মহাজনের নাও

জাহামজেদ এর ছবি
লিখেছেন জাহামজেদ [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৬/১০/২০১০ - ৩:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

বাউল করিম রাখাল বালক, গরুর পাল নিয়ে ছুটে চলে গ্রামের মেঠোপথে, দোতারা হাতে নদীর তীরে হাঁটে, রাখাল বালক হাঁটতে হাঁটতে গান বাঁধে, তার গানে থাকে ভাটির কথা, অনাহারী কৃষকের কথা, গানে গানে মানুষের দুঃখে করিম কাঁদে, করিমের কন্ঠে উঠে আসে হাওড় প্রদেশের গান, গানে উঠে আসে ভাটির টান, কন্ঠে বসন্তের কোকিলের প্রাণ-

বসন্তু বাতাসে সইগো
বসন্ত বাতাসে
তোমার বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে সইগো
বসন্ত বাতাসে...

ভাটি গ্রাম উজানধলের মসজিদের ইমাম বাউল করিমরে গান বাজনা করে বলে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়, বাউল করিম ভাটি গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে গলা ছেড়ে গান গায়, আকবর, রুহী, রণেশ সহ ভাটি অঞ্চলের বাউলের দল করিমের পিছু পিছু দলে এসে ভিড়ে যায় , সবাই মুর্শিদ মেনে করিমের শিষ্য হতে চায়, ভাটি অঞ্চল আর হাওড় প্রদেশের নদীর তীরে রাখাল বালক থেকে দিনে দিনে বাউলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়া করিম দুঃখে গান ধরে-

আমি কুলহারা কলন্কিনি
আমি কুলহারা কলন্কিনি
আমারে কেউ ছইও না গো সজনি...

ভাটির গ্রামে পুজা পার্বনে হিন্দু মুসলমান একজন যায় আরেকজনের ঘরে। বাউল করিমের ঘরে তখন আকবর, বাউল করিমের ঘরে রণেশ, রুহী, করিম গান বাঁধে, তার গানে হিন্দু মুসলমান, তার সাথে গলা জুড়ে দেয় শিষ্য বাউলেরা-

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম
আগের কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...

সুবচন নাট্য সংসদের ৩৩তম প্রযোজনা বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জীবন ও দর্শন নির্ভর নাটক মহাজনের নাও এর পুরোটা জুড়েই ছিল করিমের গান। গানে গানে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে করিমের জীবনের গল্প। মঞ্চে করিমের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে মঞ্চে নাটকের শিল্পীরা বারবার ধরেছেন করিমের গান, করিমের গানেই ছিলো তার ভাটি জীবনের গল্প, হাওড় প্রদেশের এক রাখাল বালকের বাউল হয়ে উঠার গল্প, বাউল সম্রাট করিমের গানের গল্প,তার হতাশা ও দুঃখ দিনের ব্যথার কথামালা ।

auto

বাউল সম্প্রদায়ের একটা অংশ গান রচনা করেন দেহতত্ত্ব নিয়ে। নিজেকে জানার, নিজেকে আবিস্কার করার এবং সৃষ্টিকর্তাকে খোঁজার চেষ্টায় তারা জীবনভর সাধনা করেন। তাদের বাউল হয়ে উঠা অথবা নিজের গানে নিজের গলা জুড়ে দেওয়া সেই সাধনার একটি অংশ। বাউল করিমও এর বাইরে ছিলেন না, তিনিও তার গানে নিজেকে খুঁজেছেন, সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে চেয়েছেন গানের কথামালায়। দেহতত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়ে গান লিখেছেন, রাখাল বালক করিম ভাটির নদী তীরের গ্রামে হেঁটে একতারা দোতারা হাতে গান গেয়ে দিনে দিনে বাউল করিম হয়ে উঠেছেন। করিম তার গানে নৌকাকে টেনে এনেছেন, নৌকা নিয়ে ভাটির পুরুষ গান বেঁধেছেন, গলায় অসম্ভব দরদ মাখিয়ে গেয়ে উঠেছেন-

চন্দ্র সূর্য্য বান্ধা আছে নাওয়েরই আগায়
কোনখান থাইকা আইসা নাও কোনখানেতে যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূরপন্খী নায়

কোন মিস্তিরি নাও বানাইছে
কেমন দেখা যায়...

করিম নিজেকে ভেবেছিলেন কোনো এক মহাজনের কাছ থেকে পাওয়া ধার করা নৌকা। যে নৌকার মালিক তিনি নন, চালিয়ে নেওয়াটাই ছিলো শুধু তার দায়িত্ব- মহাজনের নাও নাটকে সুবচন করিমের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে এই কথাটি বলতে চেয়েছে দর্শকদের।

auto

মূলত শাহ আব্দুল করিমের জীবনের জটিলতা, সংকট এবং তার থেকে উত্তরণের বিষয়গুলো মহাজনের নাও নাটকে প্রকাশ পেয়েছে। এরই সাথে উঠে এসেছে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে করিমের বোধ ও দর্শন। মহাজনের নাও নাটকে শাহ আব্দুল করিমের ২০টি গানের অংশবিশেষ নতুনভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। আলো ছায়ার খেলায় আর বাউল গানের মায়ায় নাটকটি দেখে দর্শক মুগ্ধ হবেন বারবার।

auto
মহাজনের নাও নাটকটি লিখেছেন শাকুর মজিদ। মহাজনের নাও নাটকের নাট্যকার শাকুর মজিদ বাউল সম্রাট করিমকে নিয়ে কাজ করেছেন ২০০৩ সাল থেকে পৃথিবীতে তার শেষ দিন পর্যন্ত। এছাড়া তিনি বাউল করিমকে নিয়ে ভাটির পুরুষ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্রও তৈরি করেছেন। মহাজনের নাও নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী।


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গিয়াস আহমেদ করছে আব্দুল করিমের চরিত্র! গিয়াস ভাই তো গানই গাইতারে না... সুবচনে নাসিম ভাই থাকতে বাউলের চরিত্র গিয়াস ভাই! নাহ্ ক্যামন আউলা লেগে গেলো...
দেখা হয় নাই নাটকটা... দেখবো আশা করি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জাহামজেদ এর ছবি

গিয়াস আহমেদ একা না, করিমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোট পাঁচজন। তবে গিয়াস আহমেদ ভালো গাইতারে না- কথা ঠিক। তবে রাসেল আর রুপা নাসরিন করিমের এমন সব গান গাইছে- নাটকটারে মনে হইছে যেন এক বাউল উৎসব।

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

৯৫ সালের দিকে সুবচনের প্রযোজনা ছিলো "খান্দানী কিস্সা" মিউজিক্যাল কমেডি। এই নাটকের একটা চরিত্র করতো গিয়াস ভাই, সে অন্য চরিত্রে গেলে সেটা জুটলো আমার কপালে। মজার কথা হইলো, দুইজনের একজনও গান গাইতে পারি না... অথচ মঞ্চে আস্ত একটা গান গাইতে হইতো... উফ... সে কী বিভৎস অবস্থা যে হইতো...

সুবচন আমার প্রথম দল, ৯৭ সালে সুবচন ছেড়ে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দিছিলাম।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জাহামজেদ এর ছবি

মহাজনের নাও নাটকটি পুরোটাই গান নির্ভর। নাটকে ২১ গানের মধ্যে আব্দুল করিমের ২০ টি গানের অংশবিশেষ গাওয়া হয়েছে। গিয়াস আহমেদ দুই/তিনটি গানে কন্ঠ দিয়েছেন।

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

করিম নিজেকে ভেবেছিলেন কোনো এক মহাজনের কাছ থেকে পাওয়া ধার করা নৌকা। যে নৌকার মালিক তিনি নন, চালিয়ে নেওয়াটাই ছিলো শুধু তার দায়িত্ব- মহাজনের নাও নাটকে সুবচন করিমের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে এই কথাটি বলতে চেয়েছে দর্শকদের ।

খুব ভাল লাগল বাউল সম্রাটের ওপর লেখাটি । নাটকটি দেখতে ইচ্ছে করছে… ধন্যবাদ আপনাকে ।

……………………………………
বলছি এক জ্যোতির্ময়ীর কথা

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

জাহামজেদ এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ। নাটকটি দেখলে আপনার অবশ্যই ভালো লাগবে।

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

নাটকটা দেখসি। আমার ভালো লাগে নাই। তবে অন্যদের দেখতে বলব।
কারণ বলি।

একদা ধর্ম ছিল সম্প্রদায়ের অধিকারে। মানুষ মানুষে মিল পাইত, তার সূত্রও ছিল ধর্ম, কোনো একপ্রকারের। কেউ কেউ বলল, মানুষ ভজ, আর তার সূত্রও ধর্ম, কোনো একপ্রকারের। এই সকল ধর্মই সম্প্রদায়ের মধ্যে বাস নিত।

তারপর, সম্প্রদায়ের কাছ থেকে রাষ্ট্র ঐ ধর্ম ছিনতাই করসে। আমরাই তখন তার নাম দিসি সাম্প্রদায়িকতা। আশ্চর্য প্যারাডক্স। এখন আমাদের অধিকারে ধর্ম সম্প্রদায় কিছুই নাই।

কিন্তু ছিনতাইকারী রাষ্ট্রেরও সেই সুদিন নাই। এখন আসছে বহুজাতিক বিজ্ঞাপনের নাওয়ে ভর করা টিভিমাওলানা।

বহুকাল ধইরা, 'ভাটির পুরুষ' করিম এইসব দেখসেন। মুরশিদের খোঁজ নিতে গিয়া তিনকালের নষ্টামী তার চোখ এড়ায় নাই। সম্প্রদায়ের ধর্ম > ধর্মের সম্প্রদায় > রাষ্ট্রের 'সাম্প্রদায়িকতা' > বিশ্বপুঁজির ধর্ম ... দেখসেন সবই। আর এই তো আমাদের ধর্মবোধের প্র্যাকটিকাল ইতিহাস।

আমার জন্য 'নাও' জিনিসটা মেটাফিজিকাল কিছু না, তবে মেটাফরিকাল। এই 'নাও' আমাদের চলমান ইতিহাসের ধারক, তার মেটাফোর। আমি এইসব কিছুই পাই নাই, এই নাটকে। পাইসি স্টক সিম্বলিজমের অক্ষম (আমার মতে) পুনরাবৃত্তি।

তবে, আমি যা চাই, তাই দিতে নাট্যকারও তো বাধ্য না। সুতরাং, আমার ভালো লাগে নাই। তবে অন্যদের দেখতে বলব।

এটলিস্ট কিছু ভালো গান আবার শুনা হবে। আর যারা কাজ করসেন, সততার সাথে, মন দিয়া, খাইটা করসেন।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

জাহামজেদ এর ছবি

এটলিস্ট কিছু ভালো গান আবার শুনা হবে। আর যারা কাজ করসেন, সততার সাথে, মন দিয়া, খাইটা করসেন।

এইটা এক্কেরে খাঁটি কথা...

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

সৈয়দ আফসার এর ছবি

ভালো লাগল।
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!

__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।