চুপকথা ০৪

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ১৬/১২/২০০৭ - ১২:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বছরের কতকগুলো তারিখ কিছুতেই ভুল হয় না, ঠিক ঠিক মনে পড়ে যায়। ক্যালেন্ডারের তারিখ শুধু নয় সেগুলি, তারা আমার স্মরণের উপলক্ষ তৈরি করে। আমি উৎসব উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতায় শামিল হতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। আমার উদ্যাপন ব্যক্তিগত, আমার নিজস্ব। তার কিছু আমার দেশের ইতিহাসের অংশ - যেসব সবার জানা। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কে ভুলবে? এখন তা সারা পৃথিবীর উদযাপনের দিন। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস? সবাই মনে রাখে কিনা জানি না। আমি রাখি, ভুল হয় না। নির্দিষ্ট দিনে মনে মনে উদযাপন করি, শোক পালন করি।

কোনো কোনো দিবস আমাদের রাষ্ট্রীয় কলঙ্কের, তা-ও ভুলে যাই না। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের দিন ভুলি না। জীবিত থাকলে শেখ মুজিব এখন হতেন অশীতিপর বৃদ্ধ। কেমন দেখতে হতেন তিনি? তাঁর তেজস্বী দৃপ্ত ভঙ্গিটি বা হাস্যময় মহিমাদীপ্ত ছবিটি দিয়ে তাঁকে চিনেছি। আশি বছরের বৃদ্ধ হিসেবে তাঁকে ভাবা যায়! কেমন হতো আজকের বাংলাদেশ তিনি জীবিত থাকলে? আমার কল্পনাশক্তি অতোদূর যাওয়ার সামর্থ্য ধরে না।

সামরিক পোশাকে ক্ষমতায় আবির্ভুত হলেও জিয়া রাষ্ট্রপতি ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাও। তাঁর হত্যাকাণ্ড আমাদের কোনো গৌরব দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধে শরীরের একটি অংশ উৎসর্গ করেছিলেন বীর যোদ্ধা কর্নেল তাহের, তাঁর ফাঁসির বার্ষিকীতে কাপুরুষতা ও বিশ্বাসঘাতকতার লজ্জায় আমি কুঁকড়ে যাই। কারাগারের আপাত-নিরাপদ কুঠুরিতে তাজউদ্দিন-সৈয়দ নজরুলদের হত্যার পৈশাচিকতা আমার দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে থাকে। বিরাশির চব্বিশে মার্চে বন্দুক হাতে আরেক বীরপুরুষের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লজ্জার দিন।

কোনো কোনো দিবস আমার নিজস্ব। সেইসব দিনে আমি সেদিনের অনুষঙ্গ ও ঘটনাগুলিকে জীবন্ত করার চেষ্টা করি, স্মৃতি হাতড়াই। আমার বাল্যকালে আমাদের বাড়িতে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ ছিলো না, পরেও তা সেভাবে কেক কাটার উৎসব হয়ে ওঠেনি। আমাদের ভাইবোনদের জন্মদিনে খাওয়া-দাওয়া একটু বিশেষ রকমের হতো, সঙ্গে পায়েস বা খেজুরগুড়ের ক্ষীর। এখনো জন্মদিনটি মনে থাকে, কিন্তু তা অন্য আর যে কোনো দিনের থেকে আলাদা কিছু নয়।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন শুধু পেছন ফিরে দেখে বিস্মিত হওয়া - এতোগুলো বছর হয়ে গেলো, এবং আমি এখনো জীবিত! কীভাবে সম্ভব হলো? মৃত্যু অতি নিকটবর্তী হয়েছিলো একবার, তারিখটি নভেম্বরের আঠারো। সাল ঊনিশশো একাত্তর। আমার বয়সের হিসেব হয়তো সেই দিনটি থেকেও করা চলে। জীবিত ফিরে আসার কথা ছিলো না সেদিন। অলৌকিক মনে হয়, হয়তো রক্ষা পেয়েছিলাম অন্য কারো জীবনের বিনিময়ে, আমাদের দলের আটজনকে সেদিন হারাই আমরা। কোনোকিছুর বিনিময়েই যুদ্ধদিনের সেই দিনগুলিকে ত্যাগ করতে আমি অনিচ্ছুক, এমনকী একটি নতুন জন্মও নয়। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অংশীদার হওয়া যে কী বিশাল, বিপুল গর্বের জিনিস, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তার স্বাদ কোনোদিন পাবে না, জানবে না। আমি জেনেছি। এই অহংকারের তুলনায় আর সবকিছুই আমার কাছে অপ্রধান ও স্বল্পতর গুরুত্বের।

আবুল হাসান আমার প্রিয় কবি। বাহাত্তরে নিজের প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইটি মাকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন, আমার মা, আমার মাতৃভূমির মতোই অসহায়। পঁচাত্তরের ছাব্বিশে নভেম্বর এই তরুণ কবি পৃথক পালঙ্কে শায়িত হয়েছিলেন। বছর বছর এই দিনটি আমার ঠিক মনে পড়ে যায়।

মে মাসের সাতাশে আমার জীবনে এইরকম একটি অবিস্মরণীয় দিন। চুয়াত্তরে এই দিনে মুনিয়া নামের আশ্চর্য একটি মেয়ের সঙ্গে জীবনের প্রথম প্রেমমূলক সম্পর্কের সূচনা ঘটেছিলো। সে আমার হয়েছিলো অতি অল্পকালের জন্যে। হয়তো এরকম একটি সম্পর্কের জন্যে অথবা অনতিবিলম্বে আমার জীবন বদলে যাওয়ার মতো কিছু ঘটনার জন্যে আমরা ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। মুনিয়া আমার জীবনের অভ্যন্তরে আর নেই, কিন্তু এখনো আছে সে। এই পৃথিবীতেই। তার সঙ্গে শেষবার দেখা পঁচাত্তরে, ডিসেম্বরের সাত তারিখে। যেদিন আমি দেশান্তরী হই।

এই যে মনে হলো মুনিয়া আমার হয়েছিলো অতি অল্প সময়ের জন্যে, আসলে ভালোবাসার জন কি কখনো অল্প সময়ের জন্যে আপন হতে পারে? তার সঙ্গে সারাজীবন অতিবাহিত করতে পারলে কীরকম হতো জানি না, এ জীবনে তা জানার আর উপায় নেই। বাস্তবে তা ঘটলে তারপরেও মনে হতে পারতো, হায়, জনমভর ভালোবেসেও যে মানুষের সাধ মেটে না! ভাবতে ইচ্ছে হয়, পরবাসী না হলে আমার, আমাদের জীবন কীরকম হতো!

আমার অন্তর কালা করলাম রে, দুরন্ত পরবাসে...


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।