চুপকথা : উপন্যাসের খসড়া (পর্ব ২)

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: সোম, ০২/০৭/২০০৭ - ১০:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২.১

মস্তিষ্ক, যাকে আমরা সাধারণভাবে সর্বত্রগামী হৃদয় বলে ভাবতে বেশি ইচ্ছুক ও অভ্যস্ত, তার চেয়ে দ্রুতগামী কোনো যান মানুষ আবিষ্কার করেনি। হৃদয়যানের যাত্রী হয়ে অনায়াসে চারপাশের মানুষজনের অজ্ঞাতে মানস-ভ্রমণটি সম্পন্ন করা যায়। কর্মস্থল থেকে ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না, অফিসে নিজের টেবিল-চেয়ারে বসে সম্পন্ন করা চলে। দূরদেশে, আমার দেশ থেকে পঁচিশ-তিরিশ ঘণ্টার বিমানযাত্রার দূরত্বে এখন আমি, অফিসের কর্মকোলাহলের ভেতরে।

পাশের কিউবিকলে সহকর্মীর স্পীকারফোন অন করা, কনফারেন্স কল। ভিন্ন ভিন্ন টাইমজোনের তিনটি শহরের সাত-আটজন মানুষ কথা বলে অনবরত। একটি কর্মপ্রকল্পে এ-যাবত চিহ্নিত ও সম্ভাব্য সমস্যাবলি নিয়ে যে যার মতামত ও বিশ্লেষণ উপস্থিত করে, নিজের অবস্থান ও ধারণার ব্যাখ্যা দেয়। এই পর্ব সম্পন্ন হলে অতঃপর সর্বজনগ্রাহ্য একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ ও কর্মদক্ষতা অনুয়ায়ী দায়িত্ববণ্টন। এইরকমই হয়ে থাকে, সবই জানা কথা। আমি আজ এই আলোচনার অংশীদার নই বলে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া আমার জন্যে বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু অনিচ্ছায় হলেও শুনতে হয়। শ্রবণপর্বের ভারী ও দায়িত্বপূর্ণ কথাগুলির কিছু আমার কানে আসে, কিছু অধরা থাকে।

জীবিকার জন্যে মানুষকে কোনো না কোনো কর্মে সম্পৃক্ত হতে হয়। আমার মতো উচ্চাকাক্সক্ষাশূন্য মানুষও ব্যতিক্রম থাকে না। এই কর্মে অর্থাগম ঘটে, আহার-বসন-গৃহসংস্থান হয়, জীবনের আয়েশ সহজলভ্য হয়। প্রত্যেকটি সভ্য মানুষের দেওয়ার মতো একটি পরিচয় থাকা প্রথাসম্মত এবং তা প্রধানত কর্মনির্ভর। এখন থেকে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ এইসব পরিচয় নিয়ে ভাবেইনি, ব্যক্তিপরিচয় বা পেশাগত কৌলিন্যের ভেদাভেদ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিলো না। শিথিল সামাজিক বন্ধনেও তারা যূথবদ্ধ হয়ে থাকতে জানতো। ভাবি, তারা কি অসুখী ছিলো?

আমি যে কাজটি করে জীবনধারণ করি, সেই পেশায় প্রসেস অটোমেশন বলে একটি কথা চালু আছে। অটোমেশন সেই জিনিস যা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষের চেয়ে যন্ত্রের অধিকতর ব্যবহার নিশ্চিত করবে, তোমার জীবনকে সহজ করবে, সময়ের সাশ্রয় ঘটিয়ে উৎপাদন দ্রুততর ও বেশি ফলপ্রসূ করবে। সরল সোজা কথায় তা বলছে, আরো বেশি যন্ত্রনির্ভর হও, আলস্যকে জীবনের মোক্ষ করো। বিস্ময়ের কথা, সুখী হওয়ার জন্যে দরকারি সব উপকরণ আজ মানুষের নাগালে ও নিয়ন্ত্রণে, তবু মানুষ সুখী নয় কেন? সবসময়ই কিছু একটা নেই মনে হয়। আমার চারদিকে তাকিয়ে দেখি, বুঝতে চাই, ঠিক কী নেই যা হলে সত্যি সুখী হওয়া সম্ভবপর হতো।

আমার কর্মস্থলে কেউ জানে না, আমি এখন এখানে নেই। কমপিউটারের মনিটরে চোখ, হাতের অভ্যস্ত আঙুলগুলি কীবোর্ডে নির্ভুলভাবে চলাচল করে, প্রয়োজনে মাউস টেপে। আর সকলের অগোচরে মনে মনে আমার দেশে যাওয়া-আসার খেলা। খেলাটি আমার প্রতিদিনের। কতোবার যে চলে! খেলাই বটে। যা ঘটছে না, ঘটার সম্ভাবনাও নিকটবর্তী নয়, তাকে মনের মধ্যে বাস্তব করে দেখা খেলা ছাড়া আর কি? দয়াহীন বান্ধবশূন্য দূর পরবাসে এইটুকু আমার একেবারে নিজস্ব, কোথাও কোনো জমা-খরচের হিসেব না-দেওয়া লুকানো প্রশান্তির জায়গা। এর মধ্যে কারো কোনো ভাগ নেই, কোনো জবাবদিহি করা নেই, শুধু আমার একার।

এখানে এখন ফুরিয়ে আসা দিন। শীতের দিনে পাঁচটার পরপরই অন্ধকার নেমে আসতে থাকে। অফিসের ভেতরে বসে কিছু টের পাওয়া যায় না, মাথার ওপরে টিউবলাইট জ্বলে দিনমান, দিনরাতের তফাৎ বোঝার উপায় নেই। সময় দেখে বুঝি, বাইরে অন্ধকার নামছে। ঘড়ির হিসেবে বাংলাদেশ সময়ের বারো ঘণ্টা পেছনে আমি। দেশে আজকের খবর কি? নতুন কি ঘটছে?

ঢাকার কাগজগুলো দেখার জন্যে ইন্টারনেটে হানা দিই। আঃ, এই আন্তর্জাল না থাকার কালে দেশের খবর পাওয়া কী দুরূহ ছিলো! সেই সময় বড়ো ধরনের বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মতো কিছু হলে টিভিতে, স্থানীয় দৈনিকে দু’চার বাক্যের সংবাদ পাওয়া যেতো। না হলে তৎক্ষণাৎ কিছু জানার উপায় ছিলো না, ভরসা ছিলো নিউ ইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিকগুলো। তার জন্যেও আবার সপ্তাহভর অপেক্ষা। আজকাল এখানকার সময়ে দুপুর তিনটার মধ্যেই ঢাকার অনেকগুলো দৈনিক ইন্টারনেটে চলে আসে। ঢাকায় পত্রিকা তখনো প্রেসে, ছাপা শেষ হয়ে বেরোতে আরো কিছু দেরি। ততোক্ষণে দেশের সব খবর পড়া মোটামুটি শেষ হয়ে যায় আমার। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ঢাকায় ফোন করলে সেখানে তখন সকাল হচ্ছে, অনেকে ঘুম থেকেও ওঠেনি, দৈনিক কাগজের প্রধান খবরগুলো সব আমার জানা। কাউকে দেশের খবর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয় না।

আজ সকাল থেকে কাজের চাপ কিছু বেশি, অল্প কিছুদিন আগে তৈরি করা একটি প্রোগ্রামের ত্রুটি মেরামতের কাজে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে পড়েছিলাম। তাগিদ ছিলো আজ দুপুরের মধ্যে শেষ করে দেওয়ার। কমপিউটারে প্রোগ্রাম লেখার স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত হয় ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনের পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে, অথচ তারপরেও ব্যবহারকালে অজানা ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কারো সন্বিৎ ফেরে - আরে, এই পরিস্থিতিটি আগে কেউ ভাবেনি কেন? বস্তুত মানুষের জীবনের গল্পেও এরকমই হয়ে থাকে, হোক তা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অথবা রাষ্ট্রীয়। তখন মনে হতে থাকে, আগে ভাবা উচিত ছিলো!

কাগজগুলো এখন দেখবো। দেরি হয়েছে কিছু, তা হোক, ঢাকায় কেউ এখনো কাগজ হাতে পায়নি। রেলস্টেশন, দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল বা সদরঘাটে অতি প্রত্যুষের যাত্রীরাও না।

দেশের সংবাদের জন্যে এতো যে আগ্রহ, অধীরতা আমার, অনেকটা হয়তো নেশাগ্রস্তের মতো, কিন্তু কী দেখবো বলে আশা করি প্রতিদিন? স্পষ্ট কোনো উত্তর জানা নেই। ঘটনা-দুর্ঘটনা, হানাহানি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিপুল বিস্তার আর হতাশার খবরে ভরে থাকে কাগজ। দৈনিক দুঃসংবাদ নামে একটি কাগজ থাকলে খুব উপযুক্ত হতো বলে মনে হয়। কাগজে আর থাকে রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা ও অদূরদর্শিতার লজ্জাহীন বিস্তারের সংবাদ - দেশ নয়, দেশের মানুষ নয়, তাদের ভালোমন্দে কিছু এসে যায়না, আমি এবং আমার দলই একমাত্র বিবেচ্য। এইসব দেখে দেখে ভারি ক্লান্ত লাগে, বিষাদে মন ভরে যায়। কখনো এমনও মনে হয়, প্রতিদিন একই খবর পড়ছি। ভাবি, কী হবে আর দেখে, একদিনের কাগজ দেখলে সারা বছরের খবর পাওয়া হয়ে যায়। অথচ পরেরদিন নির্ধারিত সময়ে আবার ইন্টারনেটে না গিয়ে উপায় থাকে না আমার - মনে হতে থাকে আজই হয়তো অন্যরকম কোনো একটি সংবাদ দেখবো। আমার দেশে নতুন ও সুন্দর কিছু একটা ঘটে যাবে আর আমি যথাসময়ে সে সংবাদটি জানতে পারবো না, তাই হয়! বাস্তব এই যে বাস্তবে কিছুই ঘটে না, সুসংবাদের অপেক্ষায় দিনের পর দিন চলে যায়, তবু আমার আশা মরে না। অন্তিম বিচারে আশা নিয়েই হয়তো মানুষ বেঁচে থাকে।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

মন্তব্য টেস্ট।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হাসান মোরশেদ এর ছবি

প্রথম পর্বের সাথে দ্বিতীয় পর্বের কোনযোগসুত্র বোধ করি গড়ে তুলেনঅনি এখনো ।
উৎসুক পাঠক কি অনুমান করতে পারে, প্রথম পর্বের সেই গ্রামীন কিশোরই দ্বিতীয় পর্বে এসে প্রবাসী নাগরিক?
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

হাসান মোরশেদ, উত্তরে 'ক্রমশ প্রকাশ্য' বলা যেতো। কিন্তু আপনি ধরে ফেলেছেন। একেকটি পর্ব পুরো দেওয়া গেলে আপনাকে এই প্রশ্ন করতে হতো না। কিন্তু দীর্ঘ পর্ব হয়ে গেলে পাঠকের ধৈর্য থাকে না দেখেছি। এবং দেখে শিখছি। হাসি

এই পর্ব আপনিই প্রথম পড়লেন বলে জানা গেলো। আমার তো একসময় মনে হচ্ছিলো কেউ পড়ছেই না, পোস্ট করা বন্ধ করবো কি না। আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, সেটাও একটা কারণ হতে পারে বলে অনুমান করা যায়।

আপনার মনোযোগের জন্যে কৃতজ্ঞতা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

জুবায়ের ভাইঃ
একটা অনেষ্ট কমেন্ট করি । বয়সে আমি অনেক ছোট হবো । আপনার লেখালেখির বয়সই হয়তো আমার বয়সের সমান । তবে অনলাইন লেখালেখি করছি বেশ কয়দিন থেকে, সেই ভরসাতেই বলি-
অনলাইন লেখালেখিতে চট করে অনেক মন্তব্য পেয়ে যেতে পারেন, না ও পেতে পারেন । অনেক সময় পড়া হয় কিন্তু মন্তব্য করা হয়না । অনেকে আবার দীর্ঘবিরতি দিয়ে ভালো লেখাগুলো খুঁজে খুঁজে পরে ।
তাৎক্ষনিক মন্তব্য পেলে ভালো লাগে । তাৎক্ষনিক মন্তব্য না পেলে লেখকের সংবেদনশীলতা আহত হয় । কিন্তু এই যে আনন্দ ও বেদনার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া সেটা কিন্তু ট্রেডিশনাল লেখালেখিতে পাওয়া যায়না । আজকে আপনার এই উপন্যাস দেশের সেরা কাগজে ছাপা হলেও আপনি কিন্তু কদাচিৎ ফিরতি মন্তব্য পাবেন পাঠকের কাছ থেকে ।

মুল কথাটা বলি এবার,পোষ্ট বন্ধ করবেননা কোন অবস্থাতেই ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

পড়ছি।
আগামী পর্বের অপেক্ষায়।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

কেউ পড়ছে জানলে ভরসা হয়। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

দ্রোহী এর ছবি

আবারও দেরী করে ফেললাম। পরের পর্বে যাই।


কি মাঝি? ডরাইলা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।