (Alianz Concern) স্বত্ব কিনেছে ৩,৩৪ কোটি ডলারের ও ফ্রাঙ্কফুর্টের DZ-Bank কিনেছে ১,৬ কোটি ডলারের ।

অথচ জার্মান এই ঋণদাতারা এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করে তাদের নিজস্ব নিয়মনীতিরই পরিপন্থী কাজ করছেন, দাবী প্রতিপক্ষের। ডয়েচে ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, “যে কোনো প্রকল্পে পরিবেশ ও সমাজের উপর যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব যথাসম্ভব কম রাখা আমাদের কর্তব্য।“ সব ঋণদাতাকেই এই প্রকল্প থেকে সরে আমার অণুরোধ জানানো হয়েছে বারবার। কিন্তু কোনো তোয়াক্কা না করে আরও বেশি ঋণদাতা খুঁজে বেড়াচ্ছে BIFPCL।

এসবের মাঝে স্টুটগার্টের ফিখ্টনার গ্রুপের কি অবদান? এ সম্পর্কে কোনো কোনো কথা বলতে নারাজ, সংস্থার সর্বপ্রধান মি: জর্জ ফিখ্টনার। “নীতিগতভাবেই আমরা এই প্রকল্প সম্পর্কে কিছু বলার অধিকার রাখি না। আপনারা ইচ্ছে করলে BIFPCL এর সাথে কথা বলতে পারেন।“, ইমেইল করে জানিয়েছেন তিনি।
নিজদেশে এক সাফ-সুতরো পবিত্র মানুষ এই ফিখ্টনার। আগামী ১৯শে সেপ্টেম্বরে তাঁর ঐতিহাসিক “ভিলা লেভী” তে “ফিখ্টনার টক” এর আয়োজন করেছেন। এতে দেশের রথী মহারথীদের অনেকেই থাকবেন। বড়ো গলায় বক্তব্য রাখবেন অনেকে। এমনকি বিভাগীয় পরিবেশ মন্ত্রী, পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টির ফ্রান্স উনটারস্টেলার সেখানে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক বক্তৃতা রাখবেন।

(বার্লিনের দৈনিক পত্রিকা TAZ এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অবলম্বনে)


মন্তব্য

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এই নিবন্ধের অসাড়তা নিয়ে কিছু বলার আছে, আছে বেশ কিছু প্রশ্নও। কিন্তু প্রশ্ন করে লাভ কি, উত্তর দিবে কে? লেখক তো বার্লিনের দৈনিক পত্রিকা TAZ এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অবলম্বনে এই ব্লগ লিখেছেন, TAZ কর্তৃপক্ষ তো আর কোন উত্তর দিতে আসছে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই নিবন্ধের অসাড়তা নিয়ে কিছু বলার আছে

- 'অসাড়তা' নাকি 'অসারতা' কোনটা বোঝাতে চেয়েছেন?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

দুঃখিত! শব্দটা হবে "অসারতা", টাইপোগ্রাফিক্যাল ত্রুটি।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শেষ বাক্যটিতে বিভ্রান্ত হলাম তীরু'দা। এটা কি TAZ-এর নিবন্ধের অনুবাদ? না কি তা থেকে তথ্য নিয়ে পুনর্লিখন? ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।