চুপকথা : উপন্যাসের খসড়া (পর্ব ৭)

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: শনি, ০৭/০৭/২০০৭ - ১০:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৫.১

ডায়েরি লেখা আমার হয় না। অনেকে বলে থাকেন, ডায়েরিতে বেশিরভাগ মানুষ সত্যি কথা লেখে না। প্রতিভাবান ব্যতিক্রম অবশ্য আছেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু গড়পড়তা মানুষ নিজে যা নয় তাই ডায়েরিতে লিখে রাখে। লেখার সময় তারা কল্পনায় একজন অচেনা পাঠককে দেখতে পায়, সুতরাং সেই পাঠকের কাছে নিজেকে মহৎ ও মহান হিসেবে উপস্থাপন করা তখন জরুরি হয়ে ওঠে।

আমি নিজে এই দুই প্রকারের কোনোটিই হতে পারিনি। তেমন করে লেখার প্রতিভা ও সামর্থ্য সকলের থাকে না, আমারও নেই। আর মিথ্যা লেখার আশংকা থেকেই সম্ভবত আমার ডায়েরি লেখার আগ্রহ হয় না। দেশ ছাড়ার সময় এক বন্ধু, কী মনে করে কে জানে, মজবুত বাঁধাই করা একটি খাতা উপহার দিয়েছিলো। এ ধরনের খাতা তখন বাংলাদেশে কিনতে পাওয়া যেতো না, এখন হয়তো যায়, ঠিক জানি না। কোথা থেকে যোগাড় করেছিলো, সে-ই জানে। প্রথম পাতায় বন্ধুটি গোটা গোটা অক্ষরে পাবলো নেরুদাকে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করে দিয়েছিলো :

For some reason or other, I am a sad exile.
In some way or other, our land travels with me
And with me too, though far, far away, live the longitudinal essences of my country.

উদ্ধৃতিটি আগে লক্ষ্য করে দেখিনি, দেশান্তরী হওয়ার উদ্বেগসংকুল ব্যস্ততার মধ্যে স্যুটকেসে ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম। পঙক্তিগুলি নেরুদার রচনা, তা-ও জানা ছিলো না। বন্ধু উদ্ধৃতি লিখেছিলো, সূত্র উল্লেখ করেনি। পরে জানা হলো চিলির প্রবাসী লেখক ইজাবেল আলেন্দের মাই ইনভেন্টেড কান্ট্রি বইয়ে উদ্ধৃত দেখে। ইনভেন্টেড কান্ট্রি! নামকরণেই চমক লাগে, লেখকের নামের শেষাংশে আলেন্দে পদবীটিও অন্য এক অনুরণন তোলে। যৌবনকালে আমরা যারা একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র ও যূথবদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্নে নিমজ্জিত ছিলাম, চিলির সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক সালভাদর আলেন্দে তাদের আত্মীয়সম মানুষ ছিলেন। সালভাদরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইজাবেল। সামরিক উর্দিধারী পিনোশের নেতৃত্বে সালভাদর আলেন্দে নিহত হন ১৯৭৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। সামরিক একনায়ক পিনোশেকে সমর্থন ও সহায়তা দেয় মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থা সিআইএ। আশ্চর্য, ঠিক বত্রিশ বছর পর সেই আমেরিকাই আক্রান্ত হয় ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর। সেদিনও মঙ্গলবার! কাকতালীয়, নাকি নিয়তি-নির্ধারিত?

সালভাদর নিহত হলে আলেন্দে পরিবারভুক্ত কারো পক্ষে চিলি তখন আর বাসযোগ্য ও নিরাপদ হওয়ার কথা নয়। ইজাবেলকে তাঁর জন্মভূমি ত্যাগ করতে হয়, এখন আমেরিকার বাসিন্দা তিনি। চিলিতে সশরীরে বাস না করলেও দেশটি এখনো তাঁর হৃদয়ে, নিজেকে তিনি চিলির মেয়ে হিসেবেই দেখেন এখনো। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাকে একাকার করে কল্পনায় একটি নতুন দেশ নির্মাণ করে নিয়েছেন, যাকে তিনি বলছেন ইনভেন্টেড কান্ট্রি।

চিলির ভৌগোলিক অবস্থান এবং তুষারময় পর্বতমালা ও দীর্ঘ সমুদ্রতটের বৈশিষ্ট্য বাদ দিলে দেশটির সঙ্গে আমার দেশের কী আশ্চর্য সাদৃশ্য। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চিলির বয়স প্রায় পৌনে দুশো বছরের। তার সমাজ, ইতিহাস, দেশের মানুষ ও তাদের সংগ্রাম, সামাজিক সংস্কার - সবই আমার দেশের সঙ্গে তুল্য। তারাও বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকে। আমার দেশের মতোই সে দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক গঠন, বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা। রাজনীতি ও এককালের ক্ষমতা বদলের সামরিক পদ্ধতিটিও। চিলির আলেন্দের সমসাময়িক ও সমগোত্রীয় আমার দেশের প্রধানতম নেতা, শেখ মুজিব, সালভাদরের দু’বছর পর নিহত হয়েছিলেন, সপরিবারে। বাঙালি জাতির জন্যে একটি পৃথক রাষ্ট্রের নির্মাতা এইভাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তা-ও আমেরিকার সৌজন্যে।

আরো একটি বিষয়ে চিলি কিছু আলাদা। সে দেশে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ প্রচুর আছে, সম্ভবত বেশির ভাগ মানুষই তাই। ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা নেই তা-ও নয়, কিন্তু এক ধর্মের মানুষরা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে বিতাড়ন বা নির্মূল করতে তৎপর হয় না, তাদের বিধর্মী বলে ঘোষণা দেয় না। ধর্ম বিষয়ে অবিশ্বাস স্থাপন করলে দেশত্যাগী হতে হয় না, প্রাণসংশয় ঘটে না। আজ শুনি আমার দেশে এই ধর্মোন্মাদদের অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান দাপট। তারপরেও জানি, বিশ্বাস করি, আমার দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ এই উন্মাদনা ও দাপটের ভুক্তভোগীমাত্র - তার অংশীদার নয়।

বন্ধুর দেওয়া খাতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, একদিন অকস্মাৎ খাতাটি আমার হাতে উঠে আসে, যেন বিস্মৃতির ভেতর থেকে। উদ্ধৃত চরণগুলি পড়ে শিহরিত হই, এসব তো আমার কথা। সম্ভবত কবিরাই অন্যদের কথা এমন সুন্দর করে বলতে পারেন, যেন তা হৃদয় মুচড়ে দেওয়া একটি দীর্ঘশ্বাস!

খাতাটি কী কাজে ব্যবহার করা যায়, ভাবি। সাদা পাতাগুলো অপেক্ষায় আছে। মনে হয়, আমার বন্ধু খাতাটি অপাত্রে দান করেছে। লেখক বা কবি এমনকী চিত্রকর হলেও কাজে লাগানো সম্ভব হতো। আমি এখন কী করি? কিছু না ভেবে একদিন নিজের মনে লিখতে শুরু করি। আমার নিজের সব কথা। কোনো কোনো কথা আছে, অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। আর আমি ভাগাভাগি করবো কার সঙ্গে? এই ডালাস শহরে বাস করি আজ পঁচিশ বছর। এ দেশীয় স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কর্মসূত্রে বা অন্য কোনোভাবে পরিচয় ঘটেছে, তারা কেউ আমার বন্ধু নয়। আমি তাদের কতোটা বুঝবো, তারাই বা আমাকে কতোটা? ভাষা বোঝা গেলেও পরস্পরের সংস্কৃতি ও সামাজিকতার রীতিসমূহ অজানা থাকে, পারিবারিক ধ্যানধারণা ও আচার অবোধ্য থেকে যায়। গাত্রবর্ণের পার্থক্যও একটি বিষয় বটে, মার্কিন দেশীয় সাদা ও কালোদের চিরকালীন বিভাজন আজও খুব বেশি জীবন্ত।

স্বগোত্রের মানুষদের সঙ্গেও আমার জমেনি। এই শহরে যখন আসি তখন এক হাতের আঙুলে বাঙালি গোনা সম্ভব হতো। পরে মানুষজন অনেক বেড়েছে, তবু চেনাজানা বেশি হয়নি। এর আগে নিউ ইয়র্কে কেটেছে বছর চারেক, সেখানেও অন্যরকম কিছু ঘটেনি। দোষ অবশ্য অন্য কারো নয়, আমারই। আমি লক্ষ্য করি, মানুষ বড়ো বেশি অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে পছন্দ করে, অহেতুক কৌতূহলী তারা। আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি - তারা কি বলে শুনবো, তাদের কথা বুঝবো বলে। জানতে চাই তারা কে, কী তাদের অভীষ্ট বা গন্তব্য। কিন্তু সখেদে টের পাই, অনেক কথা বলেও তারা আসলে কিছুই বলে না। তারা নতুন মডেলের গাড়ির কথা বলে। বাড়ির মর্টগেজে সুদের হার নিয়ে বিতর্ক করে। স্যুট-টাই ও স্বাস্থ্যবীমা বিষয়ে কথা বলে। বাংলাদেশ থেকে এখানে অবতীর্ণ হয়ে তারা কে কতোটা আমেরিকান হয়ে উঠতে পারলো তা ইংরেজি ভাষায় অনর্গল বলে অসংকোচ গর্বে। কয়েক বছর আগেও ছিলো না, সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে, কারণে-অকারণে ধর্মবিষয়ক কচকচানি - একে অন্যের চেয়ে কতোবেশি পরিমাণ ধার্মিক তার সবিস্তার বয়ান এবং অন্য অল্পপ্রাণ, স্বল্পবুদ্ধি ও গুনাহগার মানুষদের করণীয় কি, তার পাঠক্রম।

একই কথা ক্রমাগত বলে যায় তারা, কেউ অন্য কারো থেকে আলাদা কিছু শোনায় না। আর আছে বোধবুদ্ধিহীন ও স্থূল কৌতুকের অনিঃশেষ ভাণ্ডার - তরল, গরল, ইতর, অশ্লীল ও রুচিহীন। দেশের কথা বলতে তাদের প্রচুর উৎসাহ, অথচ তারা শুধু নিরাশার কথা বলে, আমার দেশটি কতো বিচিত্ররকমভাবে এবং কেন আর বাসযোগ্য নয়, আমেরিকার তুলনায় আমার দেশটি একটি জঙ্গলবিশেষ - সেইসব কথা। অবধারিতভাবে থাকে রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধির কাহিনী ও যুক্তিবর্জিত উচ্চকিত তর্ক। হয়তো আমারই ভুল, আমি মানুষের কাছে খুব বেশি আশা করি। ভুলে যাই, শুধু আমার দেশের মানুষ নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এইসব দিনানুদৈনিকের গল্পে নিবিষ্ট হয়ে থাকে। সর্বদা তারা আমোদিত হতে চায়, বিনোদনের সন্ধান করে। এইসব কথাও তাদের একরকমের বিনোদন বটে।

আমি আসলে যে কী শুনতে চাই খুব স্পষ্ট করে কি জানি? যা শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা করি, তা এইসব নিচের তলার জিনিস নয়। এইসব দিয়ে মনুষ্যজাতির বা পৃথিবীর বিশালত্ব বোঝা যায় না। আমি শুনতে চাই মানুষের অর্জনের কথা। মনুষ্যজীবনের সংগ্রাম, অর্থপূর্ণতা, সুন্দরতর বিষয়সমূহ ও অনিত্যতার কথা। অকল্পনীয় বিশাল আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাসিন্দা হিসেবে আমার বা আর যে কোনো একক ব্যক্তির অকিঞ্চিৎকরতার স্বীকারোক্তি ও উপলব্ধি। বিদেশে বসবাসের সংগ্রাম ও যাতনার কথা শুনতে চাই। দেশের জন্যে স্ফুরিত অহংকার ও ভালোবাসার উৎসারে আমার আগ্রহ। ক্ষুদ্র রাজনীতি ও ধর্মীয় উন্মাদনার বাইরে যে দেশ, সেই বৃহৎ বাংলাদেশের সমষ্টিগত আকাক্সক্ষা আর ভবিষ্যতের কথা শুনতে চাই। এইসবই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক জ্ঞান করি।

আমি যেসব কথা অন্য মানুষদের মুখে শুনি না, যে কথাগুলো আমার বলা হয় না, শোনারও কেউ নেই - সেইসব আমি নিজের মতো করে নিজেরই জন্যে লিখে যাই। এইসব আমার নিজস্ব ভাবনার কথা, আমি ভাগাভাগি করি এই খাতার সঙ্গে।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

নিজের সাথে নিজের চুপকথা!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

"চুপ যা!" মন্তব্যটা এরকম হলে বোধহয় বেশি মানানসই হতো!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

কখনোই না। নেভার।
'চুপকথা' পড়তে গিয়ে বারবার 'পৌরুষ'এর কথা মনে পড়ছে। যদিও 'চুপকথা'র লেখনী সম্পূর্ণ ভিন্ন। রেফারেন্স আসছে অনেক। সে অনুযায়ী নতুন চরিত্র/ঘটনা আসছে না। মূল চরিত্র কেবল নিজের সাথেই কথা বলছে এখনো - - -। সেটা বলছিলাম।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এক শিমুল ছাড়া কেউ পড়ছে কি না, বুঝতে পারছি না। xxবার পঠিত দেখাচ্ছে মানে যে কেউ পড়লো তা তো নয়। সেইজন্যেই মনে হচ্ছিলো "চুপ যা" কথাটা হয়তো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

তোমার পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত নেই। একটু ধৈর্য ধরতে বলতে পারি, আর কিছু নয়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ধৈর্য্য ধরেই তো আছি - - -। শেষ না হওয়ার আগে বেফাঁস কমেন্ট কীভাবে করি!

দ্রোহী এর ছবি

আবার ফ্লাডিং শুরু করলাম।


কি মাঝি? ডরাইলা?

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

নতুন কিস্তি পোস্ট করেই দেখি এই কাণ্ড!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।