একটা রূপালি বোতামের এতিম হবার গল্প

উন্মাতাল তারুণ্য এর ছবি
লিখেছেন উন্মাতাল তারুণ্য [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২৭/০৭/২০০৮ - ১:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাহীটা মরে গেল।

সেই দিনটার কথা এখনো মনে আছে। আমি স্বভাবগত নিশাচর রাত্রি কাটিয়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ টের পেলাম কে যেন আঙুল টেপাটেপি করছে। চোখ মেলতেই দেখি এক ফুটফুটে পিচ্চি মেয়ে ছোট্ট তালগাছের মত ঝূঁটি মাথায় নিয়ে আমার আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কেঁটে যাওয়া তর্জনী ঢেকে রাখা ব্যান্ড এইডটাই তার কৌতুহলের উৎস। আমি হঠাৎ চোখ খোলাতে সে একটু হতভম্ব হয়ে পড়ল। তারপর একটু লজ্জা পেয়ে আমার আঙুল ছেড়ে নিজের আঙুলটা ঠোঁটের ডগায় ছুঁইয়ে সে এমনই এক হাসি দিল, আমি মূহুর্তের জন্য ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি নাকি?!

নজর আরেকটু মেলতেই আরেক বীর বাহাদুরের খোঁজ পাওয়া গেল। আমার সিপিইউ-র রূপালি রংয়ের চকচকে বোতামটার প্রতি তার রাজ্যের কৌতুহল। ধরতে গিয়ে একটু চাপ পড়াতে ঘড় ঘড় শব্দ করে লাল-সবুজবাতি টিপ-টিপ করা শুরু করতেই তার সেকি আনন্দ! রাজার রাজ্য জয়ের আনন্দও তার কাছে নস্যি। চেহারা দেখে বুঝালাম যমজ ভাইবোন। আমাদের ছোট্ট দুই প্রতিবেশী।

এরপরও আরো অনেকবার মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছে মাহী আর মাহিন। বাসায় এলেই মাত্র হাঁটতে শেখা মাহীর প্রধান কাজ ছিল টল মল করতে করতে আমার রুমে ঢুকে চকচকে বোতামটা টিপে দিয়ে লাল সবুজবাতির টিপটিপানি দেখা। এত্তটুকু একটা ছেলে, এই কাজটা কি করে তার মনে থাকত সেটা আমার কাছে এক বিরাট রহস্য। যে রহস্যের মীমাংসা হবে না আর কোনদিনই। আর মাহিনের কাজ ছিল ভাইয়ের পেছন পেছন ঢুকে ময়লা কাপড়ের ঝুড়িটা নিয়ে খেলতে বসা। এই খেলাটাতে তার ক্লান্তি দেখিনি কোনদিন।

জন্মের পর থেকেই মাহীটা রোগে ভুগেছে খুব। প্রথমে জন্ডিস। এর পর ডেঙ্গু। সেইসাথে থেকে থেকে পেট ব্যথা লেগেইছিল। পরীক্ষা করে দেখা গেল জন্ম থেকেই ওর লিভারের আকার স্বাভাবিকের চেয়ে বড়। ওষুধও চলছিল থেকে থেকে।

মাহী আজকে সক্কালবেলাই ঘুম থেকে উঠেছিল। তারপর নাস্তার টেবিলে বাবার কোলে বসে রুটিও খেয়েছে। এরপর বাবা অফিস চলে গেল। মাহীরও বেজায় ঘুম পেল। ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে একটু পরেই। মন তার বেজায় খারাপ। সেইসাথে মাকে বার বার নিজের পেটটা দেখাতে দেখাতে ঘ্যান ঘেনে কান্না। বোঝা গেল তার আবার পেট ব্যথা করছে। ফোন করা হল মাহীর ডাক্তারকে। ওষুধের নাম বললেন ডাক্তার। সেটা খাওয়ানোও হল। এর পর পরই মাহী চুপ। ধীরে ধীরে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়তে শুরু করল ছেলেটা। লক্ষণ ভালো না দেখে শুরু হল চেঁচামেঁচি। ক্রমে খবর গেল ১১ তলার আরেক প্রতিবেশী এক ডেন্টাল সার্জনের কাছে। ছুটে এলেন তিনি। তক্ষুণি হাসপাতাল নিয়ে যেতে বললেন। সাথে সাথেই মাহীকে নিয়ে গাড়ি রওনা হয়ে গেল হাস্পাতেলের দিকে। কিন্তু লাভ হয়নি কিছুই। মাহীর সাথে সাথে তার ছোট্ট হৃৎপিন্ডটাও ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই।

আমি মাহীকে শেষবারের মত দেখতে যাইনি। সাহসে কুলোয়নি। নিচতলায় মাহিনকে দেখালাম। সে বোঝে নি কিছুই। মামীর কোলে বসে অবাক হয়ে হাঁ করে দেখছে আর ভাবছে এই মানুষগুলো কাঁদছে কেন? ভাই কি জিনিস তা ভাল করে বোঝার আগেই তার ভাইটা নাই হয়ে গেল।

এই ঘরে আর কোনদিন আসবে না মাহী। টল মল করতে করতে দরজার চৌকাঠে ঠোকর খাবে না। হোঁচট খাবে না পাপোষে। সিপিইউ-র লাল সবুজ বাতিগুলো হয়ত জ্বলবে আরো কিছুদিন। কিন্তু সেগুলো দেখার জন্য আর কোনদিন আসবে না কেউ। কারণ আমার রুপালি রংয়ের চকচকে বোতামটা এতিম হয়ে গেছে।


মন্তব্য

রায়হান আবীর এর ছবি

নো গুড... মন খারাপ

শামীম এর ছবি

মন খারাপ
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

সৌরভ এর ছবি

কষ্ট। মৃত্যু বড্ড খলনায়ক।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

খুবই মন খারাপ করা একটা গল্প। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কী'ইবা করার আছে।

কীর্তিনাশা এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেল।
--------------------------
সচল আছি, থাকবো সচল!!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

কষ্ট লাগলো খুব।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ঝরাপাতা এর ছবি

আগে পড়েছি অফলাইনে, খুব কষ্ট লাগলো। আপনার লেখার শিরোনামটা চমৎকার। শিরোনামে আপনার অর্ন্তদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।


যে রাতে গুঁজেছো চুলে বেগুনি রিবন বাঁধা ভাট,
সে রাতে নরকও ছিলো প্রেমের তল্লাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . (আবু হাসান শাহরিয়ার)


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

স্নিগ্ধা এর ছবি

কাহিনীটা এত কষ্টের, তাবে তারপরও আপনার লেখার সৌন্দর্য্য চাপা পড়ে নি।

আলোর ছটা [অতিথি] এর ছবি

এমন কষ্টের ঘটনার জন্য শোক প্রকাশ করব, নাকি আপনার লেখার তারিফ করব - ভেবে পাচ্ছিনা। অসাধারণ লিখেছেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।