আমার শিক্ষকেরা: ০১: সুনির্মল বসু ।।। যিনি শিখিয়েছিলেন- চারপাশের সবকিছু থেকেই আমরা শিখতে পারি

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: বুধ, ২৬/০৫/২০২১ - ৩:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শিক্ষক কে? যার কাছ থেকে শিখি।
কার কাছ থেকে শিখেছি? জীবনে, কারা ছিলেন আমার শিক্ষক?
এই প্রশ্নের উত্তরের আগে, একবার ভাবিতো-
কী শিখেছি আমি?
যা শিখেছি- তা কীভাবে শিখেছি?

প্রশ্নটা মহাশূন্যের মতো বিশাল। কী শিখেছি আসলে, এই জীবনে?
ভাবলে মনে হয়, এক অসীম শূন্যতার মধ্যে এসে পড়েছি। জীবন মানেইতো শেখা। শিখে চলা।
কত কি দেখেছি জীবনে! কত কি শুনেছি জীবনে। কত কি পড়েছি, জেনেছি।
কিন্তু কী শিখেছো, নিজের কাছে উত্তর দিতে গেলেই বুঝে পাই না, কী বলবো। সত্যিই তো, কী শিখেছি আসলে জীবনে?
উত্তরটা আমি জানি না। বায়োডাটার পাতায় কত কী লিখি। আমি এই শিখেছি। সেই শিখেছি। কিন্তু কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, বলোতো তুমি- কী শিখলে জীবনে? কী উত্তর দেবো?

রকেটে চড়িয়ে মহাশূন্যে এনে কেউ ফেলে দিল, এরকম মনে হয়।
পায়ের নিচে মাটি নেই। ওড়ার পাখাও নেই। শুধু ভাসছি। কোথায়? জানি না। চারিদিক শূন্যতা।
মহাশূন্যতা। কোথায় আমি? নিজেকে দেখতে চাই।
কিন্তু কোথাও নিজেকে দেখতে পাই না। ভাসছি। বিরাট একটা ‘নেই’ এর মধ্যে।
আসলে কি তাহলে কিছুই শিখি নি, জীবনে? নিজেকেই নিজে বলি?
তাতো নয়। আমরাতো বেঁচে আছি। বেঁচে থাকা মানেই কিছু না কিছু শেখা। সব সময়। কী শিখেছি জীবনে?

ভাবনার একটা মজা আছে।
ভাবনা হচ্ছে রাতের আকাশের মতো। প্রথমে মনে হয় অন্ধকার। কোন ভাবনাই আসে না।
তারপর একটা সময় অন্ধকারের মধ্যে ফুটে ওঠতে থাকে তারা। একটার পর একটা। ঝিকমিক করতে থাকে।
কোন কোন তারা চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে- তখন সেই ভাবনাটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়।
অন্ধকারে ঐতো একটা তারা ফুটেছে।
আমি ভাবতে পারছি, হ্যাঁ- শিখেছিতো।
যখন আমরা কোন ভাবনার মধ্যে একটু দাঁড়াবো,
ওখানে ম্যাজিক হয়। সিনেমার মতো।
আমরা দেখতে শুরু করি। ভাবনাগুলো চোখের সামনে সিনেমা দেখাতে শুরু করে।
আমি ভাবনাটায় থাকবো ঠিক করি। ভাবতে ভাবতে
আমিও সিনেমাটা দেখতে পেলাম।
“আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে…”
ছোটবেলার আবছা কবিতাটা সিনেমার মতো জ্যান্ত হয়ে উঠলো।

পাহাড় হয়ে, খোলা মাঠ হয়ে, বাতাস হয়ে, চাঁদ-সূর্য হয়ে, নদী-সমুদ্র-মাটি হয়ে, ঝর্ণা হয়ে, সবুজ বন হয়ে কথা বলে উঠলো-
সত্যিইতো।
আমরা ভাবি শিক্ষক মানেতো যারা আমাদের ইশকুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়িয়েছেন। কিন্তু শুধুতো তারাই নন।
শিক্ষকতো ঐ বাতাসও। আমিতো বাতাসের মতো বয়ে যেতে চা্ই। তার মানে এই শিক্ষাটাতো বাতাসের কাছ থেকে পেয়েছি।
অরভিল রাইট আর উইলভার রাইট- এই দুইভাই যেমন ওড়ার শিক্ষাটা শুরু করেছিলেন- পাখির কাছ থেকে। পাখিই ছিল রাইট ভাতৃদ্বয়ের প্রথম ওড়ার শিক্ষক।

কবিতাটাকে মনে হলো, শিক্ষককে খুঁজে পাওয়ার শিক্ষা। এভাবে ভাবতেই
ম্যাজিকটা শুরু হয়ে গেল। আমি খুঁজে পেতে শুরু কলাম, স্মৃতির ভেতর লুকিয়ে থাকা মুখগুলো
যাদের থেকে শিখেছিলাম-

কী শিখেছিলাম…
কীভাবে শিখেছিলাম…

মনে হলো জীবন কত বড়। কী বিচিত্র। আজকে তাহলে এই কবিতার শিক্ষার কাছেই থাকি।
‘সবার আমি ছাত্র’- কবিতাটা আরেকবার পড়ি।
ছোটবেলার পর এই বড়বেলায় কবিতাটা পড়তে গিয়ে দেখতে পেলাম,
আসলেই সমুদ্রের কাছে গিয়ে ঠিকই একটা শিক্ষা পেয়েছি, যে শিক্ষাটা মনের আড়ালে চলে গিয়েছিল।
আমি আবার অনুভব করলাম- মাটি। মাটিকে মনে হলো একটা স্যারের মতো। দিদিমণির মতো। মায়ের মতো।
আকাশটাও টিচারের মতো এসে সামনে এসে দাঁড়ালো। ম্যাজিক।
কবিতাটা আবার পড়ি একবার।

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে…
পাহাড় শিখায় তাহার সমান-
হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে-
দিল-খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর-
অন্তর হোক রত্ন-আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষান দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে,
গান জাগাল আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,
পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে,
নেই দ্বিধা লেশমাত্র।

কবিতাটা যেন কার লেখা?
কে যেন… কে যেন?
চারপাশটাই যে আমাদের শিক্ষক, এই শিক্ষা যার কাছ থেকে এই শিক্ষা পেয়েছি-
তার নামটাও মনে নেই।
লজ্জ্বা লজ্জ্বা লাগে।
কেউ মাথার মধ্য থেকে বলে
“না জানায় লজ্জ্বা নেই। যদি এখনই জানো।
না জেনে বসে থাকা লজ্জ্বা।”

গুগল করি।
এটা একটা মজা। শিক্ষা এখন স্কুলের পাতায় নেই। বাতাসে মিশে আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে।
ঠিকমতো কী জানবো- তা জানা থাকলেই, গুগল করলেই হলো।
বাতাস আমায় শিক্ষা দিলো’ – এটা লিখে সার্চ দেই।
আর সাথে সাথে তাঁর নাম, চেহারা চোখের সামনে চলে এলো।
উইকিপিডিয়ায় তঁর ছোট্ট করে পরিচয় আছে। ছবিও।
জীবনে প্রথমবারের মতো তাঁকে দেখলাম। আমার ছোটবেলার শিক্ষককে।
যদিও এই বুড়োবেলায় তাকে নিজের শিক্ষক হিসেবে চিনতে পারলাম
কিন্তু বুঝতে পালাম, শুধু আমার নয়, আমার বাবারও শিক্ষক তিনি। আমার দাদুরও।
জন্মের আগে থেকেই জীবনের প্রবাহমান ধারা হয়ে
আমরা তাঁর কাছ থেকে শিখে এসেছি
কীভাবে বুড়ো না হয়ে সারাজীবন শুধু বড় হয়ে উঠতে হয়।
উইকিপিডিয়া থেকে যা জানা গেল মোটামুটি এই-

সুনির্মল বসু ১৯০২ সালের ২০ই জুলাই ভারতের বিহারের গিরিডি নামক স্থানে পিতার কর্মস্থলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের মালখানগর। পিতার নাম পশুপতি বসু। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন তার পিতামহ এবং বিপ্লবী ও সাহিত্যিক মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা ছিলেন তার মাতামহ। ছোটবেলা সাঁওতাল পরগণার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁর মনে কবিতা রচনার অনুপ্রেরণা জাগায়। রচিত প্রথম কবিতা 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রধানত সরস শিশু সাহিত্য রচনাকেই সাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কবিতা রচনা ছাড়াও কিশোর বয়স থেকে চিত্রাঙ্কনেও দক্ষ ছিলেন।
বাংলাপিডিয়ায় এর বাইরে থেকে যেটা জানলাম তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে কলেজ ছেড়েছিলেন। আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্ট স্কুলে ছবি আঁকা শিখেছিলেন।

উইকিপিডিয়ায় তাঁর লেখা বইগুলোর একটা তালিকাও পাওয়া গেল।
• হাওয়ার দোলা (১৯২৭)
• ছানাবড়া
• বেড়ে মজা
• হৈ চৈ
• হুলুস্থূল
• কথাশেখা
• পাততাড়ি, ছন্দের টুংটাং (১৯৩০)
• আনন্দ নাড়ু
• শহুরে মামা
• কিপটে ঠাকুরদা (১৯৩৩)
• টুনটুনির গান
• গুজবের জন্ম
• বীর শিকারী
• লালন ফকিরের ভিটে
• পাতাবাহার
• ইন্তিবিন্তির আসর (১৯৫০)
• পাহাড়ে জঙ্গলে

ইন্টারনেটে গুগল করে দেখলাম, বেশ কয়েকটা ওয়েবসাইটে তাঁর অনেকগুলো কবিতাই আছে। ইউটিউবে জীবনি আর কবিতার/ছড়ার আবৃত্তি। পড়তে পড়তে শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো- বালকবেলা ড্রাম পিটিয়ে প্যারেড করতে শুরু করেছে।
সুনির্মল স্যারের কাছে গিয়ে মনে হলো-
যে বয়সেরই হোক
বালকবেলায় ফিরে যেতে পারলেই
সে বড় হয়, নাহলে হয় বুড়ো।

ছবি: 
04/06/2007 - 1:18অপরাহ্ন

মন্তব্য

ডা. মো. রুমী আলম  এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। অনেকদিন পর কবিতাটা পড়লাম। কোন ক্লাসের পাঠ্য ছিল তা মনে না থাকলেও মাথার ভেতর সুনির্মল বসু নামটা ঘুরঘুর করছিল। নাম মিলে খাওয়ায় খুব আশ্চর্য হলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।