ফিনল্যান্ডে মঙ্গল শোভাযাত্রা

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২৮/০৪/২০২৪ - ১২:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ফিনল্যান্ডে বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগঠন “প্রত্যাশা”-র উদ্যোগে গত ১৩ এপ্রিল, শনিবার বাংলা নববর্ষবরণোপলক্ষে প্রথমবারের মত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আয়োজন করা হয়। প্রত্যাশা গত দুই যুগ ধরে বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্য এবং বাংলার ঐতিহ্যসমূহ সঠিক চর্চার মাধ্যমে ফিনল্যান্ডের বাঙালি সমাজে প্রচার ও পরিবেশন করে আসছে। এখানকার ‘বাঙালি কমিউনিটি’ ( প্রবাসে ‘কমিউনিটি’ শব্দটি বহুলব্যবহৃত) নেহাতই ক্ষুদ্র। লোকবল সংকটে নিয়মিত সাংস্কৃতিক চর্চার পথ অতটা সুগম নয়। ২০০০ সনের ডিসেম্বরে ‘প্রত্যাশা’ তার যাত্রা শুরু করে ‘বিজয় দিবস’ উদযাপনের মধ্য দিয়ে এবং সেই থেকে এই সংগঠনটি বাংলাদেশের জাতীয় এবং বিশেষ দিবসগুলো যথাসম্ভব নিয়মিত পালন করে আসছে। প্রত্যাশার হাত ধরেই ফিনল্যান্ডে ২০১৯ সাল থেকে ‘একুশের বইমেলা’ আয়োজিত হচ্ছে নিয়মিত। বিদেশ বাড়িতে দেশ থেকে আনানো নতুন বইয়ের সম্ভার নিয়ে আয়োজিত এই গ্রন্থমেলা স্থানীয় প্রবাসী মহলে অত্যন্ত সমাদৃত।

বর্তমানে ফিনল্যান্ডের বাংলাদেশী কমিউনিটির একটি বিশাল অংশ সদ্য দেশ থেকে আগত ছাত্র-ছাত্রী; তাদের বেশিরভাগই মূলত রাজধানী থেকে দূরের শহরগুলোতে বসবাস করে থাকে। পুরানোদের সিংহভাগ রেস্তোরা ব্যাবসায় জড়িত অথবা বিভিন্ন রেস্তোরায় কর্মরত। এখানকার আইটি প্রতিষ্ঠান গুলোতেও অনেক বাঙালি কাজ করে থাকে। এছাড়াও শিক্ষক, চিকিৎসক তথা সর্বশ্রেণীর মানুষ একত্রিত হয়েই তৈরি হয়েছে এখানকার বাঙালি সমাজ। সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক চর্চার পাশাপাশি ধর্মীয় চর্চাও এখানে ব্যাপক ভাবে পরিলক্ষিত হয় এবং ব্যাপকতরভাবে যেটি দেখা যায় সেটি হচ্ছে- রাজনৈতিক চর্চা। আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাত ইসলাম- সবারই শাখা রয়েছে ফিনল্যান্ডে। বহুমতের জাতাকলে শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার পথ কখনও যে দুর্গম হয়না বা হয়নি, তা নয়। সেই শুরুর দিকে প্রত্যাশার নামে কুৎসা ছড়ানো হত এখানকার বাংলাদেশী মসজিদ হতে প্রেরিত ইমেলে ইমেলে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মঞ্চে আর বৈঠকে; বর্তমানে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তৃতিতে সেই অপপ্রচার যে আরও প্রসারিত হবে এবং হয়েছে সেটিই স্বাভাবিক। ধর্মীয় আর রাজনৈতিক বিভাজনের বাণে ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে সংগঠনের আভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডলটিও। তারপরও শত বাধা পেরিয়ে ‘প্রত্যাশা’ এখনও ফিনল্যান্ডে সর্বজনপ্রিয় নাহলেও বহুজনগৃহীত একটি সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব এখানেও বিরাজিত এবং তা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত। ভুল ব্যাখ্যা আর ভ্রান্ত অনুভূতির প্রভাবে বিচলিত অনেকেই। তবে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও যেকোনো শুদ্ধ উদ্যোগে ‘প্রত্যাশা’ কখনওই মসৃণপথ খুঁজে ফেরেনি।

১৩ এপ্রিল স্থানীয় আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত শীতল, সেই সাথে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি এবং সেইসাথে বহুমতের অনুৎসাহ আর কটাক্ষের বাণ, তথাপি সংযাত্রিকদলে ছিল জনাকয়েক বিপুল উৎসাহী যুবক-যুবতী এবং কিছু শিশু। হাতে ব্যানার আর রংবেরঙের মুখোশ সম্বলিত এই শোভাযাত্রা রাজধানী হেলসিঙ্কির মূল শহরাঞ্চলে স্থানীয় পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হাতে বানানো প্যাঁচা, হাতি, বাঘের মুখোশগুলো উপস্থিত সকলকেই স্মৃতিকাতর করে তোলে। সঙ্গে থাকা শিশুগুলো বিড়বিড়িয়ে বড়দের অনুকরণে গাইবার চেষ্টা করে- এসো হে বৈশাখ, এসো হে এসো। এ যেন এক টুকরো চারুকলা, এ যেন একটুকরো বটমূল, এ যেন এক টুকরো স্মৃতির মনিমালা। শোভাযাত্রার যাত্রীসংখ্যা নগন্য হলেও উপস্থিত সকলে ছিল আনন্দিত, উদ্ভাসিত। তারা জানেন বছর বছর সংযাত্রিকদল সংখ্যায় স্ফীততর হবে, তবে বৃহৎ বৃক্ষছায়ায় যে প্রশান্তি, বীজ বপনের তৃপ্তির চেয়ে তা অধিক কখনও নয়।

‘প্রত্যাশা’ তার পরিবেশনায় আর আয়োজনে কেবল বিনোদনে প্রণোদিত নয়, প্রতিটি আয়োজনের মাধ্যমে কিছু বার্তা প্রদান করাই তার মূল উদ্দেশ্য; আর এই আদর্শটুকুই প্রত্যাশাকে অন্যদের চেয়ে সতন্ত্র করে রাখে। একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ, একটি সাংস্কৃতিক বলয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম, একটি সাহিত্যোৎসুক তরুণতরুণীদল- এইসবই প্রত্যাশার স্বপ্ন এবং কামনার মূলে স্থাপিত; আর এই লক্ষ্য পূরণে প্রত্যাশার স্বপ্নশোভাযাত্রা নিত্যচলমান।

ছবি: 
18/08/2011 - 12:36পূর্বাহ্ন
18/08/2011 - 12:36পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। যিনি শুভর চর্চ্চা করেন তিনি পৃথিবীর যে কোণেই যান না কেন, যা কিছু ভালো ও কল্যাণকর সেসবের চর্চ্চাই করবেন। আর যাদের স্বভাব পুরীষ নাড়াঘাঁটা করা তারা পুষ্পউদ্যানেও সেটাই করে যাবেন।

মানুষ গত দুই লাখ বছর ধরে পৃথিবীর এক কোণ থেকে আরেক কোণে ছুটে বেড়াচ্ছে। সে যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় তখন তার নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের চর্চ্চা সাথে নিয়ে যায়। এভাবে এক ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সাথে আরেকটির মিলন ঘটে, উভয়ে সমৃদ্ধ হয়।

শুভর পক্ষের মানুষদের জয় হোক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

এই ছোট একদিন বড় হবে। আরো ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের এখানে, পর্তুগালে পুরো উল্টো অবস্থা। এখানে অনেক মানুষ, আমার ধারণা ৫০ হাজারের কম হবে না। কিন্তু নববর্ষের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কেউ কেউ প্রত্যাশা করলেও, কোন 'প্রত্যাশা' নেই এখানে। সারা দিন একটা পাঞ্জাবী পরে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করার পর তাগুশ নদীর পাড়ে গিয়ে বসে ছিলাম। এখন ভাবছি, ফিনল্যান্ড চলে আসলেই ভালো করতাম। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।