পরিষ্করণ

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৯/১১/২০১৩ - ১০:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের বাড়ীর পেছনের পুকুরে বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের কচুরিপানা জমেছিল একবার। বাড়ীর আর সবাই আমার মতই আলসে। মা-বাবার বয়েস হয়েছে, তাদের পক্ষে পুকুরে নেমে কচুরিপানা সাফ করা সম্ভব নয়। বাড়ীতে আমরা মর্দ তিন ভাই, দুটি বোনও আছে। কিন্তু জলে নেমে কচুরি সাফ করে পুকুরটিকে স্নান করনের যোগ্য না করে তুলে টিউবওয়েলের জমানো জলেই দিব্যি কাজ সেরে নিচ্ছিলাম। কদিন বাদেই বাবা অবশ্য সকলের সুবিধার্থে অনেক খরচপাতি করে ঘরের চালে পানির ট্যাঙ্ক বসিয়ে দিল। টিউবওয়েলের গোড়ায় একটি পাম্প বসানো, সেই পাম্প তরতর করে পানি তুলে নিয়ে ট্যাঙ্ক ভরে দেয়। আমরা কল ছাড়লেই বেরিয়ে আসে পানি। পাম্প চালানোর জন্যে একটি ব্যাটারি চালিত জেনারেটরও বসানো হয়েছে। আমাদের ফুটানি দেখে কে! ইচ্ছে করলেই বাড়ীতে কামলা খাটা লোকগুলোকে দিয়ে পুকুরটি সাফ করানো যেত, কিন্তু আভিজাত্য দেখাতেই হোক আর আলসেমি বজায় রাখতেই হোক, পুকুরটিকে আমরা প্রায় ত্যাজ্যই করলাম। পুকুরটি দিনে দিনে আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকলো। বড় আর মেজো ভাই অন্ধকার হলেই পুকুরপাড়ের নোনা গাছটির তলায় বসে মহানন্দে বিড়ি ফুঁকতো। ফুঁকা শেষ হলে অবশিষ্টাংশ ছুড়ে ফেলতো পুকুরে। বোনদের সঙ্গে আম খেয়ে আমি আঁঠিটি ছুড়ে মারতাম পুকুরে; তরকারির খোসা, মাছের নাড়িভুঁড়ি সবই ফেলা হচ্ছিল ঐ পুকুরেই। এমনি করে দিন গড়াতে গড়াতে কয়েক বছর কেটে গেল। কোনো কোনো অলস দুপুরে হঠাৎ জোর হাওয়া দিলে আমাদের যে পুকুরটি একদিন অষ্টাদশী যুবতী-গাত্রের মত উচ্ছলা বিভঙ্গে নেচে উঠতো; আজ সেখানে আবর্জনার স্তূপ। আমাদের একান্ত অবহেলায় আমাদের নিজস্ব অনেক সম্পত্তি বা সম্পদ এভাবে নষ্ট হয়। এই নষ্ট হবার বীজ আমরাই বপন করি, দিনে দিনে তার বৃদ্ধি দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাই আর সবশেষে নষ্ট হয়ে গেলে পরে অনুশোচনা ছাড়া আর কিছুই করবার থাকে না। ‘অবহেলা করণ’ বিষয়টি আমাদের মজ্জাগত।

এরপর আমি শহরে চলে আসি; কদাচিৎ পালাপার্বণে গাঁয়ের বাড়ী যাই। গেঁয়ো জীবন আর ভাল লাগেনা। পড়ালেখা শেষে শহরেই ভাল একটা চাকরী পেলাম সেই সাথে বিয়েথা করে গেড়েও বসলাম শহরেই। জীবন এগুতে থাকে, আমি দিনে দিনে সাংসারিক এবং যান্ত্রিক হতে থাকি। গাঁয়ের সাথে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। মা-বাবা গত হবার পর থেকে ঈদের ছুটিতেও আর গাঁয়ে যাওয়া পড়ে না। বড় ভাইয়ের ছেলেটা মাঝে মাঝে এটাওটা মাছ, সবজি, সরিষার তেল নিয়ে আসে। তখনই কেবল মনে পড়ে আমার একটা গ্রাম আছে। আমার সন্তানেরাও শহুরে রংঢঙে অভ্যস্ত; সেই সাথে আমিও।

গতকাল গ্রামে এলাম, কত বছর পর এলাম তা ঠাওর করে বলতে পারবো না। বছর ত্রিশেক হবে হয়তো। দীর্ঘ রোগভোগের পর বড় ভাই গত পরশু মারা গেছেন। বড় ভাবী আর ছেলেপুলে গুলোর সাথে পাড়ার মহিলারা সুর করে করে কাঁদছে। অপূর্ব কোরাস। সবার মধ্যে সুর ছাড়া ও ধরার মাঝে একটা অলিখিত বোঝাপড়া আছে। অনুশীলন ছাড়া এমন সমবেত সুরের প্রয়োগ আর কোথাও দেখা যায় না। আমার বৌ, ছেলে মেয়েরা বিরক্ত হচ্ছে, সঙ্গে আমিও। আমার সহোদর গত হয়েছে অথচ আমি শোকাহত হতে পারছি না। শহর আমাকে এতটাই মূলোৎপাটিত করেছে!

দুপুরের পর বাড়ীর পেছনে নোনা গাছটার তলায় মোড়া পেতে বসলাম। কাজের মেয়েটা এসে এক কাপ চা দিয়ে গেল। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালাম। একটি ঘুঘু এসে বসেছে গাছের ডালে, নারকেলের চিরল পাতায় পাতায় ঢলে পড়েছে রোদ্দুর, অনিয়মিত বিরতিতে বাড়ীর ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। সিগারেটে কেন যেন তৃপ্তি পাচ্ছি না কোনো; এখানটায় বড্ড দুর্গন্ধ। গাঁয়ের সকলেই বুঝি এখন এখানেই ময়লা ফেলে। হঠাৎ করে পুকুরটার জন্যে বড় মায়া হল; সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া আবেগগুলো এক ঝটকায় উদ্গিরিত হল যেন! কত কি মনে পড়ে গেল! হঠাৎ কি জানি হল, আমি দেখলাম সেখানে এক ফোটাও আবর্জনা নেই, যুবতীর তরঙ্গিত বুকের মত টলটলে জল। এই পুকুরটি আমার শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতি বিজরিত। আমার বয়েস তখন সাত-আট হবে, বড় ভাই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল এই পুকুরে। নাকে মুখে পানি খেতে খেতে আমার দম আটকে আসার যোগার। জীবন বাঁচানোর তাগিদেই হোক আর ভয়ে দিক্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়েই হোক, হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে আমি ঠিকই ভেসে থাকতে পেরেছিলাম। ভাই আমাকে সাঁতার শিখবার জন্যেই ছুড়ে ফেলেছিল। এরপর কতদিন এই জলে মীনের মত ভেসেছি। একটু বড় হবার পর আমরা তিন ভাই মিলে ডুব দেবার বাজি লাগতাম; কে কতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে ডুবে থাকতে পারি; দুই বোন পাড়ে বসে জোরে জোরে এক, দুই, তিন... গুনে গুনে সময়ের হিসেব রাখতো। আমি বরাবরই হারতাম। আমাদের কত খেলা ছিল এই পুকুরে! মাকে দেখতাম, আমার বোনদের সঙ্গে নিয়ে পুকুর পারে থালা বাটি মাজতো। পাড়ার আরো দুতিনজন খালা চাচীরাও এসে বসতো মায়ের সঙ্গে। তাদের কত সুখদুঃখের গল্প শুনেছে এই পুকুর। আমি যেন হঠাৎ সেইসব দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই পুকুর আমাদের পরিবারেরই একটি অংশ, আজকের এই জঞ্জাল এই পুকুরে শোভা পায় না। আমার চিরচেনা পুকুরটিকে আমি এভাবে দেখতে চাই না। মাথায় পাগলামি চেপে বসলো; ক্ষেতে চাষিরা কাজ করছে, তাদের থেকে একটি কোদাল নিয়ে এসে নেমে পড়লাম সেই আবর্জনার মাঝে। ময়লার সঙ্গে সঙ্গে সাপের ভয়ও আছে, ভয়ঙ্কর বিষাক্ত সাপ। আমি যেন আমার মাঝে নেই। সব ভয় সংশয়কে উপেক্ষা করে নেমেছি জঞ্জাল সাফ করতে। চাষিরা দৌড়ে এলো, আমার মত শহুরে লোককে এ অবস্থায় তারা কল্পনাও করতে পারছে না। বাড়ীর ভেতর খবর গেল, ছুটে এলো সবাই। আমার ঐ অবস্থা দেখে সবার চোখ কপালে উঠেছে। মেজো ভাই ধমকে বললো, কি করস, উইঠা আয়। আমি উঠলাম না। এই গ্রাম আমার, এই বাড়ী আমার, এই পুকুর আমার। আমার যা কিছু আপন, তা আমি নষ্ট হতে দেবো না। এই কর্ম কষ্টসাধ্য জানি, তবু অসাধ্যতো নয়। আমি একলা পারবো না, তবু শুরুতো করতে হবে কাউকে না কাউকে। আমার পাগলামি দেখে সবাই ভীত হচ্ছে; গাঁয়ের মুরুব্বী হোসেন কাকা এসে ডাকলো- উইঠা আয়, পরায় চল্লিশ বছরের ময়লা জমছে; এইডি তুই সাফ করবার পারবি না বাজান। আমি মনে মনে বললাম- না কাকা, এই পুকুরে আমার শেকড় নিহিত। চল্লিশ হাজার বছর ধরে জমে থাকা আবর্জনা হলেও আমাকেই এই পুকুর পরিস্কার করতে হবে। ততক্ষণে আরো দু’তিনজন কোদাল হাতে নেমে পড়েছে।


মন্তব্য

ঘুমকুমার এর ছবি

ততক্ষণে আরো দু’তিনজন কোদাল হাতে নেমে পড়েছে।

সেটাই। শুরুটা আমাকেই করতে হবে। অন্য কারও জন্য বসে থাকলে আর কখনই হবে না।

ঈয়াসীন এর ছবি

আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতার চাবি
তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া
তুমি বাংলা ছাড়ো

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

নীলকমলিনী এর ছবি

খুব খুব ভালো লাগলো। আমি তিন দশক দেশের বাইরে, কিন্তু আমার গ্রামের বাড়ীর সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ছোট বেলায় প্রতিবছর বাবা মার সাথে গ্রামে বাড়ী যেতাম বলে বাড়ীর প্রতি আমার অনেক মায়া। বাড়ীতে এখন চাচাতো ভাইরা আছে।
আমরা সবসময় শহরেই ছিলাম। দেশে গেলে মাঝে মাঝে বাড়ী যাই, বাবার কবর জেয়ারত করতে। সারা পাড়া চলে আসে আমাদের দেখতে, এত আদর পেয়ে অন্যরকম এক ভালো লাগায় মন ভরে থাকে। আশাকরি অচিরেই পুকুরটি জলে জলে ভরে উঠবে।

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- , পুকুরটা এখানে রুপক অর্থে ব্যবহৃত।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সৈকত চৌধুরী  এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি

চলুক
সেই ৪০ বছর এইভাবে চলে গেল-

এক লহমা এর ছবি

ঈয়াসীন, ঈয়াসীন, ঈয়াসীন! সচলে আমার পড়া সেরা লেখাগুলোর মধ্যে থেকে যাবে এ গল্প। গল্প বলায় যা সবচেয়ে কঠিন - সহজ সরল করে বলে যাওয়া, ভারহীন, অথচ প্রতিটি কথা একটা পটচিত্রে টুকটুক করে বসে যাচ্ছে, আর এমনি করে এগোতে এগোতে শেষ পর্যন্ত যা তৈরী হল তাকে কোনভাবেই এড়িয়ে যাবার উপায় নেই - এই সুকঠিন কাজটা করা হয়েছে অতি সাবলীল ভাবে। সেই ইমোটার আজ শরণ নিতেই হচ্ছে গুরু গুরু

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ঈয়াসীন এর ছবি

বিশাল সনদ; আপনি তো ভাই আমার দিনটাই ভাল করে দিলেন। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

মাথার মধ্যে তো ঢুকেই থাকে,
"এইডি সাফ করতে পারবি না"

-আমরা না করলে কে এসে করবে?

শুভেচ্ছা হাসি

শব্দ শ্রমিক এর ছবি

অনেক সুন্দর লেখা, পড়ে মুগ্ধ হলাম।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

গতকাল গ্রামে এলাম, কত বছর পর এলাম তা ঠাওর করে বলতে পারবো না। বছর ত্রিশেক হবে হয়তো। দীর্ঘ রোগভোগের পর বড় ভাই গত পরশু মারা গেছেন। বড় ভাবী আর ছেলেপুলে গুলোর সাথে পাড়ার মহিলারা সুর করে করে কাঁদছে। অপূর্ব কোরাস। সবার মধ্যে সুর ছাড়া ও ধরার মাঝে একটা অলিখিত বোঝাপড়া আছে। অনুশীলন ছাড়া এমন সমবেত সুরের প্রয়োগ আর কোথাও দেখা যায় না। আমার বৌ, ছেলে মেয়েরা বিরক্ত হচ্ছে, সঙ্গে আমিও। আমার সহোদর গত হয়েছে অথচ আমি শোকাহত হতে পারছি না।

এই জায়গাটা পড়ে কেন যেন ধাক্কা খেলাম। আপনি নিজের ভাইয়ের জন্য শোকাহত হতে পারছেন না, এমনকি যারা শোক করছেন তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করছেন, অথচ পুকুরের জন্য এমন কাতর হলেন। ব্যাপারটা কেমন বৈপরিত্যে ভরপুর না? শহরে স্বচ্ছলতার মধ্যে ডুবে থাকলেই কি মানুষ এতটা দূরত্বে চলে যায় গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে?

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ঈয়াসীন এর ছবি

শহরে স্বচ্ছলতার মধ্যে ডুবে থাকলেই কি মানুষ এতটা দূরত্বে চলে যায় গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে?
- ক্ষেত্র বিশেষে যে যায় না, তা নয়।
- গাছের ডালের ঘুঘু, নারকেলের পাতায় রোদের লুটোপুটি আর নেপথ্যে ক্রন্দন রোল- সব কিছু মিলে এক আবহ তৈরি হয়েছে যা কথককে সত্যের মুখোমুখি করেছে।
- মূল বিষয়টি হচ্ছে পুকুর এখানে রুপক অর্থে ব্যবহৃত। বহুদিনের অবশ্য করনীয় কোনো কর্মে উদ্যোগী হয়েছে বহুদিন থেকে উদাসীন থাকা একটি জাতি।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

নাজিয়া এর ছবি

খুব ভাল লাগল। পুরনো কত কিছু যে পরিষ্কার করা প্রয়োজন তা মনে করিয়ে দিলেন।

ঈয়াসীন এর ছবি

সবার আগে প্রয়োজন রাজাকার সাফ করে কলঙ্কমুক্ত একটি দেশ গঠন করা। এরপর অবশ্যই দুর্নীতির শেকড় ধরেও টান দিতে হবে।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

শিশির অশ্রু এর ছবি

গল্প বলার ঢং এবং চেতনাকে নাড়া দেবার চেষ্টাটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। একটু বৈপরিত্য আছে যদিও। ভাই এর মৃত্যু তে শোক নেই বরং অপরকে উপহাস করার চেষ্টা একটু ভাবায় বটে। তারপরেও খুব ভালো লাগলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দুর্দান্ত হয়েছে ঈয়াসীন ভাই।
এমন করে ভাবলে, এমন গল্প পড়লে আর একা লাগেনা, হতাশা আসেনা। আমরা শুরু করে দিয়ে যাই, একদিন পরিবর্তন আসবেই। অন্ধকারের অজ্ঞতা ছেড়ে আলোতে আসবেই।

মাসুদ সজীব

মন মাঝি এর ছবি

দীর্ঘ রোগভোগের পর বড় ভাই গত পরশু মারা গেছেন। বড় ভাবী আর ছেলেপুলে গুলোর সাথে পাড়ার মহিলারা সুর করে করে কাঁদছে। অপূর্ব কোরাস। সবার মধ্যে সুর ছাড়া ও ধরার মাঝে একটা অলিখিত বোঝাপড়া আছে। অনুশীলন ছাড়া এমন সমবেত সুরের প্রয়োগ আর কোথাও দেখা যায় না। আমার বৌ, ছেলে মেয়েরা বিরক্ত হচ্ছে, সঙ্গে আমিও। আমার সহোদর গত হয়েছে অথচ আমি শোকাহত হতে পারছি না। শহর আমাকে এতটাই মূলোৎপাটিত করেছে!

পুরো গল্পের মধ্যে এই প্যারাগ্রাফটা একেবারেই বেখাপ্পা! একটু কঠিন সমালোচনা করি, আশা করি কিছু মনে নিবেন না। এটা আপনার লেখার সমালোচনা, আপনার না। এবং শুধুমাত্র এই লেখাটার, অন্য কোন লেখার না।

-----------------------------------------------------

সুদূর অতীতে বড়ভাইয়ের জলে ছুঁড়ে ফেলা বা তার সাথে ডুব দেয়ার প্রতিযোগিতার কথা মনে পড়ে "সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া আবেগগুলো এক ঝটকায় উদ্গিরিত" হয়, অথচ সদ্যমৃত বড়ভাইয়ের বাড়িতে এসে তার কথা মনে করে বা তার সন্তানদের কান্না দেখে কোন আবেগ উদ্‌গারিত হওয়ার বদলে বিদ্রুপাত্নক মনোভাব আসে - এই ধরণের এ্যটিট্যুড গল্পের চরিত্রটির মানসিক সুস্থতাকে নির্দেশ করে না। আর ঐ "'আবেগের উদ্‌গারণ'-কেও স্বাভাবিক বা অথেন্টিক মনে হয় না - বাস্তব ও রূপক কোন অর্থেই।

রক্তমাংসের প্রত্যক্ষ পরম আপনজনের মৃত্যুতে শোকভারাক্রান্ত না হয়ে যে বিদ্রুপভারাক্রান্ত হয়, তাকে জঞ্জালভর্তি পুকুর দেখে এর যৌবনকালের স্মৃতি, বা রূপকার্থে ইতিহাসের বইতে শুষ্ক সাদা-কালো কালির শীতল নির্বিকার আঁচড়ের উপর ভিত্তি করে অদেখা সুদূর অতীতের শোনা ঘটনা বা তত্ত্বকথার নিয়ে আবেগ-উদ্বেলিত হতে দেখলে, সেই আবেগকে প্রচণ্ডরকম কৃত্রিম ও বানোয়াট মনে হয়। আপন ভাইয়ের মৃত্যুর মাত্র তিনদিনের মাথায় যে সেটা নিয়ে বা তার অনাথ শিশুদের ট্রাজেডি নিয়ে বিদ্রুপ করে, "চল্লিশ হাজার বছর" পুরনো আবর্জনা বা চাপাপড়া ইতিহাস যাই হোক না কেন - সেটা নিয়ে তার আবেগ-আদিখ্যেতা আসলে চরম মানসিক বৈকল্যই প্রমাণ করে। রক্তমাংসের মানুষ বা প্রিয়জনের প্রতি যার প্রেম নাই, তার দেশপ্রেমেও আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নাই। "দেশ" স্রেফ একটা ভুখণ্ড মাত্র নায়, নয় কোন তত্ত্বকথা-সর্বস্ব বায়বীয় সত্তা। সবার আগে এটা মানুষ, মানুষ নিয়েই এর শুরু, মানুষ বিহনেই এর শেষ। মানুষবিহীণ ভূখণ্ড বা তত্ত্বসর্বস্ব কোন দেশে বিশ্বাস হয়তো একটা ফ্যাশিস্ট বা ফ্যানাটিকের জন্ম দিতে পারে (যেমনটা কিছু কম্যু, নাৎসী ও ধর্মান্ধদের মধ্যে দেখা যায়), কিন্তু কোন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের জন্ম দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব। কোন সদর্থক নীতি, আদর্শ বা আবেগের প্রোটাগনিস্ট হিসেবে এমন কোন চরিত্রকে আমি বাস্তবে বা সাহিত্যে - কোন জায়গাতেই দেখতে চাই না।

-----------------------------------------------------

ডিস্ক্লেইমারঃ একটু কঠিন সমালোচনা করে ফেললাম লেখাটার। আশা করি ব্যক্তিগত ভাবে নিবেন না - আপনি আমার পছন্দের লেখক। তাছাড়া আপনি হয়তো এভাবে লিখতে বা বুঝাতে চাননি, ভুলক্রমে বা ঐ প্রক্ষিপ্ত প্যারাটার কারনে এমন লাগছে। কিম্বা আমারও বুঝার ভুল হতে পারে।

****************************************

ঈয়াসীন এর ছবি

ব্লগে একটা লেখা আর পত্রিকা কিংবা বই লেখার মাঝে ঢের পার্থক্য আছে। এর মাঝে মূল পার্থক্যটি হলো 'মন্তব্য প্রদান', তা সে যে প্রকারেরই হোক। এর সুবিধে হচ্ছে লেখক ক্ষেত্র বিশেষে উৎসাহ পেয়ে থাকে, আবার ক্ষেত্র বিশেষে নিজেকে শুধরেও নিতে পারে। আর লেখায় যে 'ভিন্ন' ও 'সহ' দুধরনেরই মন্তব্য আসতে পারে তা জেনেই কিন্তু লেখক ব্লগে লিখে থাকে। এ বিষয়টি সাধারণ পাঠকদের চেয়ে ব্লগে লেখকরা আরো ভাল করে জানে। আপনি দু'বার উল্লেখ করেছেন- আমি যেন কিছু মনে না করি। এই বদান্যতাটুকু নিষ্প্রয়োজন। মন্তব্য আসবে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আসবে পাল্টা মন্তব্য- ব্লগের সার্থকতাতো এখানেই। শুধু ক'টা থাম্বস আপ আর থাম্বস ডাউনের জন্যে ব্লগে কেউ লেখে না। আমি যে কোনো সমালোচনা সাদরে গ্রহন করি। এতে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা যায়।

এবার আসি জবাবে-
(আপনার মন্তব্যের জবাব নয়। এটি বরং লেখার উদ্দেশ্যটুকু উপস্থাপন করতে।)
প্রক্ষিপ্ত প্যারাটুকুর শেষ জ্যোতিচিহ্নটি খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই। (!)- এই চিহ্নটি ব্যবহার করা যায় বেশ কয়েকটি অর্থে, যেমন- আবেগ, আশ্চর্য, হতাশা, আক্ষেপ ইত্যাদি। এখানে তা ব্যবহৃত হয়েছে 'আক্ষেপ' বোঝাতে।
একটা উদাহরণ দিই। আমার গত পোস্টে একটি চেষ্টামূলক url=http://www.sachalayatan.com/yaseen/50442]আবৃত্তি[/url] দিয়েছিলাম। সেখানে একটি জায়গায় কবি (সুজন সেন) বলছেন- "আমাদের ভূতপূর্ব বাঙ্গাল জীবনকে আমরা তখন রীতিমত ঘৃণা করতে শিখে গেছি"... এরপর কালক্রমে কবি লন্ডনের এক সেমিনারে জাপানী এক শিল্পপতিকে অন্যদের সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলতে দেখে অনুশোচনায় ভোগেন এবং মাতৃভাষার জন্যে ৫২তে যারা জীবন দিয়েছিলেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। এখানেও বৈপরীত্য আছে বৈকি! 'অবচেতনা' বলে একটি বিষয় আছে। আমরা যা পরিকল্পনা করে করি তার বাইরেও আমরা এমন কিছু করি যা করবার জন্যে আমাদের অবচেতন শক্তি আমাদের তৈরি করে রাখে। বৈপরীত্য আসে তখনই। মানুষের প্রতি ঘৃণা কিন্তু এই লেখার কথককে বিদ্রুপকারি বা ভাইয়ের প্রতি আবেগহীন করেনি, করেছে তার দীর্ঘদিনের উদাসীনতা।

মূলত একটি ব্যক্তির জীবনে একাধিক সত্ত্বা থাকা অবাস্তব নয়। এক জীবনে কখনও একই ব্যক্তির একাধিক সত্ত্বার উন্মেষ ঘটতে পারে, নাও পারে।

যেহেতু আপনি ছাড়াও আরো অন্তত তিনজনের উক্ত প্রক্ষিপ্ত প্যারাটুকুতে খটকা লেগেছে, তাই মেনেই নিচ্ছি সমস্যা কিছু একটা আছে। আমার যে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য তা এখানে অন্তত কিছু পাঠকের কাছে আমি স্পষ্ট করতে পারিনি। এ দায় অবশ্যই আমার।

দায়মুক্তি: রচনার কথকের মাঝে একটি বিশেষ শিক্ষিত শ্রেণীকে বোঝানো হয়েছে যারা জামাত ইসলাম করেনা, রাজাকারের বিচার 'কিন্তু' 'তবে' সহযোগে চায়, তারাও না। শাপলা চত্বরের ঘটনায় হুজুরদের কানে ধরানোকে যারা সহ্য করতে পারেনা, অথচ তাণ্ডবটুকু তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় তেমন ছুপাছাগুও না। আসলে এই শ্রেণীটি তারা, ৭১ এ রাজাকারের ভুমিকা আর ২০১৩র তাণ্ডব যাদেরকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনা। যাদের মতে দেশের উন্নয়নই একমাত্র লক্ষ্য। রাজাকারের মত দুর্গন্ধময় আবর্জনা নিষ্কাশন যাদের চোখে নিছক নিষ্প্রয়োজন। ৭১এর ৩০ লক্ষ জীবন (এই লেখায় যা 'বড় ভাই' কে দিয়ে বোঝানো হয়েছে) যাদের কাঁদায় না, বরং তার প্রতিবাদে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনকে কটাক্ষ (এই লেখায় যা আত্মীয়দের কান্নাকে বিদ্রুপের মাধ্যমে উপস্থাপিত করা হয়েছে) করে। এদের সবাই কিন্তু দেশের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে না। আমার বন্ধু, আত্মীয়ের মধ্যে এমন অনেকেই আছে। আমি মনে করি আপনারও আছে। এরাও দেশকে ভালবাসে। দেশের ভাল চায়; কিন্তু একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে এরা যার পর নাই উদাসীন।
এই শ্রেণীটি একদিন কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে তাদের ভুল বুঝতে পারবে (প্রত্যাশা), আর সেদিন সম্পূর্ণ বিপরীত এক সত্ত্বা নিয়ে কোদাল (চেতনা) হাতে নেমে পড়বে জঞ্জাল (রাজাকার) সাফ করতে। এ জন্যেই বৈপরীত্যের উল্লেখ।

আমি মনে প্রানে আশা করবো ব্যাপারটি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি। না পেরে থাকলে সেটা আমারি সীমাবদ্ধতা। বোঝার কিংবা বোঝানোর ভুল আমারও হতে পারে।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

আমিও ঠিক এমন করে ভেবেছিলাম, আপনার ব্যাখা আমার ভালোলেগেছে।

মাসুদ সজীব

এক লহমা এর ছবি

চলুক
আপনি খুব সুন্দর করে আপনার কথা, গল্পের আড়ালের কথা জানিয়েছেন। আমার নিজের একটি ইচ্ছে আছে, আমার হিসেবে সার্থক, নজর-কাড়া গল্প, কবিতা ইত্যাদি নিয়ে লেখা। ছোটগল্পের সার্থক রূপায়ণের উদাহরণ হিসেবে আপনার এই গল্পটি আনার ইচ্ছে রাখি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সেটাই।
নিজেদেরই করতে হবে। (‌্য)

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

ভালো লেগেছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।