চুপকথা ১০

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ১৬/১২/২০০৭ - ১:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১০

প্রথমে স্বপ্ন বলে বোধ হয় না, তবু হয়তো স্বপ্নই। ঘুম ছিলো না, শুধু শুধু চোখ বুজে শুয়ে থাকা। রাত প্রায় দেড়টা, কাল অফিসে পৌঁছতে হবে একটু সকাল সকাল, সাপ্তাহিক টীম মিটিং। অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করি। দিনভর কাজের শেষে ঘরে ফিরেছি সাড়ে আটটার দিকে। রান্নাবান্না কিছু করা নেই, বাইরে খেয়ে এসেছি। রান্না করতে ইচ্ছে করে না, করিও না। বেশিরভাগ বাইরে খাওয়া হয়। তা-ও একঘেয়ে হয়ে যায় একসময়। কিছু করার নেই, একা মানুষের জীবন এরকমই হওয়ার কথা।

নির্ঘুম বিছানায় ছটফট করা এক ধরনের শাস্তিই। বাল্যকালে শিখেছিলাম অন্ধকার ঘরে চোখ বুজে কল্পনায় মেষ গণনা করতে থাকলে একসময় স্নায়ু অবসন্ন হয়ে পড়বে, তখন ঘুমের আর না এসে উপায় থাকবে না। আমার মেষ গণনার কৌশল ব্যর্থ হয়। একশো, নিরানব্বই, আটানব্বই করে উল্টোদিকে গুনে শূন্য পর্যন্ত আসাও হয়ে যায় বার তিনেক। একসময় মনে হয় একটু তন্দ্রামতো হয়েছিলো, তখনই দেয়ালের লেখাটি দেখি। চোখের সামনে নেই, তবু পরিষ্কার পড়া যায়। কালো বড়ো হরফের চিকা। একাত্তরের যুদ্ধাস্ত্রগুলোকে আরেকবারের জন্যে গর্জে উঠতে বলা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনের দেওয়ালে উৎকীর্ণ ছিলো। তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে দেখা দেয়ালের লিখনটি তিরিশ বছর পরে ফিরে আসে।

তন্দ্রা ছুটে গেলে প্রথমে ভাবি বিছানায় উঠে বসি। স্বপ্নটি নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। উঠি না। পাশ ফিরে চোখ বুজি, স্বপ্ন যদি ফিরে আসে! উঠে বসার চেয়ে শুয়ে থাকা অনেক আরামের। শরীর এখন কেবল আয়েশ খোঁজে। একটা সময় ছিলো, তখন দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুমালে মনে হতো কতোটা সময়ের অপচয় হয়ে গেলো। শিশুরা যেমন জোর করে জেগে থাকতে চায় - ঘুমিয়ে পড়লেই দারুণ কিছু একটা ঘটে যাবে, দেখা হবে না! একসময় ভাবতাম, দিনে আট ঘণ্টা ঘুমালে ষাট বছরের আয়ুতে শুধু ঘুমিয়ে কাটবে বিশটি বছর। কী অপচয়! কোনো মানে হয়! আজকাল আর সেসব হিসেব মনে পড়ে না।

আমার দিন শুরু হয় কাকডাকা ভোরে। এ দেশে এসে অবধি এই ঊনত্রিশ বছরে কাক দেখিনি একটিও, শুধু দেশে ফোন করলে কখনো ব্যাকগ্রাউন্ডে কাকের ডাক শোনা হয়। তবু আমার ভোর এখনো কাকডাকা ভোর। বিছানা ছেড়ে এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে ঘুম তাড়ানো। হাতমুখ ধুয়ে বাইরে হাঁটতে যাওয়া, আধঘণ্টা হাঁটা। এইসময়ে প্রতিদিন নির্ভুলভাবে বাবাকে ভাবি, জীবনে আরো অনেককিছুর মতো প্রাতঃভ্রমণের এই অভ্যাসটি আমার মধ্যে তিনি কীভাবে যেন সঞ্চারিত করে দিয়ে গেছেন। অথচ তাঁর জীবনকালে আমি কখনো ভোরে হাঁটতে যাইনি। ফিরে এসে গোসল সেরে অফিসের জন্যে তৈরি হওয়া। অফিসের সময় এমনিতে আটটা-পাঁচটা হলেও কাজের ধরণটি এমন যে কখনো তা ঘড়ি ধরে চলে না। প্রায় প্রতিদিনই গড়ে বাড়তি ঘণ্টা দুয়েক থাকতে হয়, তেমন হলে আরো বেশি, এমনকি রাতভর। ফলে, কিছু দেরি করে অফিসে যাওয়ার স্বাধীনতাটি নেওয়া চলে। আমি সচরাচর ন’টার দিকে পৌঁছাই। কায়িক পরিশ্রম কিছু নেই, তবু একটানা বসে দীর্ঘ সময় কাজ করলে তারও ক্লান্তি আছে।

জানা ছিলো, বয়স হলে ঘুম কমে যায়। কিন্তু ঠিক কতো বছরে সেই বয়সে পৌঁছানো যায়? পঞ্চাশ? পঞ্চান্ন? ষাট? বেশিদিন আগের কথা নয়, কারো বয়স বেয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ শুনলে মনে হতো, লোকটা তো বুড়ো! তখনো মনে আসেনি আমি ওই বয়সে গেলে অন্য কেউ আমাকে বুড়ো ভাববে। জিনিস একই, শুধু জায়গা বদলে গেছে। একসময়ের দর্শক পঞ্চাশে পড়ে এখন নিজেই দ্রষ্টব্য। আজকাল ঘুমিয়ে মন ভরে না, জেগে উঠলে চোখের পাতা ভারী, সারা শরীরে আলস্য লেগে থাকে আঠার মতো। তবু ঘুম কি আর আসে! এখনও চোখ বুজে শুয়ে থাকাই সার হয়, ঘুম আর ফিরে আসে না, স্বপ্নও না।

পরশু আসিফের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিলো। নিজের সংসারী হওয়া হয়নি, কিন্তু বন্ধুবান্ধবের বাচ্চারা কীভাবে যেন খুব দ্রুত আমাকে তাদের দলের একজন বলে গণ্য করে নেয়। ঠাট্টা করে বাচ্চাদের বাবা-মাকে বলি, ওরা ভালো মানুষ ঠিকই চেনে!

আসিফের ছেলেটি নিজে ফোন করেছিলো, কাকু আমার জন্মদিন।

চিনতে ভুল হয়নি, তবু ওর নামটি আমার ভারি পছন্দের। বিশেষ করে ওর নিজের মুখে খুব মিষ্টি শোনায়। পুট পুট করে সুন্দর উচ্চারণে বাংলা বলে। অথচ জানা কথা, স্কুলে যেতে শুরু করলে এই ছেলে বাংলা বলা একেবারে বন্ধ করে দেবে। বয়ঃসন্ধির আগেই না-বলায় এমন অভ্যস্ত হয়ে যাবে যে কেউ বাংলায় কথা বলতে গেলে হ্যাঁ হুঁ না এইসব বলে পালাতে চেষ্টা করবে। বড়োজোর মার্কিনি সুরে কিছু বাংলা বুলি উগরে দেবে। এ দেশে সব বাঙালির ঘরেই অনেক বছর ধরে দেখছি এরকম।

জিজ্ঞেস করি, আমিটা কে?

আমি আসমান, তুমি চিনতে পারোনি কাকু?

আসিফ আর তার বউ রুম্মানের নাম মিলিয়ে ছেলের নাম আসমান। বলি, আমি বাবা জমিনের মানুষ, আসমানের খবর কী করে পাই? তা তোর জন্মদিনটা কবে রে বাপ?

কাল। তুমি না এলে কিন্তু আমি কেক কাটবো না। মনে থাকে যেন।

তা থাকবে। তুই কতো বছরের বুড়ো হবি এবার?

চার। আমি কিন্তু বুড়ো না, বুড়ো তুমি।

আমি বুড়ো হলে তোর বন্ধু হলাম কী করে?

তোমার মাথায় কতো পাকা চুল।

চুল পাকলে কি বুড়ো হয় রে, বোকা বুড়ো...

ফোন রেখে মনে মনে ভাবি, বুড়োটা তাহলে হয় কীভাবে? এক দেশে এক লোক ছিলো। লোকটি কম বয়সে তার দেশের স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করেছিলো। অনেক দুঃখকষ্টের ভেতর দিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। তার দেশের দখল নিয়ে বসা শত্রুরা পরাজিত হয়ে ফিরে গেলো। তার দেশের কিছু মানুষ সেই বিদেশীদের পক্ষ নিয়ে ধর্মের নামে অনেক অপকর্ম করেছিলো, দেশ স্বাধীন হলে তারা লুকিয়ে পড়লো। লোকটা, সেই সময়ের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, আরো অনেকের মতো স্বপ্ন দেখেছিলো অতি উজ্জ্বল একটি ভবিষ্যতের। সত্যি হয়নি তার কিছুই। তার স্বপ্নের রং ক্রমে ফ্যাকাশে হতে থাকে, আসে অনিশ্চয়তা, নিষ্ফল ক্রোধ ও হতাশা। লুকিয়ে থাকা পরাজিত মানুষগুলি ধীরে ধীরে মুখ বাড়ায়, সুযোগমতো বেরিয়ে আসতে থাকে, সামাজিক প্রতিষ্ঠাও পেয়ে যায়। লোকটা বুড়ো হয়ে যায়, যখন সে আর প্রকাশ্যে বলার সামর্থ্য ধরে না যে সে স্বাধীনতাযুদ্ধের এক যোদ্ধা ছিলো, একসময়ে জয়ী হয়েও আজ পরাজিতের মতো নতমুখ হয়ে থাকতে হয় তাকে। পরাজিতরা আস্ফালনের অধিকার ও ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে আর যোদ্ধাকে পলাতক পরবাসী হয়ে যেতে হয়।

যুদ্ধের দিনে আমাদের দলনেতা ছিলেন কবির ভাই, তার বউ শাহানা এখন কবির ভাইকে ডাকে বুড়া মুক্তিযোদ্ধা বলে। একদিন শাহানা ফোনে আমাকে বলে, কীসের মুক্তিযোদ্ধা রে তোরা? জয় বাংলা কইয়া যুদ্ধ করলি, দেশ স্বাধীন হইলে পাছা উবুত কইরা ঘুমাইয়া থাকলি আর সব রাজাকারগুলান পাকিস্তান জিন্দাবাদ কইয়া তগো ... মাইরা দিয়া গেলো গা ...!

আসমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে লোকজন ভালোই হয়েছিলো। আমেরিকানরা বাচ্চাদের জন্মদিনে তাদের কিছু বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে পিৎজা প্ল্যানেট বা ওই জাতীয় কোথাও নিয়ে যায় কয়েক ঘণ্টার জন্যে। সেখানে বাচ্চাদের খেলাধুলার দেদার আয়োজন, খেলা হয়ে গেলে ভরপেট পিৎজা ও কেক খেয়ে বাড়ি যাও। বাবা-মায়েরা সেখানে আমন্ত্রিত হয় না। ছোটো ছেলেমেয়েদের জন্যে আয়োজন এইরকমই হওয়া উচিত, ওদের আনন্দ-ফুর্তি হলেই হলো। কিন্তু বাঙালি বাবা-মা নিজেরা নিমন্ত্রিত না হলে এবং পাতে পোলাও-বিরিয়ানি-মাংস না পেলে অসন্তুষ্ট হয়, অতৃপ্ত থাকে। হোক তা বাচ্চাদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান! একবার বারো বছর বয়সী এক মেয়ের জন্মদিনে গিয়ে দেখি, মেয়েটির একটিমাত্র বান্ধবী উপস্থিত, কয়েকটি শিশু বাদ দিলে বাকি পঁচিশ-তিরিশজন মানুষের সবাই বয়স্ক, মেয়েটির বাবা-মায়ের বন্ধুবান্ধব।

আসিফের লিভিং রুমে সোফায় অনেক লোকজন গাদাগাদি করে বসেছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে কিছু বাড়তি চেয়ার বসানো হয়েছে, তারই একটিতে বসে পড়ি। উপস্থিতদের কয়েকজনকে চিনি, অধিকাংশ অপরিচিত। আমি মানুষ হিসেবে তেমন মিশুক নই, এতো বছরেও এই শহরে বেশি মানুষকে চেনা হয়নি। বাবুলের সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা, মাথায় চুল কমেছে, ওজন বাড়তির দিকে। জানালো গ্যাস স্টেশনের ব্যবসা তার, দুটি ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। পরিচিতদের সঙ্গে কিছু মামুলি কুশল বিনিময় করি। পর্বটি সংক্ষিপ্ত হয়, কেননা তখন রাজনীতির কথা হচ্ছে, যা নির্ভুলভাবে উত্তাপ অর্জন করে থাকে। আশ্চর্যের বিষয়, এইসব আলোচনা কেউ নিচুকণ্ঠে বা স্বাভাবিক কথা বলার ঢঙে করে না। হয়তো পারা যায় না। এমনকি, সিএনএন-এর রাজনীতি বিষয়ে বিতর্কের অনুষ্ঠান ক্রসফায়ার, সেখানেও দেখি সিনেটররা গলা চড়ায় - চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে, চিৎকার করে গলার রগ ফুলিয়ে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডানোর চেষ্টা করে।

তর্কটি এখনো চিৎকারের পর্যায়ে যায়নি, তবে তার সমস্ত লক্ষণ ও উপাত্ত মজুত আছে দেখতে পাই। তিন-চারজনে মিলে যথারীতি দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। আর সবাই শ্রোতা। আলোচনাটি মনে হয় আগেই শুরু হয়েছিলো, অবধারিতভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব ও তর্ক। শেখ মুজিব না জিয়া বড়ো, হাসিনা-খালেদার মধ্যে কে শ্রেয়তর - এইসব গড়িয়ে কেমন করে প্রসঙ্গ চলে যায় বাংলা ভাই-এ, তারপরে র‌্যাব-রক্ষীবাহিনীর তুলনামূলক বিচার। কখন আবার প্রসঙ্গ পাল্টে গেছে খেয়াল করিনি, আসলে শোনার ইচ্ছেও ছিলো না। যার যার পছন্দ ও মত প্রতিষ্ঠা করার জন্যে অকারণ হৈ চৈ।

দেশে এখন কীরকম জানি না, খুব আলাদা হওয়ার কথা নয়, তবে পরবাসী বাঙালিদের মধ্যে অন্যের রাজনৈতিক বিশ্বাস বা আনুগত্য বিচারের পদ্ধতিটি খুব অদ্ভুত। বেশ কয়েক বছর আগের কথা, তখনো ইন্টারনেটে বাংলা দৈনিকের আবির্ভাব ঘটেনি। একদিন বাঙালি মালিকানার একটি দোকানে নিউ ইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিকের খোঁজে গেছি। একটিমাত্র পত্রিকার কয়েকটি কপি পড়ে আছে, অন্যগুলো, বিশেষ করে আমি যেটি নিয়মিত কিনে থাকি, নেই। দোকানে বসা ভদ্রলোকটি অপরিচিত। জিজ্ঞেস করি, আর কাগজগুলা কি আসে নাই?

ভদ্রলোক জানালেন যে, সব বিক্রি হয়ে গেছে এবং যে পত্রিকার কপি অবশিষ্ট আছে সেটির কথা উল্লেখ করে জানালেন, এইটা নিয়া যান, সবচে বেশি চলে।

আমি বলি, এই পত্রিকা আমার বিশেষ পছন্দের না।

ভদ্রলোকের মুহূর্তমাত্র লাগে সিদ্ধান্তে আসতে। জিজ্ঞেস করেন, আপনে কি আওয়ামী লীগ করেন?

সেই দোকানে আর কোনোদিন যাওয়ার উৎসাহ আমার হয়নি।

এখন হঠাৎ একজনকে বলতে শুনলাম, তাহলে আমরা বলতেছি না ক্যান হানাদার বাহিনী বলতে আমরা কাকে বুঝি? তাদের নামনিশানা পরিচয়টা কি?

প্রতিপক্ষ অতি উচ্চকণ্ঠ এবং যাবতীয় জ্ঞানের আধার, এমন ধারণা দিতে উদগ্রীব। তিনি বলেন, না বললে বোঝা যায় না? আর কবে কী ঘটছে, সেইসব নিয়া এখন আর টানাটানির দরকার কী?

তাহলে ইতিহাসের দরকার নাই বলতেছেন?

তা বলি নাই, ইতিহাসের জায়গায় ইতিহাস। কিন্তু রেষারেষি হানাহানি হইতে পারে, সেইসব কথা না তুললেই হয়।

প্রথমজন যুক্তি দেন, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের ক্রিমিনালদের তাহলে এখনো খোঁজ করে ক্যান? তাতে হানাহানির কথা কেউ বলে না। কিন্তু গোলাম আযমের নামে, রাজাকারদের নিয়া কিছু বললে আপনাদের জান পোড়ায়।

তারাও তো আমাদের দেশের মানুষ। আমাদেরই ভাই-বেরাদর।

তা আপনার পেয়ারের ভাই-বেরাদরগুলি যুদ্ধের সময় কই ছিলো? কী করছিলো? দেশ স্বাধীনের পরে পলায়া ছিলো ক্যান? তারা যাদের মারছিলো তারা কোন দেশের মানুষ ছিলো, বলেন তো?

সবজান্তা অন্য কথা বলেন এবার, আরে রাখেন মিয়া, ইন্ডিয়ান আর্মি স্বাধীন কইরা দিছিলো বইলা...

এতোক্ষণ অমনোযোগে একটি পুরনো ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে যাচ্ছিলাম। কথাবার্তার কিছু কানে আসছিলো, কিছু শুনিনি। এই ধরনের আলাপ কানে তোলার দরকার মনে হয় না বলে সচরাচর চুপচাপ থাকি। নেহাত অসহ্য লাগলে উঠে বাইরে যাই, সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকি। শেষের কথাটি মাথায় ধাক্কা দিয়ে আমাকে সচকিত করে দেয়। ইন্ডিয়ান আর্মি বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিয়েছিলো!

অজান্তে বলে বসি, চুপ করেন তো ভাই। এইসব বাজে কথা কই পাইলেন? জানেন আপনে কী বলতেছেন?

ভদ্রলোককে চিনি না, আগে কোথাও দেখেছি বলেও মনে করতে পারি না। অচেনা কাউকে এ ধরনের কথা বলে আমি নিজেকেই অবাক করে দিয়েছি।

ভদ্রলোক গলা আরেক পর্দা তুলে বলেন, জানি বইলাই তো বলতেছি। বাংলাদেশের কেউ যুদ্ধ করে নাই, বাংলাদেশ স্বাধীন কইরা দিয়া গ্যাছে ইন্ডিয়ান আর্মি। তারা হাতে ধইরা স্বাধীন না করলে আজও আমরা পাকিস্তানীই থাকতাম। ইস্ট পাকিস্তানের কেউ বাংলাদেশ চায় নাই।

আপনি কিছুই জানেন না। জানলেও বোঝেন নাই কী বলতেছেন। ইন্ডিয়া আমদের হেল্প করছিলো, সেইটা তো অস্বীকার করার কিছু নাই। কিন্তু তারা আমাদের স্বাধীনতা হাতে তুইলা দিয়া গেছে, এইটা মনে করার কোনো কারণ নাই।

তাহলে ইন্ডিয়ান আর্মি আসছিলো কী করতে?

মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টায় আস্তে আস্তে বলি, আপনার হয়তো জানা নাই, পাকিস্তানীরা মুক্তিবাহিনীর মারের চোটে দিশা না পাইয়া ইন্ডিয়ারে অ্যাটাক করছিলো। আপনার কি জানা আছে, ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের যুদ্ধ লাগার আগে বাংলাদেশের অনেক জায়গা থিক্যা পাইক্কারা পলায়া গেছিলো? মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাইছি, এই কথা তো তারা তাবৎ দুনিয়ার কাছে বলতে পারে না, ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে আমেরিকা-চীনের কাছে নালিশ করা যায়। তাই করছিলো তারা। তা ইন্ডিয়া কি তখন বইসা আঙুল চুষবো, না উল্টা মার দিবো?

মুক্তিবাহিনী বইলা কিছু কি আসলে ছিলো নাকি?

বলে কী! মাথায় রক্ত উঠে যায়। জিজ্ঞেস করি, কিছু মনে করবেন না, আপনার বয়স কতো? মানে যুদ্ধের সময় আপনার বয়স কতো ছিলো?

এবার ভদ্রলোকের গলা আরো চড়ে যায়। বলে, আমার বয়স দিয়া আপনি কী করবেন? ছয় বচ্ছর বয়স ছিলো তখন আমার।

আমি আসলে বুঝতে চাইতেছিলাম, যুদ্ধের সময় আপনের বোঝার বয়স হইছিলো কিনা, কিছু বুঝছিলেন কিনা। খালি শোনা কথা নিয়া চিল্লাইতেছেন। কথা শুনলে মনে হয় বোঝার বয়স আপনার এখনো হয় নাই। তা তখন না দেখলে না বুঝলে বইপত্র পড়লেও কিছু জানতে পারতেন।

মনে করেন আপনি একলাই পড়ছেন। আমিও কিছু পড়ালেখা কইরাই কথা বলতেছি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপরে একখান বইয়ের নাম বলতে পারবেন যেইটা আপনি পড়ছেন?

পড়ছি, নাম মনে নাই।

পেশাদার উকিলের ভঙ্গিতে বলি, তার মানে পড়েন নাই। পড়লে মনে থাকবে না ক্যান? মুখে মুখে শোনা মিছা কথাগুলি তো মনে রাখছেন ঠিকই।

তা ভাইজান, আপনি এতো কথা বলতেছেন, আপনে যুদ্ধ করছিলেন?

যদি বলি করছি?

তখন আপনার বয়স কতো আছিলো?

সতেরো।

হাসাইলেন, সতেরো বচ্ছরের পোলা পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করছে?

আমার তো তাও সতেরো। বগুড়ায় আমার বন্ধুর ছোটো ভাই টিটু ক্লাস নাইনে পড়তো, পনেরোর বেশি বয়স হওয়ার কথা না। মার্চ মাসের শেষে যখন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থিক্যা পাকিস্তানীরা বগুড়ার দিকে আসে, এই টিটু কয়েকজন বন্ধুরে নিয়া এক দোতলা দালানের ছাদে গাদা বন্দুক হাতে যুদ্ধ কইরা মারা পড়ে। আরো শুনতে চান? ঢাকা শহরের আরেকজন, তার নামও টিটো, বয়স চোদ্দো বছর, সাভারে যুদ্ধ করতে গিয়া মারা গেছিলো দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়দিন আগে। তার কবর এখনো ইচ্ছা করলে দেখতে পারবেন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে, সেইখানে তার বয়সও লেখা আছে।

আপনি যা বলতেছেন, তা সত্যি না-ও হইতে পারে।

সবজান্তার কথা কানে তুলি না। বলি, ফ্রেডি অ্যাডুর নাম হয়তো শোনেন নাই। সকার খেলে, বয়স চোদ্দো বছর। আফ্রিকায় জন্ম। তারে বলা হইতেছে আমেরিকান সকারে সেরা প্লেয়ারগুলির একজন। এইটারে আপনি কী বলবেন? আসলে বয়স দিয়া সব বিচার হয় না। আপনি দেখেন নাই, দশ-বারো বছরের পোলাপানও যুদ্ধ করছে। আমার দেখা আছে। আপনি দেখেন নাই, শোনেন নাই, শুনলেও কিছু বোঝেন নাই। আপনি বোঝনে নাই, তার মানে যে সব মিছা কথা তা কিন্তু না।

আপনি ক্যামনে জানেন?

আমি সেইখানে ছিলাম। আমি নিজের চোখে দিনগুলি দেখছি, আপনি দেখেন নাই। বুকের মধ্যে গুলি খাওয়া মানুষরে চিল্লায়া জয় বাংলা বলতে শুনছি, আপনি শোনেন নাই। যুদ্ধের ময়দানে পাশাপাশি ছিলাম, গোলাগুলি থামলে দেখি পাশের জন আর নাই। একদিকে লড়াই জেতার খুশি, পাশে রক্তমাখা বুক নিয়া আমার বন্ধু শোয়া, তার মাথার খুলি নাই, নড়ে না চড়ে না, কথাও কয় না। তাকায়া দেখি আর ডুকরায়া কানতে ইচ্ছা হয়, কানতে পারি না। মনে হয়, ওইটা আমিও হইতে পারতাম। আপনার জীবনে এইরকম কিছু জানা আছে? থাকলে এইসব নিয়া কথা বলবেন। যদি আন্দাজও করতে পারেন, তাহলে বলবেন। না হইলে চুপ যান, না জাইনা কিছু বলবেন না। ওই মরা মানুষগুলিরে অপমান না হয় না-ই করলেন।

ভদ্রলোক পুরনো প্রসঙ্গে যান, আপনে বলতে চান, ইন্ডিয়া আর্মি না পাঠাইলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হইতো?

আমি যদি বলি হইতো, আপনি বলবেন হইতো না। তার ফয়সালাটা হয় কীভাবে? খালি ইন্ডিয়ার কথা বললেন, সেই সময় রাশিয়া আমাদের পাশে দাঁড়ায় নাই? এইসব কথায় ফায়দা কি? বরং আপনি চাইলে কিছু বইপত্র আমি আপনারে দিতে পারি, পড়লে কিছু ইতিহাস জানতে পারবেন।

আপনাদের মতন মানুষগুলি যতোসব প্যাঁচ লাগায়। আপনারা কই পাইলেন একাত্তর সালে তিরিশ লক্ষ লোক মারা গেছিলো, দুই লক্ষ মাইয়ার ইজ্জত গেছে? গুনতিটা করলো কে?

ভদ্রলোকের পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করার স্বভাব মনে হয়। এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে যান লাফিয়ে লাফিয়ে। আমি ধীর গলায় জবাব দিই, একটা সত্যিকারের ঘটনা শুনাই আপনারে। আটানব্বই সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে, ছাব্বিশে মার্চ যে স্বাধীনতা দিবস সেইটা জানেন তো নাকি তা-ও মনে করায়া দিতে হবে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে খবরের কাগজে যুদ্ধের সময় তিরিশ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া আর দুই লাখ নারীর লাঞ্ছিত হওয়ার কথা বইলা লেখালেখি হইলে পাকিস্তানীদের তা পছন্দ হয় নাই। তারা ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাই কমিশনাররে ডাইকা নিয়া বলে, এইসব প্রোপাগান্ডা বন্ধ করেন, কারণ এগুলি ঐতিহাসিকভাবে অসত্য এবং সংখ্যাগুলি অনেক বাড়ায়া বলা হইতেছে। আপনে যেমন একটু আগে বললেন। তখন বাংলাদেশের হাই কমিশনার কিউ এ এম এ রহিম খুব বিনয়ের সাথে পাকিস্তানীগুলিরে বললেন, সঠিক সংখ্যাটা তাহলে আপনারাই জানায়া দিলে ভালো হয়!

তাতে কী হইলো?

জানতাম, ভদ্রলোকের মাথায় হয় জিনিসটা ঢুকবে না, অথবা না বোঝার জন্যে তিনি তৈরি হয়েই আছেন। ব্যাখ্যা করে বলি, পাকিস্তানীরা তো আজ পর্যন্ত স্বীকারই যায় নাই যে তারা একাত্তর সালে নিরীহ বাঙালিদের কচুকাটা করছিলো, মহিলাদের ইজ্জতহানি করছিলো। রহিম সাহেব যখন তাদের বললেন যে সঠিক সংখ্যাটা আপনারাই দিয়া দ্যান, পাকিস্তানীরা কী বিপদে পড়লো বুঝছেন? যদি বলে তারা দুইজন মানুষও মারছে, তাহলেও তো দোষ স্বীকার করা হয়। সেইটা তারা জীবনেও স্বীকার করতে চায় নাই, করে নাই, সে আশাও নাই। রহিম সাহেব খুব সুন্দরভাবে জুতাটা মারছিলেন। তিনি আরো বলছিলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্যে ত্যাগ স্বীকার করছিলো যে মানুষগুলি তাদের সম্মান জানাইলে যদি পাকিস্তানের মন খারাপ লাগে, সম্পর্ক খারাপ হয়, তাতে বাংলাদেশের তো কিছু করার নাই। জানেন, অবাক লাগে ওই পাইক্কাদের মুখের কথা আপনার মুখে আইসা পড়লো ক্যামনে। আরো শুনতে চান? সেই সময় জামাতী-রাজাকারগুলি ক্ষমতায় ছিলো না। তখনকার সরকার ঢাকায় পাকিস্তানী হাই কমিশনার মিসেস রিফাত ইকবালরে ফরেন মিনিস্ট্রি অফিসে ডাইকা পরিষ্কার জানায়া দিছিলো, দ্যাখেন, পাকিস্তান যদি একাত্তরের ঘটনার জন্যে মাফ চায়, আমরা মাফ কইরা দিতে পারি, তাদের দোষগুলি ভুইলা যাইতেও রাজি, কিন্তু স্বাধীনতার জন্যে যে মানুষগুলি জান দিলো ইজ্জত দিলো সেই মানুষগুলিরে ভুলি ক্যামনে?

ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না। এইসব নিয়ে তর্ক করার কোনো মানে নেই। সচরাচর করি না। আজ যে কেন করতে গেলাম! সিগারেট খাওয়ার অজুহাতে উঠে পড়ি। বাইরে কেউ নেই, কেউ লক্ষ্য করছে না দেখে গাড়িতে উঠে পড়ি। নিজের ঘরে ফিরি।

আমি না থাকলে আসমান কেক কাটবে না বলেছিলো, তার সঙ্গে দেখাও হলো না। কাল সকালে পুষিয়ে দিতে হবে। ঘরে ফেরার পথে মনে পড়েছিলো শ্লোগানটি, একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার!


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।