বাজার-যুগে গণসৃষ্টির মুক্তাঞ্চলে সৃষ্টিপণ্যের মালিকানা এবং চুরি-চামারির কথা

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি
লিখেছেন শাহ্ আসাদুজ্জামান [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৯/০২/২০০৯ - ৭:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সচলের সাম্প্রতিক দুটো লেখায় [নজরুল][ইমরুল] সচলয়াতনের মত মুক্ত-মাধ্যমে সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের মালিকানা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছে। কিছু কিছু আংশিক সমাধানও এসেছে। প্রসঙ্গক্রমে আমি বলছিলাম, যেহেতু তথ্য-প্রযুক্তিই এমন মুক্ত-মাধ্যমকে সম্ভব করে দিয়েছে, তাই এ থেকে উদ্ভুত সমস্যাগুলোর সমাধানের দায় তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের ঘড়েও কিছুটা পড়ে। সেই দায় থেকেই লিখছি।

প্রশ্নগুলো যদিও নতুন নয়, তবু সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিকতা থেকেই আলোচনার প্রয়োজন মনে করছি।

প্রশ্ন এসেছে এখানে লেখা সাহিত্যের মালিকানা কার হবে? কিভাবে সেটাকে রক্ষা করা যাবে? আবার সাথে সাথে প্রযুক্তির সহায়তায় সৃষ্ট সাহিত্যকর্মকে জনমনে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়ার যে সহজলভ্যতা, সেটাও কেউ অস্বীকার করছিনা।

মালিকানা রক্ষার ঐ প্রশ্নে আসলে দুটো শক্তির একটা দ্বন্দ্ব সামনে উঠে এসেছে। এক দিকে হল পুজিবাদের বিকাশের ফলে সৃষ্ট সাহিত্য-পণ্যের মালিকানা রক্ষার টান, অন্যদিকে সাহিত্যকর্মকে দ্রুত স্থান-কালের সীমানা পেরিয়ে সব মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেবার আকুতি।

আমি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উদ্ভবকে মানুষের ভাব বিনিময়ের মাধ্যমের বিকাশের একটা ধাপ বলেই ভাবি, যেটা মুখের ভাষা, লেখার ভাষা, কিম্বা ছাপা মাধ্যমের আবিষ্কারের মতই যুগান্তকারী একটা ধাপ। প্রতিটি ধাপই সহজ থেকে সহজতর উপায়ে এক মানুষের মনের কথাকে অন্য মানুষের মনে পৌঁছে দিয়েছে।

এখন তাহলে মালিকানার কি হবে? মালিকানার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? যুগটা যেহেতু বাজার অর্থনীতির, সাহিত্য-পণ্যের বেচাকেনার অর্থ দিয়েই যেহেতু সাহিত্যিকের অন্ন-সংস্থান, তাই এটাকে বাজারের নিরিখেই ভাবতে হবে বৈকি।

এবিষয়ে তথ্য-প্রযুক্তি জগতে বেশ অনেক বছর আগে থেকেই কথা-বার্তা হয়েছে, হচ্ছে। সেখানে মুক্তধারার প্রযুক্তিবিদদের সাথে বাজার-ধারার প্রযুক্তিবিদদের এখনো তুমুল সংঘাত বিদ্যমান। আবার প্রযুক্তির আগমনে শিল্পকর্মের মুক্তি যখন অনস্বিকার্য হয়ে পড়েছে, তখন ঐ মুক্ত-স্রোতে কিভাবে বাজারকে টিকিয়ে রাখা যায়, সে নিয়েও চিন্তা-চর্চা কম হয়নি। এসব সংঘাতের ফলশ্রুতিতেই উঠে এসেছে GPL, BSD, Creative-commons জাতীয় নতুন ধরণের নীতি বা আইন।

নজরুল ইসলামের রচনায় ইশতিয়াকের মন্তব্যে মুক্তধারা আর বাজারধারার সমন্বয়মুখী কিছু প্রস্তাব উঠে এসেছে। আর ইমরুলের রচনায় সাহিত্যপণ্যের চুরি ঠেকানোর উপায় হিসেবে উঠে এসেছে Creative commons এর প্রস্তাব।

আমি নিজে মুক্তধারার পক্ষের লোক। অতএব ঐ সংঘাতে আমার অবস্থান GPL বা Creative Commons এর পক্ষে।

এখন প্রশ্ন সচলায়তনের মত গণসৃষ্টির মুক্তাঞ্চলে শিল্পকর্মের মালিকানার ধরণ কি হবে? আমি ব্যক্তিগতভাবে সচলায়তনকে মুক্তধারার পক্ষের শক্তি মনে করি, এর মালিকানা GDPL বা Creative Commons আইনমতে মুক্তভাবে জনগণের হাতে থাকাই সমীচিন মনে হয় আমার কাছে, তবে এব্যাপারে সবাই একমত নাও হতে পারেন।

বাস্তব কিছু সমস্যা আছে এক্ষেত্রে। যদ্দুর জানি, ওসব আইনের মূল কথা হল মুক্তাঙ্গনে সাহিত্য বা শিল্পকর্মকে একবার ছেড়ে দিলে, তা দিয়ে পরবর্তীতে আইনত কেউ বানিজ্য করতে পারে না। সেক্ষেত্রে সচলে লেখা সাহিত্যকর্মকে বই আকারে প্রকাশ করলে এর মেধাস্বত্ব বলে কিছু থাকবে কিনা, থালে তা কার হবে, বিক্রীলব্ধ অর্থ কে পাবে, এসব নিয়ে প্রশ্ন আসে।

ব্লগের মত যৌথ প্রযোজনার সাহিত্যকর্মে আরো একটা সমস্যা আছে। যেমন, আমি ১০ লাইনে সাদামাটা কিন্তু প্রশ্ন/বিতর্ক উদ্রেককারী একটা পোস্ট দিলাম, এতে মাহবুব-লীলেন এসে ১০০ লাইনের গভীর চিন্তাধর্মী একটা মন্তব্য রাখলেন। এখন এই পোস্ট নিয়ে আমি যদি বই ছাপাতে যাই, তাহলে প্রচলিত আইনে এর মেধাস্বত্ত্বের অধিকারী আমি হই কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আসে।

লক্ষ্য করুন, ব্লগে সৃষ্ট সাহিত্য কর্ম নিয়ে বই প্রকাশ করাকে আমি ঐ সাহিত্যকর্মের জনবিস্তৃতির পক্ষের একটা ধাপ বলেই ভাবছি, এর বিরোধিতা করছিনা। প্রশ্ন করছি এর মালিকানা কার হবে তা নিয়ে।

মালিকানার দুটো দিক আছে। একটা হল সৃষ্টির যে সামাজিক সুনাম বা সম্মান তার মালিকানা, আরেক হল বাণিজ্যলব্ধ অর্থের মালিকানা।

সুনামের মালিকানা কোন ব্লগের সকল অংশগ্রহণকারীর যৌথ হওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি। আর বাণিজ্য যদি হয়, তাহলে সেটার অর্থ এক মতে এই সচলায়তন সংঘেরই পাওনা হয়, যা দিয়ে এই সংঘ তার নৈমিত্তিক ব্যয় চালাতে পারে। তবে এব্যাপারটা ঠিক প্রশ্নাতীত নয়।

তৃতীয় আরেক ধরণের মালিকানা আছে, সেইটা হল কপিরাইট। মানে এখানকার লেখা কেউ কপি করতে গেলে আইনত কি হবে? GPL বা Creative Commons এর মত মুক্তধারার আইন অনুযায়ী এখানে লেখা যে যখন যাকে খুশি তার কাছে বিলোতে পারবে, শর্ত হল লেখকদের নাম আর সচলায়তনের নাম উল্লেখ থাকতে হবে তাতে। এটা সচলায়তনের বর্তমান কিছু নিয়মনীতির পরিপন্থী হতে পারে, সেটা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।

আরেক ধরণের লাইসেন্স আছে (BSD style) যেখানে শিল্পকর্মের প্রাথমিক স্রষ্টাকে তার নিজ স্বার্থে ঐ শিল্পকর্ম নিয়ে ব্যবসা করার এবং শিল্পকর্মের বিতরণ বন্ধ করার অধিকার দেয়া হয়। এটা বাজারধারা আর মুক্তধারার সমন্বয়কারীদের কাজ। আমি নিজে ঠিক এটার পক্ষপাতী নই। তবে আলোচনা হতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্লগের মত যৌথ-প্রযোজনার শিল্পকর্মের প্রাথমিক স্রষ্টা কে এবং তার অধিকার কতখানি সে প্রশ্ন আসে।

আরো হয়ত প্রশ্ন আছে, সেগুলো আলোচনায় উঠে আসতে পারে। সচলের ওয়েবসাইটে এখানকার সাহিত্যকর্মের মালিকানা বা লাইসেন্সের ব্যাপারে কোন তথ্য নেই বলেই মনে হল।

তবে মুক্তাঞ্চলের লেখা চুরি করে চোরেরা যখন ব্যবসায়ে মেতে উঠেছেই, তাহলে মুক্তধারার স্বার্থেই এর প্রতিকারের ব্যবস্থাও করতে হয় অতি শীগগির। সেজন্যই আলোচনা হওয়া জরুরী।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই বিষয়টা নিয়ে আমি আসোলে কিছুটা ঘোরের মধ্যে আছি
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কিছু সাহিত্য কিংবা শিল্প বিশ্বমালিকানাধীন
আমি নিজেও তার মালিক

জীবনানন্দের একটা কবিতা কিংবা বই ফটোকপি করে বিশজনকে দিতে আমার বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ কাজ করে না
বরং এতে কেউ কোনো কথা বললে উল্টা তারে আমি গালি দেই

আমি মনে করি জীবনানন্দের কবিতা- ওটা জীবনানন্দের কবিতা বলে কাউকে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই এবং এক্ষেত্রে জীবনানন্দের উত্তারধিকার আপত্তি করলেও আমি শুনতে রাজি না

০২

আমার নিজের লেখা যদি কেউ তার নামে না ছাপায় এবং বিকৃত করে না ছাপায় তাহলে আমার কাছে খুব একটা আপত্তিকর মনে হয় না
কারণ লেখালেখিটাকে এখনও আমি স্বত্ব দিয়ে বিচার করতে পারি না

০৩

ব্লগের লেখায় আমি যেসব কমেন্ট করি আমি ধরে নেই ওগুলোর মালিক পোস্টের লেখক
তবে অবশ্যই লেখার স্বীকৃতিটা আমার

তানবীরা এর ছবি

সুন্দর জবাব লীলেনদা।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

তানবীরা এর ছবি

সুন্দর জবাব লীলেনদা।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হুম... জটিল আলোচনা... এটা নিয়ে কিছু ভাবনা আছে... একটু পড়াশোনা করতেছি... কপিরাইট আইনের একটা বই ক্রয়িত হবে আগামীকাল... আরেকটু পড়েশুনে নেই...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এই নিয়ে চতুর্থ বার ঢুকলাম পোস্টটায়। সাধারণ নিয়ম হিসেবে কোনটা সিদ্ধ, সে-বিষয়ে নিশ্চিত না দেখে কিছু লিখিনি।

ব্যক্তিগত অভিমতটা বলি।

একটি "লেখা" মানুষকে 'নাম' অথবা 'যশ' দেয়। একটি লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছার পেছনে 'লেখক' ও 'প্রকাশক/পরিবেশকের' ভূমিকা থাকে। এই ব্যাপারে জটিল গ্রিড এঁকে অনেক কিছু দেখানো যায়। সেই ঝামেলায় না গিয়ে এটুকুই বলি -- এই চারটি উপাদানের কোনটির দিকে বৈষম্যপূর্ণ ভাবে পাল্লা ঝুঁকে থাকা ঠিক না। এ-ব্যাপারে সবারই সচেতন থাকা উচিত।

কোন লেখা যদি সব কূল ছাপিয়ে যাওয়ার মত হয়, তবে আপনা থেকেই তার উপর সমকালীন সকলের অধিকার জন্মে যায়। সেক্ষেত্রে যশের প্রসঙ্গে ছাড় দেওয়া উচিত, এবং সুলেখক মাত্রই তা খুশি মনেই করবেন। এরকম ক্ষেত্রে লেখককে সামাজিক ভাবে সম্মানিত করা উচিত। সেই সাথে তাঁর নৈমিত্তিক জীবিকার ব্যাপারে সরকারের নজর থাকা উচিত।

চুরির ব্যাপারে কিছু বলবো না। ওটা ঘৃণ্য, শাস্তিযোগ্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।