চির কাঙ্ক্ষিত একটি আনন্দ মিছিল

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: রবি, ৩১/০৩/২০১৩ - ১০:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সারারাত উৎকণ্ঠা, ঘুম হয়নি একটুও। না, হয়েছে বোধহয় সামান্য; ভোরের দিকে। উচাটন মনও কখনও কখনও হার মানে ক্লান্ত শরীরের কাছে। আধো তন্দ্রায় ফজরের আযান শুনেছি। এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অল্প কিছুক্ষনের জন্যে। কি যেন আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখলাম, মনে করতে পারছি না। এখন ক’টা বাজে, সাতটা? পত্রিকা আসতে এখনও ঘণ্টা খানেক বাকী। পত্রিকায় কি আজ খবরটা বেরুবে। না, তা কি করে হয়, ততক্ষণে পত্রিকা ছাপাখানা পেরিয়ে বান্ডিলে বান্ডিলে সাজানো হয়ে গেছে সরবরাহের উদ্দেশ্যে। তবে টেলিভিশনে জানা যাবে নিশ্চই। যদিও সেখানে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বিরাজমান, সাংবাদিক-মিডিয়া কাউকে ভিড়তে দেয়া হচ্ছে না। গতকাল রাত থেকে দেশজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কোটি কোটি জনতার বুকে টানটান উত্তেজনা, আবার অন্যদিকে শত সহস্র দলীয় কর্মীর বুকে সহিংস প্রতিশোধ স্পৃহা। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্কতাবস্থায় থাকবার আদেশ প্রদান করা হয়েছে।

কোনোমতে মুখ ধুয়ে নির্ঘুম (বা স্বল্প ঘুম) রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়লাম। এ চ্যানেল ও চ্যানেল ঘুরে ঘুরে কোথাও কাঙ্ক্ষিত খবরটি পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি এ যাত্রাও হতে হতে হল না! তা কি করে সম্ভব? বাংলার ইতিহাসে এত বড় গণআন্দোলন কবে হয়েছে! সকল বৈদেশিক চাপ, দাতা দেশ সমুহের ক্রমাগত হুমকি, বিরোধীদলের চোখ রাঙ্গানি এমনকি সরকারের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ- সকলি দলিত হয়েছে জনতার আকাঙ্ক্ষার পদতলে। সমগ্র দেশ ব্যাপী কোটি কোটি সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছে, ছাত্র-শিক্ষক ছেড়ে এসেছে তাদের শিক্ষাঙ্গন, হাসপাতাল ছেড়ে পথে নেমে এসেছে চিকিৎসক, অফিস আদালত কারখানা কোথাও কেউ নেই; বন্দরে-ঘাটে কুলি নেই, বাসে-ট্রেনে চালক যাত্রী কেউই নেই। গোটা বাংলাদেশ গত তিনদিন যাবত অচল। রায় ঘোষিত হবার পর এতগুলো মাস কেটে যাওয়াতেও রায় কার্যকর না হওয়ায় সরকারের এই দীর্ঘসূত্রিতা জনগন মেনে নেয়নি। ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের মত ফুঁসে উঠেছে জনতার দাবী। শুরুতে অনেকেই দ্বিধান্বিত ছিল; এত বছর পর কি প্রয়োজন? কি দরকার পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে জাতিকে বিভক্ত করবার? যে দেশে মানুষ না খেয়ে মরে, সমর্থ পুরুষ কাজের অভাবে পেটের জন্তুকে শান্ত করতে মেয়ে বৌ দের বিক্রি করতে বাধ্য হয়; সেই দেশে চার দশক পূর্বের অপরাধের বিচারের নথি ঘাঁটবার কি যৌক্তিকতা? কিন্তু সকলের মনে এখন ভ্রান্তির মেঘ কেটে শুভচিন্তার রোদ উঠেছে। জনতা জানতে শিখেছে এই দাবী শুধু মাত্র দলীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে নয়, এই দাবী আপামর বাঙ্গালীর, এই দাবী মনুষ্যত্বের। বাঙ্গালী আজ গর্জে উঠেছে, বহুদিনের ঘুমন্ত বাঘ আজ জেগে উঠেছে, বহুকালের বহু আকাঙ্ক্ষিত দাবী মন্থিত সমুদ্র হতে উত্থিত হয়েছে জনতার সম্মিলিত কণ্ঠে। সকল দ্বিধা কাটিয়ে জনতা অভ্রভেদী স্লোগানে স্লোগানে পবিত্রতর করেছে বাংলার বাতাস। সরকার বাধ্য হয়েছে বিচারের রায় কার্যকরণে। আজ ফজরের নামাজের পরপর সাতটি ভিন্ন ফাঁসির মঞ্চে রচিত হতে যাচ্ছে অভিন্ন একটি ইতিহাস। বাঙ্গালী তার কলঙ্ক থেকে পাবে মুক্তি, আজকের এই জনতা ৭১-এ শত সহস্র মৃত ও ধর্ষিতর চরণে প্রতিদান সরূপ রাখবে যোগ্যতম নিছনি।

সকাল দশটা বেজে গেল; পত্রিকায় কোনো নতুন খবর নেই, টিভি থেকেও কিছুই জানা যাচ্ছে না। দশটা পঁচিশে টিভি এবং বেতারে বিশেষ ঘোষণায় জানানো হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বেলা এগারোটায় টিভি ও বেতারে বিশেষ ভাষণ প্রদান করবেন। বুকের ভেতরটা আগাম আনন্দে ভরে উঠলো। মানুষ হয়ে আমি মানুষের মৃত্যু কামনায় আনন্দ আর গর্ব বোধ করছি! কেন? কেননা ঐ দোষী মানুষ গুলো শুধুমাত্র ভুল করেনি, তারা করেছে ঘোরতর পাপ। ভুল হলে তা শুধরে দেয়া যায়, মার্জনা করা যায়; কিন্তু পাপের যথোচিত শাস্তি না হলে সে পাপের পুনরাবৃত্তি ঘটবেই। ইতিহাসে তার ঢের প্রমান রয়েছে। আমার অনেক কাছের বন্ধুই যারা দ্বিধান্বিত ছিল, আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, দেশে বর্তমানে সরকারী-বিরোধী সকলেই নিত্য অপরাধ করে বেড়াচ্ছে, খুন এখনও হচ্ছে, হচ্ছে ধর্ষণও; সেসবের বিচার কি অপ্রয়োজনীয়? আমার উত্তর হচ্ছে সন্দেহাতীত ভাবে সকল অপরাধের বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়, তবে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সেসবের তুলনা করে যুদ্ধাপরাধীদের আড়াল করবার কোনো পথ নেই।

বেলা এগারোটার বিশেষ ঘোষণায় জানানো হলো আজ ভোরে বাংলার ইতিহাসের জঘন্যতম সাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির কার্য সম্পন্ন হয়েছে। আমি উচ্ছ্বসিত হতে পারলাম না; চোখ বেয়ে জল গড়ালো কিছুটা, আনন্দও কখনও কখনও জলের রুপ ধরতে জানে। ধীর পায়ে উঠে বসার ঘরের জানলাটা খুলে দিলাম। ওমা এ কি! বহুদিন ধরে বাঁধে আটকে রাখা জল প্রবল বর্ষণে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে যেমন তীব্র গতিতে সম্মুখে ধাবিত হয়, জানলা খুলতেই তেমনি হুরমুরিয়ে ঢুকে পড়লো এক রাশ আলো; সে কী আলো, আলোর রুপে সত্য ধেয়ে এল; সত্যের বন্যায় যেন দায়বদ্ধতা ঘুচিয়ে দিয়ে গেল। আমার এ জানলাতো প্রতিদিনই খোলা হয়, তবু মনে হলো ৪২ বছর ধরে আটকে রাখা কোনো জানলা যেন খুলে গেল এক ঝটকায়।

আমার পাশে আমার বৃদ্ধ পিতা, আমরা হাঁটছি; না, হাঁটছি নাতো, জনতার স্রোতে ভেসে চলেছি। কোথায় গিয়ে এ স্রোত থামবে জানা নেই, কোনদিক উদ্দেশ্য করে ভাসছি তারও ঠিক নেই। এই মুহূর্তে এই স্রোত বয়ে চলেছে গোটা দেশে; প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি নগরে। মৎস্য ভবনের কদম গাছের ডালে বসা পাখিগুলো আজ ডাকছে সম্পূর্ণ অন্য সুরে, এমন মধুর ডাক তারা কোনোদিন ডাকেনি, সূর্যের আলো কোনোদিন এতটা সোনালী হয়নি, এমন সুন্দর একটা দিন গত ৪২ বছরে কোনোদিন আসেনি; যে গুটিকয়েক ভ্রান্ত তরুণ-যুবক প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছিল, লাখো কোটি বাঙ্গালীর ঐক্যবদ্ধ মূর্তির চরণে মাথা ঠেকে তারাও পিছু হটেছে। তাদের অনেকেই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে, তারাও অংশ নিয়েছে জনস্রোতে।জলের স্রোতের মাঝে প্রবাহমাণ প্রতিটি জলবিন্দু যেমন সমন্বিত, তেমনি সম মানসিকতায় ধাবমান আজ বাংলার কোটি কোটি জনতা, বাঙ্গালীর এমন ঐক্যবদ্ধ মিলন পৃথিবী কখনো দেখেনি। সকলেরই মুখে দীপ্ত হাসি, সকলেরই মুখ কলংকমুক্ত। ইতিহাসের সর্ববৃহৎ আনন্দ মিছিলে আমিও একজন; এ অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।


মন্তব্য

jhuma এর ছবি

সুধুই কল্পনা। আজব!!!

ঈয়াসীন এর ছবি

কল্পনা কোথায়? এ যে আকাঙ্ক্ষা।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনার ব্লগে ফুল চন্দন পড়ুক হাসি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

জব্বার ফারুকী এর ছবি

এমন সকাল আমার আসেনি, এমন ঘটেনি সুঘটনা, তাই সারক্ষণ চোখ থাকে বাঁধের উপর.......
তুমি আসবে বলেই আকাশ মেঘলা ব্ ষ্টি এখনো হয়নি
তুমি আসবে বলেই অন্ধ কানাই বসে আছে গান গায়নি......

ঈয়াসীন এর ছবি

চমৎকার

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।