নটরডেমিয়ান ১: নবীনবরনের ব্যবচ্ছেদ (ব্যাচ '৯৯)

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: বুধ, ২৭/০৬/২০০৭ - ৪:৪৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

Notre Dame College
নটরডেমের গেটের কাছে দাড়িয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে ভেতরে তাকাই। বাবা-মার পীড়াপীড়িতে নটরডেমে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, আমার ইচ্ছা ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার, স্কুলের সব বন্ধুরাও ঢাকা কলেজেই। বাবা-মার ধারনা আমি যে রকম ট্যাটন, ঢাকা কলেজে ঢুকে গোল্লায় চলে যাব। আমার জন্য দরকার শক্ত হাতের শক্ত তদারকি।

কলেজটা লাল-নীল কাগজে বেশ ভালই সাজিয়েছে। ভেতরে কয়েকজন দোস্ত থাকার কথা। ঢোকার পথেই বিপত্তি। দু'জন শিশুসুলভ সিনিয়র ভাই গলায় ঢালাও মমতা নিয়ে বললেন, "ভাইয়া, নতুন ব্যাচ?"
আমি "জ্বী" বলেছি কি বলিনি তারা একটা "স্বাগতম হে নবীন" লেখা কাগজের টুকরো পিন দিয়ে আমার শার্টে আটকাতে গিয়ে পিন আমূল আমার বুকে ঢুকিয়ে দিল। সে এক রক্তারক্তি কান্ড। আমি এতটাই বিহবল যে টু শব্দটাও গলা দিয়ে বেরুলো না, দেখলাম এক ফোঁটা রক্ত শার্টে মিশে গেল। গর্দভ বড় ভাই দু'টো চরম বিব্রত হয়ে "স্যরি ভাইয়া, স্যরি ভাইয়া" করতে লাগলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই হচ্ছে কলেজের ছাত্রদের অবস্থা! এই কলেজেই পড়তে হবে দু'দুটো বছর!

কলেজের মাঠে প্যান্ডেলের মত সাজানো হয়েছে। ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুলে পড়েছি, ঢাকা কলেজের নবীন বরনে কনসার্ট দেখতে (পড়ুন মারামারি করতে) কম যাওয়া হয়নি। এখানে সিন দেখি পুরা উল্টা। সবাই বাবা-মা-ভাই-বোন নিয়ে সপরিবারে উপস্থিত। আমি শামিয়ানায় ঢুকে দোস্তদের খোঁজ করি। ইমতিয়াজ, ফয়সাল, রনি, নিয়াজ, বনি আরও অনেকের সাথেই দেখা হয়ে যায়।
রনি কানে কানে বলে, "দোস্ত, এখনও সময় আছে, ঢাকা কলেজে যাই গা চল।"
আমি গা লাগাই না।
নিয়াজ গোমড়া মুখে বলে, "বাবা-মা আসতে চাচ্ছিলেন, আমি দিয়েছি ঝাড়ি, বলেছি নবীন বরনে গার্ডিয়েনরা যায় নাকি! এখানে অবস্থা দেখেছিস, স্টুডেন্টদের চেয়ে গার্ডিয়েন বেশী!"
ওকে আর কি বলবো, আমারও বাসায় একই কাহিনী হয়েছে।
ইমতিয়াজ বলে, "দোস্ত অনেকে বোন নিয়ে এসেছে। ঐ কর্ণারে সবুজ জামা পড়া মেয়েটাকে দেখ... চরম না?"

এরই মাঝে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। নটরডেম যে কেবল ভাল ছাত্র বানায় না, শুদ্ধ মানুষও বানায় সেটাই ইনিয়ে বিনিয়ে সবাই বললেন। স্টেজে লম্বা সাদামাটা ফাদার পিশাতো উঠে চমৎকার বাংলায় নিজের বক্তব্য রাখলেন। এরপর শুরু হয়ে গেল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ-গান-আবৃত্তি উপভোগ করছি, এমন সময় স্টেজে আসলেন নাদুস নুদুস মায়া মায়া মার্লিন ক্লারা পিনেরু। টইটম্বুর গলায় বললেন, "এবার একটা অবাক কান্ড হয়েছে! প্রতিবার আমাদের পুরানো ছাত্ররা পারফর্ম করে। এবার তোমাদেরই একজন আমাকে একটু আগে বলেছে সেও কিছু করতে চায়। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই স্টেজে উঠছে, ওকে অনেক, অনেক হাততালি।"
স্টেজে উঠে এলো হাড়গিলে এক ছেলে, টাইট জিন্স আর লাল রঙের শার্ট পড়া। মাথায় আবার ফুটকি মারা লাল ব্যান্ডানা।
ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি পারফর্ম করবে?"
ছেলেটি মেয়েলি গলায় বলল, "ক্লাসিকাল ড্যান্স!"
আমি মনে মনে বললাম, হে ধরণী, দ্বিধা হও!
ছেলেটি মনে হয় পকেটে সব সময় ক্যাসেট নিয়ে ঘুরে, সেটা বের করে ম্যাডামকে দিয়ে বলে, "এটাতে মিউজিক আছে আপা!"
গান শুরু হতেই আমার পিলে চমকে উঠলো, চটুল হিন্দি গান, "গোরে গোরে মুখরেপে কালে কালে চশমা..."
আর সেই সাথে খ্যামটা নাচ। দর্শকরা দু'ভাগে ভাগ হয়ে শামিয়ানার নিচে বসে ছিল। বাম দিকে নতুন ছাত্ররা, ডান দিকে গার্ডিয়েনরা। আমি দেখলাম খ্যামটা নাচের সাথে সাথে ডান দিকের সবার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। ছেলেটির কেরামতি আছে বলতে হবে, দেহের প্রতিটা অঙ্গ গরলের মত ওঠানামা করছে। দেখা গেল ছেলের আগ্রহটা আসলে গার্ডিয়েন সাইডের বড় আপাদের দিকে। সোজা ঐ দিকে তাকিয়ে তার কোমড় সঞ্চালনের বিশেষ পারদশিতা পুরোদমেই প্রকাশ্যমান। নাচের ফাঁকে কাবিল ছেলে আবার মাথার ব্যান্ডানাটা খুলে নিখুঁত নিশানায় সবুজা জামা পড়া আপুর দিকে ছুঁড়ে দিল। আমি মুগ্ধ চোখে ছেলেটার হাতের টিপ দেখছি, ইমতিয়াজ কানে কানে বলল, "কান্ডটা দেখলি? হারামজাদার পুঁইতা ফালামু আজ।"
হঠাৎই গান বন্ধ হয়ে যায়। আমরা দেখি মিশকালো ঠোটের শ্যামলা রাগী চেহারার একজন মানুষ স্টেজে উঠে আসেন। কান ধরে ছেলেটিকে স্টেজের পাশে এমন এক জায়গায় নিয়ে যান যেখানে সাবাই তাদেরকে দেখতে পাবে ঠিকই কিন্তু মনে হবে তিনি কাজটা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। কিছু বোঝার আগেই ছেলেটার গালে গুনে গুনে পাঁচটা বিরাষি শিক্কার চড় পড়ে। আমাদের সেই প্রথম পরিচয় নটরডেমের ত্রাস টেরেন্স পিনেরু স্যারের সাথে। সারা মাঠে তখন পিনপতন নিঃস্তব্ধতা।
একটু পরেই আবার উঠে এলেন মার্লিন ক্লারা পিনেরু, তাঁর সেই ঢলঢল গলায় বললেন, "যে ছেলেটি নাচলো সে কিছু বলতে চায়!"
কান্না জড়া গলায় থেমে থেমে কথা আসে ছেলেটার, "আ....আমি বলেছিলাম ক্লাসিকাল ড্যান্স দেখাবো... কি....কি...কিন্তু যা দেখিয়াছি তা ছিল অশ্লীল... আমি ক্ষমাপ্রার্থী।"
ইমতিয়াজ কানে কানে বলল, "উচিৎ শিক্ষা হয়েছে শালার!"

বিস্মিত আমি গুম হয়ে ভাবলাম, এইরে কলেজে উঠেও স্যারদের মার খেতে হবে নাকি! স্টেজে এলেন লিংকন ভাই, উঠেই ধরলেন হ্যাপি আখন্দের "চলনা ঘুরে আসি..." সময়টা মন্দ কাটে না।
সুর্য ডোবার সাথে সাথে অনুষ্ঠান শেষ। দোস্তরা মিলে বাইরে এসে একটা টং দোকানে সিগারেট চাই। সিনিয়র এক ভাই উঠে আসেন। জলদ কন্ঠে বলেন, "ফার্স্ট ইয়ার?"
"জ্বী ভাইয়া!"
"তাহলে মাইকেল মামুর দোকানে যাও। রফিক মামুর দোকান সিনিয়রদের জন্য, ঠিকাছে? আর যেন না দেখি এখানে।"
আমরা মিনমিনে গলায় "জ্বী ভাইয়া" বলে সরে আসি। এতক্ষনে নটরডেমকে কলেজ বলে মনে হয়, পরিচিত আবহাওয়ায় মনটাও ভাল হয়ে আসে। নাহ, যতটা ম্যাড়মেড়ে ভেবেছিলাম কলেজটা, ততটা মনে হয় না!

[প্রথম প্রকাশ সামহোয়্যার ইন ব্লগে | ২০০৭-০৫-৩১ ০৬:২৭:১৭]

© অমিত আহমেদ

(চলবে)


মন্তব্য

অরূপ এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

আশফাক আহমেদ এর ছবি

চরম

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।