ক্ষুদ্র গল্প: ০১: অন্ধকার

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: শুক্র, ০৭/০৯/২০১২ - ৮:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অন্ধকার রাত। কিশোরী মেয়েটার চোখে ঘুম নেই। আর সবাই ঘুমিয়ে গেছে। তবু আরও খানিকক্ষন অপেক্ষা করলো সে। তারপর নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে সে বের হয়ে গেল। কেউ টের পেল না।
ভেতরে যেমন অন্ধকার বাইরেও তেমনি অন্ধকার। এমনিতে অমাবস্যার রাত। তার উপর সন্ধ্যা থেকে মেঘ করেছে। বারান্দার রেলিং ধরে সে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হটাৎ তার মনে হলো দুরে টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে। মেয়েটা একটু অবাক হয়। আলোটা জ্বলছে যেখানে সেখানে শুধূ পাহাড়। এখানে কোথাও ইলেকট্রিসিটি নেই। ঐ গহীন পাহাড়ে কে বাতি জ্বেলেছে?
- আগুন জ্বলছে। জুম চাষ করবে ওরা।
মেয়েটা চমকে গেল। চমকানোর চেয়ে ভয়ই পেল বেশি। মনে হলো বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো।
এতক্ষনে সে ওকে দেখতে পেল। অন্ধকারের মধ্যে আরো ঘন অন্ধকার। মুথ দেখা গেল না। কিন্তু বোঝা গেল তার বয়সেরই কেউ। বড়ো কেউ নয়।
- আজকে গিয়েছিলাম ওখানে। জুম চাষ দেখতে,,, একটা ঝর্ণা আছে ওধারে। এখান থেকে বোঝা যায় না। ওখানে গেলে বোঝা যায় - পাহাড় কাকে বলে।
ছেলেটার কথায় মেয়েটার মনে ভয় কেটে যেতে শুরু করে। অন্ধকারে দুজনের কেউ কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু দুজনের দুজনকে আর অচেনা মনে হচ্ছিল না। দুজনেরই বেশ ভাল লাগছিল। ভাল লাগার আনন্দে ওরা ভুলেই গিয়েছিল ছেলেটা কিংবা মেয়েটার যে কেউ ঘর থেকে বের হয়ে আসতে পারে। এত রাতে দুজনে একলা কথা বলছে দেখতে পেলে আর লজ্জ্বার শেষ থাকবে না।
দুজনেরই একটু শীত শীত করতে লাগলো। ঠান্ডা বাতাসটা গায়ে কাটার মতন বেধে। ওরা আর একটু কাছাকাছি দাড়ালো। দুজনের শরীরের ওম কাথার মত কাজ করছিল।
ছেলেটা কিংবা মেয়েটা কেউই বলতে পারবে না তাদের কে প্রথম অন্যজনের হাত ধরেছিল। তাদের কেউই বলতে পারবে না - ছেলেটা নাকি মেয়েটা প্রথম ঠোট জোড়া এগিয়ে দিয়েছিল। তাদের কেউ কোনদিনই বলতে পারবে না তাদের মধ্যে কে প্রথম অন্যকে জড়িয়ে ধরেছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ছাড়িয়ে ওরা আরও অনেকদুর হেটে গিয়েছিল। জানতেও পারে নি। যখন বুঝতে পেরেছে কেউ কারো সাথে আর কথা বলতে পারে নি। তাকিয়ে দেখার সুযোগতো ছিলই না। ওরা নিঃশব্দে আবার যে যার ঘরে ফিরে গিয়েছিল। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে একই কটেজে ওঠা, মেয়েটার কিংবা ছেলেটার দেখা হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হয় নি। মেয়েটার বাবা অসসুস্থ হয়ে যাওয়ায় পাহাড় দেখা বাতিল করে ওরা শহরে ফিরে গেল সেই ভোরেই। ছেলেটার কাছ থেকে মেয়েটা আর মেয়েটার কাছ থেকে ছেলেটা হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।
সময় কেটে যেতে থাকলো। দিনের পরে দিন। মাসের পরে মাস। বছরের পর বছর।
কিশোরী মেয়েটা আর কিশোরী নেই। সেই কিশোর ছেলেটাও এখন তরুণ যুবক।
দুজনের কারো কোন ছবি কারো মনে ছিল না সত্যি তবু ছিল না সেটাও মনে হয় সত্যি নয়।
বিশেষ করে অন্ধকার রাতে যখন ঘুম আসে না মেয়েটার সেই রাতের কথা মনে পড়ে। মনে পড়লে সব সময় একই অনুভূতি হতো তা নয়। কখনও কখনও খূব লজ্জ্বা পেত মনে মনে। আলো থাকলে সবাই দেখতো- ও লাল হয়ে উঠছে। আবার কখনও কখনও একটা অজানা অচেনা পুলক অনুভব করতো। মনে হতো ঐ স্পর্শটা যদি আবার ফিরে আসে।
মেয়েটারই যে এমন হতো তা নয়। ছেলেটারও হতো।
এই অনুভূতি দুটো দুজনেরই অন্ধকারের গল্প। দিনের আলোয় ওরা নিজেরাও এ সব কথা মনে আনতো না।
ওখানে ওদের আরেক জীবন।
মেয়েটির জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে একটি ছেলেকে ভালবেসে ফেললো। এইবার অবশ্য কে কাকে প্রথম ভালবাসার কথা বলেছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না, কিন্তু তর্ক ছিল। মেয়েটি বলতো, ছেলেটি তাকে প্রথম প্রস্তাব করেছিল। আর ছেলেটি বলে - মেয়েটিই তাকে প্রথম ভালবাসার কথা জানায়। কিন্তু সে ছিল দুষ্টুমীর তর্ক। আসলে দুজনেই দুজনকে পেয়ে মনে করেছিল সে যাকে মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছিল - এ হচ্ছে সেই জন। মেয়েটা ছেলেটার কথা কখনই মনে হতো ফ’রোবে না। চড়–ই পাখির মত ওরা কথা বলছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, উড়ে বেড়াচ্ছে। জীবনের সব কথা বলেও মনে হচ্ছিল কিছুই বলা হলো না। কিন্তু সব মানে আসলেই সব না। মেয়েটা কিন্তু সেই রাতের কথা তার প্রেমিককে বললো না। অথবা ভুলে গেল।
ছেলেটার গল্প এক কথায় বললে একই রকম। সেও এক মেয়ের প্রেমে পড়লো। নিজের গোপন বাহির সব কিছু মেয়েটাকে জানালো। শুধু ঐ রাতের ঘটনাটি ছাড়া। সেও হয় বলে নি, কিংবা ভুলে গিয়েছিল।
মেয়েটার সাথে ছেলেটিকে এবং ছেলেটার সাথে মেয়েটিকে মানিয়েছিলও দারুন। কোন ঝামেলা ছাড়াই ওদের বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে।।
বিয়ের রাতে মেয়েটি নববধূর সাজে খাটে বসে ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করছে। ছেলেটি বাতি নিভিয়ে দিতেই সব অন্ধকার হয়ে যেতেই মেয়েটির মনে পড়লো সেই রাতের কথা।
আশ্চর্য্যজনকভাবে ছেলেটির ক্ষেত্রেও ঘটলো একই ঘটনা। বাসর ঘরের বাতি নিভিয়ে দিতে সব অন্ধকার হয়ে যেতেই তারও পড়ে গিয়েছিল সেই রাতের ঘটনা।
ওরা দুজনেই নিজেকে সামলে নিয়েছিল। স্মৃতিটাকে মনের ভেতর থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছিল। মেয়েটা আধা শংকা, আধা ভয়, আধা বিহ্বলতা, আধা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে নিজেকে তার প্রেমিক স্বামীর আলিঙ্গনে দেখতে পেল। তার হারিয়ে যেতে থাকলো আরও গভীরে। আরও গভীরে। সেই করুণী নববধু যত হারিয়ে যেতে লাগলো তার কাছে তত স্পষ্ট হয়ে জেগে উঠতে থাকলো সেই রাত। তার মনের মধ্যে কে জানি বারবার বলে যেতে লাগলো - চিনি চিনি। আমি একে চিনি।
ছেলেটির গল্পও তাই। তার নববধূকে জড়িয়ে হারিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, একে আমি চিনি। আমি চিনি। আলাদাভাবে হিসেব করলে, তারা দুজনেই বাকি জীবন খুব সুখে শান্তিতেই কাটিয়েছিল। সঙ্গী নিয়ে তাদের কোন হতাশা ছিল না। স্বপ্নভঙ্গও ছিল না। তারা দাম্পত্য জীবনে খুবই সুখী হতে পেরেছিল।
কিন্তু তবু এই কথাটি কেউই বলে নি। মেয়েটি অবশ্য নিশ্চিত হতে পারে নি, এই যে চেনা - এটা কি সত্যিই চেনা, নাকি মনের ভুল। ছেলেটির ক্ষেত্রেও সেই একই কথা।


মন্তব্য

পাঠক এর ছবি

অসাধারণ লিখেছেন।
সচলায়তনের নিয়মিত পাঠক হলেও মন্তব্য করা হয় না আলসেমীর কারণে, গল্পটা পড়ে মন্তব্য না করে থাকতে পারলাম না।

রানা মেহের এর ছবি

আপনার অন্যান্য লেখার মতো ভালো হয়নি

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

গল্পের প্লটটা দারুণ।

একটা সংশয় ছিল। করুণী মানে ঠিক বুঝলাম না।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লেগেছে চলুক

-এক জোনাকি

দীপ্ত এর ছবি

ভালো লেগেছে। বিশেষত, গল্প শেষের ওই ছেলেমেয়ে দুজন বহুদিন আগে পাহাড়ে দেখা হওয়া ছেলে-মেয়েটা ছিল কিনা- এটা খোলসা করে বলেননি, পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন এইটুকু।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দুইজনেই পাক্কা ওস্তাদ.... প্রেম করাও জানে। সংসার সামলানোও জানে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।