শুক্রবারের গন্ধ 


অনিন্দ্য রহমান এর ছবি
লিখেছেন অনিন্দ্য রহমান (তারিখ: বুধ, ০৬/০৩/২০১৯ - ৪:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কয়েক বছর আগে গ্রামের রাস্তায় উল্টাদিক থেকে আসা একটা গরুকে বাঁচাতে গিয়ে গর্তে পড়ে যাই। শুনেছিলাম— আমার বোন বলছিল— রাস্তাটা গাড়ি চলার মতো বড় হয়েছে।

বাড়ি ছেড়েছি গত শতকে। আম্মা চলে গেল হঠাতই। আসলে হঠাৎ-ই বা বলি কীভাবে। আমার স্মৃতিতে যতদিন আম্মা আছে ঠিক ততদিন আমাদের উনি মরার হুমকি দিয়ে গেছেন। সুতরাং ঘটনাটা ঘোষণা অনুযায়ীই ঘটল। আর যেকোনও পুরাতন উপন্যাসের নায়কের মতোই আমি পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়লাম। 
তারপর, কয়েক বছর আগে, আমি ফিরে আসতে পারতাম, যেকোনও পুরাতন উপন্যাসের নায়কের মতোই। কেবল মাঝের সময়টা আমি পৃথিবীর জয় করতে পারিনি।

বোন বলল— তুই যা, গেলে দেখবি চারিদিক কত সুন্দর আর গোছানো হয়ে গেছে। সবাই তোকে দেখতে চায়। কত্ত নাম করেছিস! সে গ্রামের সাথে যোগাযোগটা রাখে এখনও, পৃথিবীর উল্টোপিঠে থেকেও। তার কথায় উৎসাহী হলাম। সুন্দর আর গোছানো! কিন্তু শেষে হল এই, প্রত্যাবর্তনের নাটক করতে গিয়ে আমি একটা হাস্যকর তামাশার শিকার হলাম। কোনও পুরাতন উপন্যাসেই এমন কিছু ঘটবে না, লিখে দেওয়া যায়।


গরুটা বেঁচে গেল। গাড়িটা চারপাঁচজন মিলে সোজা করে নিলো। কেবল আমি বুঝলাম, আমি আর কোনও কিছুরই গন্ধ পাচ্ছি না।


ডাক্তার চল্লিশ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিনেমার মতো করে বলল, আই অ্যাম সরি, মানুষের স্নায়ু এভাবে নষ্ট হয়ে গেলে সারানো যায় না। নিজে থেকে সারতে পারে। ওষুধ কাজে লাগতেও পারে— তারপর আবার সিনেমার মতো করেই বলল, না-ও লাগতে পারে।


লোকে শুনতে পায় না, দেখতে পায় না, তারচেয়ে এটা সামান্য সমস্যা। খিদা লাগলে খান তো? তা খাই। তাহলে আরকি,— ডাক্তার বলে। লেখালেখি চলছে? ডাক্তার ছোট্ট টর্চবাতিটা কলমের মতো আঙুলে ঘোরায়। ঐ আরকি, লেখালেখি তো কিছু না, কলম চালানো। ডাক্তার বলে, লিখবেন। চিন্তাটাকে চালু রাখবেন। কারণ, ন্যাচারালি, আপনি যা যা করেন সেগুলি করতে থাকলেই — এইটুক বলে, ডাক্তার থামে। তারপরে, গোপন সংবাদ দেওয়া মতো করে বলে— থাক্, বেশি চিন্তাভাবনার দরকার কি! 


কিন্তু লিখতে গেলে ঝামেলায় পড়ে যাই। গল্প বলাটা সহজ, লেখাটা নয়। তাও লিখি, লিখলে স্মৃতি থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, আমার বোন বলে— তোর মতো লিখে ভুলে যেতে পারলে ভাল হত। আমি ভাবি, সেটা কি সহজ?— স্মৃতি থেকে নিস্তার? আমরা স্মৃতির সাথে, বিশেষত জীবনপ্রবাহের তুচ্ছ ঘটনাবলীর সাথে লেপ্টে থাকতে ভালোবাসি। আমরা নিস্তার চাই না। একটা ঘটনা থেকে আরেকটা ঘটনা, এক ধরনের তুচ্ছতা থেকে আরেক ধরনের তুচ্ছতায় ভ্রমণ, আমাদের একান্ত বিনোদন।


আজ থেকে বহু বহু বছর আগে গ্রামের রেল স্টেশনে একটা শিমুল গাছ ছিল। সেখানে প্রথম আমি ফেল করা ট্রেনের গন্ধ পাই। ভোরবেলা বাড়ি থেকে পালিয়ে স্টেশনে গেছি। আমাদের স্টেশনে সারাদিন একটাই গাড়ি থামত, সেটা সাড়ে ছয়টায়। বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত তার আগের রাতেই নেয়া। ভেবেছিলাম উত্তেজনায় ঘুম হবে না। কিন্তু গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম কী কারণে জানি। তারপর, হুশ হতেই দেখি আলো ফুটে গেছে। বাড়ির পেছেনে বেগুন খেত, তার পেছনে খাল, খালের পরে আরও খেতি জমি, জমির পরে, দূরে শিমুল গাছটা মাথাচাড়া দিয়ে আছে। 


দৌঁড়ে স্টেশনে যেতেই গাড়িটা ছেড়ে দিল। বেঞ্চিতে বসে হাঁপাই, তখনই, ফেল করা ট্রেনের গন্ধটা পাই। গন্ধটা কেমন, লিখে বোঝানো কঠিন— সেটা যেকোনও গন্ধের জন্যই খাটে। ট্রেনের গন্ধ, ট্রেনের ডিজেল ইঞ্জিন, আর লোহা, আর কমলা, বাদাম আর পেশাবের গন্ধ মিলে একটা রেল স্টেশনের গন্ধ হয়। সেটা তেমন নয়। আর যেখানে দিনে একটাই গাড়ি থামে, তাও পাঁচ মিনিটের জন্য, সেখানে, সেই স্টেশন স্টেশনের গন্ধ অর্জনের উপযুক্তই নয়।

যদি ব্যাখ্যা না করতে পারি, সে গন্ধটা কেমন, ভাল লেখকেরা পারতেন, আমি সেটা না, তখন দুয়েকজন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। নানা ধরনের ধাতব গন্ধের উদাহরণ মেলে ধরবে। তাদের আগাম ধন্যবাদ। কাসার থালায় গরম ভাত ঢাললে সেটার একটা গন্ধ হয় সেটা? উঁহু। শিলপাটায় বটি ঘষার আঁশটে গন্ধ? সেটাও না। আরও জটিল কিংবা সহজ কিছু কি? ভালো কিংবা খারাপ কিছু? কেউ বোকার মতো বলবে, আচ্ছা শিমুলের গন্ধ না তো? বোকার মতোও না আসলে, শিমুলের ফুলের গন্ধ আছে একরকম। কিন্তু তার বর্ণনা দিতে পারতেন বিভূতিভূষণ। তিনি ঘেটু ফুলের গন্ধ নিয়ে একপাতা লিখেছেন। তার গন্ধ নাকি 'তেতো তোতো'।  তেতো তেতো! আমরা কেমন করে যে বলি কোনও কোনও ফুলের গন্ধ নাই। গোলাপের গন্ধ নিয়ে আহ্লাদের শেষ কি, অথচ চন্দ্রমল্লিকা, যাকে দেখলেই আমার স্বাস্থ্যবতী প্রতিবেশী কথা মনে পড়ে, সেটার, ঐ মেয়েটির গায়ের গন্ধ নিয়ে আমার আহ্লাদের অন্ত নাই। মাঝে মাঝে সেটাও মনে করার চেষ্টা করি। 

আমি গন্ধ জিনিসটাকে অন্যভাবে ব্যখ্যা করতে লাগলাম। তেতো তেতো বা মিষ্টি কিংবা আরও যেসব খাদ্যদ্রব্যের স্বাদ দিয়ে মানুষ ফুলের গন্ধকে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করেছে, এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমি সজাগ হই। ফুল খেয়ে দেখতে তেতো কিংবা কষটে লাগতেই পারে। খেয়ে তো কেউ দেখে না। ফেল করা ট্রেন আমি খেয়ে দেখিনি, আর সেটা কোনও প্রকার ফুলও নয় নিশ্চিত। যদিও আমাদের স্টেশনটা একটা শিমুল গাছের তলায় ছিল। 

দুর্ঘটনার পর থেকে আমি বিচিত্র গন্ধের স্মৃতিতে কাতর হয়ে পড়ি। তবে শহরে আসার পরে আবিষ্কার করেছিলাম শুক্রবারেরও একটা গন্ধ রয়েছে। শুক্রবার দুপুরের। সেসময়, শুক্রবার দুপুর বেলা মানুষজন খুব একটা বের হত না। রাস্তাঘাট ফাঁকাই থাকত। বাসা থেকে আমিও বের হতাম কি? মনে হয় না। এই একদিনই দুপুরবেলা বাসায় থাকতে পারতাম আর ঐ দুপুর বেলাতেই গন্ধটা পেতাম। একদম দুপুর না, একটু বিকালের দিকে। অনেকদিন অনুসন্ধানের চেষ্টা করি, কোথা থেকে আসে? শুক্রবার দিন ভালমন্দ রান্না হয় কোনও কোনও বাসায়। পোলাউ? গরুর মাংস ইত্যাদি ইত্যাদি? সেরকম কিন্তু না। একদিন আবিষ্কার করি সেটা মাড় দেওয়া শাড়ি আর জেট পাউডারে ধোয়া কাপড় আর দুপুরের রোদ মিলে তৈরি হয়। কিন্তু সেটা কি অন্য দিনগুলিতেও হতে পারত না? 


কখনও কখনও ভোরবেলা পৃথিবীর উল্টোপিঠে থাকা আমার বোন আমাকে ফোন দেয়। শুক্রবারের গন্ধ বলে কিছু জানিস? উইকেন্ড?— সে জানতে চায়। নাহ, উইকেন্ড না ঠিক, ঢাকা শহরে, শুক্রবার? এখনকার না, ধর, লেইট নাইন্টিস পর্যন্ত পাওয়া যেত। দুপুরের দিকে। আমি ওকে সাহায্য করতে চাই। সে গম্ভীর গলায় বলে, তো, সেটা যখন বন্ধ হয়ে গেল, মানে যেদিন থেকে গন্ধটা আর পাচ্ছিলি না, তার আগে পরে কিছু মনে আছে? তুই কি তখনও ধানমন্ডি থাকতি না? নাকি উত্তরায় চলে গেছিলি ততদিনে? ধানমন্ডির গন্ধ না তো আবার? সে আর আমি একটা বিশেষ জায়গার কথা মনে করি হাসতে থাকি।

আরেকদিন প্রকৌশলী বন্ধু হাসানের সঙ্গে দেখা। ডাক্তারের চেম্বারেই। সে বলে, নাইনটিসে অনেকগুলি গন্ধ ছিল, বুঝলা, যেটা আর পাবা না। যেমন ঢাকা থেকে টু-স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি উঠে যাওয়ায়, আনবার্নড হাইড্রোকার্বন কমে গেছে, তাতে বাতাসের গন্ধ বদলানোর কথা। রাস্তাঘাটে। কিন্তু সেটা কি শুক্রবার করেই মনে পড়বে শুধু! হাসানকে পাল্টা প্রশ্ন করি না। থাক। 


তারপর আমরা বেবিট্যাক্সি আর সিএনজি নিয়ে আলাপ করি কিছুক্ষণ। বেবিট্যাক্সির মালিকরাই কি সিএনজিগুলি কিনেছিল? লোনটোন নিয়ে? বেশিবেশি লোন থাকায় নাকি তাদের বেশিবেশি ভাড়া তুলতে হত। আমরা মিনিস্টার ও তার আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে আলাপ করি। তেলের বদলে গ্যাস দিয়ে গাড়ি চলার ভাল দিক মন্দ দিক রাজনীতি পরিবেশ এইসব। তেলের আন্তর্জাতিক দর, ভেনিজুয়েলা আর ইরানের মতিগতি। আমার বোন বলছিল— সামারে ব্রেক আছে, চলে আয়। আমাদের এদিকটায় তেলের দাম পানি দর হয়ে গেছে। তোকে ইচ্ছামতো ঘুরাবো ফিরাবো। অন্যসময় আসলে উইকেন্ড ছাড়া পারব না। 


শুক্রবার নিয়ে আমি ভাবতে থাকি। 


বৃহস্পতিবার বিকালে আব্বা বাসায় আসত। বৃহস্পতিবার রাতের গন্ধ ছিল বড় বড় করে কাটা আলু আর গরুর মাংসের তরকারির। আম্মা দুপুর থেকে ঐ একটা কাজই করতেন। তিনি রান্নাবান্না পারতেন না তেমন একটা। একটা কিছু রান্না করতে তার ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেত। আমরা ডাল ভাল ডিম আলুভর্তা অথবা বেগুনভর্তা দিয়ে বেশিরভাগ দিন খেয়ে নিতাম। আমরা নিজেরাই বেগুন তুলে আনতাম। আব্বা আসত তার মটরসাইকেলে করে। একটু দূরেই থামত, বেগুন খেতের ধারে। বেগুনগাছগুলির নিচে সুলেখা। আব্বা ডাকত সুলি। সুলি দৌঁড়ে দৌঁড়ে ভিতরে গিয়ে আম্মার কাছে গিয়ে জড়সড় হত। তোমার মেয়ে আমাকে ভয় পায় কেন? 


একসময় আম্মা তার একমাত্র ‘ভালো’ রান্না শেষ করে আনে। আমরা টেবিলে বসে বেশিবেশি এলাচ আর তেজপাতা দেওয়া গরুর মাংস খাই। কিন্তু আমার মন জুড়ে থাকে ঐ সুন্দর গন্ধটা। আব্বা আমাকে বিকালে এসেই কোলে তুলে নিত। ঠিক তখন পেতাম। একদিন রাতে অনেক ঝগড়াঝাঁটির শেষে, আম্মাকে বলতে শুনি— তোমার শার্ট থেকে পর্যন্ত ঐ মেয়েটার গন্ধ পাওয়া যায়। আমি ঐ গন্ধটা সম্পর্কে আরেকটু জানতে পারি। শনিবার আব্বা আবার কাজে যাওয়ার আগে, শার্টটা ইস্ত্রি হয়ে ফেরত আসে। আমি খরখরে কাপড়কাঁচার সাবান আর গরম ইস্ত্রির ধাতব গন্ধ ভেদ করে ‘ঐ মেয়েটার গন্ধ’ পাই। 


ঐ মেয়েটাকে, মানে ঐ মহিলাকে আমি বহুবছর পরে, আমাদের জেলা শহরের একটা অনুষ্ঠানে দেখতে পাই। কেউ একজন বলে— ইনিই উনি। আমার আম্মা নিশ্চিত ওনার থেকে সুন্দর ছিল। কেউ একজন আমাকে তার সামনে নিয়ে যায়। কেমন আছো বাবা? তোমার বোন আসেনি? খরখরে কাপড়কাঁচার সাবানের আর গরম ইস্ত্রির ধাতব গন্ধ পাই। কিংবা এলাচ আর তেজপাতার ঝোলের। 


শুক্রবারদিন আম্মা সারাদিন কান্নাকাটি করত। সুলেখাকে নিয়ে আব্বা মটরসাইকেলে ঘুরত। এলাকার লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলত। বাজার থেকে এটাসেটা কিনে দিত। আম্মা বলত— সপ্তাহে একটা দিন, বাপের সাথে থাক, আমার পিছে পিছে ঘুরিস না। আমি মরলে পরে তোর বাপ সৎ মা নিয়ে আসবে। বাপের সাথে খাতির রাখ। আমি শুক্রবার দিনটা কখনও আম্মাকে হাতছাড়া করি নাই।  


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

কোন কোন লেখা নিজের ব্যক্তিগত বেদনা থেকে শুরু হয়ে বৃহত্তর বেদনার জগতে উত্তীর্ণ হয়ে যায় - এরা মহৎ সাহিত্য। অনিন্দ্যর এই লেখাটি সেই মহত্ত্বে পৌঁছে গেছে। অসাধারণ। ৫ তারা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

নিছক গল্প । অনেক ধন‍্যবাদ মন্তব‍্যের জন‍্য।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লেখার মাঝখানে হঠাৎ হঠাৎ L SEP লেখা একটা সিম্বল আসছে, এটা কী?
ব্যখ্যা > ব্যাখ্যা।

খুব সম্ভাবনা নিয়ে জীবন শুরু করা এক সহপাঠীকে নিয়ে চলা রিক্‌শাকে পেছন থেকে বাস ধাক্কা দেয়। দৃশ্যত সে খুব বেশি আঘাত পায়নি, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে সে অচল হয়ে যায়। অফিস থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ধার করে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করে ফেরে। তার বাকি জীবনটা যাবে ধার শোধ করতে করতে। স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত না পেয়েও এভাবে একটা মানুষ পঞ্চইন্দ্রিয়ের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে।

স্মৃতিতে বড় ঘটনাগুলোর বিশেষ কিছু থাকে না। থাকে বড় ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ছোট ঘটনা। তারচেয়ে বেশি মনে থাকে দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়গুলো। কারণ, ওগুলো কয়লার স্তুপের মধ্যে গড়ে ওঠা হীরকখণ্ড।

পানসে, নোনতা, টক, মিষ্টি, ঝাল, তেতো - স্বাদগুলোকে যেভাবে খুব স্পষ্ট করে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে গন্ধকে সেভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়নি - আসলে শ্রেণীবিভাগ করা যায়নি। তাই গন্ধগুলো হয় অমুক ফুলের, তমুক ফলের, সমুক বর্জ্যের, নমুক বস্তুর। কিন্তু আমাদের বাসার গোলাপীরঙা ছোট গোলাপ ফুলের গন্ধের সাথে মৃদুলদের বাসার বিশাল আকারের কমলা গোলাপের গন্ধের যে কোন মিল নেই সেটা কী করে বোঝাবো? তাহলে গোলাপের সুবাস বলে একক কোন সুবাস কি হয়!

প্রত্যেকটা সময়ের গন্ধ থাকে, প্রত্যেকটা স্থানের গন্ধ থাকে, প্রত্যেকটা কালের গন্ধ থাকে। একবার এক প্রখর দুপুরে ভারতের এক অখ্যাত শহরে রোদের গন্ধ আমার নাক দিয়ে ঢুকে মাথায় স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। তার অনেক বছর পরে আরেক রোদের দিনে বনানী বাজারের কাছে বাস থেকে নামতে সেই রোদের গন্ধ আমার তন্ত্রীতে আবার ঘাই মারে। তারপর থেকে হঠাৎ হঠাৎ করে সেই রোদের গন্ধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় - এমনকি হিমাঙ্কের তাপমাত্রায় গভীর রাতে - অনেকটা বসুধার স্মৃতির মতো।

আশির দশকে কোরিয়া ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশনের ওভারসিয়ার পর্যায়ের এক কোরিয়ান লোক ইটখোলার এক রাঁধুনীকে 'কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ' করে আমাদের পাশের বাসার এক ফ্ল্যাটে রাখে। তার ওপর রিকশাওয়ালারা খুশি ছিল কারন সে ৩ টাকা ভাড়ার জায়গায় ২০ টাকা দিতো। বাড়িওয়ালা তার ওপর খুশি ছিল কারণ সে আড়াই গুণ ভাড়া দিতো। সেই কোরিয়ান সপ্তাহে একদিন (রবিবার) আসতো, তাদের বছর বছর সন্তান জন্মাতো। তবু দেখা যেতো তার ‘কন্ট্রাক্ট ওয়াইফ’ খুশি আছে। সে জানতো আরও পাঁচ বছর পরে বাচ্চাকাচ্চাসহ তাকে ফেলে এই কোরিয়ান তার দেশে চলে যাবে – তবু দেখা যেতো সে খুশি আছে। তার সাথে আশেপাশের কোন ভদ্রমহিলা মিশতো না – বেশ্যার সাথে কি ভদ্রমহিলারা মিশতে পারেন! তার বাচ্চাদের সাথে অন্য বাচ্চারা খেলতো না — বেশ্যার বাচ্চার সাথে ভদ্রলোকের বাচ্চারা খেলবে কেন! তবু দেখা যেতো ঐ পরিবারের সবাই খুশি ছিল। তারা আসলে খুশি ছিল কিনা সেখবর আমরা রাখতাম না। যেমন আমরা খবর রাখতাম না সপ্তাহে একবার বা মাসে একবার বা অনিয়মিতভাবে বাড়ি আসা বাবাদের পরিবারগুলোর মানুষ, যেমন সালামদের পরিবার, শাহীনাদের পরিবার বা মালতীদের পরিবার, আসলে খুশি ছিল কিনা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ব‍্যাখ‍্যা ঠিক করলাম।
সিম্বল তো দেখতে পা্ই না।
বিজয়ের লে-্আ্উট ব‍্যবহার করে বাংলা, ম‍্যাকের মেশিনে, ব্রা্উজারের ভিতরে --- নিয়ন্ত্রণ না্ই

আপনার মন্তব‍্যে দু্ইটা অনুগল্প লুকিয়ে ্আছে। তাতে ৫ তারা। বাকিটা সাক্ষাতে


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেখা অনিন্দ্য রহমান। আপনি নিয়মিত লিখলে দারুণ হয়।

---মোখলেস হোসেন

তাসনীম এর ছবি

লেখাটা চমৎকার লাগলো। লেখাটাতেও স্মৃতি জাগানিয়া গন্ধ আছে। আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়র মধ্যে সাড়ে চারটা কার্যকর। স্নায়বিক এক রোগে ডান কান প্রায় শ্রবনশক্তিহীন হয়ে গেছে।আমি শুনেছি গন্ধের স্নায়বিক সমস্যা সেরে জেতে পারে। আমি হুমায়ূন আহমেদের একটা লেখাতে পড়েছিলাম, ওনারও এই সমস্যা হয়েছিল এবং ফাইনালি সেরে গেছে। আশাকরি আপনারটাও সেরে যাবে। আরও অনেক কিছু লিখতে চাইছিলাম, কিবোর্ড ধরার পরেই সব ভাবনা উধাও। ভালো থাকুন।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

কনফুসিয়াস এর ছবি

খুব ভালো লাগলো লেখাটা। বহু আগের জমজমাট ব্লগ, যেখানে হরদম ভালো লেখা আসছে, ভালো গল্প আসছে আর আমরা মন্তব্য করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছি, ঠিক সেরকম একটা গন্ধ পেলাম যেন লেখাটায়।

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

পৃথ্বী এর ছবি

আমার স্মৃতিগুলো গানের সুরে মুদ্রিত হয়। কিছু কিছু গান শুনলে বহু বছর আগে অটোরিকশায় চেপে ইনানী বিচে যাবার পথে সূর্যাস্তের লাল স্ফূরণে চোখ ঝলসে যায়। কিছু গান শুনলে বুয়েটে প্রথম ব্যাচ প্রোগ্রামের নিশীথ রাতে ক্যামপাসে গাছ ও কাঁদামাটির গন্ধ পাই। বাংলাদেশ ছেড়ে আসার দিন কোন গান শুনিনি, সেই দুঃসহ স্মৃতি চাইনি কোথাও লিপিবদ্ধ থাকুক। কিছু গান শুধু সেন্ট ক্যাথেরিন স্ট্রিটে মধ্যরাতে পদচারণার সময় শুনি; যদি বা যখন দেশে চলে যাবো, এই গানগুলো মন্ট্রিয়লের আটলান্টিক হীমবায়ু হয়ে দেশের বিষুবীয় গরমে কাঁপুনি ধরিয়ে দিবে।

মোবাইলের প্লেলিস্ট আমার অবিনশ্বর ফটো অ্যালবাম।


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

মাহবুব লীলেন এর ছবি

অদ্ভুত বর্ণনার ধরন। রীতিমতো ঘোর লাগা; আমার তো মনে হইতেছিল বাক্যেরও গন্ধ পাইতেছি আমি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

খুবই চমৎকার লেখা। মাঝে যেয়ে সামান্য একটু মনোযোগ নড়ে গিয়েছিল, তবে শুরুটা, আর শেষ, অসাধারণ।
গন্ধের ব্যাপারে বললে, শুক্রবার দুপুরে (এখন অফিস থাকে, আগে যখন শুক্রবার ছুটির দিন ছিল...) আমি বাসার গলিতে সাবানেধোয়া কাপড়ের গন্ধ আর মুরগির ঝোলের গন্ধ পেতাম। হতে পারে মনের ভুল, তবে এটা একদম আলাদা একটা গন্ধ, যেটা অন্যসময়, অন্যদিন পাওয়া যায় না অতটা। গান যেমন কোনো স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পারে, গন্ধও অনেকটা তাই।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

কী মায়াময় একটা লেখা! ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। এই গন্ধ ব্যাপারটা আধিভৌতিক। প্রতিটা মানুষের এই গন্ধ ব্যাপারে কিছু না কিছু অনুভূতি কাজ করে। প্রতিটা গানের মধ্যে আমি সময়ের গন্ধ খুঁজে পাই। যখন যে গানটা প্রথম শুনেছিলাম, বিশেষ সেই গানগুলো একই গন্ধ নিয়ে হাজির হয় বহুবছর পরেও। শব্দের মধ্যেও একটা গন্ধ কাজ করে, সময়ের ঘ্রাণ পাওয়া যায় গানের সুরে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।