লেক কনস্ট্যান্সের পথে-২

বন্দনা এর ছবি
লিখেছেন বন্দনা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ৩০/০৭/২০১২ - ৬:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এখানে ও মেঘলা আকাশ, সূর্যহীনা বিবর্ণ শহর কেমন বিশ্রী আর ফ্যাকাসে লাগে বড্ডো। ম্যাকে ঢুকে নাস্তা সেরে চটজলদি বের হয়ে জেটির দিকে হাঁটতে লাগলাম, বোটের খোঁজ নিতে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের একটা ট্যুর আছে কিছুক্ষণ বাদেই, ওটা সেরে শহরটা ঘুরে দেখা যাবে। ছোট্ট শহর তেমন কিছুই নেই, পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়তো ঘন্টাখানেক লাগবে।
P1030268

DSC02274

DSC02282

টিকেট কিনে বোটের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। টিপটিপ বৃষ্টি ও থেমেছে কিছুক্ষণ হয়। আকাশের ভার মুখ, ততোধিক ভার আমার নিজের মুখ। ছবিগুলা এমন পচা আসছে, অথচ এখানে আর হয়তো কখন ও আসা হবেনা আমার। সূর্যি-মামার এই যারপরনাই শত্রুতায় মেজাজ গরম হয় আমার। খানিক বাদেই বোট এসে ভিড়ল জেটিতে। আর ও অনেকের সাথে আমরা ও বোটের সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। জায়ান্ট মত দেখতে জার্মান এক লোক সবাইকে সাহায্য করছে বোটে উঠতে। আমার পালা আসতেই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো আমার হাত, বাতাসের মত পল্কা আমাকে প্রায় টেনে বোটে উঠিয়ে দিল। বসতেই পাশের রোতে দেখি এক দুষ্টু বুড়ি আমার দিকে চেয়ে আছে মিষ্টি হেসে। মিষ্টি একটা হাসি ফেরত দিয়ে বুড়ীকে হাত নাড়ি আমি। বুড়ী ততক্ষণে আমার সাথে লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে একবার মায়ের আড়ালে যায়, আবার ফিরে চায়। আমি ভেংচি কেটে তাকাই বুড়ির দিকে, বুড়ি তাতে আর ও মজা পেয়ে খিটখিট করে হেসে উঠে। ওর মা ফিরে তাকাতেই ভেংচিকাটারত অবস্থায় ধরা পরে যাই, অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে কোনরকম সামাল দিয়ে সটকে পড়ি তখনকার-মত। বাইরে ডেকে গিয়ে ঠেলেঠুলে অন্যদের মাঝে জায়গা করে রেলিং এর কাছে দাঁড়িয়ে যাই। ছোট্ট বোট , তবে বসার জায়গা ছাড়া ও বাইরের ডেকটা বেশ বড়, সুন্দর সাদা রঙের ছিমছাম বোটটা আমাদের নিয়ে তীর ছেড়ে ধীরে ধীরে চলা শুরু করলো। শহরের গির্জাটার ভিউ বোট থেকে বেশ ভাল লাগছিল, ছবি তুলে ফেললাম। বোট আর ও একটু দূরে যেতেই সামনে কিসের যেন একটা মূর্তি মত পরলো।
DSC02284

DSC02306

DSC02311

বৃষ্টি না থাকলে ও আকাশের যথারীতি মন খারাপ, ছবিগুলা তাই সুবিধের আসছিলনা খুব একটা। তবু ও বোট থেকে চারিপাশের ছবি তুলে নিচ্ছিলাম যতখানি পারা যায়। বোটে জার্মান ভাষায় আশেপাশের কি কি আছে সব বর্ণনা করে যাচ্ছে সমানে, যদি ও আমরা দুজনে তার একবর্ণ ও বুঝছিলাম্না। আমাদের বেহাল দশা দেখে, এক সুইস মহিলা এগিয়ে আসলেন আমাদেরকে উদ্ধার করতে। ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে দিচ্ছিলেন মাইকে যা বলছে। লেকের উপর অনেকগুলা পালতোলা নৌকা দেখা যাচ্ছিল। কথায় কথায় জানতে চাইলাম এত নৌকা একসাথে কেন? উত্তরে বললেন এই সময়ে সেইলিং কম্পিটিশন হয় লেকে, আশেপাশের অনেকেই নিজস্ব নৌকা নিয়ে চলে আসে লেকে। অদ্ভুত ব্যাপার হল সবগুলা নৌকার পালই সাদা। একটু পরেই উনি হাত উঁচিয়ে দেখালেন আল্পসের চূড়া। হাল্কা ধোয়া-ধোয়া সাদাটে একটা পর্দার আড়ালে আল্পস ঢাকা পড়ে গেছে, সেই ছবি তোলা সম্ভব হোলনা। গতবছর আল্পসের যেই সৌন্দর্য দেখেছি, এইবার তার ছিটেফোঁটা ও দেখা গেলনা ঘোড়ার ডিমের মেঘলা আকাশের জন্য। সুইস আন্টী কথায় কথায় আমাদের আর ও জানালেন তিনি সুইস, জার্মান, ইংরেজি তিনটা ভাষাই জানেন। আমরা কোথা থেকে এসছি সেটা ও জেনে নিলেন মিশুক মানুষটা। যেচে পড়ে আমাদের দুজনের একটা ছবি ও তুলে দিলেন। সুইস আন্টির বর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, একমনে চারদিক দেখে যাচ্ছেন কোন কথা খরচ না করেই।

P1030214

P1030227

P1030229

P1030232
১০

আন্টি খানিক পরেই বললেন, বোটের একদিকে নাকি সুইজারল্যান্ড, অন্যদিকে অস্ট্রিয়া, আর একদিকে জার্মানি। আমি উনার কথা শুনতে শুনতে আর ও গাদা-খানিক পচু পচু ছবি তুলতে থাকি, যদি ও পরে ঠিক আলাদা করতে পারিনি কোনটা কোন দেশের সীমান্তের ছবি। এক-ফাঁকে উনার একটা ছবি ও নিয়ে নিলাম বলেকয়ে। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক, চোখে কালো রোদচশমাপরা আন্টিকে ছবিতে বেশ মিষ্টি লাগছিল। পঁয়তাল্লিশ মিনিট শেষ হয়ে আসতেই বোট ও ফিরে এসে তীরে ভিড়ল। আন্টি বললেন, চাইলে আমরা বোটে থাকতে পারি, যেহেতু মেঘলা আকাশের জন্য আমাদেরকে কিছু দেখাতে পারেনি ওরা,পরের ট্যুরটায় আমরা বিনে-পয়সায় যেতে পারবো। কিন্তু আকাশের মুডের কোন ঠিক নেই বুঝে আমরা শহর ঘুরতে যাবো বলেই ঠিক করলাম। আসার আগে আন্টি আমাকে ছোট্ট একটা হাগ দিয়ে দিল, গালে ছোট্ট একটু চুমো। অবাক হয়ে গেলাম এত অল্প সময়ের পরিচয়ে একটা মানুষকে এত আপন করে নিতে পারে কেমন করে এরা। কেমন যেন অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে গেল মনটা, উনার গায়ের পারফিউমের মিষ্টি একটা গন্ধের আবেশ নিয়ে হাত নেড়ে মাটিতে নেমে এলাম।
P1030238
১১
P1030247
১২


মন্তব্য

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

নীল সমুদ্র সাদা ফেনা/ যতই করুক ধার-দেনা/সমুদ্রকে যাইনা চেন।----- উত্তম জাঝা!

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

বন্দনা এর ছবি

ধন্যবাদ রনি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

শাব্দিক এর ছবি

মেঘলা দিনে বেড়াতে আমার দারুন লাগে। ১ আর ৩ নম্বর ছবিদুটো ভাল লাগল ভীষণ।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

বন্দনা এর ছবি

মেঘলা দিন আমার ও ভালো লাগে, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর ছবি আসলে তখন এমন মন খারাপ লাগেরে ভাই সেটা আর না বলি। নেটে খুঁজে দেইখেন লেকটার অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি আছে, আর আমি কি জিনিস তুলে আনছি দেখতেই তো পারছেন।

অমি_বন্যা এর ছবি

ছবি আর বর্ণনা দুটোই দারুন, বন্দনা। চলুক

বন্দনা এর ছবি

ধন্যবাদ অমি ভাই।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

লেকের তিন পাড়ে তিন দেশ?
এইটার একটা নাম দেওয়া দরকার... বারমুদা ট্রায়াঙ্গল টাইপ ভয়ঙ্কর নাম...
তারপর এইটা নিয়ে একটা রহস্য গল্প হাসি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বন্দনা এর ছবি

আপনি একটা নাম দিয়ে দেন নজু ভাই।

নিরবতা এর ছবি

দারুন লাগলো। চলুক

বন্দনা এর ছবি

ধন্যবাদ নিরবতা।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

চলুক

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

বন্দনা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

এক নাম্বার ছবিটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো।
পুরো জার্নিতেই তো দেখি বৃষ্টি আর মেঘলা আকাশ আপনাকে খুব জ্বালাইসে।

কোথাও গেলে আমি সেখানকার ছবি তোলার চেয়ে দু'চোখ ভরে দেখতেই বেশি ভালোবাসি।
অবশ্য ফটগফুরদের কথা ভিন্ন। দেঁতো হাসি

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

বন্দনা এর ছবি

আমি সময় পেলেই পুরানো ছবি খুলে দেখতে বসি, খুব ভালো লাগে আপু। কিন্তু এমন ছবি তুলে আনলে আসলেই মন খারাপ হয়।মেঘলা দিন আমার ও ভালো লাগে, কিন্তু ছবির পুরাই তেরটা বাজায়ে দিসে মন খারাপ

তারেক অণু এর ছবি

(গুড়)
শেষটা ভালো লাগল। চলুক ঘোরাঘুরি

বন্দনা এর ছবি

আমার ও অনেক ভালো লাগছে। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ক্রেসিডা এর ছবি

বেড়ানোর দিনে হঠাৎ মেঘ ..

সুন্দর পোস্ট। ছবিগুলোও ভালো লাগলো। চলুক

__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;

বন্দনা এর ছবি

ধন্যবাদ ক্রেসিডা, ছবিগুলা আসলে অনেক সুন্দর হত যদিনা আকাশ মেঘলা থাক্তো। নেটে খুঁজে দেখতে পারেন লেক্টা আসলেই মেলা সুন্দর।

কড়িকাঠুরে এর ছবি

হুম-
পানি যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্রের আকার ধারণ করে, আর
যে পরিবেশে থাকে সেই পরিবেশের স্বভাব অনুসরণ করে...

ব্যাপার না- রিঘুরাঘুতে গরুর গাড়ি চাক্কা...

বন্দনা এর ছবি

ধন্যবাদ কাঠুরে ভাই। শেষের লাইন্টা ঠিক বুঝলাম না।

কড়িকাঠুরে এর ছবি

গরুর গাড়িতে হাওয়া-তেল লাগে না । সিরাম এক গাড়ি । দাদা বানিয়ে রেখে গেছে তো নাতি এখনো চালাচ্ছে । এবং রাজকীয় হালেই চলার কথা । শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় চলছে তো চলছেই । কোন থামথামি নাই । এই আর কি... চলুক... হাসি

আর রিঘুরাঘুতো "ঘুরাঘুরি"...

পথিক পরাণ এর ছবি

এক নম্বর ছবিটা জব্বর হৈসে আপু।

বন্দনা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- নেন পথিক ভাই।

উতপাখির হৃদয় এর ছবি

সেইলিং বোটের ছবি গুলো বেশ ভাল লেগেছে আপু

উতপাখির হৃদয়

কৌস্তুভ এর ছবি

আন্টিকে পছন্দ হইছে! খাইছে

বন্দনা এর ছবি

আমার ও মেলা পছন্দ হয়েছে। খাইছে

ইয়াসির এর ছবি

মেঘলা ছবিগুলোকে বিবর্ণ বলছেন কেন? ভাল ছবি হতে হলে রোদে ঝকঝক করতে হবে এমন কোন কথা নেই হাসি

আমার কিন্তু বেশ লেগেছে। আগামী সামারে বেড়াতে যাব ভাবছি

বন্দনা এর ছবি

নেটে একটু খুঁজে দেইখেন ভাইয়া, এই ছবিরে পচা না বইলা উপায় নাই। যান যান ঘুরে আসেন, জায়গাটা কিন্তু বেশ সুন্দর।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ভাল লাগলো ছবি আর লেখা।

বন্দনা এর ছবি

ধন্যবাদ প্রৌঢ় ভাবনা ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।