এপার ওপারের কিসসা: তানজিয়ার্স, মরক্কো

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শনি, ০৫/০৭/২০০৮ - ৫:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চৌদ্দ কিলোমিটার সমুদ্র পেরিয়ে একবার ওপারে চোখ ফেলা। একই আবহাওয়া, একই আকাশ, একই গরমের হলকা শরীরে। এপারের জিব্রাল্টারের মতো ওপারে আরেকটি স্তম্ভ তৈরী করে হারকিউলিস আকাশকে ঠেকিয়ে রেখে মাটি ভাগ করে আটলান্টিক ও ভুমধ্যসাগরকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। হারকিউলিস কি ভেবেছিলেন, এই চৌদ্দ কিলোমিটার হাজার কিলোমিটারের ভাগ সৃষ্টি করবে এপার আর ওপারের মাঝে?

পয়তাল্লিশ মিনিটে উন্মাদের গতিতে জিব্রাল্টার প্রনালী পেরিয়ে জাহাজ যখন আফ্রিকার উপকুলে তানজিয়ার্সের বন্দরের সামান্য দূরে, তখনও এমনটি মনে হয়নি। জাহাজ থেকেই চোখে পড়ে, সমুদ্রতীরে সারি সারি বিশাল হোটেলের বহর, সমুদ্রতটে হাজার হাজার স্নানার্থী নারী পুরুষের মেলা। এপারে ইউরোপীয়ান উপকূলের তো একই চেহারা। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? ওপারের হোটেলগুলো তো আরো বিশাল, ঢেউএর দোলায় আন্দোলিত নারী পুরুষের ভীড় তো আরো বেশী। এই সমীকরণের আরেকটি দিক জানা থাকলে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে কাহিনী। ওই হোটেলগুলোর কিছু মালিক ওপারে বাস করে বিলাসবহুল এলাকায়, তানজিরের সাধারণ মানুষ এই এলাকাকে ক্যালিফোর্নিয়া নাম দিয়েছে। আর বাকী মালিকগুলো এপারে, ইউরোপে ও পৃখিবীর বিভিন্ন ধনী দেশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

তাহলে তানজিয়ার্সের সাধারণ মানুষের কপালে কি জোটে? জলকেলীরত ও আমাদের মতো একদিনের ট্যুরিষ্টরা বেলাভুমি ছেড়ে মাঝে মাঝে শহরের অলিতে গলিতে পা ফেলে। কোন এক চিড়িয়াখানা দর্শনের দৃষ্টি নিয়ে নিজেদের গা বাঁচিয়ে এখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দেখতে আসে। কখনো সখনো কিছু কেনাকাটা করে নিজের শো’কেসে সাজনোর জন্যে। কখনো সখনো কারো জন্যে একটা, দুটো সুভেনিয়ের। তানজিরের সাধারণ মানুষ, তাদের যা আছে, তাই নিয়ে মুখিয়ে আছে পশরা সাজিয়ে। এরা ট্যুরিষ্টদের পেছনে পেছনে ছোটে, অনুনয় বিনয় করে বিক্রি করার চেয়ে বেশী বিরক্তই করে তাদের। একঘন্টার শহরে অলিতে গলিতে হাঁটাপথে যদি পঞ্চাশ জন বিক্রেতা একই ধরণের জিনিষের জন্যে গড়ে কুড়িবার করে অনুনয় বিনয় করে, তাহলে ট্যুরিষ্টের বিরক্ত না হওয়া ছাড়া উপায় কি? নিজেও বিরক্ত হয়েছিলাম, তবে এমনি এক দরিদ্র দেশের মানুষ হিসেবে সে বিরক্তির চেয়ে বুকের ভেতরে কষ্টের পরিমানই ছিল বেশী। একসময় এসব ঝামেলা সেরে ফেরা পথে জাহাজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে প্রথমে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে পরে নিজের বিরক্তিকে ধিক্কারও দিলাম। কিন্তু তানজিয়ার্সের সাধারণ মানুষের তাতে কিছু লাভ হলো কি?

এপারের তারিফাতে ঠিক করা হলো সব। এপার ওপারের জাহাজের টিকিট, ওপারের ট্যুরিস্ট গাইড, মাইক্রোবাস সহ ড্রাইভার, সবই আগে থেকেই পরিকল্পিত। পকেটে লাল রংএর ট্যুরিষ্ট কোম্পানীর স্টিকার লাগানো হলো, যাতে ওপারের এজেন্টরা আমাদেরকে খুঁজে নিতে পারে। আমাদের মতো ট্যুরিষ্টদের সাথে জাহাজে সহযাত্রী হলো অনেক স্বদেশযাত্রী মরক্কোর অধিবাসীও। বেশীরভাগই মহিলা ও তাদের লটবহরের পরিমাণ দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। জাহাজে যে সব গাড়ী উঠলো, তার ভেতর সহ ছাদেও মালামাল বোঝাই।

জাহাজ থেকে নেমে কাষ্টমস্ পেরুনোর পর ওপারের গাইড আমাদেরকে একটি মাইক্রোবাসে তুললেন। তানজিয়ার্সের মূল শহর একটু ঘুরিয়ে দেখানোর পর পর নিয়ে গেলেন আমাদেরকে তথাকথিত বড়লোকের এলাকা ক্যালিফোর্নিয়াতে। সাদা দেয়ালে মর্মরের কাজ করা বিলাসবহুল বাড়ীঘর। মনে হয় মরক্কের সমস্ত সম্পদ জমা হয়েছে এখানেই। এখানেই বিশাল এলাকা জুড়ে মরক্কোর বাদশাহর বাসস্থান। চারপাশে কড়া নিরাপত্তা পাহাড়া। এর মাঝে একবার উটের পিঠে চড়ানো হলো ট্যুরিষ্টদের সামান্য ইউরোর বিনিময়ে।

তানজিয়ার্সের মেদিনা এলাকাটি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী। পাহাড়ের গায়ে ঘিন্জি বাড়ীঘর ও দোকানপাটের মাঝে মধ্যবিত্তদের বাস। সেখানে মাইক্রোবাস ছেড়ে দেয়া হলো, যাতে আমরা এলাকাটা পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে পারি। তখনই পেছনে লাগলো নানা বিক্রেতার দল। নানাভাবে তাদের জিনিসপত্র গছাতে চাইলো আমাদের। গাইডের পরিকল্পনা অনুযায়ীই একটি রেষ্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের দুপুরের খাবারের জন্যে। ফেরিওয়ালাদের পাল্লা থেকে কিছুটা সময়ের জন্যে বেঁচে স্বস্তির নি:শ্বাস ছাড়লাম। বেশ বড় রেষ্টুরেন্ট। মাঝখানে আরবী বাজনার সাথে গান গাইছেন কয়েকজন গায়ক। সে গান শুনতে শুনতে দুপুরের খাবার সারলাম আমরা। বেশ ভাল খাবার। স্যুপ, কাবাব ও মরক্কোর বিশেষ খাবার কুসকুস। মুরগীর মাংস ও সবজীর সাথে ভাপে সেদ্দ করা মোটা দানার সুজী। তবে বাংলাদেশী খাবারের চেয়ে ভালো খাবার পৃথিবীতে নেই, তার অন্ততপক্ষে নিজের কাছে প্রমাণিত হলো আরেকবার।

এরপর বাস্তবায়িত হলো পরিকল্পনার মূল অংশটুকু। একটা দুটো ঐতিহ্যবাহী মসজিদ ও এলাকা দেখানোর পাশাপাশি নিয়ে যাওয়া হলো একটার পর একটা দোকানে। প্রথম এলো নানা ভেষজ প্রসাধন সামগ্রী ও মশলার দোকান। আধঘন্টা নানা ভাষায় বক্তৃতা ও দ্রব্যপরিচিতি পাঠের পর কেনাকাটা।না কিনতে চাইলে অনুনয় ও দামাদামি। এটাই হয়তো আরবীয়ান ঐতিহ্য। তারপর কার্পেটের দোকান, তারপর একটার পর একটা সুভেনিয়ার সামগ্রী। একেকটি দোকান থেকে বেরুনোর পরপরই গোটা ত্রিশেক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। এসবের মাঝে বিভ্রান্তি যখন চরমে, তখন দেখলাম এক রাস্তার মোড়ে আমাদের মাইক্রোবাস। আমাদেরকে বন্দরে পৌঁছে দেয়া হলো। পাসপোর্ট পরীক্ষার পর জাহাজে উঠে যে শান্তি, তার কথা তো আগেই বলেছি।
তবে ফেরৎ জাহাজে ওঠার আগে বাইরে অনেকক্ষন অপেক্ষা করতে হলো আমাদের। জাহাজ থেকে যেসব যাত্রীরা নামলো, তাদের বেশীরভাগই মরোক্কান মহিলা। তাদের সাখে যে পরিমান লটবহর আর সে লটবহর টানাটানির বেলায় তাদের যে ক্ষমতা, তা দেখে কে বলবে, আরবীয় সমাজে মহিলারা পিছিয়ে! তানজিয়ার্সের রাস্তায় হিজাব আর বোরখা পড়ে হাঁটার সময়েও তাদের কোন জড়তার প্রভাবে পিছিয়ে আছে বলে মনে হয়নি।


মন্তব্য

পুতুল এর ছবি

"চৌদ্দ কিলোমিটার সমুদ্র পেরিয়ে একবার ওপারে চোখ ফেলা। একই আবহাওয়া, একই আকাশ, একই গরমের হলকা শরীরে। এপারের জিব্রাল্টারের মতো ওপারে আরেকটি স্তম্ভ তৈরী করে হারকিউলিস আকাশকে ঠেকিয়ে রেখে মাটি ভাগ করে আটলান্টিক ও ভুমধ্যসাগরকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। হারকিউলিস কি ভেবেছিলেন, এই চৌদ্দ কিলোমিটার হাজার কিলোমিটারের ভাগ সৃষ্টি করবে এপার আর ওপারের মাঝে?"

এভাবেই ভ্রমনবৃতান্ত তীরন্দাজীয় বৃতান্ত হয়ে উঠে।

একদিন কাজে যাওয়ার খুব তাড়া ছিল, উ বানে উঠার আগে "কফি টু গো" কেনার লাইনে, আগের জনকে অনুরোধ করে বল্লাম; আমার একটু তাড়া আছে দয়া করে আমকে কফিটা আগে নিতে দেয়া যায়?

কথা শুনে ভদ্রলোক আমার দিকে ঘুরে বল্লেন; তাড়া করে কফি খাওয়া যায় না, সময় নিয়ে কফির স্বাদ উপভোগ করতে হয়!

সত্যিই ইউরুপের মানুষেরা বিশ্বের তাবৎ ভোগ্য সামগ্রীর সব রকম ব্যবহার খুব ভাল জানে।

কফির খামারের মালিকও এরা। শুধু কফি উৎপাদনের মাটি অন্য মহাদেশে, কিন্তু সে মাটি টুকুও এরা কিনে নিয়েছে। এমন হল কলা, সব গুলো বাগান দক্ষিন আমেরিকায় কিন্তু কলা বাগানের মালিক এরা।

হারকিউলিসের সীমানা ইউরুপের ধনী মানুষেরা আরো বিস্তৃত করেছে, তাই মরোক্কোতে সুন্দর আবহাওয়্ উপভোগের জন্য বিলাস বহুল অবকাশ যাপন কেন্দ্র তৈরী করেছে। সে সব অবকাশ যাপন কেন্দ্রের মালিকও এরা।

শুধু বিরক্তিকর হচ্ছে সে দেশের গরীব মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদে কিছু বেচা বিক্রির চেষ্টা।

এসব অসংগতি তীরুদার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দৃষ্টির আড়ালে থাকতেই পারে না। এই জন্যই তীরুদার লেখা এত ভাল লাগে।

ধন্যবাদ তীরুদা, সম্পূর্ণ একটা পরিব্রাজকীয় পোষ্টের জন্য।

**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

এতো বড়, সুন্দর ও আন্তরিক মন্তব্যের জন্যে পুতুলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হা দীর্ঘশ্বাস...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তীরন্দাজ এর ছবি

সুযোগ আসবে জীব´নে অবশ্যই নজরুল ভাই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শাহীন হাসান এর ছবি

যেতে পারেল মন্দ হতো না ....!
ভাল লাগলো লেখাটি।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

তীরন্দাজ এর ছবি

কেমন আছেন শাহীন?
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

কীর্তিনাশা এর ছবি

অনবদ্য।
----------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।