ছোটু কাহিনী

আব্দুর রহমান এর ছবি
লিখেছেন আব্দুর রহমান [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৩/০৭/২০১০ - ৭:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“ এই লেখাপড়া দিয়া তো কিছু হইবোনা।এর চাইতে রিকশা কিনা দিমু,রিকশা চালাবা, তখন বুঝবা জীবন আসলে কী? বাপের পয়সায় গায়ে বাতাস লাগায়া ঘোরো তো, কিছু টের পাও না। রাস্তার দুইপাশে দেখোনা, তোমাদের চাইতে অনেক অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে হয়।” পড়াশোনায় ঢিল দিলেই আমার মা অথবা বাবা এই ডায়লগ দিতেন।রিকশা চালাতে তেমন আপত্তি না থাকলেও, আমি আর আমার ছোটবোন বুঝতাম যে এখন এখানে বসে থাকাটা বা পালটা যুক্তি দেয়াটা, কেবল বিপদ বাড়ানো ছাড়া আর কোনো সুবিধা দেবে না। আমরা তখনি বই নিয়ে বসতাম, মানে দেখাতে চাইতাম যে আমরা রিকশা চালাতে আগ্রহী নই। আমার ছোটভাই আমার চাইতে সাড়ে দশ বছরের ছোট। তাকেও একদিন ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় এই অমোঘ বাণী শোনানো হল। কিন্তু সে দেখা গেলো নড়ে চড়ে না। বই টই আনার ধারে কাছে দিয়ে গেলো না, বসে বসে কি যেনো ভাবে। ভাবুকদের জন্যে বাংলাদেশ ভালো জায়গা না, তার কাছে জানতে চাওয়া হোলো সে কী ভাবছে? উত্তর হোলো, সে ভেবে দেখছিলো , ঢাকা শহরের কোন কোন রাস্তা তার চেনা, সম্ভাব্য খ্যাপ মারার জায়গা গুলো কি হবে। যেহেতু সে নিজের স্কুল ছাড়া আর কিছু চেনে না, তাই তার সুচিন্তিত মতামত হোলো যে , সে দিনে দুইবার রিকশা চালাবে, সকালে স্কুলে যাবার সময় দুইজনকে রিকশা চালিয়ে নিয়ে যাবে, আবার আসার সময় নিয়ে আসবে।

আমাদের বাসায় আমরা টিভি দেখতাম সবাই একসাথে বসে।এখন পঞ্চাশ বছর বয়সী দুইজন, কুড়ি এবং তার চাইতে সামান্য বেশি বয়সী দুইজন এবং দশ বছরের একজন, সবার দেখার মতোন অনুষ্ঠান কোনো চ্যানেলই দেখায় না। আমরা তাই আপাত নিরীহ নাটকগুলো দেখতাম, মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতাম। আবেগঘন সেরকম কোনো দৃশ্য আসলে যার হাতে রিমোট তার দায়িত্ব হলো অন্য চ্যানেল এ চলে যাওয়া এবং খানিকপরে ফিরে আসা। মাঝে মাঝে অবশ্য পালাতে গিয়ে আরো বিপদজনক চ্যানেল এ গোত্তা মেরে ফিরতে হোতো। একদিন স্টার মুভিজ এ Hollow Man দেখাচ্ছে। আর সবাই যার যার কাজে আর ক্লাস টু পড়ুয়া ভাইজান চোখ বড় বড় করে সিনেমা দেখছে। একটা দৃশ্যে, অদৃশ্য মানব নায়িকার অন্তর্বাস নিয়ে টানাটানি করছে, এই দেখে তার মন্তব্য হোলো, “হায় আল্লাহ! ছোট ব্লাউজটাও খুলে ফেল্লো!”

ছোটবেলায় মা মাঝে মাঝে মারতো। আমরা যখনি আভাস পেতাম যে আক্রমণ হতে পারে, তখনি বারান্দায় চলে যেতাম। আশেপাশের বারান্দায় মানুষজন আছে ,তাদের সামনে আমাদের সম্মানহানি মা করবে না, এই আশা আমাদের ছিলো। বেশি রেগে গেলো অবশ্য বারান্দায় গিয়েও কাজ হোতো না। তখন আশেপাশে তাকাতাম কেউ দেখলো কিনা, কেউ না থাকলে ঠিকাছে। আর মারামারির পরে বা ধমকাধমকির পরে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকতাম। রাগ দেখানোর একমাত্র উপায় হোলো না খেয়ে বসে থাকা। আম্মুকে তো আসতেই হবে রাগ ভাঙ্গাতে। আমার ছোটভাইকে বকাবকি করা হয়েছে। রীতি অনুযায়ী সে বারান্দায় মৌনব্রত পালন করছে। আম্মু একবার তাকে খেতে ডেকেছে সে আসেনি, তখন মনে হয় দুএক ঘা খেয়েছে। একটু পরে বাবা আবার তাকে ডাকতে গেছে এবং হুমকি দিয়েছে যে এখন খেতে না আসলে তাকে আরো নিপীড়িত হতে হবে। অশ্রু ছলোছলো চোখে তার জবাব, “মারেন, আরো মারেন। মারামারি ছাড়া আপনারা আর কী পারেন? আপনার বউ একটু আগে মাইরা গেছে, এখন আপনিও মারেন।”

আমাদের বাসায় বাজার থাকে না। বাবা নিয়মিত বাজারে যেতে চাইতেন না।আমিও যেতে চাইতাম না।কারণ, কেউ যদি কোনো কিছুর দাম বারোশো টাকা চায়, সেটার দাম আমি কিছুতেই দুইশ বলতে পারি না। আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। আর তারপরে যদি মাছওয়ালা বলে যে এই দামে মাছ পাইবেন্না, ল্যাঞ্জা খান, তখন মাথায় আগুন ধরে যায়। কাজেই রাস্তার ফেরিওয়ালারা যা আনতো আর ডিম, ব্রয়লার মুরগি এই দিয়েই বেশিরভাগ দিন চলতো। আমার ছোটভাই দেখি খাওয়ার সময় গোটা পাঁচেক গল্পের বই আর কমিক্স নিয়ে খেতে বসে। প্রতিদিন প্রায় একই বই নিয়ে বসে আর খাওয়া শেষ হবার সাথে সাথে বইগুলোও শেষ।আধা ঘন্টা লাগে খেতে এর মধ্যে তো সবগুলো পড়তে পারার কথা না। বইগুলো হচ্ছে অ্যাসটেরিক্স,মহাভোজ রাজভোজ, সুইস ফ্যামিলি রবিনসন, আঙ্গুল কাটা জগলু। বাকিগুলো তো সবারই চেনা বই, মহাভোজ রাজভোজ নিয়ে একটু বলি। প্রতাপকুমার মুখোপাধ্যায় এর লেখা এই বইয়ের বিষয়বস্তু হোলো, লেখক সারাজীবন যেখানে যেখানে খেয়েছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। একটু নমুনা দেই, একটা লাইন এমন , খুব সুন্দরী রমণীর গলা যেমন হাস্কি না হলে মানায় না, তেমনি নলেন গুড়ের সন্দেশ এ খানিক পোড়া গন্ধ না পেলে সেটা ঠিক জাতে উঠলো না। আমি ছোটলুকে বললাম,তো এগুলো ভাত খাবার সময় পড়বার মানে কি? আর এতো অল্প সময়ে এতোগুলো বই কিভাবে পড়ে? তার প্রত্যুত্তর হোলো, সে ওই বইগুলোর খাবারের বর্ণনা যেটুকু অংশে আছে সেটুকু পড়ে। কাজেই ভাত খাচ্ছে হয়তো আলু ভর্তা আর ডিম দিয়ে , কিন্ত সে ভেবে নিচ্ছে , অ্যাসটেরিক্স এর মতো বুনো শুকর এর রোষ্ট বা মহাভোজ রাজভোজ এর মত কাকোরি কাবাব, মাটন চাপ, চিকেন কাটলেট অথবা লখনৌ বা হায়দারাবাদি বিরিয়ানি।


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- হে হে হে
বেশ মজার তো!

আমার ছোট ভাইয়েরও বেশ কিছু মজার কাহিনি আছে। যেগুলো বলে বলে আমরা এখনও গড়িয়ে গড়িয়ে হাসি তার সামনে। দেঁতো হাসি
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

আব্দুর রহমান এর ছবি

আমরারেও এট্টু কন না, ফ্রব্লেম না থাইকলে।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

বক এর ছবি

আমি ঘরে সবার ছুডু।ছুডুবেলায় সবাইরে হাসাইছিলাম বইলা বড়বেলায় আইসাও শান্তি নাই মন খারাপ

আব্দুর রহমান এর ছবি

শান্তি নাই কেন? আপনার ছোটবেলার কাহিনী শুনতে চাই।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ মজা পাইলাম। হাসি

অনন্ত

আব্দুর রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

বাউলিয়ানা এর ছবি

হা হা হা...

মারেন, আরো মারেন। মারামারি ছাড়া আপনারা আর কী পারেন? আপনার বউ একটু আগে মাইরা গেছে, এখন আপনিও মারেন।”

-হাহাপগে!!

আব্দুর রহমান এর ছবি

একজন নিপীড়িত মানুষের কান্নায় আপনি হা হা প গে?

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

সাইদ এর ছবি

অসাধারণ............

আব্দুর রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক সুন্দর হইছে.............অনেক মজা পাইছি...........অনেক ধন্যবাদ

----অ্যামেচার----

আব্দুর রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

অতিথি লেখক এর ছবি

মজা পেলুম। কিন্তু ছোট হয়ে গেছে। আরো পড়তে চাচ্ছিলাম। মন খারাপ

নীল ভুত।

আব্দুর রহমান এর ছবি

অনেক বড়ই তো লিখলাম, আমার লেখা সবচাইতে বড় পোস্ট বোধহয় এটাই।

অনেক ধন্যবাদ। কেবল মজাই পেলেন? ছোটুর কষ্টটা টের পেলেন না?

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

নিবিড় এর ছবি

হো হো হো
মজা পেলাম আপনার ছোট ভাইয়ের কাহিনী পড়ে


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

আব্দুর রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

ভালো তো!

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

আব্দুর রহমান এর ছবি

ভালো লেগেছে শুনে আমারো ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।

আপনার ছড়াকার হয়ে উঠবার এবং জীবনের টানাপোড়েন এর কথাগুলো নিয়ে সিরিজটা অনেকদিন লিখছেন না, অপেক্ষায় আছি।

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

অতিথি লেখক এর ছবি

মজা পাইছি =))=))গড়াগড়ি দিয়া হাসি

সাবরিনা সুলতানা

অতিথি লেখক এর ছবি

দেঁতো হাসি
____________
ত্রিমাত্রিক কবি

নিঃসঙ্গ গ্রহচারী [অতিথি] এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।