পি’য়ের জন্য ফুল

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: রবি, ২৪/০৮/২০১৪ - ৫:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পি’কে জীবনে সে মাত্র একবারই দেখেছিল। অনেক দুর থেকে। তাও ত্রিশ বছর আগে।
এরপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে নি।
এখন ৪২ বছর চলছে। প্রতিদিন মা অনুযোগ করে যাচ্ছেন। তাঁর সময় হয়ে গেছে। এখন মরার আগে ছেলের বৌয়ের মুখ দেখে যেতে চান। তা না হলে মরেও শান্তি হবে না। মা যতক্ষন এসব বলতে থাকেন, সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। মায়ের মনেও প্রতিবার আশা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ছেলে বুঝি এইবার তাঁর কথা শুনবে। মা কথা থামিয়ে ছেলের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেন। ছেলে খানিকটা সময় নিয়ে প্রতিবারই একই উত্তর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
সময় আসে নি মা।
মায়ের এই এক কান্না। মা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারেন না, ছেলের আর কবে সময় হবে। তেতাল্লিশ বছরের পুরুষ, সন্ধ্যার মত। এখনও যদি সংসারী না হয় - পরকালেও পরিত্রাণ মিলবে না। অভিমানী চোখে ছেলের দিকে তাঁকান। সে তখন ফুল বাগানের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
সত্যিই বিরাট। দিগন্ত পর্যন্ত। ফুল আর ফুল। কত বর্ণের। এত যে রঙ আছে পৃথিবীতে, ফুলগুলোর দিকে তাকালে মন উঁদাস হয়ে যায়। বাতাসে সবসময় মিষ্টি একটা গন্ধ ভাসছে।
মায়ের অবশ্য তা মনে হয় না। ফুলের রঙগুলো তার কাছে চোখের পীড়া মনে হয়। আর ফুলের গন্ধটা- মনে হয় কাটার মত। নিঃশ্বাসে নিঃম্বাসে বুঁকে গিয়ে বিধছে। আসলে গাছগুলোকে মা দেখতে পারেন না। সতীনের মত। ছেলেটাকে ভুলিয়ে তাঁর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
আসলেই সে বাগানের ফুল গাছগুলোর কাছে গেলে সব ভুলে যায়।
কি অবস্থা তোমার, সব ঠিকঠাক চলছেতো ?
গাছগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জিজ্ঞাসা করে।
হ্যাঁ। ফুলে টইটুম্বুর একটা গাছ হেসে উত্তর দেয়। ও-ও হাসে। আরেকটা গাছের কাছে যায়।
গাছটার মধ্যে সলজ্জ্ব একটা ভঙ্গি। গর্বের সঙ্গে একটু শঙ্কা মিশে আছে। সে বুঝতে পারে গাছটার ফুল আসছে। ফুল আসার আগে গাছগুলো এরকম হয়ে যায়। গর্ভবতী মায়ের মত। এ সময় একটু যতœ আত্তি দরকার। কিন্তু মালীগুলোর সেদিকে খেয়াল নেই। সব ফাঁকিবাজ।
তোদের কি দয়ামায়া বলে কিছু নেই। চোখে দেখছিস না গাছটায় কড়ি ফুঁটেছে। আর ওর গোড়ার মাটি এত শক্ত। ফুঁলটায় গন্ধ আসবে কি করে। বিকলাঙ্গ শিশুর মত ও-ও বেঁড়ে উঠবে। পানি দে। পানি দে। গোবর ফেল। ফুলের ছাট পাপড়িগুলো মাটিতে মিশিয়ে দে। তাঁতে ফুলগুলো আরও খোলতাই হবে।
হাঁকডাক করতে শুরু করে ও। সবাই তটস্থ হয়ে ছুটে আসে।
ভয় পেও না। ফুল আসলেই দেখবে কেমন মধুর হয়ে যাবে সবকিছু। নিজেকে মনে হবে- রাণীর মত।
গায়ে হাত বুলিয়ে সাহস দিয়ে আরেক দিকে এগোয়।
সবাই বলে, নেশা। ফুলের নেশা নয়- টাকার নেশা। ফুল বেঁচে টাকা আনে। সে ফুলের মজা বুঝবে কি করে?
এটা একদিক থেকে সত্যি। ফুল কিনতে গেলে, তাঁর ফুলটাই আগে খোঁজে সবাই। তাঁর ফুলের গন্ধ যে শুঁকেছে সে অন্য ফুলে গন্ধই পাবে না। আর রঙও। ওর ফুলের প্রতিটা পাপড়ি যেন সদ্যস্নাতা কুমারী মেয়েটার মত। লাজুক। নরম। কিন্তু জ্বলছে। নিরবে কি জানি বলে যাচ্ছে। তার পাশে অন্য ফুলগুলো একদমই পানসে। ম্যাড়মেড়ে। তাই বাজারে দামটাও তাঁর ফুলেরই সবচাইতে বেশি। রঙ আর গন্ধ বিলিয়ে প্রতিদিন ফুলগুলো প্রতিদিন স্রোতের মত টাকা বইয়ে দেয়। তাঁর বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। চারিদিক ছড়ানো ছিটানো মাটির টিনের কয়েকটা বাড়ীর মধ্যে ঝকঝকে পাকা দোতালা দালান মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারা শরীরে লক্ষীর শ্রী ঝকমক করছে। শিকের দরজা লাগানো গ্যারেজ গেটটা খুলে কাঁচা রা¯তা দিয়ে সৌভাগ্যের ধুঁেলা উড়িয়ে গাড়িটা যখন ছুটে যায় সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। টাকার নেশা এমনই, মেয়ে মানুষও কিছু না। মুখফোড়া কেউ কেউ বলেও ফেলে। অন্যরা মাথা দোলায়। মেয়েরাওতো টাকার পেছনেই ছোটে। টাকা এমনই ধন। ওর সামনে কেউ এসব নিয়ে আলাপ না তুললেও সে জানে। ঠিকই বাতাসে ভর করে টুকরো টাকরো শব্দ কানে উড়ে আসে।
তাঁর রাগ হওয়ার কথা। কিন্তু হয় না। তার বদলে সে ফুলের দিকে তাঁকায়। মিটিমিটি হাসে। মানুষ আসেলে কত বোঁকা। সে যা ভাবছে তাই ঠিক বলে জেনে মরে যায়। জানতেও পারে না জানাটা সত্যি থেকে কত দুরে। ফুলটাকে আলতো করে ছুঁয়ে বলে
তুই যদি পি’র বাড়ি যাস তাহলে তোর গন্ধে ওকে ভুলিয়ে দিস। ওর চোখের জলটা যেন মুছে যায়।
যেন পি এখনও কাঁদছে। ত্রিশ বছর আগের সন্ধ্যার মত।
দুরে নদী বইছে। আকাশের কোণে লালের ছটা। চিতার আগুনটা ততক্ষনে বড় হয়ে উঠেছে। চন্দন কাঠ আর ঘিয়ে মোড়া পি’র দাদীর সুগন্ধ মাখা দেহ থেকে ধোঁয়ারা কুন্ডলী পাঁকিয়ে পাঁকিয়ে মেঘ হয়ে উড়ে যাচ্ছে। আর পি বাবার বুকে মুখ রেখে কাঁদছে। সন্ধ্যার রঙ, চন্দনের গন্ধ, পোড়া কাঠের শব্দ, কম্পমান ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে কাঁপা কাঁপা দৃশ্যটা তাঁর মাথায় ঢুকে যায়। দাদীর শোকে মূহ্যমান পি’কে ভালবেসে ফেলে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই।
তারই বা তখন কত বয়স। তেরোয় পা দিয়েছে। কিন্তু এই এতগুলো বছর পরও সেই দৃশ্যটা একইভাবে দেখতে পায় সে। পি বাবার বুকে মুখ রেখে দাড়িয়ে। চোখে শূন্যতা। ওর ইচ্ছে করে ও গিয়ে পি’র সব শূন্যতা মুছে দিয়ে ওঁর চারদিক ভরিয়ে তুলতে। যেখানে কোন শোকের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। ওর চারপাশে ফুঁটে থাকবে ফুল আর ফুল। ফুলের বাগানে কোন চন্দন পোঁড়ার গন্ধ থাকবে না। ফুলের সুঘ্রাণের মধ্যে সে হেঁটে বেড়াবে।
সময় যে কিভাবে গড়িয়ে যায়, কেউ টেরও পায় না। ত্রিশ বছর। সে তেরো থেকে মধ্য বয়সে এসে পড়েছে। পি’র দাদীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর বাড়ির আঙিনায় দুটো ফুলগাছ লাগিয়েছিল। কবে ফুল ফুটবে? কবে? তাঁর কি অধীর অপেক্ষা। যেন ফুল ফুটলেই পি’র সেই কান্না মুছে যাবে। তাঁর আর তর সয় না। তারপরও একদিন সত্যি সত্যি গাছদুটোয় ফুল আসলো। কিন্তু পি'কে আর দেয়া গেল না। কারণ পি ততদিনে আর নেই। শহরে ফিরে গেছে। অবশ্য পি যদি নাও যেত, সে এই ফুল তাঁকে দিতে পারতো কিনা সন্দেহ।
পি’রা এই এলাকার সবচাইতে বনেদী পরিবার। দাদুর আমল থেকেই কেউ না কেউ ওদের মধ্য থেকে মন্ত্রী মিনিষ্টার হয়, প্রতিবারই। নির্বাচনের সময় ওর বাবা কাকারা কয়েকদিনের জন্য একবার আসেন। এলাকার গণ্যমান্য লোকেরা তাঁদের সঙ্গে একটু দেখা করার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়ায়। কাছে ভেড়াই কঠিন। পি যদি থাকতোও- ধাঁরে কাছে যাওয়ার সুযোগটাও সে আসলে পেত বলে মনে হয় না।
ফুলগুলো পি’কে দিতে না পারলেও সে আশা ছাড়ে নি। তাঁর মনে হতো পি এখনও কাঁদছে। একদিন শহরে গিয়ে পি’র কাছে ফুল নিয়ে হাজির হবে। ফুলের গন্ধে পি’র কান্না মুছিয়ে দেবে। এরপর অনেকবারই ঐ গাছদুটো ফুল দিয়ে মরে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর অপেক্ষা ফুরোয় নি। বরঞ্চ দুটি গাছের বদলে গাছের সংখ্যা বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে এখন দিগন্ত ছুয়েছে। ট্রাক বোঝাই হয়ে ফুলগুলো শহরের দিকে ছুটে যায় ওর বুক কাঁপতে থাকে। ও জানে এই ফুলগুলোর কেউ না কেউ ঠিকই পি’র বাড়িতে পৌঁছে যাবে।

পি’দের বাড়ি মন্ত্রী মিনিস্টারের বাড়ি। নানা ফিকিরে নানা ধরণের লোকজন ভিড় জমায়। তাঁদের অনেকেই যাওয়ার সময় ফুল নিয়ে যায়। সে জানে, সেই ফুলগুলোর মধ্যে তাঁর ফুল থাকবেই। প্রতিটা ফুল যখন ফোঁটে- সে কল্পনায় দেখে তাঁর ফুলের সুবাসে পি’এর সেই কান্নামুখ মুছে যাচ্ছে। যেন পি এখনও সেই বাবার বুকে মুখ রেখে কাঁদছে। ওর মনেই পড়ে না, অনেক সময় বয়ে গেছে। সেই বাবাও গত হয়েছেন অনেক বছর আগেই। পি-ও একা নেই। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁরও বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন দু সšতানের মা। এই উপলক্ষ্যে তাঁদের গ্রামেও খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছিল। দুবার কথা রটেছিল, পি তাঁর জামাইকে নিয়ে গ্রামে আসবে। যদিও শেষ পর্যšত আসে নি। এসব খবর থেকে নিজেকে দুরে রাখার জন্য, সে পত্রিকা পর্যšত পড়ে না। সেখানে ওঁদের খবর প্রায়ই ছাপা হয়। টিভিটাও এই কারণে কেনে নি।
এরপরও - মাঝে মধ্যে যে সে টের পায় না, তা নয়। কখনও কখনও হটাৎ হটাৎ উঁদাস হয়ে যায় সে। মেঘের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, পি কি আগের মতো আছে? কিন্তু এসব ভাবনা বেশিক্ষণ থাকে না। বাবার বুকে মুখ রেখে পি’র সেই কান্না ভেজা মুখটা আবার ভেসে আসে। পি’র সেই ছোট্ট চেহারাটার বাইরেও সে পি’কে মাঝে মাঝে অনুভব করতে পারে। সেটা কবিতা পড়ার সময়। ফুলের বাইরে এই তাঁর আরেক জগৎ। সে যখন কবিতা পড়ে তখন সে পি’কে দেখতে পায়। মনে হয় তাঁর কাছে হেঁটে আসছে। এই পি’টা যেন দশ বছরের বালিকা নয়। সে এখন বড় হয়ে গেছে। তরুনী। যদিও সেই সময়টায় পি’র চেহারাটা সে ঠিকমতো দেখতে পায় না। একটা অবয়বের মত। কিন্তু মনে হয়, পিকে সে পেয়েছে। চারদিক ভরে ওঠে।
এরকম করেই কেটে যাচ্ছিল ওর দিনগুলো। যতদিন না সে শহরে গেল।
সে শহরে কখনও যায় নি। এতবড় ব্যবসা, সবই শহরে। তারপরও সে কখনও যায় নি। আসলে যায় না। কেন যায় না, সে নিজেও জানে না। কিন্তু শেষপর্যন্ত এবার যেতে হলো। বিরাট এক বড় কেউকেটা - তাঁর অনেক অনেক ফুল লাগবে। তিনি সরাসরি মালিককে আসতে বলেছেন।
অর্ডার ক্যানসেল করো। শহরে ফুলের এজেন্টকে বলেছিল ও। আমি শহরে যাবো না। এজেন্ট জানালো, তাঁকে যেতেই হবে।
: কেন? কেন যেতেই হবে? আমি শহরে যাই না- বলো নি তাঁকে।
: বলেছি। কিন্তু উনি বলেছেন, আপনাকে আসতেই হবে। না হলে, উনি আপনাকে ব্যবসা করতে দেবেন না।
: কেন আমি কি তাঁর ব্যবসার অংশীদার? সে ক্ষেপে উঠেছিল। যে সে আমার ব্যবসা বন্ধ করে দেবে?
: না, কিন্তু তিনি এটা পারেন। তিনি চাইলে সবকিছু করতে পারেন। আপনার ফুলের ব্যবসা বন্ধ করতে পারেন। আপনাকে ভিটে ছাড়া করতে পারেন। জেলের ঘানি টানাতে পারেন। এত ক্ষমতা তাঁর। আপনি চলে আসুন। এ ছাড়া কোন পথ নেই।
সে একবার ভেবেছিল যাবে না। কিন্তু ফুল বাগানের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হলো, এই ফুল যদি শহরে না পোঁছে - তাহলে পি’র চোখের কান্না সে ভুলিয়ে দেবে কি করে।
সে সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে গাড়ি বের করে জীবনে প্রথমবারের মতো শহরে হাজির হলো।
লোকটার অফিসে সে যখন ঢুকলো, তাঁর মনে হলো দম বন্ধ হয়ে আসছে। বিরাট অফিস। চারদিকে দামী দামী সব জিনিষপত্র। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু সব চোখে বাড়ি মারার মত। যেন চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বলছে, আমাকে দেখ। আমাকে দেখ। সে বিরাট সোফার মধ্যে চোখ বন্ধ করে সংকুচিত হয়ে বসে রইলো।
কতক্ষন খেয়াল ছিল না। এক কেতাদুরস্থ লোক এসে ডাকলে ঘোর ভাঙে।
টেবিলের ওপাশে লোকটা বসে ছিল। তাঁকে দেখে প্রথমেই যে অনুভূতিটা হলো - হিন্দী সিনেমার ভিলেন দেখছে। বুকখোলা চামড়ার জ্যাকেট। কাঁধ থেকে ঝুলে পড়েছে। সাদা রঙের হাত কাটা গেঞ্জি। গলায় মোটা চেন। সোনার। হাতে অনেকগুলো আংটি। পাথরগুলো খুব দামী। ঝকমক করছে। চোখে মুখে একটা চালাকী কিলবিল করছে^। মাথার উপরে সানগ্লাসটা উঠিয়ে রেখেছে। দেখেই লোকটাকে অসহ্য মনে হলো তাঁর। অভদ্র।
সামনে আমার একটা অনুষ্ঠান আছে- দেশ বিদেশের বড় বড় লোকরা আসবেন।- লোকটা বলতে শুরু করে। ফুলের দায়িত্ব আপনার। সবার চোখ ট্যা করা চাই। বুঝলেনতো।
মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়।
পুরো হিন্দী সিনেমার মত। কথাগুলোতে বটেই, চারপাশটা পর্যšত। দেয়ালে লোকটার কয়েকটা ছবি ঝুলানো। দেশ বিদেশের নামীদামী লোকদের সাথে। খুব সিরিয়াস ঢঙের ছবি। কিন্তু শুধু লোকটার উপস্থিতির কারণে কার্টুনের মতো লাগে। পাশের একটা সোফায় কয়েকজন লোক বসে ছিল। আগে খেয়াল করে নি। একজন হটাৎ জোরে একটা অশ্লীল রসিকতা করলে সবাই হেসে উঠলে সে ওদের দেখে। এই চেহারাগুলোও চেনা। ভিলেনের স্যাঙাৎগুলোর মত। তাঁর হটাৎ মনে হয় এটা- আসলে কি সত্যি? না কি স্বপ্ন ? সিনেমার কোন দৃশ্য ঘুমের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
: লোকটা তাড়া দিয়ে ওঠে। বুঝেছেনতো?
: আমি এই কাজটা করতে চাই না। আমাকে বাদ দিন।
: আমি ঠিক করেছি, এই কাজটা আপনিই করবেন। আর এর জন্য যা লাগে এটাও আমার হয়ে আপনি দেবেন। আর এটা আমার ব্যবসায় আমার ইনভেস্টমেন্ট। আর জানেনতো আমার নাম থাকলেই আপনার ব্যবসা হু হু করে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
সে ভাবে একবার, তাঁর নামটা জিজ্ঞাসা করবে কি না। এজেন্ট নামটা বলেছিল বটে, কিন্তু নামের চেয়ে ক্ষমতার বহরটার কথা এত বেশি ফুঁটিয়ে তুলেছিল নামটাই ভুলে গিয়েছে।
ঠিক এই সময় তাঁর ছবিটার দিকে চোখ গেল।
পি। সেই কত বছর পর, ৩০ বছর পর পিকে দেখতে পায় সে। আর আগের মত ছোট্ট বালিকাটি নেই। রীতিমত মহিলা হয়ে গিয়েছে। তারপরও সে বুঝতে পারে এটা পি-ই। ওই তো পি’র বাবার ছবিও। হৃদপিন্ডের শব্দ শুনতে পায় সে। হাতুড়ির মতো ঘাই মারে। পি'কে আবার দেখে। দাদীর মতই হয়েছে চেহারাটা। একই রকম হাসি। পি’র দাদীর মুখ মনে পড়ে তাঁর। পাশের আরেকটা ছবি দেখে। দেখে আবার চমকে ওঠে। এই লোকটা পি’য়ের ঘাড়ে হাত দিয়ে আছে। আশ্চর্য্য!!! এই লোকটা পি’র স্বামী! তাঁর মাথা কাজ করে না। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে। কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু অনন্তকালের মত মনে হয়। সে ধাতস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না পি একে কিভাবে পছন্দ করলো! লোকটার চেহারা দেখে আর একবার। আশ্চর্য্য। একে বিয়ে করলো পি ! এ রকম একটা মানুষকে! কিভাবে?! সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। হটাৎই নিজেকে ছেড়ে দেয় সে। পি’কে লোকটার মতই মনে হয়। এতদিন ধরে প্রতি মুহূর্তের সেই নিষ্পাপ কান্নাভেজা মুখটা একবার মনে করতে চায়। মনে পড়ে না। খুব ক্লাšত লাগে তাঁর । ফুল, ফুলের বাগান, ফুলের ব্যবসা সবকিছু হারিয়ে ফেলে।
: আমি এই কাজটা করতে পারবো না।
লোকটার চোখদুটো জ্বলে ওঠে। কালকেউটের মতো ফুঁসে ওঠে।
: তাহলে আপনার এই ব্যবসাই থাকবে না।
: দরকার নেই। আমি ফুলের ব্যবসা আর করবো না। - ক্লাšত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কোনদিকে না তাঁকিয়ে বের হয়ে আসে।
শহর থেকে ফিরে এসে সে তাঁর ফুলবাগানের সবাইকে ডেকে পাঠালো। ১ বছরের বেতন দিয়ে জানিয়ে দিল, সে ফুলের বাগানটা বন্ধ করে দিচ্ছে। তারপর সোজা মাকে গিয়ে বললো, আমি বিয়ে করবো। তুমি মেয়ে দেখ।
মায়ের খুশি আর ধরে না। বেশ কয়েকটা মেয়েকেই তাঁর মনে ধরেছিল। কিন্তু এখন তাঁদের আর কাউকেই ছেলের জন্য উপযুক্ত মনে হচ্ছে না। তিনি চরকীর মতো বউ খুঁজতে ঘুরতে শুরু করলেন। একজনের পর একজন। কয়েকদিনের অযতেœ বাগানের সব গাছগুলোই শুকিয়ে ন্যাকড়ার মত হয়ে গেল। ঝুরঝুরে গাছগুলো দেখে এতদিন যারা ঈর্ষা করতো, তাঁদেরও খুব খারাপ লাগে। শুধু তাঁরই কোন ভ্রক্ষেপ নেই। সে দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে সময় পার করে দিতে লাগলো। শেষপর্যন্ত মা এসে বললেন, একটা মেয়ে পাওয়া গেছে। লক্ষী মেয়ে। সে শুধু বললো-হু।
সে রাতে তাঁর কিছুতেই ঘুম আসলো না। জানালা দিয়ে একটা চাঁদ উঠেছে। সে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
হটাৎ সে টের পেল, কেউ একজন বিছানায় উঠছে।
সে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পেল, সেই লোকটা। হিন্দী সিনেমার ভিলেনের মতো বিছানায় উঠে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখছে।
তাঁর খুব অসহায় লাগলো। খুব কষ্ট। সে বাবার বুক খুঁজলো। সেখানে মুখ রেখে সে একটু কাঁদবে।
কিন্তু কেউ নেই। লোকটা তাঁর আরও কাছে সরে এসেছে।
তাঁর খুব কান্না পায়। সে দেখতে পায় চারদিকে চিতার আগুন। ছাই এসে তাঁর চোখে মুখে পড়ছে।
কোঁথায় বাবা। ঠিক সেই মুহূর্তে সে একটা গন্ধ পেল। মিষ্টি একটা গন্ধ। ফুলের গন্ধ। সে চোখ বন্ধ করে ফুলের গন্ধের মধ্যে সেই লোকটার উপস্থিতি ভুলে গেল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই সে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। বুকটা শুকিয়ে এসেছে। একটু পানি খেতে পারলে ভাল হতো। সে উঠতে গিয়ে শব্দটা শুনতে পারলো। কান্নার আওয়াজ। তাঁর কাছে মনে হলো পি কাঁদছে। সে ভাল করে কান পেতে শুনলো। সে স্পষ্ট শুনতে পারলো, পি ফুঁপয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এত আস্তে যে পৃথিবীর কেউ যেন শুনতে না পারে। যে ফুলের গন্ধের মধ্যে প্রতিটা রাত সে ঐ লোকটার সান্নিধ্য ভুলে যায় সেই ফুলের গন্ধ সে খুঁজে পাচ্ছে না এইজন্য এই কান্না।
মোরগ ডেকে উঠতেই সে টের পেল, গাল বেয়ে জলের ধারা নামছে। জীবনে এই প্রথম সে পি’র জন্য কাঁদলো।
সে বাইরে বেরিয়ে এলো। ফুলের বাগানে শুকনো গাছগুলো দাড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় ওদের কঙ্কালের মত লাগে। সে গিয়ে কঙ্কালগুলোর কাছে যায়। হাত বুলাতে বুলাতে বলে, তুই মরিস না। তোর গায়ে ফুল ধরবে। আর সেই গন্ধে আমার পি’র চোখের পানি মুছে যাবে। রাত ভরে উঠবে। তুই মরিস না...
পরদিন সকালেই সে সবাইকে খবর পাঠালো, তাঁরা যেন ফিরে এসে কাজে যোগ দেয়। মা খবর শুনে ছুটে আসলেন। তাঁর আশঙ্কা সত্যি করেই সে মাকে জানালো, সে আপাতত বিয়ে করছে না। মা শূনে শূন্য দৃষ্টিতে খানিকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর নিজের ঘরে চলে গেলেন। সে একবার মায়ের চলে যাওয়া দেখল। চোখের আড়াল হতেই ফোন তুলে নিল।
শহরে তার এজেন্ট ফোন ধরলে সে জানালো, কেউকেটা লোকটাকে গিয়ে বলতে - এখন থেকে লোকটার যত অনুষ্ঠান তার সবগুলোতো বটেই, প্রতিদিন তাঁর বাড়িটাও তাঁজা ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেবার দায়িত্বটা এখন থেকে তাঁর। এবং এর জন্য কোন টাকা সে নেবে না।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

"জনম জনম ধরে তব তরে কাঁদিব" -এই লাইনটা কেন যেন মনে পড়ল গল্পের শেষে এসে।

চরিত্রের নামটা পি‌‌ ‌ হওয়াতে কেন যেন সারাটা সময় ধরে পটভূমিটা কেবল 'চাইনিজ চাইনিজ' মনে হচ্ছিল।

ভাল লেগেছে গল্পটা, শুভেচ্ছা হাসি

আয়নামতি এর ছবি

অনেকদিন পরে লিখলেন ভাইয়া।
অসংখ্য টাইপো, অনাবশ্যক চন্দ্রবিন্দু এসব দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব তাড়াহুড়ো করে লেখাটা পোস্ট করেছেন।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ভাইয়া, লেখাট খুবই সুন্দর মনে হচ্ছে - কিন্তু মোবাইলে প্রথম কয়েকটা প্যারার পর আর এগোতে পারলাম না - প‌্যারাগুলোর মাঝখানে একটা করে লাইন গ্যাপ থাকলে পড়তে সুবিধা হতো। পরে ওয়েবে এসে পড়ে যাবো।

____________________________

মরুদ্যান এর ছবি

গল্পটা ভাল লেগেছে।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

বন্দনা এর ছবি

কেমন যেন রাশান অনুবাদের মত লাগলো।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

পি? পিইই? পিইইই? হায়াল্লাহ! আর আদ্যক্ষর পাইলেন না? মন খারাপ

গল্প ভালো লেগেছে, আরও আটোঁসাটো করা যেত মনে হয়! হাসি

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।