রবীন্দ্রনাথ থেকে ঋতুপর্ণ

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি
লিখেছেন অনিন্দ্য রহমান (তারিখ: বুধ, ৩১/০৫/২০১৭ - ১১:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[পুরাতন ইমেইলে খুঁজে পাওয়া গেল। ৩০ মে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত‍্যুদিবস]

৪৯ বছর বয়সে এবং সৃষ্টিশীল অবস্থায় ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু নিঃসন্দেহে ভারতীয় চলচ্চিত্র ও ভারতীয় বাংলা ছবির জন্য আঘাত। সত্যজিৎ-মৃণাল-উত্তর জমানায় আন্তর্জাতিক আসরে ‘ভারতীয়’ ছবিকে গুছিয়ে তুলে ধরেন তিনি। ভারতের, বিশেষত পশ্চিম বাংলার, ‘স্বাধীন’ [ইন্ডি] চলচ্চিত্রকারদের উৎসাহ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, যদিও তার নিজের ছবিগুলো ঠিক ‘স্বাধীন’ গোত্রের নয়।

ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে উনিশ শতকের তথাকথিত বাঙালি রেনেসাঁর ধারাবাহিকতা (এবং ধারাবাহিক ক্ষয়িষ্ণুতা) কেউ কেউ লক্ষ্য করবেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে সত্যজিতের তৈরি 'চারুলতা' এবং একই লেখকের উপন্যাস নিয়ে ঋতুপর্ণের 'চোখের বালি'র তুলনা করেছেন কেউ। দুটোই 'রেনেসাঁ'র উন্মেষকালে বিত্তবানের ঘরোয়া প্রসঙ্গের, বিশেষত নারীর যৌন অবদমনের, অনুচ্চকণ্ঠের মেলোড্রামা। সত্যজিৎ রায় যেখানে গল্পকারের প্রতি মোটের ওপর বিশ্বস্ত থেকেছেন, ঋতুপর্ণ সেখানে গল্পের শেষটা পাল্টে ফেলেছেন। এতে মনে করা যায়, সত্যজিৎ বঙ্গীয় রেনেসাঁ-উপজাত সংবেদনশীলতার অধিকারী হলেও, সেই সংবেদনশীলতার বিকাশ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না, অন্যদিকে ঋতুপর্ণের মধ্যে ঐ সংবেদনশীলতার কালক্রমিক বিকাশ কিংবা ক্ষয় উপস্থিত।

রবীন্দ্রনাথকে ঋতুপর্ণ কীভাবে ব্যবহার করে গেছেন তাতে রবীন্দ্রনাথ ও ঋতুপর্ণ উভয়কেই বোঝা সহজ হতে পারে।

অবস্থাপন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে অনুমোদিত যৌন আকাঙক্ষা ও সম্পর্কের কাহিনী ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে বের হয় 'বঙ্গদর্শনে'। বিধবা নারীর মনোদৈহিক চাহিদার যে বিষয়টি উপন্যাসের আধেয়,তা মৌলবাদীদের আক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারত। রবীন্দ্রনাথ শেষে গিয়ে সকল সমাজবিরুদ্ধ প্রাণীকে লাইনে নিয়ে আসতে চান। অবদমিত নারী যৌনতার এই উনিশশতকী পরিশিষ্ট ঋতুপর্ণ বদলে দেন। এমনকি বিবধাবিবাহের মাধ্যমে বিধবার ‘মুক্তি’র যে প্রস্তাব উনিশশতকের উদারমনাদের কাছে বাজার পেয়েছিল সেটিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় ঋতুপর্ণের গপ্পো। নারী মুক্তির জন্য পুরুষের অভিভাকত্ব অনিবার্য নয়, তাই ঋতুপর্ণের চোখের বালি শেষ হয় উনিশশতকী নারীমুক্তির ধ্যানধারণাকে নস্যাৎ করে। তার বিধবা নায়িকা জানায়, নারীর কোনো দেশ হয় না। ‘দেশ’ বলতে – ঋতু নিজেই ব্যখ্যা করেছেন – ‘নিজের জায়গা’, জাতি বা জাতিরাষ্ট্র নয়। আরো অনুমান করা যায় ‘স্বদেশী’ জাতীয়তাবাদের মধ্যে নারীর নিজের জায়গাটিকে অগ্রাহ্য করার এই ফোকড় ঋতুপর্ণকে পীড়িত করেছে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ নারীর নিজের জায়গাটি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ভেবেছেন সেটি তার ছবিগুলোতে স্পষ্ট। তার সঙ্গে যা প্রাসঙ্গিক, সেটি হলো তার নিজের যৌনপরিচয়। কথনে, অভিব্যক্তিতে নারীসুলভ ‘মুদ্রা’র ব্যবহার এবং একপর্যায়ে কখনো নারীদের জন্য সমাজের বেঁধে দেয়া কাপড়চোপড় পড়ায় ঋতুপর্ণকে ‘আলাদা’ করে দেখার একটা বিষয় ছিল।

প্রায়শই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের লক্ষ্য ঋতু নিজে তার নারীত্ব নিয়ে অনুচ্চার ছিলেন না। তবে ‘পূর্ণ’ নারী হয়ে যেতে চেয়েছেন এমনটা কখনোই বলেননি। পুরুষের নারীভাব অনিবার্যরূপে চিকিৎসেয় নয়। বরং বুঝিয়েছেন মানুষের যৌনপরিচয়ে দ্বৈততা স্বাভাবিক তো বটেই বিরলও নয়। একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন উনিশ শতকের প্রধান নারীচরিত্র রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্গদায় নারী ‘কাহিনীর প্রয়োজনে’ পুরুষ সেজে থাকে, বলে ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী … যদি পার্শ্বে রাখ মোরে/সংকটে সম্পদে,/সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে,/পাবে তুমি চিনিতে মোরে’। ঋতুপর্ণের জীবনকালে মুক্তি পাওয়া শেষ ছবি ‘চিত্রাঙ্গদা’। অভিনয় করেছেন নারীচরিত্রেও।

ঋতুপর্ণের ছবিতে নারীত্বের উদঘাটন শিল্পোত্তীর্ণ কিনা, রাজনৈতিকভাবে যথার্থ কিনা, তাতে পরিমিতবোধের খামতি কিংবা আদিখ্যেতার আধিক্য আছে কিনা এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে, চলতেও পারে। কিন্তু পুরুষবাদী মিডিয়ায় নিজের নারীত্ব নিয়ে মিনমিনে সম্মতিভিক্ষা না করে যে দাপট ঋতুপর্ণ দেখিয়ে গেছেন, সেটি রবীন্দ্রনাথ থেকে উত্তরণের একটা বড় ধাপ বলে মনে করা যায়। শেষ ছবি নিয়ে ঋতুপর্ণ বলে গেছেন, ‘একদিন চিত্রাঙ্গদা তার জায়গা খুঁজে পাবে’।

ছবি: 
18/07/2008 - 11:49অপরাহ্ন

মন্তব্য

মন মাঝি এর ছবি

পুরুষবাদী বা সামন্তবাদীদের মতো ঋতুপর্ণ নিজেও কিন্তু নিজের মতো করে কমবেশি সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স, শভিনিজম বা অন্যকে ডিহিউম্যানাইজেশনের প্রবণতায় ভুগতেন ভিন্ন ক্ষেত্রে। এই হি্সেবে বললে ছবিতে বা তার বাইরেও তিনি যেসব ফেনোমেনার সমালোচনা করেছেন, বাস্তব জীবনে নিজেই বোধহয় সেরকম সাইকোলজিতে আক্রান্ত ছিলেন অনেকসময় (নারী, ট্রান্সজেন্ডার, গে, এফিমিনেট জাতীয় শব্দগুলি অন্যকিছু দিয়ে বদলে দিলে)। এটা কি ভণ্ডামি, নাকি ভিক্টিমরা যেমন অনেকসময় নিজেরাই ভিক্টিমাইজার হয়ে যায় বা নারীবাদীরা পুরুষবাদের সমালোচনা করতে করতে অনেকসময় যেমন নিজেদের অজান্তে নিজেরাই "পুরুষবাদী" সাইকোলজি এডপ্ট করে ফেলেন - সেরকম কিছু? জানি না। তবে এটা জানি যে বহু মানুষ, পাব্লিক পার্সোনালিটি বা সেলিব্রিটির ক্ষেত্রেই এটা ঘটে। এই সচেতন বা অসচেতন দ্বৈততা (আমি ভণ্ডামি বললাম না, তবে কেউ কেউ বলতেই পারে) অতিক্রম করার জন্য যতটা ম্যাচুরিটি, মানবিকতা আর ঔদার্য্য বা প্রজ্ঞা দরকার ছিল, তা তার ছিল না বলেই মনে হয়েছে।

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সিনেমা হল/সিনেপ্লেক্সে মুক্তি দেবার কথা ভেবে যারা চলচ্চিত্র বানান তাদের কেউই বোধকরি 'স্বাধীন'/'মুক্ত দৈর্ঘ্য'/'বিকল্প ধারা' ইত্যাদি তকমা পেতে আগ্রহী হন না। এই প্রকারের চলচ্চিত্রকারদের একাংশ বাজারের কাটতিকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মাণ করেন; বাকিরা নিজের ভাবনা, শিল্পের দাবী ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ এই দ্বিতীয় প্রকারের নির্মাতা।

দুটোই 'রেনেসাঁ'র উন্মেষকালে বিত্তবানের ঘরোয়া প্রসঙ্গের, বিশেষত নারীর যৌন অবদমনের, অনুচ্চকণ্ঠের মেলোড্রামা

এগুলো যদি সত্যি সত্যি তথাকথিত রেনেসাঁ'র অভিঘাত প্রকাশের চেষ্টা হয়ে থাকে তাহলে ব্যাপারটা করুণাকর। শ্রেণী নির্বিশেষে ভারতীয় নারীর যৌন অবদমনের গল্প কিন্তু কম-বেশি সর্বত্রই আছে। রূপবান বা মালঞ্চের উপাখ্যান কি এক অর্থে নারীর যৌনতার কাঙ্খিত রূপপ্রয়াসী নয়?

এতে মনে করা যায়, সত্যজিৎ বঙ্গীয় রেনেসাঁ-উপজাত সংবেদনশীলতার অধিকারী হলেও, সেই সংবেদনশীলতার বিকাশ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না, অন্যদিকে ঋতুপর্ণের মধ্যে ঐ সংবেদনশীলতার কালক্রমিক বিকাশ কিংবা ক্ষয় উপস্থিত

- চারুলতাতে সত্যজিত তো গল্পের শেষটা পাল্টেছেন। এজন্য এটা 'নষ্টনীড়' না হয়ে 'চারুলতা' হয়েছে। নষ্টনীড় আর চারুলতার তুলনায় আমার কাছে বুড়াকে ঢ্যাঙার তুলনায় অধিক বাস্তবোচিত ও প্রগতিশীল মনে হয়েছে। ঐতিহাসিক সামাজিক ঘটনাবলীজাত চেতনার ক্রমিক বিকাশের কথা যদি বলা হয় তাহলে সত্যজিত কি তাঁর কোন চলচ্চিত্রে সেটা দেখিয়েছেন? আমি নিশ্চিত না। এক একটি নির্মাণে তিনি বরং যে সময়কালটির চিত্রায়ণ করেছেন সেগুলোর প্রত্যেকটা বারোক চিত্রকলার মতো দক্ষতায় সূক্ষ্ম ডিটেইলে তুলে ধরেছেন। নিজের চিন্তার স্বাধীনতার প্রয়োগ করতে কোনরূপ দ্বিধাগ্রস্থ না হয়ে তিনি গল্প চিত্রায়ণ করেছেন কিন্তু বিকাশ বা ক্ষয়ের উপস্থাপনা তিনি করেননি। এই মতটা আমার ব্যক্তিগত।

অবস্থাপন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে অনুমোদিত যৌন আকাঙক্ষা

- অনুমোদিত নাকি অবদমিত?

তার বিধবা নায়িকা জানায়, নারীর কোনো দেশ হয় না। ‘দেশ’ বলতে – ঋতু নিজেই ব্যখ্যা করেছেন – ‘নিজের জায়গা’, জাতি বা জাতিরাষ্ট্র নয়। আরো অনুমান করা যায় ‘স্বদেশী’ জাতীয়তাবাদের মধ্যে নারীর নিজের জায়গাটিকে অগ্রাহ্য করার এই ফোকড় ঋতুপর্ণকে পীড়িত করেছে।

- গুড অবজারভেশন। এটা ঋতুপর্ণ বলেই বোধহয় দেখতে পেয়েছেন। নারী নির্মাতারাও দেখতে পাবার কথা। হয়তো দেখতে পানও, কিন্তু অমন চিত্রায়ণ এখনো দেখতে পাইনি।

তবে ‘পূর্ণ’ নারী হয়ে যেতে চেয়েছেন এমনটা কখনোই বলেননি

- শুনেছিলাম তিনি কিছু মাইনর সার্জারি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, এবং আরও মেজর সার্জারির পরিকল্পনা তাঁর ছিল। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে যা কিছু মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি সেটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। এটা নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি হয়নি, হলে কী জানা যেতো কে জানে!

নারী ‘কাহিনীর প্রয়োজনে’ পুরুষ সেজে থাকে

- লিঙ্গান্তরে আকাঙ্খা বা সমকামীতা যে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয় সেটা এখনো কতভাগ মানুষ মেনে নিতে পেরেছে? আমার মনে হয় এই 'কাহিনীর প্রয়োজন'গুলো এমনসব বিষয়গুলোকে একটু ভাণ-ভণিতার সাথে উপস্থাপনের চেষ্টা। কানু বিনা গীত নাই।

নিজের নারীত্ব নিয়ে মিনমিনে সম্মতিভিক্ষা না করে যে দাপট ঋতুপর্ণ দেখিয়ে গেছেন

- এই জায়গাটিতে ঋতুপর্ণ 'নিঃসঙ্গ শেরপা'। এই কারণে শেষের দিকের প্রায় সব চলচ্চিত্রে এই বিষয়টি অবধারিতভাবে এসেছে। এবং প্রায় সবগুলোতে তাঁকে নিজেকেই অভিনয় করতে হয়েছে।

লৈঙ্গিক পরিচয় এবং যৌনাকাঙ্খা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে সমাজ-সংসার ছড়ি ঘোরালেই সমস্যা। কিন্তু পরম পাকা বৃদ্ধদের সমাজে সহসা অবস্থার পরিবর্তন আশা করা যায় না। কারণ, লৈঙ্গিক পরিচয় এবং যৌনাকাঙ্খার এই ব্যক্তিক স্বাধীনতা মেনে নিলে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ধ্বসে পড়বে।

ফাইন চলচ্চিত্র নির্মাণে অচিরে অনেকেই হয়তো ঋতুপর্ণকে ছাড়িয়ে যাবেন, তবে লৈঙ্গিক পরিচয়ের সংগ্রামের জায়গাটিতে প্রয়াত ঋতুপর্ণকে আরও অনেক কাল একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

পুনশ্চঃ সার্চ ইঞ্জিনে আমাদের খোঁজাখুঁজির প্যাটার্নটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক। এখান থেকে সাধারণ মন্তব্য করা যায় বটে, তবে তাতে কিছু অতিসংবেদনশীল মানুষ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন। আজাইরা তর্ক করতে ভালো লাগে না। তাই এটা নিয়ে কিছু বললাম না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।