খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই…

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৭/২০০৮ - ৪:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বছর চার-পাঁচেক আগে ডালাসে বাঙালিদের একটা অনুষ্ঠানে গেছি। বিরতির সময় অডিটরিয়ামের বাইরে সবাই চা-সিঙাড়া খাচ্ছে, গল্পগুজব করছে, ধূমপায়ীরা ভবনের বাইরে নির্ধারিত এলাকায়। আমি শেষের দলভুক্ত। একসময় খেয়াল করলাম, এক ভদ্রমহিলা বাংলাদেশে ছাপা একটা রসিদবই নিয়ে সবার কাছে যাচ্ছেন চাঁদা সংগ্রহ করতে। একটু কান পেতে বোঝা গেলো, চাঁদা তোলা হচ্ছে মহিলার গ্রামের বাড়িতে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্যে। তাঁর বাড়ি কোথায় জানি না। হতে পারে বাংলাদেশের যে কোনো গ্রামে, কথা শুনে বোঝার উপায় নেই। আশ্চর্য লাগলো, বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা হবে, তার জন্যে চাঁদা সংগ্রহ করা হচ্ছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে।

যথাসময়ে মহিলা আমার কাছেও এলেন। তাঁকে স্পষ্ট করে জানাই, মাদ্রাসা-মসজিদের জন্যে চাঁদা আমি দিই না।

অনিচ্ছুক কারো কাছে ঠিক এই জবাব হয়তো তিনি পাননি। ফলে, তাঁর বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ আমাকে বেশ কয়েক মুহূর্ত নিরীক্ষণ করে। অতঃপর আর কোনো কথা না বলে (মনে মনে সম্ভবত আমার দোজখবাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে) তিনি পরবর্তী কোনো ধর্মপ্রাণ দয়ালুর সন্ধানে যান।

কিন্তু বাংলাদেশে এই কথাগুলি ঠিক এইভাবে আমি বলতে পারতাম? নিজের ভেতর থেকে না-সূচক উত্তরই পাই। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যতো প্রকার গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মাদনার বিস্তার ঘটেছে, তা একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যে যথেষ্ট আতংকের। হুমায়ূন আজাদের পরিণতি আমাদের জানা আছে। তিনি নিজেও হয়তো আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করতেন। তবু তাঁর স্পষ্টবাদিতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। স্বীকার করে নিই, তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তাঁর অপরিমেয় সাহস ও স্পষ্টবাদিতার ছিঁটেফোঁটাও আমার মধ্যে দেখতে পাই না।

বরং যা দেখি, তা আমাকে বিচলিত করলেও অন্য কাউকে জানতে দিই না। বিপদ চোখের সামনে দেখি না, দেখতেও হয় না, বিপদের একটা সম্ভাবনা অনুমান করা গেলেই শামুকের মতো খোলসে লুকিয়ে থাকি।

তবে আমার সাহস কম, এরকম কথা মানবো কেন? আমি ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে, দেশে জলপাই শাসনের বিরুদ্ধে কি কথা বলি না? নিশ্চয়ই বলি। একশোবার বলি। কীভাবে? না, ইন্টারনেটে। ব্লগ লিখে। তাতে কারো কিছু এসে-গেলো? না যাক, আমি বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারি। আত্মশ্লাঘার বোধ আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। আমি বোধহয় একটা কিছু করেই ফেললাম। ইন্টারনেটের বিপ্লবী না আমি!

তখন আমার এই বোধ ঘুমন্ত থাকে যে, ঘোর বিপদের সম্ভাবনা মাথায নিয়ে, গর্দানহীন হওয়ার আশংকার মধ্যেও বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে অনেকে আজও কাজ করে যাচ্ছেন, ধর্মোন্মাদনা ও রাজাকারতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাচ্ছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সামরিকায়নের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিচ্ছেন। প্রকৃত সাহসী তাঁরাই, অভিবাদন তাঁদের প্রাপ্য।

কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে যোজন দূরে আয়েশী ভঙ্গিতে ল্যাপটপে আমার নেট-নির্ভর বিপ্লব সংঘটন অব্যাহত থাকে। যা খুশি বলতে পারি আমি। আমার লেখা কেউ সেন্সর করবে না। আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলেও হাত-পায়ের রগ কাটতে কেউ আসবে না। জলপাই-রঙা ঊর্দি মাঝরাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করবে না। আমি নির্ভয়। সুতরাং অকুতোভয়। বিপদের সব সম্ভাবনা থেকে বিস্তর দূরে।

একটা গল্প মনে পড়ছে। এক চাষীর বউ মহাদজ্জাল। তার দাপটে চাষী কোনো কথাই মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। একদিন মাঠের কাজ সেরে ক্লান্ত চাষী ঘরে ফিরে খেতে বসেছে। আয়োজন সামান্য, সামান্য শাক আর ডাল। কিন্তু ডাল একেবারে বিস্বাদ, লবণ দেওয়া হয়নি। মেজাজ খারাপ হলেও বউকে কিছু বলার উপায় নেই। চুপচাপ খায় সে। রান্না কেমন হয়েছে, বউ জানতে চাইলেও সে চুপ করে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে বউ যথারীতি মুখ ছোটায়, তাকে বোবা, বেআক্কেল ইত্যাদি বলতে থাকে। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে চাষী বাড়ির পেছনের খালের ওপারে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, কাউরে না ডরাইয়া কই, খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই, ডাইলে তুই লবণ দ্যাস নাই, দ্যাস নাই, দ্যাস নাই…


মন্তব্য

জিফরান খালেদ এর ছবি

চমতকার লিখসেন জুবায়ের ভাই...।

এই অনুভূতিটা হয় প্রায়ই...

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এই অনুভূতিটা হয় প্রায়ই...

আমি তাহলে একা নই!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হিমু এর ছবি

খালের ঐপাড়ে দাঁড়িয়ে আলুনির অভিযোগেও দেখা যাচ্ছে উসখুস করছে অনেকে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

লবণ দ্যাস নাই...লবণ দ্যাস নাই....

তবে পোস্টে লবণ ঠিকই আছে। কাইট্টা ছিল্লা লবণ লাগায়া দেয়ার মত লবণ...

-----------------------------------------------
Those who write clearly have readers, those who write obscurely have commentators.--Albert Camus

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

রান্না ঠিক হয়েছে জানলে পাচক খুশি হয়। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

স্নিগ্ধা এর ছবি

কি যে অদ্ভুত এক দিন আজ! কোন লেখা পড়ে মন একটু ভালো হচ্ছে তো কোন লেখা পড়ে খারাপ!

এটাও কেমন যেন বিষণ্ণ করে দিলো, মুজুদা!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এটা তো আমারই বিষণ্ণতা, স্নিগ্ধা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

রেনেট এর ছবি

তোফা!
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

দ্রোহী এর ছবি
প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হা হা হা .... ঠিকই, অনেকেরই এই কৃষকের মত অবস্থা।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আর খেতে না দিলে নাই, তবু বলবো... শুধু যে ডাইলে লবণ কম, তা নয়। মানুষেও মগজ কম!


রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বলাটা কি খালের এপার থেকে না ওপারে গিয়ে? চোখ টিপি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

কীর্তিনাশা এর ছবি

আমি একটা ছড়া জানি দুই লাইনের -

"ছিল্লা কাইট্টা লবন দিলি
বাতাস দিলি না!"

আমি এত নিষ্ঠুর না। বাতাস দিতে চাই।

যাইগ্গা, জুবায়ের ভাই লেখা ভালো হইছে।

-------------------------
সচল আছি, থাকবো সচল!!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নিঘাত তিথি এর ছবি

হুমম।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

কনফুসিয়াস এর ছবি

মনের কথা বলে ফেললেন।

-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

পাঠ ও মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ হিমু, রেনেট, ধূসর গোধুলি, দ্রোহী, প্রকৃতিপ্রেমিক, কীর্তিনাশা, নিঘাত তিথি ও কনফুসিয়াস।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

sumy এর ছবি

Bhai:
Youre write up is too good-Compu kana -thats why can't type Bangla very well and this mouse takes so much time that kills my mind to comment; expectation for good write up is going high.

রিসালাত বারী এর ছবি

গুরু গুরু মন খারাপ

কাজি_মামুন এর ছবি

স্বীকার করে নেই, তাকে নিয়ে মুগ্ধ হতে আমার কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু তার অপরিমেয় সাহস ও স্পষ্টবাদিতার ছিটেফোঁটাও আমার মধ্যে দেখতে পাই না।
বরং যা দেখি, তা আমাকে বিচলিত করলেও অন্য কাউকেও জানতে দিই না। বিপদ চোখের সামনে দেখি না, দেখতেও হয় না। বিপদের একটা সম্ভাবনা অনুমান করা গেলেই শামুকের মত খোলসে লুকিয়ে থাকি।

এই অকপট সত্য কথনের মাধ্যমে জুবায়ের ভাই সমাজের প্রগতি-মনা একটা বড় অংশকেই তুলে ধরেছেন। আর আমার মত অধমদের লজ্জায়ও ফেলে দিয়েছেন।
এইতো কিছুদিন আগে কর্মস্থলে হুমায়ূন আজাদকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এক সহকর্মী হুমায়ূন আজাদকে নিয়ে খুব অশালীন মন্তব্য করছিলেন। আমার ভিতরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল, কিন্তু সে শুধু ভিতরেই। মুখ ফুটে একটা কথাও বলতে সাহস করিনি আমি। কারণ ওখানে ধর্ম-প্রেমিক (ধার্মিক শব্দটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি না, যেহেতু প্রাকটিসিং ধার্মিক তাদের মধ্যে খুব কমই ছিল) লোকদেরই ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আমি যদি এমনকি সামান্য প্রতিবাদও করতাম বা পালটা যুক্তি প্রদর্শন করতাম, আমাকে অধার্মিকের লেবেল এঁটে দিত তারা। আর যে সমাজে অধার্মিক মানেই অপরাধী, সে সমাজে বরং চুপ থাকাই কি শ্রেয় নয়? কেই বা সেধে বিপদ ডেকে আনবে? আমাদের সচেতনতা আর যৌক্তিক বোধ যে কি ভীষণ অন্তঃসারশূন্য, জুবায়ের ভাই তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখাটিতে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।