একুশের প্রথম কবিতার জন্মকথা…

বিপ্রতীপ এর ছবি
লিখেছেন বিপ্রতীপ (তারিখ: শুক্র, ২০/০২/২০০৯ - ১২:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto






একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ নামটি প্রায় সবারই কমবেশি জানা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষনের খবর শুনে সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে বসে কবিতাটি রচনা করেন ভাষাসৈনিক কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। একুশের এই কবিতার সাথে মিশে আছে অনেক আত্মত্যাগের ইতিহাস। আসুন, ফিরে দেখি এই ঐতিহাসিক কবিতাটির জন্মকথা।

১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ২৫ বছরের টগবগে তরুন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতির সাথেও যুক্ত। প্রায় ৫ বছর ধরে 'সীমান্ত' নামে একটি মাসিক পত্রিকাও সম্পাদনা করছেন। ২৭শে জানুয়ারি ১৯৫২ সালের খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণের পর সমগ্র পূর্বপাকিস্থান জুড়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ৪০ সদস্যের 'সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ'। সভায় আরবী হরফে বাংলা লেখার সরকারী প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচীও গ্রহণ করে।

ফেব্রুয়ারি মাস। মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর বিশ্রাম নেই। চট্টগ্রামে ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচী সফল করতে প্রচন্ড ব্যস্ত। এতো পরিশ্রম সহ্য হলো না, অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় যখন টেলিফোনে খবর পেলেন ঢাকায় মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষনের কথা, তখন তার প্রচন্ড জ্বর। খবরটি শুনামাত্র রাগে ক্ষোভে কবির শরীর কাঁপছে, কাগজ কলম হাতে নিয়েছেন কিছু লিখবেন বলে। কিন্তু সেই মুহুর্তটাতে লেখার বিন্দুমাত্র শক্তি তার শরীরে নেই। মুখেই বলে যাচ্ছেন একের পর এক লাইন…

ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য…

তখন কবির পাশে ছিলেন ননী ধর। তিনিও কবির মতোই বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত, কাজ করেন চট্টগ্রামের এক সিনেমা হলে। তিনিই কবির মুখে শুনে লিখে রাখলেন পুরো কবিতাটি। কিছুক্ষণ পর সেখানে এলেন ঢাকা থেকে আসা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস; কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে আন্দোলনের কর্মসূচী দেখতে এসেছেন। রচনার পর তিনিই এই ঐতিহাসিক কবিতাটির প্রথম শ্রোতা। কিছুসময় পর সেখানে এলেন চলচ্চিত্র বিষয়ক মাসিক উদয়ন পত্রিকার সম্পাদক রুহুল আমিন নিজামী। সেখানেই সবাই মিলে এই দীর্ঘ কবিতাটি বই আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

শহরের আন্দরকিল্লার কোহিনূর প্রেসে রাতেই শুরু হয় ছাপার কাজ। কিন্তু, কিভাবে যেন পুলিশের কানে পৌছে যায় সে খবর। শেষরাতের দিকে পুলিশ প্রেসে হানা দেয়। প্রেসের কর্মচারীরা দ্রুত লুকিয়ে ফেলেন সবকিছু। পুলিশ খালিহাতে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। পুলিশ চলে যাবার পর আবারও শুরু হয় ছাপার কাজ। বাধাঁই শেষে পরদিন দুপুরে প্রকাশিত হয় ১৭ পৃষ্টার দীর্ঘ কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’। এর দাম রাখা হয় দু’আনা। ২২ ফেব্রুয়ারি লালদিঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে কবিতাটি প্রথম জনসম্মুখে পাঠ করে শোনান চৌধুরী হারুনূর রশীদ। এর পরপরই কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করে সরকার। শুধু বাজেয়াপ্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা। পাশাপাশি কবি, জনসম্মুখে কবিতাটির প্রথম পাঠক, প্রেসের ম্যানেজার সহ এই ঐতিহাসিক কবিতার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরূদ্ধে গ্রেফতার পরোয়ানা জারি করা হয়। ছাপার অপরাধে কোহিনূর প্রেসের ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী এবং জনসম্মুখে পাঠ করার অপরাধে চৌধুরী হারুনূর রশীদকে গ্রেফতার করা হয়। তা্রা দু'জনই দীর্ঘদিন কারাবরণ করেন।

‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি জনসম্মুখে প্রকাশের তারিখ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। মূল কবিতাটি প্রায় ১৭ পৃষ্টার হলেও দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ থাকার কারনে সম্পূর্ন কবিতাটি এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না। একুশের প্রথম কবিতা নিয়ে এ ধরনের বিভিন্ন তথ্যগত বিভ্রান্তি থাকায় অনেকেই এ নিয়ে বিভিন্নজন গবেষণা করেছেন বিভিন্ন সময়। এদের মাঝে গবেষক চৌধুরী জহুরুল হকের নামটি উল্লেখযোগ্য। কারন, এ প্রসঙ্গে তার গবেষনাকেই বেশি নির্ভরযোগ্য হিসেবে ধরা হয়।

২০০৭ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর ভাষাসৈনিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী মারা যান। রাজনীতি, সাহিত্য সহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকলেও আমৃত্যু তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল একটাই-তিনি একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র স্রষ্টা…

তথ্যসূত্রঃ

১। সদয় অবগতির জন্যে, চৌধুরী জহুরুল হক, বিডিনিউজ আর্টস (২৮ ডিসেম্বর ২০০৭)
২। মায়ের ভাষার গান-রবীন্দ্র গোপ
৩। একুশের যত প্রথম , এম আর মাহবুব, দৈনিক প্রথম আলো (২৯ ফেব্রুয়ারী ২০০৮)
৪। বাংলা উইকিপিডিয়া (http://bn.wikipedia.org/wiki/ভাষা_আন্দোলন)

ছবিসূত্রঃ
একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের আঁকা দেয়ালচিত্র। কৃতজ্ঞতাঃ তমাল বড়াল

ইন্টারনেটের গতি ভালো থাকলে ইউটিউবে পাওয়া কবিতাটির কিছু অংশ আবৃত্তি শুনতে পারেন। আবৃত্তিটি এনটিভিতে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠান থেকে নেয়া; আবৃত্তি করেছেন কাজী আরিফ।


মন্তব্য

আলাভোলা এর ছবি

কবিকে আজ একুশে পদক দেওয়া হলো।
আশ্চর্য্য লাগলো। এই সম্মানটুকু কি তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে আমরা দিতে পারতাম না !

===================
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।

বিপ্রতীপ এর ছবি

সেইটাই...ইতিহাস বিকৃতি আর বই চুরিতে সহায়তাকারী শিক্ষাবিদদের বেঁচে থাকতেই একুশে/স্বাধীনতা দিবস পদক জোটে...মাহবুব উল আলম চৌধুরিদের জুটে না...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান...

দৃশা এর ছবি

সেই হইল কথা। সময়ের কাজ আমরা কখনই সময়ে করি না।
যার যা প্রাপ্য তা সে নিজ জীবদ্দশায় দেইখা যাইতে পারব না। এটা মোটামোটি অলিখিত নিয়ম হইয়া দাড়াইছে।
সময়োপযোগী পোস্টের লাইজ্ঞা বিপ্র কে ধন্যবাদ
-----------------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

s-s এর ছবি

কবিকে শ্রদ্ধা , সময়ের লেখা, সময়ের প্রয়োজনে - আপনাকেও তাই ধন্যবাদ আর একুশের শুভেচ্ছা।

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

কবিকে শ্রদ্ধা জানাই।

না-জানা অনেক কিছুই জানা হলো। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

তানবীরা এর ছবি

শ্রদ্ধা কবিকে।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

পরম শ্রদ্ধা কবিকে।
চমত্কার লেখার জন্য বিপ্র-কে অভিনন্দন।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।