কিছুটা আঞ্চলিক সম্প্রদায়বোধের চর্চা

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি
লিখেছেন শাহ্ আসাদুজ্জামান [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৮/০১/২০০৯ - ৪:২৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অর্ঘ্য, গৌতম, রাগিব আর আমার "সাম্প্রদায়িক" হাসি পোস্ট নিয়ে ধর্ম-সম্প্রদায় বোধের তো অনেক চর্চা হল। সেটা চলছে চলুক। তার পাশাপাশি চলুন আঞ্চলিক সম্প্রদায়বোধের কিছু চর্চা করি।

ভাষার মাস আসছে, তাই চর্চাটা ভাষা নিয়েই হোক। সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুর সহ আমাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চমতকার ভাষা বৈচিত্র আছে। এমনকি সিলেট এবং চট্টগ্রামের মত অঞ্চলের ভাষাগুলো প্রমিত বাংলার চেয়ে এতটাই আলাদা যে এসব অঞ্চলের লোকেরা সচেতন সম্প্রদায়বোধ নিয়ে তাদের ভাষাকে সংরক্ষণ করেন, এবং তাদের ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা বললে রীতিমত রাগ করেন।

আমার সিলেটি কমিউনিটিতে গিয়ে যদি আমি ভুল করে প্রমিত বাংলা বলি, তাহলে এমন একটা মন্তব্য শুনতে হয় - "ভাইসাবে সিলটী মাতইন না, বাংলা মাতইন"।

সিলেটী ভাষার একসময়ে আলাদা একটা লিপিও ছিল (সিলেটী-নাগরী)। সেতুলনায় দক্ষিন-পশ্চিম বঙ্গ, মানে খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া অঞ্চলের ভাষা প্রমিত বাংলার অনেক কাছাকাছি। কারণটা অবশ্যই প্রমিত বাংলার বিকাশকেন্দ্রের আঞ্চলিক নৈকট্য।

যাহোক, যে চর্চার কথা বলছিলাম। আমার জানামতে ডঃ শহীদুল্লাহ "বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান" তৈরির মধ্য দিয়ে ঐ ভাষা বৈচিত্র সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর আগে-পরে আরো এরকম উদ্যোগ আছে কিনা আমার জানা নেই, হয়তো আছে। সেটা জানতে চাই।

শব্দ-ভাণ্ডারের পাশাপাশি, এসব আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে বৈচিত্রের আরেকটা বড় দিক হল রূপতত্বে, কিছু ক্ষেত্রে বাক্যরীতিতেও। ক্রিয়ার রূপ দিয়ে বলি -
তেমন সিলেটীতে "খা" ধাতুর পুরুষ-কাল ভেদে রূপগুলো হবে এমন -

বর্তমানঃ
আমি খাই, তুই খা/ তুমি খাও/ আফনে খাইন, হে/তা খায় /তাইন খাইন

পুরাঘটিত বর্তমানঃ
খাইছি, খাইছস/খাইছ/খাইছইন, খাইছে/খাইছইন

অতীতঃ
খাইছ্লাম, খাইছলে/খাইছলায়/খাইছলাইন, খাইছিল্/খাইছ্লা

নিত্তবৃত্য অতীত এবং ইচ্ছাসুচক ভবিষ্যতঃ
খাইতাম, খাইতে/খাইতায়/খাইতাইন, খাইত/খাইতায়/খাইতা

ভবিষ্যতঃ
খাইমু, খাইবে/খাইবায়/খাইবাইন, খাইব/খাইবাইন

এভাবে আমাদের যার যার আঞলিক ভাষার ক্রিয়ারূপ গুলো জানালে কেমন হয়?

(ব্লগটা বাংলায় বলে বাংলা ভাষার রূপ গুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলাম, তবে, বাংলার বাইরে অন্য যে ভাষাগুলো বাংলাদেশে প্রচলিত (যেমন সাওতাল, চাকমা, মণিপুরী), সেবিষয়ে কেউ কিছু যোগ করলে ভাল বই মন্দ হয় না)।


মন্তব্য

রাগিব এর ছবি

অনেকেরই মনোভাব, কুষ্টিয়া, শান্তিপুর, নদীয়া, এসব এলাকার লোকেরা "শুদ্ধ" ভাষায় কথা বলে, আর নোয়াখালীর লোকেরা কিংবা চট্টগ্রামের লোকেরা অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু ভাষার আসলে "শুদ্ধ" বা "অশুদ্ধ" বলে কিছু নেই। আসাদ ভাই যেটা বলেছেন, সেটাই, মানে ভাষার আছে প্রমিত রূপ। রবীন্দ্রনাথ অথবা প্রমথ চৌধুরির বাড়ি নোয়াখালী হলে আজ আমরা নোয়াখালীর ভাষা শুনেই আহা-উহু করতাম, আর কুষ্টিয়া/শান্তিপুরের ভাষা শুনে হাসতাম।

চর্চার ক্ষেত্রে বলা চলে, খোদ বাংলাদেশের ভিতরেই আঞ্চলিক ভাষাকে হেলা ফেলা করা হয়। বহুকাল ধরে বিটিভির নাটক ম্যাগাজিনের কমেডিয়ান চরিত্রটি হতো চট্টগ্রাম বা নোয়াখালীর লোক। কথার টান নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয় হরদম। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কেউ নিজের এলাকার ভাষায় ভাষণ দিয়েছেন কি না জানি না, কিন্তু যতটুকু জানি, শেরে-বাংলা এ-কে ফজলুল হক কিন্তু অখন্ড বাংলার আমলে আইনসভায় বরিশাইল্যা ভাষায় ভাষণ দিয়েছিলেন।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

অমিত আহমেদ এর ছবি

সিলেটী আর চাটগাঁইয়া বুলিকে বেশির ভাগ ভাষাবিদ আঞ্চলিক নয়, আলাদা ভাষা হিসেবে গন্য করেন বলেই জানি।


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

এনকিদু এর ছবি

অনেক আগে এই দুই অঞ্চলের ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা ধরা হত । পরে ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিচার করে যখন দেখা গেল আলাদা ভাষা হবার মত কিছু কিছু গুনাগুন রয়েছে তখন থেকে কোনকোন ভাষাবিদ আলাদা ভাষা হিসেবে ধরেন ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

তথ্যবহুল একটা লেখা। ভাল লাগল।

--------------------------------

--------------------------------------------------------

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

তথ্যবহুল কৈ হৈল? তথ্য তো চাইলাম। দিলেন না তো?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সিলেটী এবং চাঁটগাইয়া বুলি অবশ্যই আলাদা ভাষা। সিলেটীর তো এক কালে ভিন্ন নাগরী পর্যন্ত ছিল। আলাদা ভাষা হবার জন্য আলাদা নাগরী থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। ককবরক ভাষারও তো আলাদা নাগরী নেই। জনসংখ্যা বিচারে সিলেটী (১০.৩ মিলিয়ন) এবং চাঁটগাইয়া বুলি (১৪ মিলিয়ন) পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ভাষা



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রাগিব এর ছবি

ঠিক, কিন্তু কথা আছে। সব ভাষাবিদেরা এই শ্রেণীবিন্যাস মানেন না। সামার ইন্সটিটিউট অফ লিঙ্গুইস্টিক্স নামের একটা খ্রিস্টান মিশনারী সংগঠন এই বিষয়ে শ্রেণীকরণ করার সময়ে চট্টগ্রাম ও সিলেটের ভাষাকে উপভাষা বা ডায়ালেক্ট না ধরে আলাদা ভাষা বলেছে। অন্য অনেক ভাষাবিদ এগুলোকে আলাদা ভাষা বলেন না, বাংলারই উপভাষা/ডায়ালেক্ট বলেন।

উইকির এথনোলগ (সিল এর প্রকাশনা) নিবন্ধে যে সমালোচনাটি আছে তা এরকমঃ

"What counts as a language depends on socio-linguistic evaluation: see Dialect. Some accuse the Ethnologue of dividing languages, preferring to call the different varieties "dialects". In other cases, the Ethnologue has been accused of lumping together different languages as "dialects" of single languages. As the preface says, "Not all scholars share the same set of criteria for what constitutes a 'language' and what features define a 'dialect.'""

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

বড়ো দুঃখের কথা, আমরা ভদ্রজন হতে গিয়ে প্রায়ই আমাদের আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্র্য জলাঞ্জলি দিচ্ছি। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের একটা লেখায় দেখলাম, সারা পৃথিবী থেকেই অনেক ভাষা বিলীন হয়ে গেছে। আরো শতাধিক ভাষা বিপন্ন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এগুলো মরে যাবে। তাই ভাষার বিভিন্ন রূপ সংরক্ষণ জরুরি।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পোস্টটা বেশ ইন্টারেস্টিং
কিন্তু আমার মনে হয় সাধারণভাবে করা গড় কমেন্ট কিংবা আড্ডারু মুডের কারণে এই পোস্টটাও গভীরতার দিকে না গিয়ে শুধু উপরের সারফেসে ঘোরাফেরা করছে

০২

যতদূর জানি বাংলাদেশের বাংলা ভাষার মধ্যে ১১টা ডাইলেক্ট আর ৪৮টা একসেন্ট আছে
এর মধ্যে প্রমিত বাংলাটা কোনো অঞ্চলেরই ডাইলেক্ট না
এমন কি যে নদীয়া শান্তিপুরি এর সূচনা সময়ের একটা প্রধান সূত্র ছিল এখন সেখান থেকেও তার দূরত্ব অনেক বেশি

বাংলাদেশে বহুদিন ধরে দুটো প্রাতিষ্ঠানিক প্রমিত ভাষা চলছিল
দাপ্তরিক কাজের জন্য (লিখিত) সাধু ভাষা আর কমিউনিকেটিভ কাজের জন্য প্রতিম চলতি (প্রধানত কথ্য)

পত্রপত্রিকা থেকে সাধু ভাষা উঠে গেলেও (ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় ছাড়া) আমাদের সংবিধান কিন্তু এখনও সাধু ভাষায়।

সাধু ভাষা চলে যাওয়ার পরে আরেক ধরনের সরকরি কিংবা দাপ্তরিক চলতি চালু হয়েছে যার কমিউনিকেটিভ চলতির থেকে সাধু ভাষার সঙ্গেই যার সম্পর্ক বেশি (সরকরি বিজ্ঞপ্তি কিংবা চিঠিগুলো পড়লেই বোঝা যাবে)

পত্রিকার সম্পাদকীয় এবং নিউজের স্টাইল কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই আলাদা
টিভি রেডিওর নিউজ এবং প্রোগ্রামের চলতি কিন্তু একেবারেই আলাদা

আবার প্রমিত মিটিং লেংগুয়েজের (কথ্য) ধরন যেমন অন্য রকম তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কমন কমিউনিকেটিভ লেঙ্গুয়েজের ধরনটা আরেক রকম

সবগুলোই কিন্তু প্রমিত বাংলা

এবং সবগুলোরই উচ্চারণ রীতি ও ভোক্যাবলরিও আলাদা

এখন কোনটাকে স্ট্যান্ডার্ড ধরবেন? নাকি আদৌ কোনোটাকে স্ট্যান্ডার্ড ধরার দরকার আছে?

(গত এক দশকে চলতি প্রমিত বাংলা প্রচণ্ড গতিতে চেঞ্জ হচ্ছে। মাত্র কয়েক বছর পরে হয়তো আমার এই বাক্য গঠনটাই পুরোনো হয়ে যাবে। তাহলে?)

০৩

ডক্টর শহীদুল্লার অভিধান এক ধরনের বিভ্রান্তিও তৈরি করে
ওটা পড়লে মনে হয় সবগুলো একেকটা বিদেশি ভাষা
(যদিও নাম আঞ্চলিক ভাষা)

০৪

বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাকে মিশিয়ে ফেলার কোনো সুযোগ একেবারেই নেই

আঞ্চলিক ভাষাকে ঘেন্না কিংবা তাচ্ছিল্য করাটা শুরু হয়েছে কলকাতার বাবু কালচারের সময় থেকে

শেকড়বিহীন মানুষরা যখন নতুন গজিয়ে উঠা কলকাতা শহরে এলিট কিংবা বাবু হিসেবে নিজেদেরকে প্রচার করা শুরু করল তখনই সচেতনভাবে তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বানাবার জন্য নন-কলকাতী লোকজনকে নিয়ে ঠাট্টা শুরু করল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে

তখনই শ্রেণীকে আলাদা করা হলো সদর আর মফস্বল শব্দে
এবং ভাষাকে আলাদা করা হলো শুদ্ধ ভাষা ও চাষী কিংবা অশুদ্ধ ভাষা হিসেবে

এবং এই প্রাকটিসের ধারাবাহিকতায় প্রতিটা শহরই তার আশপাশের গ্রামের ভাষাকে ঘেন্না কিংবা তুচ্ছ করা শুরু করল আর মনে মনে তার থেকেও বড়ো নগরের কালচার আর ভাষা আয়ত্ব করা শুরু করল

কলকাতা যখন সব দিক থেকেই বাংলার রাজধানী ছিল তখন পুরো ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলাকেই আঞ্চলিক কিংবা অশুদ্ধ ভাষা হিসেবে ধরার প্রচলন ছিল
পরে ঢাকাও সেই কালচার শুরু করল

অথচ কলকাতার প্রমিত বাংলা যেমন কলকাতার ভাষা না
ঢাকার প্রমিত বাংলাও তেমন ঢাকার ভাষা না

দুটোই আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার একটা সংকলিত রূপ

০৫

এই লেখকেও কিন্তু তার পোস্টে আঞ্চলিক ভাষার প্রতি এক ধরনের ঘেন্না কিংবা তাচ্ছিল্ল এড়াতে পারেননি (নিজেকে স্ট্যান্ডার্ড প্রমাণের ইচ্ছা বোধহয়)

০৬

কুষ্টিয়া যশোরের ভাষাকে যারা বর্তমান প্রমিত বাংলার সাথে মিলিয়ে ফেলেন
আমার ধারণা তাদের কুষ্টিয়া যশোরের ভাষা সম্পর্কে যেমন জ্ঞানের অভাব আছে তেমনি প্রমিত বাংলার সাথেও আছে বিস্তর যোগাযোগহীনতা

এই মুহূর্তে মিলগুলো কি আদৌ আছে?
ভোকাবলারি কিংবা একসেন্ট
সবগুলোই তো আকাশ পাতাল দূরত্ব

তাহলে?

০৭

আঞ্চলিক ভাষার প্রতি ঘেন্না কিংবা তাচ্ছিল্যের একটা প্রধান কারণ সেই অঞ্চলের লোকরাই

কুদ্দুস বয়াতি যখন নিজেকে জাতে তোলার জন্য ময়মনসিংহ গীতিকার পালা শুদ্ধ বাংলায় গাওয়ার চেষ্টা করে তখন সেটা হাস্যকরই শোনায়

ময়মনসিংহের একসেন্টে ইত্তেফাকের পুরোনো ভাষা...

ভাবেন তো একবার কীরকম ভয়াবহ আর হাস্যকর শোনায় সেই গান?

সেই গান শুনে মানুষ হাসবে না তো কী করবে

অথচ যে কোনো আনাড়িও লালনের গান গাওয়ার আগে কুষ্টিয়ার শব্দগুলোর উচ্চারণ জেনে নেয়ার চেষ্টা করে
শব্দের অর্থগুলো জানার চেষ্টা করে

তথাকথিত সমস্ত শিক্ষিত প্রমিত আর বাবু ভাষার বিরুদ্ধে সম্ভবত বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার একটাই প্রতিষ্ঠান। সেটা হচ্ছে লালন ফকির

তার তিনি নিজে যেমন তার ভাষা কিংবা শব্দকে প্রমিতে অনুবাদ করার চেষ্টা করেননি। তার শিষ্যরাও তা করেননি (ফরিদা পারভীনসহ অনেক শিল্পীদের উচ্চারণ দোষ ছাড়া)

এই কনফিডেন্সের কারণেই লালন আজকে লালন হয়েই সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য
বাক্যে- শব্দে- উচ্চারণে
অথচ আমরা কয়জন লালনের গানের শব্দের সবগুলো অর্থ বুঝি?

০৮

বাংলাদেশের উপভাষাগুলো নিয়ে কাজ হয়েছে খুবই কম। অথবা হয়ইনি
(চল্লিশের দশকে প্রফেসর শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি নামে একজন কিছু কাজ করেছিলেন বলে শুনেছি কিন্তু কোনো রেফারেন্স পাইনি। আর বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন ডক্টরেট করছে বলে জানি)

বাংলাদেশের সবগুলো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাষা পড়ানো হয় সেখানে আদৌ আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে কিছু পড়ানো হয় বলে আমার জানা নেই

০৯

চিটাগাংয়ের লোক বাংলার অন্য এলাকার লোককে বলে বইঙ্গা
আর সিলেটের লোক বরে বেঙ্গলি
এই দুইটাই কিন্তু ভাষা নির্দেশক শব্দ
এই দুইটাই প্রমাণ করে ভাষাগুলো আলাদা
(উত্তরের কিছু লোককে অন্য এলাকার লোককে ভটিয়া বলতে শুনেছি)

সুতরাং 'ভাইসাবে সিলটী মাতইন না, বাংলা মাতইন"।

এই কমেন্টের সূত্রটা বোধহয় অনেক পেছনে। এবং অনেক গবেষণার দাবিদার

১০


এসব অঞ্চলের লোকেরা সচেতন সম্প্রদায়বোধ নিয়ে তাদের ভাষাকে সংরক্ষণ করেন

এটা একেবারেই গড়পড়তা একটা আপত্তিকর কথা
আমি বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো ভাষা অঞ্চলের সাথেই পরিচিত
আমি তাদের কথা না বোঝায় তাদের অনেক মন্তব্য শুনেছি
কিন্তু কোথাও মনে হয়নি ওটা সাম্প্রদায়িকতা কিংবা আঞ্চলিকতা

বরং মনে হয়েছে কমিউনিকেট করতে না পারার সীমাবদ্ধতাই ফুটে উঠেছে তাদের কমেন্টে

আনিস মাহমুদ এর ছবি

আলাদা একটা (অথবা একাধিক) পোস্ট দিলেন না কেন এটা নিয়ে?

.......................................................................................
আমি অপার হয়ে বসে আছি...

.......................................................................................
Simply joking around...

হিমু এর ছবি

উবাও পথিকবর!
জন্ম যদি তব সিলটো ...

ভাষাটা দীর্ঘদিন চর্চার অভাবে বলতে পারি না আগের মতো, বুঝতে সমস্যা হয় না যদিও। কিন্তু চট্টগ্রামের ভাষা শেখার আগ্রহ আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

রণদীপম বসু এর ছবি

১.
মাহবুব লীলেনের মন্তব্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

২.
আসলে ভাষার স্থায়ীত্ব নির্ভর করে জনভাষ্য তা কতটুকু ধারণ করে রেখেছে তার উপর। প্রাচীন এত যে সম্ভ্রান্ত ভাষা সংস্কৃত, তা এখন মৃতভাষা হিসেবে সহানুভূতি পাচ্ছে এজন্যই। ওটার আর জীবন ফিরে পাওয়াও সম্ভব নয়। আমাদের প্রমিত ভাষার সাধু রীতি সংবিধানে বা সরকারী গেজেট এবং গণ্ডিবদ্ধ কিছু ক্ষেত্রে এখন মৃতপ্রায় ধুকপুক করার কারণও তাই। আর এজন্যই হয়তো সাহিত্যের রম্যভাষা হিসেবে বর্তমানে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে এটা। অর্থাৎ এটাকে অপ্রচলিত হাস্যকর ভাষা হিসেবে উপহাস করছি।

৩.
কোন ভাষাই কি আসলে স্থায়ী ? প্রধান ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা বা অঞ্চলের প্রধান ভাষা যাই বলি তা যদি টিকে থাকার একমাত্র শর্ত হয় জনভাষ্যের ধারণযোগ্যতা, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ভাষার আত্তিকরণ ক্ষমতা কিংবা রক্ষণশীলতা কোনটিকে আমরা প্রাধান্য দেব ? আত্তিকরণ না চাইলে ভাষার ব্যাপ্তিমানতা ও প্রবহমানতাকে ধারণ করতে পারবো না। তাতে সময়কে ধারণ করার মতো ব্যবহারযোগ্য হ্রাস পেতে পেতে একদিন হয়তো অকেজো ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে। আবার রক্ষণশীলতা টিকাতে না পারলে ভাষার মৌলিকত্ব ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এ বিষয়টা ভেবে দেখার গুরুত্বকে খাট করা যাচ্ছে না।

৪.
সাধু ভাষা ব্যবহারযোগ্যতা হারাচ্ছে মৌখিক ভাষা থেকে বিচ্যুত বলে। ভাষার ইতিহাস হয়তো তাই বলে যে, জনভাষ্যের রীতিটাই কালক্রমে লেখ্যরূপও পেয়ে যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে নতুন নতুন শব্দাবলীকে আমরা লেখ্যরূপে আনতে না পারলে ভাষার বিকাশও মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। ফলে কিছুটা আন্তর্জাতিকতাও ভাষার মধ্যে প্রবেশ করবে। আবার উদার আন্তর্জাতিকতা ভাষার নিজস্ব রূপটিকে একটু একটু করে বিবর্তিত করতে থাকে। এর আদিরূপ হারাতে থাকে। এটাকেও বোধ করি ক্ষয়িষ্ণুতা বলে।

৫.
সিলটি কিংবা চাটগাইয়া কিংবা এরকম অন্য যে কোন ভাষারই দীর্ঘস্থায়ীত্ব নিয়ে সমূহ আশঙ্কার কারণ হচ্ছে, এসব ভাষা কেবল জনভাষ্যেই আছে, লেখ্য রূপ বা সৃজনশীলতার চর্চায় এর ব্যবহার নাই। আমি এখন ঢাকায় বসবাস করি বলে আমার সন্তানকে চলমান ভদ্রলোকি ভাষাটাই রপ্ত করাচ্ছি যাতে সে তার শিক্ষাপরিবেশে ক্ষেত হিসেবে চিহ্নিত হতে না হয়। আমি আমার স্ত্রীর সাথে পুরানা খাসিলত অনুযায়ী সিলটি ভাষায় কথা বলি। কিন্তু সন্তানের সাথে তার চর্চাটাকে অক্ষুণ্ন রাখতে ভদ্রলোকি বুলি আউড়াচ্ছি। তাতে করে আগামী কয়টা প্রজন্ম শেষপর্যন্ত এই বুলিভাষা হিসেবে অঞ্চলভাষাটাকে ধরে রাখবে ?

৬.
তাই ভাষাগত বিষয়টা আমার কাছে জটিল একটা বিষয়। সেই রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে হয়, আমরা কি ভাষার পুকুরে সাঁতরাবো, না কি ঘড়ায় তুলে ব্যবহার করবো ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

প্রথমে রণদীপম বসু আর মাহবুব লীলেন কে অনেক ধন্যবাদ তথ্যবহুল মন্তব্য দেয়ার জন্য।

লীলেন ০২:

নাকি আদৌ কোনোটাকে স্ট্যান্ডার্ড ধরার দরকার আছে?

প্রমিতকরণের প্রশ্নটা আরো আলোচনার দাবী রাখে, তবে সংক্ষেপে আমার (অসম্পূর্ণ)ধারণাটা বলি। প্রমিতকরণ সার্বজনীনতার প্রয়োজনেই জরুরী। প্রমিত একটা বাংলা না থাকলে সিলটী আমি তো চাটগাইয়া আমার চাটগাইয়া বন্ধুর সাথে কথা চালাতে পারতাম না। আজকে এই ব্লগের আলোচনাটাও হয়ত হত না।

তবে এও ঠিক, প্রমিতরূপ যখন বিবর্তনের ধারায় স্বাভাবিকত্ব হারায় তখন তাকে জোরে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে এক ধরণের মৌলবাদ জন্ম নেয় ("এটাই ভাষার 'শুদ্ধরূপ', অন্যগুলো বে'দাত")। সেজন্য প্রমিতরূপেরও সময়ের সাথে পরিবর্তন জরুরী। সেটা বাস্তব প্রয়োজনেই হয়ও। সেটা বিবর্তনে হয় না বিপ্লবে হয় সেটা নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে।

রণদীপম ০৫- এ ব্যপারে আমার মতও তাই। চাটগাইয়া বুলি বা সিলটী কালোত্তীর্ণ হবেনা হয়তো, যদি তাতে সাহিত্যসৃষ্টি না হয়। তবে এই ভাষা/বুলিগুলোর স্বতন্ত্র সত্বার কারণ যেমন সামাজিক/প্রাকৃতিক/ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা, এগুলো পরষ্পরকে প্রভাবিত করে পরষ্পরের মাঝে বিলীন যদি হয়, তবে তার কারণও বাস্তব সামাজিক/রাজনৈতিক/রাষ্ট্রিক নৈকট্য। প্রমিত ভাষা যদি এই পরষ্পরের মাঝে বিলীন হবার স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে তৈরী হয়, সেটা সবচে বেশী গ্রহণযোগ্য হয় হয়তো। তবে বাস্তবে যেটা হয়, সেটা হল অগ্রসর একটা জন গোষ্ঠী তাদের সাহিত্য চর্চার প্রয়োজনে প্রমিত ভাষা তৈরী করে, সেটা বাকী গোষ্ঠীগুলো ঐ অগ্রসরতার প্রভাবে স্তিমিত হয়।

লীলেন-১০ - আমি কিন্তু সম্প্রদায়বোধ বলেছি। সাম্প্রদায়িকতা বলিনি। এদু'য়ের পার্থক্য আমার ধারণায় আছে। তবে সীমানাটা যে কোথায় সেটা নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতাও আছে।
এটা নিয়ে পরে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে। আপাততঃ আমার আগের পোস্টে একটা ছোট কমেন্ট রেখেছিলাম, যেটা ধর্মের তাপে কারো চোখে পড়েনি।

ঐ পোস্টেও আপনার ঝাঝালো মন্তব্য চাইছি, নিজের অস্পষ্টতা গুলো দুর করার জন্যই।

বজলুর রহমান এর ছবি

কোলকাতায় যেমন হিন্দী আর ইংরেজীর আগ্রাসনে বাংলার ব্যবহার কমে যাচ্ছে, এখানেও হয়তো শেষতক ইংরেজীই সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে। অনেক পরের কথা অবশ্য। ইংরেজীর মার্কিন রূপই হয়তো বিশ্ববাজারে ইংলিশ ইংলিশকে বসিয়ে দেবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।