অন্ধরাতের ঘোড়া

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শনি, ১৯/০৭/২০০৮ - ৭:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাঁটতে হাঁটতে বারবার ঘড়ির দিকে তাকানো বহুদিনের পুরানো অভ্যাস জাফর সাহেবের। বারবারই মনে হয় কোথায় কি একটা যেন হারিয়ে গেল। সেটা যে শুধুমাত্র সময়ই হতে হবে এমন কোন কথা নয়। যা কিছুই হতে পারে, টাকা পয়সা, কাপড় জামা বা পকেটের কলম। মাঝে মঝে মনে হয় কোন কোন মানুষই হারিয়ে গেল এভাবে। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকালেই হঠাৎ যেন সে নেই নেই ভাবটা দুর হয়ে যায়। পকেটের কলমটা যেন পকেটেই ফিরে আসে, আলমারীতে জামাটা আগের জায়গাতেই খুঁজে পাওয়া যায়, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আর হারানো মনে হয়না।

আজও কিছু একটা নেই নেই বলে মনে হচ্ছিল আর সে সাথে অসহ্য জলতেষ্টা। অজান্তেই চোখ গেল ঘড়ির দিকে। তক্ষুনি মনে হলো ছেলের কথা। ছেলেটাকে যে বাড়ীতে এতক্ষন একা রেখে এসেছেন, ভুলেই গিয়েছিলেন। মনে হতেই সামান্য ভেবে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলেন তিনি। পেছনের একটা লোকের সাথে ধাক্কাই লেগে যেত, কোনক্রমে সামলে নিলেন। মনটা কেমন যেন ভার ভার, অন্যরকম হয়ে গেল। যে খাবারটুকু রেখে এসেছিলেন তা খেল কি না, নাকি এতোক্ষন উপোষ করলো বেচারা, তা ভেবে বুকের ভেতর একটা কষ্ট এসে জেঁকে বসল শক্ত হয়ে। কষ্টটাকে কমাতে সামনের দোকান থেকে বেশ দাম দিয়েই একটা খেলনা এরোপ্লেন কিনে নিলেন। তাড়াতাড়ি ফেরার জন্যে স্কুটার খুঁজছিলেন, না পেয়ে রিকশাই নিতে হলো। মাথার উপর তখন কড়া রোদ। কিন্তু রিক্সার হুড তুললেন না, এমনকি তেষ্টার কথাও ভুলে গেলেন। রিকশাওয়ালাকে বারবার তাগাদা দিলেন তাড়াতাড়ি চালানোর জন্যে।

বাসায় ফিরে ছাতাটা ঘরের কোনে রেখেই ছুটলেন জাফর সাহেব ছেলের ঘরের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে ওঠার সময় পিছলে ছড়ে গেল পায়ের চামড়া অনেকটা জায়গা জুড়ে। কিন্তু সেদিকে নজরই গেল না। ছেলে চুপ করে বসে বিছানায় খোলা জানলাটার দিকে চোখ রেখে। একরাশ বিভিন্ন কমিকের বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারপাশে। কিন্তু কেউ খুলেছে বা পড়েছে বলে মনে হলোনা। সকালের দেয়া নাশতাও যেমনি দেয়া হয়েছিল তেমনি পড়ে আছে অবহেলায় একপাশে। হাতের খেলনাটার দিকেও কোন নজর গেলনা। জাফর সাহেবের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল জানলার দিকে। তিনি নিজেই খুললেন বাক্সটা।
-- নে বাবা, তোর জন্য এনেছি। কি সুন্দর উড়োজাহাজ !
কোন উত্তর দিলনা ছেলে। চোখের তারায় নির্লিপ্ত বিষন্নতা আর ক্লান্তি।
-- নে, নে, হাতে নিয়ে দেখ, কি সুন্দর জাহাজ !
কিন্তু ছেলে মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। ক্লান্ত মাথাটা এলিয়ে দিল বিছানার লাগোয়া দেয়ালের গায়ে। চুলগুলো এলোমেলো, মুখের কোনে লালার দাগ। জাফর সাহেবের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল ছেলের চেহারা দেখে। খেলনাটাকে একপাশে রেখে জগ থেকে হাতে জল নিয়ে মুছে দিলেন মুখ, টেবিল থেকে চিরুনী নিয়ে আঁচড়ে দিলেন চুল। তারপর সকালের খাবারটাই এগিয়ে দিলেন ছেলের দিকে। ছেলে আস্তে মাথা নেড়ে আপত্তি জানালো। জাফর সহেব যত্ন করে ব্যাটারী লাগালেন খেলনাটার। সুইচ টিপতেই শোঁ শোঁ আওয়াজ করে বিচিত্র সব বাতি জ্বালিয়ে বিছানার উপর চলতে শুরু করল উড়োজাহাজ। কিছুক্ষন সোজা, তারপর ডানদিক বাঁ দিক ঘুরে আবার পেছন দিকে। নিজেই বেশ মজা পেলেন জাফর সাহেব।
-- কি রে, পছন্দ হয়েছে ?
ছেলে তাকাল জাফর সাহেবের দিকে। কিন্তু সে দৃষ্টিতে কোন আলো নেই, প্রতিফলন নেই কোনকিছুর। বরফের মত মৃত, শীতল সে দৃষ্টি। এই কি সেই ছেলে, যার চোখে একসময় ছিল এত আনন্দ, এত বিস্ফুরিত কৌতুহল ? সে আনন্দ দেখেইতো সে ছেলের জন্যে এতো বিপদ মাথায় নিলেন তিনি। হাত রাখলেন ছেলের কাঁধে। সে যেন চমকে উঠল। ছেলের চমকানো দেখে রাগ হল তাঁর।
-- বল্ পছন্দ হয়েছে কি না। কতোবার বলেছি, যা বলার স্পষ্ট বলতে !
এবারও কোন উত্তর দিলনা ছেলে। লক্ষ লক্ষ পিপড়ে যেন একসাথে কামড়ে ধরলো জাফর সাহেবের মগজের প্রতিটি কোষ। মাথা থেকে সে ব্যাথা ক্রোধ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। ছেলের দু’কাঁধে ধরে ঝাকুনি দিলেন কয়েকটা। মাথাটা একটু ঠুকে গেল দেয়ালে।
-- যা বলতে বলেছি বল!
ছেলের চোখের শুন্যতার সাথে এবার বাসা বাঁধল ভয়। জাফর সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যা বলল।
-- এইতো লক্ষী ছেলের মত কথা। তুই কিছু না বললে, আনন্দে না থাকলে আমার যে খুব কষ্ট হয় জানিস?
এবারও সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল ছেলে। সামান্য দ্বিধা করে খেলনাটা নিল হাতে।

এতেই খুশী হলেন জাফর সাহেব। বেশ মায়া হল তাঁর ছেলের জন্যে। ক’দিন ধরেই তো বেশ ঝড়ঝাপটা যাচ্ছে বেচারার উপর। এতটুকু ছেলে, কতটুকুই বা তার সহ্যক্ষমতা! কিন্তু তাঁর নিজের ও তো অন্য কিছু করার পথ ছিলনা। মানুষের মত মানুষ হওয়া, জীবনকে সঠিকভাবে চালানোর জন্যে নিজেকে তৈরী করা তো সহজ নয়! নষ্ট মানুষ, ব্যর্থ মানুষ হয়ে বেঁচে থেকে কি লাভ ? সুতরাং সময় থাকতেই শোধন দরকার। আর সে শোধনের পথটা অনেক সময় কষ্টের বৈকি। জীবন আর মরণ তো সবারই রয়েছে। জীবন মরনের কথা তাঁর ভাবনার সুতোতে গাঁথা পড়তেই একটা সরিসৃপ কিলবিল করে উঠল জাফর সাহেবের মগজে। নিজের অজান্তেই ঘড়ির দিকে তাকালেন। কিছু একটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। বাইরে তালা লাগাতে ভুললেন না। খেলনাটা একপাশে রেখে খোলা জানলার দিকে আবারো শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছেলে।

বসার ঘরে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন জাফর সাহেব। মনটাই খারাপ হয়ে আছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানের ঘুর্নির সাথে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনাগুলোও একটা আবর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে বারবার। রাতে ঘুম হয়না একেবারে, চোখ বন্ধ করলেই দম বন্ধ হয়ে আসে, বাকী নি:শ্বাসেও অক্সিজেনের পরিমান কমে আসে কোন এক অজানা কারণে। বুকের ভেতরের ভাঁজে ভাঁজে অনেকগুলো বুদবুদ জমে জমে আবদ্ধ হয়ে আছে। এরা সারাক্ষণই একটা বিচিত্র খেলা খেলে চলেছে তাঁর সাথে। এরা অনেক সময় নিজেদের মাঝেই কথা বলাবলি করে, তর্কে মত্ত হয়। বুকেরই কোন কোন অংশে কেউ কেউ আকারে বিশাল হয়ে আবার হয়তো মিলিয়েও যায়। খুব তেষ্টা পায় তখন। গ্লাস গ্লাস জল খেয়েও সে তেষ্টা মেটেনা। যখন তখনই একটা শীতল ঘামের স্রোত বেয়ে যায় শরীরে। মাথার ভেতরের মগজের টুকরোগুলো যেন বাজপাখী হয়ে ওড়াল দেয় আকাশে। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না তখন। তারপরেও সফরুদ্দীন কেমন করে যেন টের পেয়ে যায় মনিবের কষ্ট। কাছে এসে শান্ত গলায় আওয়াজ দেয় মনিবকে। তাতেও না হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় পরম মমতায়। জাফর সাহেব আবার জেগে ঢক্ ঢক্ করে জল খান গ্লাসের পর গ্লাস। তারপর বাকী রাতটুকু জেগে জেগে বারবার ঘড়ি দেখেই কাটিয়ে দিতে হয়।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে আবারো জলতেষ্টা পেল তাঁর। বরাবরের মতো সফরুদ্দীন না ডাকতেই একজগ বরফদেয়া ঠান্ডা জল ও গ্লাস রেখে গেল টেবিলে। কোন কথা না হলেও সফরুদ্দীনের চেহারার কাটা দাগটা দেখে জল খেতে খেতেই আবার অতীতে তলিয়ে গেলেন জাফর সাহেব।

এ বাড়ীর সবচে’ পুরোনো চাকর সফরুদ্দীন। মায়ের মৃত্যুর পর অন্যান্য চাকর বাকর ও দুরের আত্বীয় স্বজনরা একে একে এ বাড়ী ছেড়ে চলে গেলেও সফরুদ্দীন রয়েই গেল। এ বাড়ীর ইটপাথরের ভাঁজে ভাঁজে লুকানো শীতল শঙ্কা, মানুষগুলোর বুকের ভেতরে লুকানো আর্তনাদ, কোনকিছুই তাকে এ বাড়ী থেকে বের করতে পারেনি। বাবার চাবুকের আঘাতে রক্তাক্ত মুখ নিয়েও সবার ফুট ফরমাস খেটে খেটেই কেমন যেন এ বাড়ীর ইট পাথরের মতোই বাড়ীরই একটা অংশ হয়ে গেল সে। সফরুদ্দীনই এ বাড়ীর একমাত্র লোক, যার সাথে সারাদিনে একটা দু'টো হলেও কথা বলা যায়। সফরুদ্দীনই এ বাড়ীর একমাত্র লোক, যার উপর এ বাড়ীর জমাট বাঁধা শীতলতা তার বাইরের বাঁধনে ছোঁয়াচ লাগালেও ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি।

ওকে ডাকলেন জাফর সাহেব। সফরুদ্দীন কোন উত্তর না দিয়ে নি:শব্দে এসে দাঁড়াল। গ্রাম থেকে তার বাবার অসুখের খবর এসেছিল কোন এত আত্বীয়।
-- কি রে, তোর বাবা কেমন আছে ?
-- বাবা মরে গেছে।
নিরুত্তাপ উত্তর তার। এরকম একটা মৃতপুরীতে এতটুকু প্রভাব তো পড়াই স্বাভাবিক।
-- কবে মারা গেল ?
-- কাল।
-- দেশে যাবি না ?
-- দেশে গিয়ে কি হবে ?
-- কবর দিবি না ?
-- কবর ওরাই দিয়েছে।
ওরা কারা সে প্রশ্ন করলেন না জাফর সাহেব। এটুকু কথাই বা তাঁর সাথে কে বলে ! কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আবার নি:শব্দেই চলে গেল সফরুদ্দীন। জাফর সাহেব নীরবে তাকিয়ে থাকলেন সে অপসৃয়মান দেহটির দিকে।

মা মারা যাবার পর থেকে আরো যেন শীতল হয়ে গেছে এ বাড়ীর বাতাস। তাঁর মৃত্যুটা তেমন স্বাভাবিক ছিলনা বলেই হয়তো। মা যতটা পারতেন, আনন্দে রাখতে চাইতেন সবাইকে, বাবার চোখের আড়ালে হলেও। বাবা রাগারাগি করতেন, শারিরীক অত্যাচারও করতেন মায়ের উপর। কিন্তু মায়ের আপ্রান চেষ্টা থাকত, এসব যাতে বাইরে প্রকাশ না পায়। কিন্তু অনেক সময়েই মায়ের চেহারায় ও চাকর বাকরদের কথাবার্তায় গোপন থাকত না সবকিছু। কোন এক বৃষ্টিভেজা সকালে দশ বছরের ছেলেকে একা রেখে হঠাৎ একদিন মায়ের লাশ বেরুলো বাবার ঘর থেকে। বাবাকে অন্যান্য দিনের মতোই গম্ভীর, কিন্তু শোকাক্রান্ত মনে হলনা। খাটিয়ায় চেপে মা বাড়ীর বাইরে বেরুতে পারলেও কোন কানাঘুষা এ বাড়ীর চৌহদ্দি পেরিয়ে খুব একটা দুরে যেতে পারল না। বাড়ীর নিরুত্তাপ, মৃত পরিবেশের দাপটে সফরুদ্দীন ছাড়া চাকর বাকররাও সবাই একজন একজন করে বিদায় নিল। আর ত্রানকর্তী হিসেবে মায়ের ভুমিকার অবসানের পর তাঁর অনেক সময় কেটেছে ওই চিলেকোঠায়। বাবার দেয়া শাস্তিতে বন্ধ ঘরে একা একা তালাবন্ধ অবস্থায়। বাইরে পাহারা দেয়ার ও খাবার দেবার দ্বায়িত্বে থাকত দগদগে কাটা ঘা মুখে নিয়ে সফরুদ্দীন।

বুকের ভেতরের জলন্ত ক্রোধ নিয়ে চিলেকোঠা থেকে মুক্তির পর সে রাগ গিয়ে পড়ত সফরুদ্দীন এর উপর। কোন রকম অত্যাচারই বাদ পড়ত না। কোন না কোন দোষ খুঁজে বের করা হতো। আর তা পাওয়া গেলে বাপ ছেলের কোন মতবিরোধ থাকত না। ওদের দুজনেরই একঘেয়ে জীবনের একমাত্র আনন্দের উৎস ছিল সফরুদ্দীনের উপর নিত্য নুতন আবিস্কৃত নির্যাতন। পাশপাশি ওদের কথা বলার ও একমাত্র সঙ্গী ছিল একই সফরুদ্দীন।

ঢং ঢং করে দেয়াল ঘড়িটা বেজে উঠতেই হঠাৎ যেন কেঁপে উঠলেন জাফর সাহেব। সে মুহুর্তেই দেয়াল থেকে একটা টিকটিকি কোন কিছুর তাড়া খেয়ে ছিটকে পড়ল তার জলের জগে। রাগে যেন অন্ধ হয়ে গেলেন জাফর সাহেব। জগটাকে দু’হাতে তুলে ছুড়ে মারলেন সামনের দেয়ালে। পুরোনো দেয়ালের পলেস্তারা খসিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল জগটা। সফরুদ্দীন কে ডাকলেন।
-- হারামজাদা, ঘরবাড়ী ঠিকমতো পরিস্কারও রাখতে পারিস না। এসব পোকা মাকড় আসে কি ভাবে ঘরে? দেখতে পারিস না কুত্তার বাচ্চা।
কোন কথা বলল না সফরুদ্দীন। মেঝেতে ছড়ানো কাঁচের টুকরোগুলোর দিকে ধীর চোখে একবার তাকালো মাত্র। জাফর সাহেবের রাগ বেড়ে গেল আরো। মেঝ থেকে চটিটা নিয়ে চটাস করে মারলেন গালে।
-- শুয়োরের বাচ্চারা যেন সারাদিন তালা দিয়ে রাখে মুখে !
কিন্তু তারপরেও নি:শ্চুপই রয়ে গেল সফরুদ্দীন। শুধুমাত্র মখের কাটা দাগটা লাল হয়ে উঠল বেশী। ধীরপায়ে এসে একটা ঝাটা দিয়ে পরিস্কার করে নিয়ে গেল সে। দু’মিনিট পর আরেকটা ভরা জলের গ্লাস রেখে গেল টেবিলে।

দেয়াল ঘড়িতে চোখ পড়ায় কিছুটা শান্ত হলেন জাফর সাহেব। বিকেল সোয়া পাঁচটা তখন। শীতের সময়ে অন্ধকার নামে তাড়াতাড়ি, আর এ বাড়ীতে নামে তো আরো আগেই। জল খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই আবার ছেলের কথা মনে হলো তার। চটিটা পায়ে গলিয়েই ছুটলেন ছেলের ঘরের দিকে।

ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় অনেক্ষন একা একা হাঁটলেন জাফর সাহেব। দোকানপাটগুলোতে তখন আলো জ্বলেছে সবেমাত্র। এ এলাকায় কোন কারনে ভোল্টেজ কম থাকায় আধো সন্ধ্যায় বাতির আলোগুলোকে আরো বেশী মরামরা মনে হয়। লাল গেটওয়ালা বাড়ীর কাছে আসতেই ভেতরটা কেমন যেন গুমড়ে উঠল। চোখের সামনে সেই বারো বছরের শিশুর নি:স্পাপ চেহারাটা ভেসে উঠল। স্কুলের ব্যাগ কাঁধে প্রাণবন্ত উদ্দাম আনন্দ। সেই সাথে আর কিছু মুখ। কিন্তু তারপরেও একটা চেহারাই গেঁথে রইল তাঁর মনের ভেতর। এক পোড়োবাড়ীর ভুতুরে রূপ নিয়ে লাল দালানটা তাঁর সামনে। কোন একটা শোকের যেন মুর্তিমান বহি:প্রকাশ বাড়ীটি এই ভর সন্ধ্যায়। কি যেন হারিয়ে ফেলেছে এখানকার বাসিন্দারা। ক’দিন যাবৎই বাড়ীটার এমনি চেহারা, এমনকি দিনের বেলাতেও। প্রখর রোদের আলোও যেন এ বাড়ীর সীমানার কাছাকাছি এলে শক্তি হারিয়ে সোডিয়ামের রং ধরে। জাফর সাহেবের মাথার ভেতর থেকে একগুচ্ছ পোকা গলার স্পর্শকাতর জায়গাগুলো বেয়ে বেয়ে বুকের ভেতর নেমে আসতে চাইল। চোখের সামনে লাল দেয়ালগুলো কোন একটা ঘুর্নির আবর্তে চেপে ধরতে চাইল তাঁকে। তার প্রভাবেই হয়তো রাস্তার পাশে বসেই বমি করলেন তিনি। তারপর উঠে পকেটের রুমাল দিয়ে মুখ মুছে ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে ফিরলেন নিজের বাড়ীর দিকে।

অন্ধকার তখন অনেকটা জেঁকে বসেছে রাস্তার কোনায় কোনায়। এরই মাঝে হেঁটে চলেছেন জাফর সাহেব তাঁর নিজের বাড়ীর দিকে নতমুখে। তার কাঁধে যেন অনেক দিনের জমান কোন ভার। জাফর সাহেবের ভর সন্ধ্যার এই আরো ম্লান করে দিল চরপাশকে। সেসাথে আধো আধো মেঘলা আকাশ তার ছায়া প্রকৃতিতে ফেলে আরো ভুতুড়ে করে দিল শহরটাকে। একজন লোক উল্টো দিক থেকে এসে তাঁকে চিনতে পেরে যেন ভয়েই পাশ কাটিয়ে গেল দ্রুত। জাফর সাহেব সেটা যেন বুঝতে পেরে আরো বেশী কুঁজো হয়ে গেলেন।

হাঁটতে হাঁটতে বসার ঘরের দেয়ালে টানানো নিজের বাবা মায়ের ছবিটার কথা হঠাৎ করেই মনে হল তাঁর। দাপুটে বাবার ছবির পাশে ছোট্টখাট্ট সাদামাটা মায়ের ছবিটা নিতান-ই বেমানান হলেও টানানো হয়েছে যত্নের সাথেই। বাবা শহর থেকে ক্যামেরাম্যান আনিয়ে ছবিটা তুলিয়েছিলেন। মা বাইরের লোকের সামনে এভাবে ছবি তুলতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু বাবার জোরের সামনে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ছবিটাতো ছোট একটা ব্যাপার ছিল, সব ব্যাপারেই জোর খাটাতেন বাবা। কাছের মানুষদের উপর, কর্মচারীদের উপর, এমনকি পশুপাখীদের উপরও বাবার জোর খাটানোর কোন কমতি ছিল না। বাড়ীতে একবার চোর ঢুকেছিল বলে একবার নিজের পোষা কুকুরকেই গুলি করে মেরে ফেলেছিলেন। কুকুরটা ছিল তার ছোটবেলার নিত্য সঙ্গী। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া পাড়ার ভালমন্দ যেকোন ছেলের সাথেই মেশা বারণ ছিল তার। এমনকি স্কুলের মেলামেশার খবরগুলোও মাঝে মাঝে পৌঁছে যেত বাবার কাছে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন শাস্তি দেয়ার ব্যপারে বাবার উদ্ভাবনী শক্তি ছিল প্রখর।

সফরুদ্দীন দরজা খুলে দিল। জাফর সাহেব ধীরে ধীরে ঢুকলেন ঘরে। সফরুদ্দীন দরজা বন্ধ করল।
-- ভাত দেব ?
-- রান্না করেছিস্ ?
-- না, দোকান থেকে কিনে এনেছি।
জাফর সাহেবের মেজাজটা আবারো নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছিল প্রায়। কিন্তু সফরুদ্দীনের কাছে বার বার হেরে যেতে চাইলেন না।
-- গরম জল কর। আগে গোসল করব।
-- গরম জল করা আছে।
-- ঠিক আছে, এবার সর চোখের সামনে থেকে।

কোনক্রমে খাওয়া শেষ করলেন জাফর সাহেব। খাবারটা গলার কাছে এসেই কেমন করে তেতো হয়ে যাচ্ছিল বারবার। দোকান থেকে কেনা খাবার বলে নয়, যে কোন খাবারই এমনি তেতো হয়ে যায় গলার কাছাকাছি এলেই। ডাক্তারদের কাছে গিয়েছেন অনেক। তাঁরাও অনেক ধরণের পরীক্ষা করেই দেখেছেন। কিন্তু কোন কাজই হয়নি। বরং আরো বেড়েছে। স্ত্রী যখন বেঁচে ছিলেন, তখনই একই সমস্যা ছিল। খেতে না পেরে রেগে যেতেন তাঁর উপরেই। তারপর মারধোর। মার খেয়ে একটা শব্দও করতেন না সালেহা। মারের প্রতিক্রিয়া না দেখানোর একটা অলিখিত চুক্তিই যেন ছিল সালেহা আর সফরুদ্দীনের মাঝে।

একেবারে একা একা মৃত্যুকে বরণ করলেন বাবা। কেউ ছিলনা কাছাকাছি, এমনকি সফরুদ্দীনও না। দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকেছিলেন বিশ্রামের জন্যে। সবসময় দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ঘুমোনোর অভ্যাস ছিল তাঁর। বিকেল বেলাও অনেক ডাকাডাকির পর কোন সাড়া না পেয়ে দরজা ভাঙ্গে সফরুদ্দীন। বাবার মৃত চেহারাটা প্রথম চোখে পড়ে তারই। ঘরের এক কোনে উবুজুবু অবস্থাতেই বিদায় নিয়েছে প্রাণ। দেখেই বোঝা যায়, খুব কষ্ট পেয়েছেন মৃত্যুর আগের মূহুর্তেও। কিন্তু ডাকেন নি কাউকেই। হয়তো কাউকেই ডাকার মতো কাছের ভাবেননি বা নিজের অসহায়ত্বকে নগ্ন করতে চাননি। বাবার মৃত্যুতে তেমন কোন শোকের ছায়া পড়ল না বাড়ীতে। শুধুমাত্র সফরুদ্দীন বাবার ঘরের মেঝেতে পড়ে পড়ে কাঁদল অনেকক্ষন।

জাফর সাহেবের রাতের সপ্নগুলো খাওয়ার চেয়েও আরো বেশী কষ্টকর, আরো বেশী বিভৎস। তাঁর জীবনীশক্তিতে চুষে চুষে ছিবড়ে বানিয়ে ক্রমশ:ই আরো বেশী ভয়ংকর হয়ে উঠে এই সপ্নগুলো। তাই রাতকে ভীষন ভয় তার। পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টায় সারারাত বাতি জ্বলে তার ঘরে। বারবারই চীৎকার করে জেগে ওঠেন, আর প্রতিবারই সফরুদ্দীন এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে যায়।

আজও সপ্নে সালেহা কে দেখলেন তিনি। সাথে তার অনেক অনেক সঙ্গী। ওদের পরণে কালো কাপড়ের বিষন্নতার ঘন ছায়া। তাদেরকে চারপাশে নিয়ে শীতল একটা বাতাস ছড়িয়ে সালেহা এসে দাঁড়ালেন সামনে। সে বাতাসে কোন এক অজানা ফুলের নিবিড় গন্ধ। কিন্তু সে গন্ধের নিবিড়তায় আনন্দে মন ভরে না, বরং ভয়ের হীমশীতল বাতাস কাঁপুনি আসে বুকের ভেতরে। মনে হয় শরীর থেকে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খসে পড়বে এক এক করে সে গন্ধের তীব্রতায়। এতোটা অসাঢ় হয়ে গেলেন জাফর সাহেব যে, চাদরে মুখ ঢাকবেন, সে ক্ষমতাও রইল না। ভয়ে কাঠ হয়ে সালেহার সঙ্গীদের দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন,
-- এরা কারা ?
-- এরা কেউনা, এরা তুমি।
এর মাঝে সালেহার সঙ্গীরা ঘরের আসবাবপত্র একটার পর একটা পাল্টানো শুরু করেছে কোন কথা না বলেই। টেবিলের কাঁচের জগটি পাল্টিয়ে প্লাষ্টিকের কালো একটি জগ রাখলো। একজন দেয়ালে মায়ের ছবিটি পাল্টাতে ব্যাস্ত। সেদিকে তাকিয়ে সালেহা জিজ্ঞেস করলেন,
-- তুমি নিজে ছেলেকে নিজের কাছে রেখে আমাকে কবরে পাঠালে কেন?
ভীষন ভয় পেলেন জাফর সাহেব। বিছানার পাশের টেবিলের জলের গ্লাসটির দিকে হাত বাড়াতে চেয়েও সে শক্তিটি পেলেন না নিজের ভেতরে। সেখানেও আগেরটি বদলে অন্য একটি রাখা হয়েছে। তারপরেও ক্ষীন আওয়াজে বললেন,
-- তোমরা কেউ আমার সাথে কথা বলতে না, তুমিও না, ছেলেও না ?
সালেহার সঙ্গীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল একজন আরেকজনের। সালেহা তাদেরকে হাতের ঈশারায় স্থির হতে বললেন।
-- তুমি মুখ বন্ধ করে রেখেছ সবার, কথা বলতে দিয়েছ কাউকে ?
এরই মাঝে সোফার সাদা কুশন পাল্টানো শুরু করেছে সালেহার সঙ্গীরা। মায়ের ছবিটির বদলে যার ছবিটি টানানো হলো, তাকে জাফর সাহেব চিনতেই পারলেন না। মুখের ভেতরটা কাঠ হয়ে আছে শুকিয়ে। কথা বলতে গেলে ঠোঁটের সাথে প্রায় আঠা লেগে যায় ঠোঁটের। তাপরও খুব কষ্টে উত্তর দিলেন জাফর সাহেব।
-- বোবা ছেলের জন্ম দিলে তুমি! তুমিও কথা বলতে না, সেও না!
-- আমি ভালোবাসতাম ছেলেকে, ওর সাথে কথা বলতাম, তুমি তাও পারনি?
এবার কোন উত্তর দিতে পারলেন না জাফর সাহেব। তা বুঝতে পেরেই যেন কোন এক রহস্যময় হাসি সালেহার চেহারায়। সঙ্গীদের দিকে তাকালেন একবার। তাদের কয়েকজন তখন দেয়ালে কালো রঙ লাগাতে ব্যাস্ত।
-- তাহলে ছেলেকে তুমি রেখে দিলে কেন?
-- আমি তাকে কথা বলা শেখাতে চেয়েছি। এখন সে কথাও বলে, আজও বলেছে।
তীক্ষ্ণ কাচভাঙ্গা হাসিতে চৌচির হয়ে উঠল চারপাশ। হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরলেন সালেহা। তার সঙ্গীরাও যোগ দিল সে হাসিতে।
-- কথা বলেছে! এতো বোকা তুমি? আমার ছেলেতো এখন আমারই কাছে চলে এসেছে, .. আমারই কাছে!
বলতে বলতে হাসতে হাসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সালেহা। তার সঙ্গীরাও তাকে অনুসরন করল। কিন্তু তারপর যখন সিঁড়ি বেয়ে উপরের চিলেকোঠার দিকে এগুতে শুরু করলো সবাই, সহ্য করতে পারলেন না জাফর সাহেব। চীৎকার করে জ্ঞান হরালেন। সফরুদ্দীন কোন এক অজানা কারণে সে রাতে টের গেলনা কিছু।

কোত্থেকে কে খবর দিল জানা গেলনা। পরদিন পুলিশ এসে প্রতিবেশীর বাড়ীর ছেলেটিকে উদ্ধার করল জাফর সাহেবের চিলেকোঠার ঘর থেকে। ছেলেটি তখন ভয়, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মৃতপ্রায়। চোথে ভীত উদভ্রান্ত দৃষ্টি। খুন ও অপহরণের অভিযোগে জাফর সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হল। কিন্তু তাঁর মুখ খেকে কোন কথা উদ্ধার করা গেলনা । একেবারেই যেন বোবা হয়ে গেলেন তিনি। শোবার ঘরের আলমারীতে পাওয়া গেল তাঁর নিজের ছেলের রক্তমাখা সার্ট ও ড্রয়ারে ক্লোরোফর্মের শিশি। চিলেকোঠার ছেলেটির ও সেবাড়ীর বাসিন্দাদের বাড়ীতে আসার সময়গুলোও একটা পুরোনো ডায়েরীর ভেতর টোকা। মনে হয়, অনেকদিনেরই পরিকল্পনা ছিল তার। সেমতেই নিজের বোবা ছেলেকে খুন করে সেই লাল দালানের ছেলেটিকে ধরে এনে নিজের চিলেকোঠায় আটকে রেখে দিয়েছিলেন। হয়তো তাঁর বাবা যেমন কুকুর আর চাকর পাল্টাতেন, তেমন ভাবেই। ‚সবই পাল্টনো যায়’ এমনি এক বিশ্বাস তার নিজের বাবার মতোই হয়তো তাঁর ভেতরেও তৈরী হয়েছিল। ছেলেটাকে যখন নিয়ে গেলো পুলিশ, সেদিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকলেন ফ্যালফ্যালিয়ে। বাগানের একটা জায়গাটায় ঘুরেফিরে বিড়বিড় করছিল সফরুদ্দীন। ধরে এনে তাকে জেরা করা হল তাকে। ঠিক সে জায়গাতেই খুঁড়ে লাশ পাওয়া গেল জাফর সাহেবের ছেলের। সে লাশ গর্ত থেকে বের করে আনতেই পুরো উন্মাদ হয়ে গেল সফরুদ্দীন। তাকে পাঠানো হল পাগলা গারদে।

সকালে রোদ উঠল ঝিলমিলিয়ে। লাল গেটওয়ালা বাড়ীর লাল দেয়ালগুলো সে রোদের আলোতে পাশের অন্যান্য বাড়ীগুলোর আজ আরো বেশী আলোকিত মনে হলো।


মন্তব্য

তীরন্দাজ এর ছবি

ধুসর একেবারে "সবেধন নীলমণি"!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নিরিবিলি এর ছবি

অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়ে শেষ করে ফেললাম। ভালো লাগলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।