আমার 'বীক্ষণ প্রান্ত' পাঠ

আশফাক আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন আশফাক আহমেদ [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৩/১০/২০১৩ - ১:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হিমালয় ভাই আমার বড় ভাইয়ের মত। কিংবা এক অর্থে বড় ভাই-ই। এরকম ঘনিষ্ঠ একজনের গ্রন্থ নিয়ে রিভিউ লিখতে কিছুটা হিম্মতের দরকার হয়। পছন্দের মানুষ---কাজেই রিভিউ লিখতে গিয়ে একটা বায়াস চলে আসতেই পারে। সেই বায়াস থেকে নিজেকে শত হাত দূরে রাখতে সচেতন প্রয়াসের দরকার আছে বৈকি।

যাহোক, বকর বকর না করে কাজের কথায় আসি। কথা হচ্ছে উনার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ 'বীক্ষণ প্রান্ত' নিয়ে। লক্ষ করবেন, আমি এটাকে নিছক বই না বলে 'গ্রন্থ' বলছি। কারণ আছে। আমার দ্‌ষ্টিতে দুই মলাটে বন্দী বস্তুদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক তো বই---যেগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় বা যায় না। আসল কথা, সেগুলো আময়া 'পড়ে ফেলি'। সেগুলো আমাদের চিতাভাবনার দরজায় টোকা দিতে সমর্থ হয় না। বছরখানেক পর আপনার কোন বন্ধু যদি জিজ্ঞেস করে, অমুক বইটা পড়েছিস, আপনি নির্ঘাৎ মাথা চুলকাবেন। দুই নম্বর ক্যটাগরীয় পড়ে 'বীক্ষণ প্রান্ত' এর মত গ্রন্থ। যার লেখার শৈলীতে ভালোমন্দ মেশানো থাকতে পারে, কিন্তু পড়তে গিয়ে তা আপনার চিন্তার দেয়ালে ঠোকর মারবেই। ভাগ্য ভালো হলে আপনার মনের দু-একটা দরজা খুলেও এতে পারে।

হিমালয় ভাই'র গল্পগুলোকে এক এক করে ব্যবচ্ছেদ করার পক্ষপাতী নই আমি। গল্পগুলো উনার চিন্তাভাবনারই একটা সামগ্রিক প্রতিফলন। চিন্তাগুলোকে দার্শনিকের মত খটমটে ভাষায় রূপ না দিয়ে উনি গল্পের আশ্রয় নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই টিপিক্যাল বাংলা ছোটগল্পের পাঠক উনার গল্প পড়তে গিয়ে সামান্য হলেও ধাক্কা খাবেন।

রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা কমবেশি সব লেখকই করেন। কিন্তু একে ছোটগল্পের পরিসরে রূপ দেবার দুঃসাহস করন খুব কমই। এই গ্রন্থে আমরা তেমনই কিছু সোশ্যাল ফিকশানের সন্ধান পাই। 'ধাঁধায় দ্বিধা' ও 'ঢ়-তত্ত্ব' তেমনই দুটি প্রতিনিধিত্বমূলক গল্প। আমার দুর্ভাগ্য, এই গল্প দুটির প্লট আমি আগেই হিমালয় ভাই'র কাছ থেকে শুনে ফেলেছিলাম। আড্ডা দেবার উদ্দেশ্যে প্রায়ই উনার অফিসে যাওয়া হত। সেই সূত্রে গল্প দুটি'র প্লট আগে থেকেই আনা ছিল। পড়তে গিয়ে দেখি, যা শুনেছিলাম, এখানেও ঠিক তাই। আমার প্রত্যাশা হয়তো একটু বেশি ছিল, তাই কিছুটা আশাহত হয়েছি। আগে থেকে প্লট জানা না থাকলে আমিও হয়তো আরো অনেকের মত-ই এ দুটো গল্প পড়ে হা হয়ে থাকতাম। এরপর থেকে কানে ধরছি, উনার কোন গল্পের প্লট আগেভগে শুনবো না। নেভার। এর মধ্যেও ঢ়-তত্ত্ব গল্পের প্লটটা আমার বিশেষ পছন্দ হয়েছে। আমার ধারণা, এই প্লট একটি চমৎকার উপন্যাস দাবি করে। গল্পের ছোট মোড়কে একে বেঁধে রাখার কোন মানে হয় না। এ আরো বেশি স্পেস ডিজার্ভ করে।

আমার পছন্দের গল্প 'কর্মচারী তত্ত্ব'। সাধারণ ধাঁচে শুরু করা একটি গল্প কীভাবে শেষমেশ অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে---তার চমৎকার নিদর্শন এই গল্পটি। গল্পে গ্রেডিং এর পক্ষপাতী না আমি। তাও গ্রেড করতে বললে একে আমি পাঁচে পাঁচ দেব। বাংলাদেশের ছোটগল্পে ইলিয়াস ছাড়া আর কেউ কারো মনস্তত্ত্ব নিয়ে এতোটা ঘেটেছেন বলে আমার মনে পড়ে না।

'কিন্তু' গল্পটাও বেশ আগ্রহোদ্দীপক। প্রতিটা স্‌ষ্টিই প্রচলিত ফর্মের বিরুদ্ধে চলার চেষ্টা করে। এক সময় সে হয়তো ফর্মকে ভাঙতেও পারে। অতঃপর? অতঃপর সে নিজেও একটা ফর্ম দাঁড় করায় এবং অন্যদের সেই ফর্ম মেনে চলতে বাধ্য করে। এককালের প্রগতিশীল এইভাবেই পরিণত হয় একজন প্রতিক্রিয়াশীলে। এরকম একটা ট্রাজেডি নিয়ে নির্মিত 'কিন্তু' গল্পের অবয়ব। তবে পাঠক হিসেবে আমি আরেকটু নতুন কিছু আশা করেছিলাম এই গল্প থেকে। সেটা পাইনি। সেটা কি পাঠক হিসেবে আমার ব্যর্থতা না লেখক হিসেবে হিমালয় ভাই'র---সে বিচারের ভার আমি অন্যদের উপর ছেড়ে দিলাম।

সমাজতত্ত্ব নিয়ে আরেকটি দারুণ গল্প হতে পারতো '৩য় বন্ধনী'। আধুনিক সমাজের জন্য বিয়ে কতোটা উপযোগী ব্যবস্থা, বিয়েতে এই যে এতো আনুষ্ঠানিকতা আমরা করি---তার কোন দরকার আছে কিনা, প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিয়ে অদূর ভবিষ্যতে টিকবে কিনা---এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই গল্পে। কিন্তু এই গল্পেও লেখক নতুন কোন বক্তব্য নিয়ে আসতে পারেননি বা তার ইঙ্গিত-ও নেই গল্পের কোথাও। হিমালয় ভাই'র বক্তব্য---এই গল্পে তিনি পাঠককে নিয়ে একটা পাজল খেলেছেন। সে পাজলটা কী বা কোথায় বা আদৌ কোন পাজল আছে কিনা---তা আমি অন্যদের কাছ থেকে শুনতে আগ্রহী।

তবে যা-ই হোক, হিমালয় ভাই'র গল্প মানেই নতুন কিছু। ফর্ম ও প্যাটার্ন নিয়ে, ফিলোসফি ও সমাজতত্ত্ব নিয়ে এক ধরনের খেলা করা। যারা গল্পের শরীরে নিছক 'কাহিনী' না খুঁজে অন্য কিছুর সন্ধান করেন, তারা এই গ্রন্থ কিনলে ঠকবেন না---এইটুকু কথা দিতে পারি।

[[[গ্রন্থঃ বীক্ষণ প্রান্ত
লেখকঃ মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়
পাওয়া যাচ্ছেঃ রকমারি.কমের এই লিঙ্ক থেকে]]]


মন্তব্য

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

যারা গল্পের শরীরে নিছক 'কাহিনী' না খুঁজে অন্য কিছুর সন্ধান করেন, তারা এই গ্রন্থ কিনলে ঠকবেন না---এইটুকু কথা দিতে পারি।

ইন্টারেস্টিং। পড়ার চেষ্টা করবো।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

রিভিউ ভালো লাগল। পাওয়া যাবে কোথায়?

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

তানভীর রাব্বানী  এর ছবি

রিভিও ভাল লাগছে। বইটা (আপনার ডেফিনেশনে আমার কাছে এখনো গ্রন্থ না) খুজে পাওয়ার জন্যে আরেকটু ডিটেইল ইনফরমেশন দিলে ভাল হয়। বিশেষত "কর্মচারী তত্ত্ব" পড়ার জন্যে আগ্রহ জাগছে - সম্ভবত ইলিয়াস মনস্তত্ত্ব শুনেই।

রিক্তা এর ছবি

বীক্ষণ প্রান্ত এর লেখকের পুরো নাম কি? বই ইবুক (স্ক্যানড কপি না লিগাল কপি) আকারে কিনতে পাওয়া যাবে?

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

এস এম নিয়াজ মাওলা  এর ছবি

রিভিউ পড়ে আগ্রহ জাগছে। কিন্তু লেখা শেষে লেখক এবং বইটি সম্পর্কে তথ্য থাকলে ভালো হতো।

-এস এম নিয়াজ মাওলা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।