চুপকথা : উপন্যাসের খসড়া (পর্ব ২২)

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ২২/০৭/২০০৭ - ১০:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৫

জীবনের অর্ধেকের বেশিকাল যে দেশে অতিবাহিত হলো, তা আমার দেশ নয়। হবে না কোনোদিন। নিশ্চিত জানি বলে হয়তো এই বিষয়ে আমি কিছু বেশি অনুভূতিপ্রবণ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো একটি অনুষঙ্গ পেয়ে যাই যখন অনিবার্যভাবে মনে পড়ে যাবে, আমি এখানকার কেউ নই। অনেকদিন আগে একবার আমাদের অফিসে সিকিউরিটি অ্যালার্ম বসানোর জন্যে লোকজন এসেছে। দলনেতা লোকটি আমার টেবিলে বসে, কথায় কথায় একসময় বলে, তুমি দেখছি বেশ ভালো ইংরেজি বলো!

তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, তাই তো, আমার কি ইংরেজি বলার কথা! কী অসম্ভব ব্যাপার! এখানকার কেউ তো নই আমি!

লোকটি হয়তো কিছু ভেবে বলেনি, তার মন্তব্যটিকে প্রশংসাসূচকভাবে নেওয়ারও সুযোগ ছিলো, হয়তো তাই সে বোঝাতে চেয়েছে। অথচ আমার মনে হয়েছিলো, কথাটির গূঢ় অর্থ আসলে এইরকম : তোমার এখানে কী চাই বাবা, কী করে কোত্থেকে এসে জুটলে তুমি, বলো তো? হিন্দি অনুবাদে মেরে আঙ্গনে মে তুমহারা কেয়া কাম হ্যায়!

এ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্যে মানুষের আকুতির শেষ নেই। শুধু বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ যারা এখানে আসে, মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করাকে তারা পরম সৌভাগ্য ও মোক্ষ জ্ঞান করে থাকে। দোষের কিছু আছে বলে মনে করি না, যারা পারে তারা পারে। আমি পারিনি, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে পেরে উঠবো এমন ভরসা নেই। আসলে বোঝাপড়াটি করতেই অনিচ্ছুক আমি। আইনসম্মতভাবে এখানে থাকার জন্যে যতোটুকু না হলে নয়, তার বেশি কিছু আমার দরকারি মনে হয়নি। গাঢ় নীল রঙের মার্কিন পাসপোর্ট না হলে আমার কী আসে যায়? পরের দেশে আমার ভোটাধিকার দিয়ে আমি কী করবো? নাগরিকত্ব নিতে গেলে এ দেশের জন্যে নিঃশর্ত আনুগত্যের শপথ করতে হয়। তা কী করে সম্ভব বুঝতে পারি না। আমার সবুজ পাসপোর্টটি, যদিও আমার কোথাও যাওয়ার কথা নেই এবং এই পাসপোর্ট পৃথিবীর অনেক জায়গায়ই আজকাল দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে শুনতে পাই, তবু সময়মতো আজও নবায়ন করিয়ে আনি।

চিলির কন্যা ইসাবেল আলেন্দে আমেরিকায় বসে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা মিলিয়ে কল্পনায় একটি দেশ বানিয়ে তাকে ইনভেনটেড কান্ট্রি নাম দিয়েছেন। আমার হয়নি। হবে না।

স্কুলে ছোটো ক্লাসে পড়ার সময় কোনো উর্দু ছবির একটি সংলাপ মানুষের মুখে খুব শুনতাম - আফসোস, ম্যায় আমরিকা মে পয়দা নেহি হুয়া! তখন ভালো করে বোঝার বয়স হয়নি, পরে ভাবলে মনে হতো, ঠাট্টার ছলেও কি এ কথা বলা চলে! একজন পাকিস্তানি আমেরিকায় জন্মায়নি বলে আক্ষেপ করলে তার দাস্য মনোবৃত্তিটিই প্রকাশ পায়। অথচ উল্টোদিকে প্রায় একই সময়ে ভারতীয় হিন্দি ছবির একটি জনপ্রিয় গান ছিলো, মেরা জুতা হ্যায় জাপানি, ইয়ে পাৎলুন ইংলিস্তানি, শ্যরপে লাল টোপি রুশি, ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি...। জাপানের পাদুকা, বৃটিশ পরিধেয়, রুশ টুপি হলে কী হয়, আমার হৃদয়টি কিন্তু ভারতীয়। হৃদয়টিকে শুদ্ধ ও একাগ্র রাখাই জরুরি।

এ দেশে আমি বাস করি দীর্ঘকাল ধরে অথচ তার জন্যে আমার কোনো টান নেই, তার ভালোমন্দে আমার কিছু এসে যায় না - এ-ও হয়তো এক ধরনের প্রবঞ্চনা। একটু কঠিনভাবে বললে, ভণ্ডামি। কিন্তু কোথায় যাবো আমি?

সোভিয়েট ইউনিয়ন ষাটের দশকের শেষভাগে চেকোশ্লাভাকিয়া দখল করে নিলে কমিউনিস্টবিরোধী চেকরা দলে দলে দেশান্তরী হতে শুরু করে। দেশত্যাগে ইচ্ছুক এইরকম একজন গেছেন সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে, যেখানে আবেদনকারীদের পছন্দের দেশে ভিসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। আবেদনকারীকে সরকারি অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোন দেশে যেতে চান?

উত্তরে আবেদনকারী বললেন, তা তো জানি না। তবে এমন কোথাও যেতে চাই যেখানে একটু শান্তি ও স্বস্তি নিয়ে বাস করতে পারি।

সরকারি অফিসার একটি গ্লোব ধরিয়ে দিলেন আবেদনকারীর হাতে। বললেন, দেখেশুনে একটা দেশ ঠিক করে নিন।

আবেদনকারী অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গ্লোবটি দেখলেন। তারপর সেটি ফিরিয়ে দিয়ে সরকারি কর্মচারিটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কাছে আর কোনো গ্লোব আছে?


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

তুমি দেখছি বেশ ভালো ইংরেজি বলো!

প্রথম পরিচয়ের পর এরা সবচেয়ে বেশী যে জিনিসটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছে সেটা হলো - তুমি আর কতদিন এখানে থাকবে / পড়াশোনা শেষের পর কি করবে ?

প্রথম প্রথম না বুঝে নানারকম পরিকল্পনার কথা বলতাম । একটু বুঝ আসার পর থেকে আমি দেশে ফিরে যাবো বলতে শুরু করি । সবাইই বেশ খুশি হয় দেখি এটা শুনলে ।


আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

হাসিব, আমাকে অবশ্য তুমি কতোদিন এ দেশে থাকবে প্রশ্নটি তেমন শুনতি হয়নি। কতোদিন আছো শুনেছি ম্যালা। আমার মনে হয়, অঞ্চলভেদে সাংস্কৃতিক পার্থক্য এর একটা কারণ হতে পারে। আপনি ঠিক কোন অঞ্চলে আছেন?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হাসিব এর ছবি

আমি জার্মানীর সাউথে থাকি, উলম শহরে ।


আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে

??? এর ছবি

ভাল্লাগল। এইটা বোধয় ফার্স্ট জেনারেশন ডায়াসপোরা-র ক্ষেত্রে কমন স্টেটমেন্ট। আচ্ছা... সেকেণ্ড জেনারেশন-এর কী হাল? মানে... জুবায়ের ভাইয়ের পুত্র-কন্যারা যাদের জন্ম আমেরিকায়? তারা তাদের দেশ বলতে কী বোঝে? পিতামাতার "পিছুটান"কে কীভাবে ব্যাখ্যা করে তারা?

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সুমন, আপনার মন্তব্য অনেক প্রসঙ্গ ও ব্যাখ্যা উস্কে দেয়। প্রবাসে প্রথম প্রজন্মের বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা কিছু বিচিত্র।

তিনবেলা ভাত খাওয়া, ঘরে সর্বক্ষণ লুঙ্গি-পরা অসংখ্য মানুষ দেখেছি যারা কয়েক বছর অন্তর দেশে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে সাধারণভাবে উদাসীন। তারা বরং আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিষয়ে অধিক আগ্রহী।

আরেক শ্রেণী আছে যাদের ধড়টি পরবাসী হলেও আত্মা গচ্ছিত রাখা আছে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে। আমার লেখার চরিত্রটি এই অংশের প্রতিনিধিত্ব করে।

আরেক ভাগে আছে যারা খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও সামগ্রিক জীবনচর্যায় পুরোপুরি মার্কিন। একজনকে জানি যে গোগোল গাঙ্গুলির মতো কাগজে-কলমে নাম বদলে ফেলেছে। তারা বাংলাদেশের মতো দেশে জন্মেছে বলে প্রায় শোকগ্রস্ত। গায়ের রংটি পরিবর্তন করতে না পারার দুঃখে খুব কাতর থাকে।

আরো একদল আছে যারা এ দেশীয় কাউকে বিয়ে করেছে - প্রয়োজনে বা ভালোবাসায় - এবং সন্তানাদিও হয়েছে, তাদের পরিস্থিতি ও মানসিকতা সম্পূর্ণ মিশ্র। এরা না স্বদেশীদের সঙ্গে সহজ হতে পারে, না ওই সমাজে নিজেদের মানাতে পারে। জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর মনরক্ষা করতে এদের প্রাণাতিপাত করতে হয়।

দ্বিতীয় প্রজন্ম সম্পর্কে আপনার প্রশ্নের উত্তরও একই রকম জটিল ও মিশ্র। নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ বাবা-মায়ের দেশ সম্পর্কে অনুভূতিকাতরতাকে সহানুভূতি নিয়ে দেখে। আরেক দলের কাছে তা অতিশয় হাস্যকর ও যুক্তিহীন। তাদের প্রশ্ন, তোমাদের যদি দেশের জন্য এতোই প্রেম, বিদেশে এসেছিলে কেন?

দ্বিতীয় প্রজন্মকে নিয়ে আমার এক ধরনের অসহায় অপরাধবোধ আছে। নিজের ছেলেমেয়েদের চোখের সামনে বড়ো হতে দেখি আর ভাবি, এরা এদেশের জীবনচর্যায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, বাবা-মায়ের কারণে নিজেদের বাঙালি পরিচয়ও পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারছে না, অথচ গায়ের রংটি এদের আজীবন এ দেশীয়দের থেকে আলাদা করে রাখবে। শত চেষ্টাতেও তারা মূলস্রোতের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে যেতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। বাঙালি পরিচয়েও তারা কোনোকালে ফিরতে পারবে না, সম্ভব নয়।

পরের প্রজন্মের জন্যে আমরা পরিচয়ের এক ভয়াবহ শূন্যতা ও সংকট ছাড়া আর কী রেখে যাচ্ছি? তখন মনে হয়, নিজেদের (হয়তো তাদের কথাও বিবেচনায় ছিলো, কিন্তু সংকটটা বোঝা যায়নি) বর্তমান ও ভবিষ্যত স্বাচ্ছন্দ্যের লোভে তাদের ভবিষ্যতকে বলি দিয়েছি।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

দ্রোহী এর ছবি

এই পর্ব বেশ ভালো লেগেছে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।